গল্প
পথ-পরম্পরা
ফিরোজ আহমদ
প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০
কোমরটা চিকন হলে তারে সুঠামই বলা যেত।
ইয়াব্বড় সব হাত-পায়ের পাতা আর যে কোনো জায়গার থেকে আঙুলের গলাগুলো সাদাটে! দেখে বোঝা যায় হাত-পাগুলো ধুলোর থেকে কাদা চেনে বেশি। হাতের তেলোতে আধসের নুন রেখেও জায়গা থাকে- আর গলা-মুখের থেকে ঘাড়-পিঠ কালচে মতন। রোদে পোড়া।
বুজবুনে লঞ্চঘাটটায় যে একটা-দুটো মুড়ি-মুড়কির দোকান তার একটায় খুলনা থেকে আনা চানতারা বিস্কুট, চানাচুর, সন্দেশ-গুড়ের তেলতেলে ঝাপসা প্যাকেট আর ইন্তাজ বাড়ির বড় ক'টা না ভাঙা কাগুজে মোড়ক সাজিয়ে রাখা। একটা শুধু খোলা। বড়সড় আগন্তুক মানুষটা গলায় চুনের দাগ দেওয়া একটা পিতলের কলসি হাতে এগিয়ে দোকানের দিকে এলে- উদোম গতর দোকানি ঘাড়ের গামছা ঘুরিয়ে বাতাস খেতে খেতে জিজ্ঞেস করে-
বাপুরে! কোন দিগি যাবা?
হাঁটুর একটুখানি নিচে নামানো লুঙ্গি, কোমরে গামছা আর ঘাড়ের ওপরে দুই পাশে পকেটওয়ালা হাফহাতা নীল মতন ফতুয়াটার একটা পকেট সামনে, বুকের দিকে। সেটাতেই যৎসামান্য টাকাকড়ি। বাঁ-হাতে জামাটায় মুখ মুছে ছলেমান উত্তর দিল-
ভান্ডারকোট যাব রে ভাই, বিয়েই বাড়ি- তার মাইয়ের বিয়ে।
দোকানি বলল- আইসলে কোয়ানথে?
অল্প কথায় সারতে চেয়ে ছলেমান বলল-
শরাফপুর। গাওঘরা আমাইগে গিরাম।
ওরে বাবারে! সে তো কোম দূর না, বসো বসো, মোটা মতন দোকানদারটা বলল।
ওরেন্না দূর আর কট্টুক! ময়ূরীর গাঙ আর রূপসা খেয়া পারায়ে হাঁটা ধরলাম, হাঁইটে ঝাপসো, বাইনতলা; বিটামানুষ হাঁটা ধরলি দুইনে তাই ফুরোয়ে আসতি লাগে! আর এ তো সামাইন্য পথ; যাইগ্েগ এক প্যাকেট বিড়ি দেও আর এট্টু পানি দিয়েনে- একদমেই এত কিছু বলে তবে ছলেমান থামল।
দোকানের উল্টো দিকটায় রাস্তাটার ওধারে বড় ছাইতান গাছটার তলায় ছেঁড়া একটা ধানের বস্তা বিছিয়ে কটা দয়াকলা, গোটা তিনচার বড় বড় ডেউয়া ফল আর একটা অ্যালুমিনিয়ামের থালায় কতক ঝুরি ভাজা- এইসব নিয়ে থাক থাক কোঁকড়ানো লম্বা চুল আর তার চেয়ে লম্বা দাড়ি, গলায় রুদ্রাক্ষের মালাটা চুল-দাড়ির ফাঁক গলে গুরু ধরার সংবাদটা যেন গোপন করতে চেয়েও পারে না, এই রকম এক গোঁসাই বসে আছে।
তার দু'চোখে ঘর ছাড়ার নেশা আর গেরস্থালির মোহ তার সারা শরীরে। বাংলার নিপাট গ্রামগুলোর আরও বহু লোকের মতো এসব দোটানা বয়ে বেড়ানো মানুষ, স্বার্থের গন্ধহীন তাদের যে চেয়ে থাকা- গোঁসাই সেই চোখে ছলেমানের দিকে চাইল।
লঞ্চ আসতে এখনও সেই আধপহর বাকি। লঞ্চঘাটটায় এখন তাই সাকল্যে মানুষ এই তিনজন। লঞ্চ আসার আগ দিয়ে হয়তো আরও দু'চারজন এসে পড়বে। যদিও বেড়িয়ে বেড়ানোর দিন এখন নয়- ক'দিন বাদেই এই গোঁসাইদের দেশের গেড়োমুঠি, ছত্তরভোগ- এইসব ধানে হলদে রোদের রং লাগা শুরু হবে। বেড়ানোর যাত্রী লঞ্চে তাই আঙুলের কর গোনা, ছলেমানের মতো দু'একজন হতচ্ছাড়া বাদে। বাধ্য না হলে এখন আর কারোরই এলাকাছাড়া হওয়ার জো নেই, তাদের ভেতরেই এইসব ছলেমানদের বসবাস... কাণ্ডজ্ঞান ছাড়া আর সব যাদের ঠিক!
