প্রচ্ছদ
গুরিঙ্যে
চাকমা ভাষায় মূল ও বাংলায় অনুবাদ :ঝিমিত ঝিমিত চাকমা
প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০
গুরিঙ্যের আসল নামটা গুরিঙ নয়। সে সবার চেয়ে বেঁটে আর ছোট বলে গুরিঙ্যে ডাকতে ডাকতেই এ নামের প্রতিষ্ঠা। তার আসল নামটা হারিয়ে গেছে। গ্রামের সমবয়সীরা তো বটেই, বয়স্করাও সবাই তাকে গুরিঙ্যে নামে ডাকে। এমনকি পরিবারের সবাই ওই নামটাই প্রতিষ্ঠা করেছে। গ্রামে তার চেয়ে অনেক কম বয়সীরাও তার চেয়ে।
সবাই বলে, বড় গাঙের ওপর কোথায় জানি একটা বাঁধ দেওয়ায় বানের কারণে উজানে গ্রামকে-গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে যায়। তাদের গ্রামটাও পানির নিচে ডুবে যায়। গ্রামের যে নারিকেল গাছটা অনেক উঁচু হওয়ায় কেউই গাছটাতে উঠতে চাইত না, শুধু এমনি ঝরে পড়লে তবেই নারিকেল পাওয়া যেত, সেটাও পানির অনেক নিচে নিঃশ্বাস বন্ধ করে ডুব দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গুরিঙ্যেদের গ্রামটা যে সময় ডুবে যায়, সবাই বলত তার বয়স তখন পাঁচ-ছয় বছর। তবে গ্রামের অধিকাংশ লোক বিশ্বাস করত তাদের গ্রামটা পানি থেকে আবার উঠে দাঁড়াবে। গ্রামের সব পরিবারকে পরিবারপিছু সরকারের লোকজন এসে কিছু অর্থকড়ি হাতে তুলে দিয়ে কাচালং নদীর উজানে বনজঙ্গল, সাপখোপ, জন্তুজানোয়ারে ভর্তি, ডোবা-নালায় পূর্ণ এক স্যাঁতসেঁতে জায়গায় নতুন বসতি করে থাকতে হবে। এমনকি তাদের জন্য পরিবারপিছু কিছু জায়গাজমিও বন্দোবস্ত করা হয়েছে, যা বর্তমানের তুলনায় একেবারে নগণ্য।
তাই কেউ কেউ দেখি কী হয়, তা দেখার জন্য একটু উঁচু পাহাড়ে আস্তানা বানিয়ে থাকল। বাদিমিলে বাপের পরিবার আর উরিঙে বাপের পরিবার হাতের কাছে একটা নৌকা রেখে, দুই পরিবার একটা পাহাড়ের চূড়ায় মাথা গোঁজার আস্তানা বানিয়ে, তারাও তা দেখতে থেকে গেল। আবার হরহামেশা পাহাড়ের ছোট ছোট ছড়ায় গিয়ে তাতে বাঁধ দিয়ে ছড়ার মাছ চিংড়ি, কাঁকড়া নিয়ে আসার সময় দেখেছে ঘণ্টাখানেক যেতে না যেতেই ওই বাঁধ ভেঙে গিয়ে সব ভাসিয়ে নিয়ে যেত। অনেক লোকজন তাই ভাবত, সরকার যত শক্তিশালীই হোক, অত গাঙে বাঁধ দিয়ে পানি আটকে রাখতে কোনোভাবেই পারবে না।
হঠাৎ ওই বছর বর্ষায় তুমুল বৃষ্টিপাত হওয়ায় আস্তানা গেড়ে থাকা পাহাড়টাও রাতের অন্ধকারে তলিয়ে যেতে থাকে। হাতের কাছে নৌকা থাকায় সামনে যে যা পেরেছে হাতে তুলে নিয়ে নৌকায় এসে আশ্রয় নিলো। নৌকার একপাশে ছই থাকায় তাতে মেয়েছেলেরা কোনো প্রকারে মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়েছে। আর পুরুষদের সারারাত বানরভেজা ভিজে সারাক্ষণ নৌকার পানি সেচতে হয়েছে।