দোকানটার তলা থেকে একটা কুকুর হাতার ওপর মুখ রেখে চেয়ে আছে। ছলেমান রাস্তাটুকু পার হয়ে ছাইতান গাছটার তলায় এসে দাঁড়ায়। বলে-
ও'দা দয়াকলা কত এরে রাখপানে কওদিন! গোঁসাই বলল- নিজির ঝাড়ের তা! দিয়েনে যা হয়, আটটা এরে বেচি, নিয়েনে টাহায় দশটা।
তা না হয় হলো... গুরু ধরিছো কোহানকের? ছলেমান বসতে বসতে প্রশ্ন করে। পাছার অর্ধেকটা তার ধুলোয়, বাকি আর্ধেকটা বস্তার কোনায়।
সদগুরুর নিবাস নড়াল জেলা- সদগুরু শব্দটা বলতে গোঁসাইয়ের চোখজোড়া মুদে এল যেন ভক্তিতে। ছলেমান দেখতে পেল গোঁসাইয়ের অন্তরের গদগদ ভাবটা আর গোঁসাই দেখতে পেল তার গুরুর মুখের ছবি! আর এই দু'জন আধা গেরস্ত, আধা ঘরছাড়া একে অন্যকে চিনে ফেলল যেন নিমেষেই। বাউণ্ডুলে মনটা থিতিয়ে এলে গোঁসাই গেরস্ত হয়ে উঠে বলল-
ও'দা, তোমার বসত কোনদিগি রে।
তোমাইগের এই মরাপশোরের গাঙ বইয়ে বইয়ে যাইয়ে সুকদে, আদাঘাট, ভাঙনপাড় এইসব ছাড়ায়ে যেহেনে কুমোরখালীর নাম নেছে- তাও ছাড়ায়ে সেই শোলমারির পারে আমার বসত- কাচড়া ধানের দেশ। এই বাংলায় আর কুত্থাও কাচড়া ধান হয় না, তা জানো তো! ছলেমান বলল।
নিজের দেশের জন্য মনে গর্ব হলো তার।
গোঁসাই যেন বিদেশি পথিকের সম্মান আরও খানিক বাড়িয়ে দিতে চেয়ে বলল-
হয় রে দাদা! আরেক পদের ধান- ওই যে বীরপালা! একসাথে আউশ আর আমন বোনো তুমরা, আউশ কাইটে নিলি আমন বাড়তি থাহে জোগার পানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, এই এক আশতার্য ব্যাপার!
ছলেমান খুশি হয়ে গোঁসাইদের এই এলাকাটাকেও যেন একটু মাহাত্ম্য দিতে চাইল, বলল- তোমাইগে জটা-বালাম আর বাঁশফুল- এ্যাও খারাপ না কলাম।
বিড়ির প্যাকেটটা খুলে একটা বিড়ি গোঁসাইয়ের দিকে বাড়িয়ে ধরে আবার সে বলল- তয় তোমাইগের এদিকি আনাজের খন্দ সেরাম না।
এডা তো নাবাইলে এলেকা, আনাজ হবে কিরাম! জোয়ার-ভাটা উঠতিছে নামতিছে, তুমাইগে তো ট্যাঁক ভুঁই, আহা ওে, পোটোলের মাচা দেকলি পরানডা জুড়োয়ে যায়! আর আমাইগে এডা তো বাদাবনের শুরুর মুখ, বনের মতন এদিগিউ দেখপা ঝোপেঝাড়ে নোনাঝাউ, উলু, শ্বেত-আকোন্দো, তেলাকুচো, এইসবের বাহার! এদিকির জলাব্যাড়েও দেখপা সেই বাদাবনের মতন ট্যাংরা, ফাইশে, কাইন, ভেটকি; বলতে বলতে গোঁসাই আবার যেন এই বিশ্বের এক ছন্নছাড়া দর্শকে পরিণত হলো।
আবারও বলতে লাগল-
আহা রে বিধির বিধান! বুঝলে দাদা, এই জগৎ যেন বাজারের মতন সাজায়ে রাহা- চালির আড়ত একদিগি তো মাছের বাজার আরেক কুনায়, মধ্যিখানে যেমন কাঁচাবাজার! এই রহম আরকি।
আরও নানান আলোচনা শেষে গোঁসাই বলে- বইকেলের লঞ্চ ধইরেনে দাদা, দুফরে আমাইগের বাড়িত্থে অন্নসেবা কইরে যাও। খালে পাটা ফেলায়ে কাইলকে এট্টা কাইনমাগুর পাইলাম।
ছলেমান বলল- আইজকে থাইগ্েগন দাদা, আরেকবার দেহা হলি খাইয়ে যাবানে।
আরও আধা ঘণ্টা পরে লঞ্চের ভেঁপু শোনা গেল বাঁকটার আড়াল থেকে। হঠাৎ শব্দে দুটো দোয়েল উড়ে গেল ছাইতান গাছটা ফেলে- তবে আবার তারা ফিরবে। এইসব আধা বাউল উড়নচণ্ডী মানুষ যেমন ফিরে ফিরে আসে তাদের নোনতা স্বাদের মেয়েলোকগুলোর কাছে। এইসব গ্রামের নোনা হাওয়ায় নিজেদের জুড়িয়ে নিতে- সেই রকম।
বাঁকটা পেরিয়ে লঞ্চটা বেরিয়ে এলো সেইভাবে- খোড়ল থেকে ভাতশালিকেরা যেভাবে বেরোয়। ডুবডুব ডুবডুব শব্দে কুকুরটার ঘুম ভেঙে গেলে কান-মাথা উঁচু করল সে। লোকজন যারা নামবে তাদের দু'একজন দোকানে এসে বসবে এবার। দু'একজন এগিয়ে যাবে সিকি মাইল দূরের ইট বসানো রাস্তাটার দিকে- বাগেরহাট, পিরোজপুরের বাস ধরতে।
তাদের বয়ে আনা পাউরুটির একটু-আধটু কোনা, গুঁড়োসমেত বিস্কুটের প্যাকেটগুলো ফেলে যাবে তারা। এমনকি গন্ধ হয়ে গেলে কখনও দু'একটা আস্ত রুটির টুকরোও। কুকুরটা ঝাড়া মেরে ঘুমের আলিস্যিটা নামিয়ে ফেলল গা থেকে।
পাড় থেকে হাত-দশেক দূরে দাঁড়াল লঞ্চটা। কাঠের সিঁড়ি নামিয়ে দিয়ে একটা লম্বা বাঁশ সিঁড়িটার সমান্তরালে উঁচু করে ধরে রাখে ছোকরা মতন কর্মচারী ছেলেটা। যারা নামার আছে- সিঁড়িতে পা আর বাঁশে হাত রেখে তারা নামবে এবার। ছেলেটা চেঁচায় সমানে- এই যে আসেন, ভান্ডারকোট, বিএস ঘাট, গৌরম্ভা, যাতি হলি উঠতি হবে- নামার থাকলি নামতি হবে!
গোঁসাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিতে উঠে দাঁড়িয়ে ছলেমান বলল-
বিয়েই বাড়ি একদিন থাকপো দাদা, ফিরে এই পথেই যাব মোল্লাহাট। নাইলোর বাজারে ষাঁড়ের নাড়োই আর ঢালীপাকের মেলা, এইসব দেহে ফিরে আসপো, যাবা নাকি?
কোদাইলের বিল পারায়ে যাতি হবে নাকি দাদা? গোঁসাই জিজ্ঞেস করে।
হয়, ছলেমান বলে চলে- বিলির এইমাথা তো ফইরহাট, সেই ওই মাথায় ঢালীপাকের মেলা বসপেনে, কাঁসার থালে বাড়ি পড়লি!
বলতে বলতে যেন শিউরে ওঠে সে।
দয়াকলা আর ঝুরি ভাজা সব বিক্রি হয়ে গেল গোঁসাইয়ের। ডেউয়া ফলগুলো ফেরত নিয়ে গুরুর বাঁধা পদগুলোর একটা গাইতে গাইতে সে বাড়ির পথ ধরল-
পদ বান্ধো রে মন মহাজন
মন বান্ধিবো কিসে
দড়ি-কাছির বেহাল দশা
হায়রে লোভের বিষে
ও মন মন বান্ধিবো কিসে রে...
বেশ কিছুদিন বাদে মনের মধ্যে উড়নচণ্ডী ভাবটা আবার চাগাড় দিল তার, আর অসার লাগতে লাগল সংসারের সব সারবত্তা।
বাঁশটা না ধরেই লঞ্চটায় উঠে গেল ছলেমান। দুই তক্তার আড়ে আড়ে ক'টা কাঠ পেটানো সিঁড়িটা দুলতে লাগল। ছলেমান জানে- দোলে বলে ভাঙে না, না দুললে এইসব তক্তার সাঁকো কবেই ভেঙে যেত এতদিনে! এই সাঁকো-সিঁড়িটার মতোন মনও দোলে তার, তা-ই হয়তো ভাঙে না।
কেবিনগুলো পেরিয়ে গিয়ে নিচে নামল সে। জনাদশেক লোক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছে- দু'তিনজন ভাত খাচ্ছে। লঞ্চে রাঁধা টেংরা মাছের ঝোল দিয়ে। আর নদীর পানির মতো ডাল, কাঁচালংকা ফাড়া থাকে বলে বোঝা যায় যে এটা ডালের তরকারি।
ছলেমান দেখতে লাগল, একটা দড়ির এক মাথা একটা পুলিশের হাতে প্যাঁচানো, আরেক মাথা একজনের কোমরে। মাজায় দড়ি বাঁধা লোকটার একদমই লজ্জা হচ্ছে না তাতে। বোঝাই যায় এ দড়ি তার বেশ আগের চেনা। হেসে হেসেই সে গল্প করছে বুড়ো মতন পুলিশটার সাথে। সাজার মেয়াদ পুরতে আর অল্প ক'দিন যাদের বাকি থাকে- এমন কয়েদিরা পালায় না। এসব তো সবাই জানে। ছলেমান আরও দেখতে পেল- কৃষিকার্য করা দু'জন মানুষ কথা বলছে- বীজধান আর সারের দাম নিয়ে যাদের তুমুল অসন্তুষ্টি। আরও কয়েকজন এগিয়ে আসা ইলেকশন নিয়ে আলোচনা করেই চলেছে- বোধহয় না ইহজীবনে তাদের মতের মিল হবে!
এর মধ্যে ওপরতলা থেকে আধমরা মতন একজন শহুরে মেয়েছেলে, আর চিকনচাকন একটা ছেমড়ি বহু কসরত করে নিচে নেমে এসেছে- তার হাতে খালি একটা পানির বোতল। সরা চাপা দেওয়া পানির মটকিটার পাশে দাঁড়িয়ে বিরক্ত মুখে বেঁধে রাখা মগটা চুবিয়ে বোতলটায় পানি ভরে সে। বোঝাই যায় বাধ্য না হলে এই পানি তারা খেত না। এমন সময় তারের জালি ঘেরা ইঞ্জিন ঘরটার মাথায় বেঁধে রাখা ঘণ্টাটা টুনটুন করে বেজে ওঠে দু'বার। প্রায় সাথে সাথে সেই সিঁড়ি নামানো ছেলেটা হেঁকে ওঠে, বিএস ঘাট, বিএস ঘাট! নামতি হলি আসতি হবে!
দু'জন লোক শুধু নড়ে বসে, ওঠে না। তারা জানে এখনও পনেরো মিনিট।
ছলেমানের ততক্ষণে কাঁটাশুদ্ধ টেংরা মাছটা চিবিয়ে গিলে ফেলা সারা। এক হাঁটু পানিতে পোলো বাইতে যে রকম ছপাৎ ছপাৎ শব্দ হয়, সে রকম শব্দ করে এবার সে ডাল নিয়ে পড়লে- ফিরে যেতে যেতে মেয়েছেলে দু'জন চাইল তার দিকে, বোধহয় শব্দে আকৃষ্ট হয়েই। নিজেরা চোখাচোখি করল তারা, হয়তো মনে মনে ভাবল-
কী অভদ্র রে বাবা- এমন শব্দ করে মানুষ আবার খায় নাকি!
ছলেমান কিছু টের পেল না- দু'ভাগ হওয়া একটা কাঁচাঝাল ভালো করে ডলল সে ভাতের সাথে, ভাবল- সত্যি! এই কাঁচাঝালের ঘেরানডাই অন্য রকম!
পা'র কাছে রাখা কলসিটার গায়ে ছিটকে পড়া ক'ফোঁটা ডাল সে মুছে ফেলল বাঁ-হাত দিয়ে।
সেই পরবিকেলে লঞ্চ এসে ভিড়ল ভাঙনপাড়। এই নদীপথটার অন্য সব লঞ্চঘাটের তুলনায় ভাঙনপাড় মোটামুটি একটা বড় মোকাম। বনের চোরাই কাঠ আর নারকেল-সুপারির রমরমা এদিকে। বেশ ক'জন লোক উঠল-নামল সেই মহিলা দু'জনের সাথে আর দু'জন লোক আর ছলেমান- কলসিটা হাতে করে।
আতিয়ার দুলাভাইয়ের তো থাকবার কথা ছিল ঘাটে- মোটা মহিলাটা বলল।
আতিয়ার বেয়াইয়ের নাম শুনেই তার দিকে চাইল ছলেমান, বলল-
আতিয়ার মেম্বারের বাড়ি যাবেন আপনারা?
মেয়েরা একটু বিরক্তই হলো যেন। অল্প বয়সী ছোঁড়াটা শুধু বলল- জি।
উনি তো আমার বিয়েই হয়- এটুকু বলে কলসি ধরা হাতটা একটু উঁচু করে সে আবার বলল- উনার বড় ভাইয়ের বউ আমার বুন, তার মাইয়ের বিয়েতেই তো যাচ্ছি আমি, তা আপনারা?
মেয়েছেলে দু'জন একটু হতাশই হলো যেন। মোটাজন মুখটা একটু গোমড়া মতন করে বলল- হ্যাঁ উনি আমার ভগ্নিপতি।
তাহলি তো আপনি আমাগে বেয়াইন হন- ছলেমান বলল।
এই সড়াৎ সড়াৎ করে ভাত খাওয়া লোকটা যে তার বেয়াই হতে পারে ভেবে মহিলা পেরেশান হয়ে পড়ল, আর অল্প বয়সী মেয়েটা আলবোলা মতন হয়ে গেল।
ছলেমান তেমন কিছু বুঝল না। তার ভাত খাওয়ার ভঙ্গিতে অভদ্রতা হেতু অনেক মানুষ যে তাকে আত্মীয় ভাবতে বিব্রত বোধ করতে পারে, এসব তার কল্পনাতেও এলো না। তবে ঘাটে নেমে সে এইটুকু মনে করতে পারল যে- বিয়েই বাড়ি পান-সুপোরি না নিলি মানুষি মোন্দো কবেনে! দলটাকে ইশারা করে পথ দেখিয়ে দিয়ে সে বলল-
এই পথে আগোন, আমি কয়ডা পান-সুপোরি কিনে নিয়ে আসি।
গল্পটার এইসব ঘটনাক্রম এখানেই শেষ।
তা হলেও- বহুদিন পরে গল্পটা যখন লেখ্য হয়ে উঠল, তখন গল্পকার লিখতে থাকলেন-
বিবর্তন এবং ঘটনাপ্রবাহকে সাথে নিয়ে পেরিয়ে যাওয়া ষাটটা বছর যে কতটা দীর্ঘ- সেটা টের পায় শুধু তারাই, যারা সেটা পেরিয়ে এসেছে।
তারপরও সেদিনের সেইসব বিয়েবাড়ি, সেইসব বর-কনে, লঞ্চের সেইসব কর্মচারী ছেলে, কোমরে দড়িবাঁধা লঞ্চযাত্রী কয়েদি, দড়ি ধরা সেইসব মধ্যবয়সী পুলিশ, এই গল্পটার বয়ান জুড়ে থাকা চাষাড়ে ছলেমান, গোঁসাই, সেই কুকুরটা...
তারা সব এই দীর্ঘ সময়ের কোন কোন ভাঁজে আটকা পড়ে গেল- তার দিশে আজ আর কেউ করতে পারে না।
পেট অব্দি চড়া পড়ে নাইলো নামের সেই রমরমা নদীটা আজকাল শুকিয়ে আধমরা।
যেখানে সেখানে তরমুজ-বাঙির ক্ষেতে আমদানি করা ইউরিয়া সারের আধিক্যে কালো হয়ে আসা সবুজের বিজ্ঞাপন। তার সাথে এখানে ওখানে লম্বা লম্বা টিনশেডের পুলিশ ফাঁড়ি। নদীদের নরম নাম চাপা পড়ে গেছে বড় সব ব্রিজ আর তেলতেলে কালো চওড়া রাস্তার তলায়। প্রৌঢ়া রমণীদের মতো ঝরঝরে কিন্তু রং-করা মুখের বাসগুলো মানুষে পেট বোঝাই করে নিয়ে ছুটছে চতুর্দিকে। খুলনা থেকে সেই মোংলা, চালনা, পাইকগাছা, সাতক্ষীরা, শ্যামনগর, কালিগঞ্জ- এক্কেবারে সেই সুন্দরবনের মুখের গোড়ায়।
পাটা ফেলে যেসব গহিন খালে কাইনমাগুর ধরা হতো, সেগুলো এখন সটান পাকা রাস্তা। দু'ধারে হাইব্রিড ধানের বীজের বেছন। টোয়েন্টি-থ্রি, টোয়েন্টি-নাইন- এই রকম কত্ত সব নামের বাহার। ফাঁকফোকরে রাইস মিল আর ইটভাটার উঁচু উঁচু সব কাণ্ডকারখানা
গোঁসাই আথবা ছলেমানের প্রোপ্রৌত্রিরা এখন রাইস মিলগুলোর সিমেন্ট বাঁধানো চাতালে ধান শুকোয়। আর আধপোড়া কালো কালো সব মেয়েলোকের দল বড় বড় সব চুলোয় তুষ ছুড়ে জাগিয়ে রাখে কোনো রকমে বেঁচে থাকার মতন আগুন। সেসব আগুনের হুহু দাউ দাউ পেছনে ফেলে- ভূতের জিহ্বার সমান লকলকে রাস্তাগুলো বিছানো থাকে- এমাথা থেকে সেই ওমাথা।
মোড়ে মোড়ে বহুবর্ণ দোকানগুলোর সিডি প্লেয়ারে বাজতে থাকে- মুন্নি বদনাম হুয়ে ডার্লিং তেরে লিয়ে... আর সানসিল্ক্ক শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপনী কেশবতীরা দোল খেতে থাকে প্রাগৈতিহাসিক হাওয়ায়।
ইয়াব্বড় সব হাত-পায়ের পাতা আর যে কোনো জায়গার থেকে আঙুলের গলাগুলো সাদাটে! দেখে বোঝা যায় হাত-পাগুলো ধুলোর থেকে কাদা চেনে বেশি। হাতের তেলোতে আধসের নুন রেখেও জায়গা থাকে- আর গলা-মুখের থেকে ঘাড়-পিঠ কালচে মতন। রোদে পোড়া।
বুজবুনে লঞ্চঘাটটায় যে একটা-দুটো মুড়ি-মুড়কির দোকান তার একটায় খুলনা থেকে আনা চানতারা বিস্কুট, চানাচুর, সন্দেশ-গুড়ের তেলতেলে ঝাপসা প্যাকেট আর ইন্তাজ বাড়ির বড় ক'টা না ভাঙা কাগুজে মোড়ক সাজিয়ে রাখা। একটা শুধু খোলা। বড়সড় আগন্তুক মানুষটা গলায় চুনের দাগ দেওয়া একটা পিতলের কলসি হাতে এগিয়ে দোকানের দিকে এলে- উদোম গতর দোকানি ঘাড়ের গামছা ঘুরিয়ে বাতাস খেতে খেতে জিজ্ঞেস করে-
বাপুরে! কোন দিগি যাবা?
হাঁটুর একটুখানি নিচে নামানো লুঙ্গি, কোমরে গামছা আর ঘাড়ের ওপরে দুই পাশে পকেটওয়ালা হাফহাতা নীল মতন ফতুয়াটার একটা পকেট সামনে, বুকের দিকে। সেটাতেই যৎসামান্য টাকাকড়ি। বাঁ-হাতে জামাটায় মুখ মুছে ছলেমান উত্তর দিল-
ভান্ডারকোট যাব রে ভাই, বিয়েই বাড়ি- তার মাইয়ের বিয়ে।
দোকানি বলল- আইসলে কোয়ানথে?
অল্প কথায় সারতে চেয়ে ছলেমান বলল-
শরাফপুর। গাওঘরা আমাইগে গিরাম।
ওরে বাবারে! সে তো কোম দূর না, বসো বসো, মোটা মতন দোকানদারটা বলল।
ওরেন্না দূর আর কট্টুক! ময়ূরীর গাঙ আর রূপসা খেয়া পারায়ে হাঁটা ধরলাম, হাঁইটে ঝাপসো, বাইনতলা; বিটামানুষ হাঁটা ধরলি দুইনে তাই ফুরোয়ে আসতি লাগে! আর এ তো সামাইন্য পথ; যাইগ্েগ এক প্যাকেট বিড়ি দেও আর এট্টু পানি দিয়েনে- একদমেই এত কিছু বলে তবে ছলেমান থামল।
দোকানের উল্টো দিকটায় রাস্তাটার ওধারে বড় ছাইতান গাছটার তলায় ছেঁড়া একটা ধানের বস্তা বিছিয়ে কটা দয়াকলা, গোটা তিনচার বড় বড় ডেউয়া ফল আর একটা অ্যালুমিনিয়ামের থালায় কতক ঝুরি ভাজা- এইসব নিয়ে থাক থাক কোঁকড়ানো লম্বা চুল আর তার চেয়ে লম্বা দাড়ি, গলায় রুদ্রাক্ষের মালাটা চুল-দাড়ির ফাঁক গলে গুরু ধরার সংবাদটা যেন গোপন করতে চেয়েও পারে না, এই রকম এক গোঁসাই বসে আছে।
তার দু'চোখে ঘর ছাড়ার নেশা আর গেরস্থালির মোহ তার সারা শরীরে। বাংলার নিপাট গ্রামগুলোর আরও বহু লোকের মতো এসব দোটানা বয়ে বেড়ানো মানুষ, স্বার্থের গন্ধহীন তাদের যে চেয়ে থাকা- গোঁসাই সেই চোখে ছলেমানের দিকে চাইল।
লঞ্চ আসতে এখনও সেই আধপহর বাকি। লঞ্চঘাটটায় এখন তাই সাকল্যে মানুষ এই তিনজন। লঞ্চ আসার আগ দিয়ে হয়তো আরও দু'চারজন এসে পড়বে। যদিও বেড়িয়ে বেড়ানোর দিন এখন নয়- ক'দিন বাদেই এই গোঁসাইদের দেশের গেড়োমুঠি, ছত্তরভোগ- এইসব ধানে হলদে রোদের রং লাগা শুরু হবে। বেড়ানোর যাত্রী লঞ্চে তাই আঙুলের কর গোনা, ছলেমানের মতো দু'একজন হতচ্ছাড়া বাদে। বাধ্য না হলে এখন আর কারোরই এলাকাছাড়া হওয়ার জো নেই, তাদের ভেতরেই এইসব ছলেমানদের বসবাস... কাণ্ডজ্ঞান ছাড়া আর সব যাদের ঠিক!
দোকানটার তলা থেকে একটা কুকুর হাতার ওপর মুখ রেখে চেয়ে আছে। ছলেমান রাস্তাটুকু পার হয়ে ছাইতান গাছটার তলায় এসে দাঁড়ায়। বলে-
ও'দা দয়াকলা কত এরে রাখপানে কওদিন! গোঁসাই বলল- নিজির ঝাড়ের তা! দিয়েনে যা হয়, আটটা এরে বেচি, নিয়েনে টাহায় দশটা।
তা না হয় হলো... গুরু ধরিছো কোহানকের? ছলেমান বসতে বসতে প্রশ্ন করে। পাছার অর্ধেকটা তার ধুলোয়, বাকি আর্ধেকটা বস্তার কোনায়।
সদগুরুর নিবাস নড়াল জেলা- সদগুরু শব্দটা বলতে গোঁসাইয়ের চোখজোড়া মুদে এল যেন ভক্তিতে। ছলেমান দেখতে পেল গোঁসাইয়ের অন্তরের গদগদ ভাবটা আর গোঁসাই দেখতে পেল তার গুরুর মুখের ছবি! আর এই দু'জন আধা গেরস্ত, আধা ঘরছাড়া একে অন্যকে চিনে ফেলল যেন নিমেষেই। বাউণ্ডুলে মনটা থিতিয়ে এলে গোঁসাই গেরস্ত হয়ে উঠে বলল-
ও'দা, তোমার বসত কোনদিগি রে।
তোমাইগের এই মরাপশোরের গাঙ বইয়ে বইয়ে যাইয়ে সুকদে, আদাঘাট, ভাঙনপাড় এইসব ছাড়ায়ে যেহেনে কুমোরখালীর নাম নেছে- তাও ছাড়ায়ে সেই শোলমারির পারে আমার বসত- কাচড়া ধানের দেশ। এই বাংলায় আর কুত্থাও কাচড়া ধান হয় না, তা জানো তো! ছলেমান বলল।
নিজের দেশের জন্য মনে গর্ব হলো তার।
গোঁসাই যেন বিদেশি পথিকের সম্মান আরও খানিক বাড়িয়ে দিতে চেয়ে বলল-
হয় রে দাদা! আরেক পদের ধান- ওই যে বীরপালা! একসাথে আউশ আর আমন বোনো তুমরা, আউশ কাইটে নিলি আমন বাড়তি থাহে জোগার পানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, এই এক আশতার্য ব্যাপার!
ছলেমান খুশি হয়ে গোঁসাইদের এই এলাকাটাকেও যেন একটু মাহাত্ম্য দিতে চাইল, বলল- তোমাইগে জটা-বালাম আর বাঁশফুল- এ্যাও খারাপ না কলাম।
বিড়ির প্যাকেটটা খুলে একটা বিড়ি গোঁসাইয়ের দিকে বাড়িয়ে ধরে আবার সে বলল- তয় তোমাইগের এদিকি আনাজের খন্দ সেরাম না।
এডা তো নাবাইলে এলেকা, আনাজ হবে কিরাম! জোয়ার-ভাটা উঠতিছে নামতিছে, তুমাইগে তো ট্যাঁক ভুঁই, আহা ওে, পোটোলের মাচা দেকলি পরানডা জুড়োয়ে যায়! আর আমাইগে এডা তো বাদাবনের শুরুর মুখ, বনের মতন এদিগিউ দেখপা ঝোপেঝাড়ে নোনাঝাউ, উলু, শ্বেত-আকোন্দো, তেলাকুচো, এইসবের বাহার! এদিকির জলাব্যাড়েও দেখপা সেই বাদাবনের মতন ট্যাংরা, ফাইশে, কাইন, ভেটকি; বলতে বলতে গোঁসাই আবার যেন এই বিশ্বের এক ছন্নছাড়া দর্শকে পরিণত হলো।
আবারও বলতে লাগল-
আহা রে বিধির বিধান! বুঝলে দাদা, এই জগৎ যেন বাজারের মতন সাজায়ে রাহা- চালির আড়ত একদিগি তো মাছের বাজার আরেক কুনায়, মধ্যিখানে যেমন কাঁচাবাজার! এই রহম আরকি।
আরও নানান আলোচনা শেষে গোঁসাই বলে- বইকেলের লঞ্চ ধইরেনে দাদা, দুফরে আমাইগের বাড়িত্থে অন্নসেবা কইরে যাও। খালে পাটা ফেলায়ে কাইলকে এট্টা কাইনমাগুর পাইলাম।
ছলেমান বলল- আইজকে থাইগ্েগন দাদা, আরেকবার দেহা হলি খাইয়ে যাবানে।
আরও আধা ঘণ্টা পরে লঞ্চের ভেঁপু শোনা গেল বাঁকটার আড়াল থেকে। হঠাৎ শব্দে দুটো দোয়েল উড়ে গেল ছাইতান গাছটা ফেলে- তবে আবার তারা ফিরবে। এইসব আধা বাউল উড়নচণ্ডী মানুষ যেমন ফিরে ফিরে আসে তাদের নোনতা স্বাদের মেয়েলোকগুলোর কাছে। এইসব গ্রামের নোনা হাওয়ায় নিজেদের জুড়িয়ে নিতে- সেই রকম।
বাঁকটা পেরিয়ে লঞ্চটা বেরিয়ে এলো সেইভাবে- খোড়ল থেকে ভাতশালিকেরা যেভাবে বেরোয়। ডুবডুব ডুবডুব শব্দে কুকুরটার ঘুম ভেঙে গেলে কান-মাথা উঁচু করল সে। লোকজন যারা নামবে তাদের দু'একজন দোকানে এসে বসবে এবার। দু'একজন এগিয়ে যাবে সিকি মাইল দূরের ইট বসানো রাস্তাটার দিকে- বাগেরহাট, পিরোজপুরের বাস ধরতে।
তাদের বয়ে আনা পাউরুটির একটু-আধটু কোনা, গুঁড়োসমেত বিস্কুটের প্যাকেটগুলো ফেলে যাবে তারা। এমনকি গন্ধ হয়ে গেলে কখনও দু'একটা আস্ত রুটির টুকরোও। কুকুরটা ঝাড়া মেরে ঘুমের আলিস্যিটা নামিয়ে ফেলল গা থেকে।
পাড় থেকে হাত-দশেক দূরে দাঁড়াল লঞ্চটা। কাঠের সিঁড়ি নামিয়ে দিয়ে একটা লম্বা বাঁশ সিঁড়িটার সমান্তরালে উঁচু করে ধরে রাখে ছোকরা মতন কর্মচারী ছেলেটা। যারা নামার আছে- সিঁড়িতে পা আর বাঁশে হাত রেখে তারা নামবে এবার। ছেলেটা চেঁচায় সমানে- এই যে আসেন, ভান্ডারকোট, বিএস ঘাট, গৌরম্ভা, যাতি হলি উঠতি হবে- নামার থাকলি নামতি হবে!
গোঁসাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিতে উঠে দাঁড়িয়ে ছলেমান বলল-
বিয়েই বাড়ি একদিন থাকপো দাদা, ফিরে এই পথেই যাব মোল্লাহাট। নাইলোর বাজারে ষাঁড়ের নাড়োই আর ঢালীপাকের মেলা, এইসব দেহে ফিরে আসপো, যাবা নাকি?
কোদাইলের বিল পারায়ে যাতি হবে নাকি দাদা? গোঁসাই জিজ্ঞেস করে।
হয়, ছলেমান বলে চলে- বিলির এইমাথা তো ফইরহাট, সেই ওই মাথায় ঢালীপাকের মেলা বসপেনে, কাঁসার থালে বাড়ি পড়লি!
বলতে বলতে যেন শিউরে ওঠে সে।
দয়াকলা আর ঝুরি ভাজা সব বিক্রি হয়ে গেল গোঁসাইয়ের। ডেউয়া ফলগুলো ফেরত নিয়ে গুরুর বাঁধা পদগুলোর একটা গাইতে গাইতে সে বাড়ির পথ ধরল-
পদ বান্ধো রে মন মহাজন
মন বান্ধিবো কিসে
দড়ি-কাছির বেহাল দশা
হায়রে লোভের বিষে
ও মন মন বান্ধিবো কিসে রে...
বেশ কিছুদিন বাদে মনের মধ্যে উড়নচণ্ডী ভাবটা আবার চাগাড় দিল তার, আর অসার লাগতে লাগল সংসারের সব সারবত্তা।
বাঁশটা না ধরেই লঞ্চটায় উঠে গেল ছলেমান। দুই তক্তার আড়ে আড়ে ক'টা কাঠ পেটানো সিঁড়িটা দুলতে লাগল। ছলেমান জানে- দোলে বলে ভাঙে না, না দুললে এইসব তক্তার সাঁকো কবেই ভেঙে যেত এতদিনে! এই সাঁকো-সিঁড়িটার মতোন মনও দোলে তার, তা-ই হয়তো ভাঙে না।
কেবিনগুলো পেরিয়ে গিয়ে নিচে নামল সে। জনাদশেক লোক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছে- দু'তিনজন ভাত খাচ্ছে। লঞ্চে রাঁধা টেংরা মাছের ঝোল দিয়ে। আর নদীর পানির মতো ডাল, কাঁচালংকা ফাড়া থাকে বলে বোঝা যায় যে এটা ডালের তরকারি।
ছলেমান দেখতে লাগল, একটা দড়ির এক মাথা একটা পুলিশের হাতে প্যাঁচানো, আরেক মাথা একজনের কোমরে। মাজায় দড়ি বাঁধা লোকটার একদমই লজ্জা হচ্ছে না তাতে। বোঝাই যায় এ দড়ি তার বেশ আগের চেনা। হেসে হেসেই সে গল্প করছে বুড়ো মতন পুলিশটার সাথে। সাজার মেয়াদ পুরতে আর অল্প ক'দিন যাদের বাকি থাকে- এমন কয়েদিরা পালায় না। এসব তো সবাই জানে। ছলেমান আরও দেখতে পেল- কৃষিকার্য করা দু'জন মানুষ কথা বলছে- বীজধান আর সারের দাম নিয়ে যাদের তুমুল অসন্তুষ্টি। আরও কয়েকজন এগিয়ে আসা ইলেকশন নিয়ে আলোচনা করেই চলেছে- বোধহয় না ইহজীবনে তাদের মতের মিল হবে!
এর মধ্যে ওপরতলা থেকে আধমরা মতন একজন শহুরে মেয়েছেলে, আর চিকনচাকন একটা ছেমড়ি বহু কসরত করে নিচে নেমে এসেছে- তার হাতে খালি একটা পানির বোতল। সরা চাপা দেওয়া পানির মটকিটার পাশে দাঁড়িয়ে বিরক্ত মুখে বেঁধে রাখা মগটা চুবিয়ে বোতলটায় পানি ভরে সে। বোঝাই যায় বাধ্য না হলে এই পানি তারা খেত না। এমন সময় তারের জালি ঘেরা ইঞ্জিন ঘরটার মাথায় বেঁধে রাখা ঘণ্টাটা টুনটুন করে বেজে ওঠে দু'বার। প্রায় সাথে সাথে সেই সিঁড়ি নামানো ছেলেটা হেঁকে ওঠে, বিএস ঘাট, বিএস ঘাট! নামতি হলি আসতি হবে!
দু'জন লোক শুধু নড়ে বসে, ওঠে না। তারা জানে এখনও পনেরো মিনিট।
ছলেমানের ততক্ষণে কাঁটাশুদ্ধ টেংরা মাছটা চিবিয়ে গিলে ফেলা সারা। এক হাঁটু পানিতে পোলো বাইতে যে রকম ছপাৎ ছপাৎ শব্দ হয়, সে রকম শব্দ করে এবার সে ডাল নিয়ে পড়লে- ফিরে যেতে যেতে মেয়েছেলে দু'জন চাইল তার দিকে, বোধহয় শব্দে আকৃষ্ট হয়েই। নিজেরা চোখাচোখি করল তারা, হয়তো মনে মনে ভাবল-
কী অভদ্র রে বাবা- এমন শব্দ করে মানুষ আবার খায় নাকি!
ছলেমান কিছু টের পেল না- দু'ভাগ হওয়া একটা কাঁচাঝাল ভালো করে ডলল সে ভাতের সাথে, ভাবল- সত্যি! এই কাঁচাঝালের ঘেরানডাই অন্য রকম!
পা'র কাছে রাখা কলসিটার গায়ে ছিটকে পড়া ক'ফোঁটা ডাল সে মুছে ফেলল বাঁ-হাত দিয়ে।
সেই পরবিকেলে লঞ্চ এসে ভিড়ল ভাঙনপাড়। এই নদীপথটার অন্য সব লঞ্চঘাটের তুলনায় ভাঙনপাড় মোটামুটি একটা বড় মোকাম। বনের চোরাই কাঠ আর নারকেল-সুপারির রমরমা এদিকে। বেশ ক'জন লোক উঠল-নামল সেই মহিলা দু'জনের সাথে আর দু'জন লোক আর ছলেমান- কলসিটা হাতে করে।
আতিয়ার দুলাভাইয়ের তো থাকবার কথা ছিল ঘাটে- মোটা মহিলাটা বলল।
আতিয়ার বেয়াইয়ের নাম শুনেই তার দিকে চাইল ছলেমান, বলল-
আতিয়ার মেম্বারের বাড়ি যাবেন আপনারা?
মেয়েরা একটু বিরক্তই হলো যেন। অল্প বয়সী ছোঁড়াটা শুধু বলল- জি।
উনি তো আমার বিয়েই হয়- এটুকু বলে কলসি ধরা হাতটা একটু উঁচু করে সে আবার বলল- উনার বড় ভাইয়ের বউ আমার বুন, তার মাইয়ের বিয়েতেই তো যাচ্ছি আমি, তা আপনারা?
মেয়েছেলে দু'জন একটু হতাশই হলো যেন। মোটাজন মুখটা একটু গোমড়া মতন করে বলল- হ্যাঁ উনি আমার ভগ্নিপতি।
তাহলি তো আপনি আমাগে বেয়াইন হন- ছলেমান বলল।
এই সড়াৎ সড়াৎ করে ভাত খাওয়া লোকটা যে তার বেয়াই হতে পারে ভেবে মহিলা পেরেশান হয়ে পড়ল, আর অল্প বয়সী মেয়েটা আলবোলা মতন হয়ে গেল।
ছলেমান তেমন কিছু বুঝল না। তার ভাত খাওয়ার ভঙ্গিতে অভদ্রতা হেতু অনেক মানুষ যে তাকে আত্মীয় ভাবতে বিব্রত বোধ করতে পারে, এসব তার কল্পনাতেও এলো না। তবে ঘাটে নেমে সে এইটুকু মনে করতে পারল যে- বিয়েই বাড়ি পান-সুপোরি না নিলি মানুষি মোন্দো কবেনে! দলটাকে ইশারা করে পথ দেখিয়ে দিয়ে সে বলল-
এই পথে আগোন, আমি কয়ডা পান-সুপোরি কিনে নিয়ে আসি।
গল্পটার এইসব ঘটনাক্রম এখানেই শেষ।
তা হলেও- বহুদিন পরে গল্পটা যখন লেখ্য হয়ে উঠল, তখন গল্পকার লিখতে থাকলেন-
বিবর্তন এবং ঘটনাপ্রবাহকে সাথে নিয়ে পেরিয়ে যাওয়া ষাটটা বছর যে কতটা দীর্ঘ- সেটা টের পায় শুধু তারাই, যারা সেটা পেরিয়ে এসেছে।
তারপরও সেদিনের সেইসব বিয়েবাড়ি, সেইসব বর-কনে, লঞ্চের সেইসব কর্মচারী ছেলে, কোমরে দড়িবাঁধা লঞ্চযাত্রী কয়েদি, দড়ি ধরা সেইসব মধ্যবয়সী পুলিশ, এই গল্পটার বয়ান জুড়ে থাকা চাষাড়ে ছলেমান, গোঁসাই, সেই কুকুরটা...
তারা সব এই দীর্ঘ সময়ের কোন কোন ভাঁজে আটকা পড়ে গেল- তার দিশে আজ আর কেউ করতে পারে না।
পেট অব্দি চড়া পড়ে নাইলো নামের সেই রমরমা নদীটা আজকাল শুকিয়ে আধমরা।
যেখানে সেখানে তরমুজ-বাঙির ক্ষেতে আমদানি করা ইউরিয়া সারের আধিক্যে কালো হয়ে আসা সবুজের বিজ্ঞাপন। তার সাথে এখানে ওখানে লম্বা লম্বা টিনশেডের পুলিশ ফাঁড়ি। নদীদের নরম নাম চাপা পড়ে গেছে বড় সব ব্রিজ আর তেলতেলে কালো চওড়া রাস্তার তলায়। প্রৌঢ়া রমণীদের মতো ঝরঝরে কিন্তু রং-করা মুখের বাসগুলো মানুষে পেট বোঝাই করে নিয়ে ছুটছে চতুর্দিকে। খুলনা থেকে সেই মোংলা, চালনা, পাইকগাছা, সাতক্ষীরা, শ্যামনগর, কালিগঞ্জ- এক্কেবারে সেই সুন্দরবনের মুখের গোড়ায়।
পাটা ফেলে যেসব গহিন খালে কাইনমাগুর ধরা হতো, সেগুলো এখন সটান পাকা রাস্তা। দু'ধারে হাইব্রিড ধানের বীজের বেছন। টোয়েন্টি-থ্রি, টোয়েন্টি-নাইন- এই রকম কত্ত সব নামের বাহার। ফাঁকফোকরে রাইস মিল আর ইটভাটার উঁচু উঁচু সব কাণ্ডকারখানা
গোঁসাই আথবা ছলেমানের প্রোপ্রৌত্রিরা এখন রাইস মিলগুলোর সিমেন্ট বাঁধানো চাতালে ধান শুকোয়। আর আধপোড়া কালো কালো সব মেয়েলোকের দল বড় বড় সব চুলোয় তুষ ছুড়ে জাগিয়ে রাখে কোনো রকমে বেঁচে থাকার মতন আগুন। সেসব আগুনের হুহু দাউ দাউ পেছনে ফেলে- ভূতের জিহ্বার সমান লকলকে রাস্তাগুলো বিছানো থাকে- এমাথা থেকে সেই ওমাথা।
মোড়ে মোড়ে বহুবর্ণ দোকানগুলোর সিডি প্লেয়ারে বাজতে থাকে- মুন্নি বদনাম হুয়ে ডার্লিং তেরে লিয়ে... আর সানসিল্ক্ক শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপনী কেশবতীরা দোল খেতে থাকে প্রাগৈতিহাসিক হাওয়ায়।
- বিষয় :
- গল্প
- ফিরোজ আহমদ