সকাল হলে কিছু সময়ের জন্য বৃষ্টি থামলে সামান্য ভাত আর সবজি রেঁধে সবাই একটুখানি পেটে দিয়ে নৌকায় দাঁড় টানা শুরু করল পুরুষরা। দাঁড় টানা শুরু করতে না করতেই আবার মুষলধারে শুরু হয়ে যায় বৃষ্টিপাত। সে যে কী বৃষ্টিপাত, সাতপুরুষের জীবনে তা কেউই দেখেনি। আর দেখেনি কাচালং নদী স্রোতের টান আর প্রবল স্রোতের টানে সৃষ্টি হওয়া পানির ঘূর্ণি। স্রোতের টানের বিপরীতে আর প্রবল ঘূর্ণিকে পাশ কাটিয়ে দাঁড় বেয়ে উজানে বেয়ে উঠে যাওয়া সে যে কী কষ্টকর, যে করেনি আর যে দেখেনি, কল্পনা করেও বুঝতে পারবে না। স্বাভাবিক অবস্থায় এর আগে কাত্তনে যেতে তিন-চার ঘণ্টায় যতদূর যাওয়া যেত, সেই ভোর থেকে সন্ধ্যা অবধি একটানা দাঁড় বেয়ে মাত্র পুংখেয়ে্য ছড়া দোর পর্যন্ত উজানে আসা সম্ভব হয়েছে। পুংখেয়ে্য ছড়া দোরে অনেক আগে তৈরি করা একটা মাঝারি আকারের আলকঘর (মাচাঙঘর) রয়েছে। ঘাটে ছাদ খোলা তিন দাঁড়ের একটা নৌকা বাঁধা। আলকঘরটাতে রাত কাটানোর আশায় বরখুলো আর উরিঙে বাদে বাকি পনেরো-ষোলোজন পুরুষ, মেয়ে বাচ্চাকাচ্চারা বৃষ্টি উপেক্ষা করে খাড়া পাহাড়ি পথ বেয়ে আশ্রয় নিতে ছুটল। সবাই গিয়ে পৌঁছে দেখল, আগে থেকেই বাচ্চাকাচ্চাসহ বিশ-পঁচিশজন মানুষে ঘরভর্তি হয়ে রয়েছে। তারাও আঁটাআঁটি করে ঘরটাতে গিয়ে ঢুকল। ঢুকেই দেখতে পেল পুরো ঘরটা ডাবার (বাঁশের হুক্কা) ধোঁয়ায় পূর্ণ। বয়স্ক মেয়ে-পুরুষ প্রায় সবার হাতে ডাবা আর ডাবার প-ল-লৎ প-ল-লৎ আওয়াজ। তাদেরও কয়েকজন ডাবা চেয়ে নিয়ে টানা শুরু করল।
সারাদিন কারোর ডাবা টানার কপালে জোটেনি একটানা কাজের চাপে। উরিঙে বাপের কাশির টান, তা সত্ত্বেও ডাবা টানা শুরু করতে না করতেই কাশির দমকে দম আটকে মরে যাবার অবস্থা। তা দেখে পেদা উরিঙে বাপের হাত থেকে ডাবাটা কেড়ে নিয়ে নতুন করে তামাক সেজে সে আরাম করে টেনে, আরেকজনের হাতে তুলে দিয়ে, বাঁশের লাকড়ির মশাল জ্বালিয়ে, আলকঘরের নিচে গিয়ে দেখতে পেল, একটা অজগর একটা ছাগলের বাচ্চাকে পেঁচিয়ে চেপে ধরেছে। পেদা সা-প সা-প বলে চেঁচিয়ে ওঠায় আলকঘরের ওপর থেকে পাঁচ-ছয়জন লোক নিচে নেমে এসে অজগর সাপটাকে মেরে সাবারাং দিয়ে রান্না করল। ঘরে আশ্রয় নেওয়া সবার রাতের ভোজটা খুব ভালোমতো হলো। সবচেয়ে তৃপ্ত হলো বরখুলো আর উরিঙে। বরখুলো সবার অগোচরে নিয়ে আসা দুচুয়ানি নৌকার পানি সেচে ফেলছিল। দু'জনেই ফুরফুরে মেজাজে। তাদের দু'জনের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া সাবারাং দিয়ে অজগর সাপের তরকারি আর ভাত- খাওয়া শুরু করামাত্রই নিমেষে হাওয়া!
মধ্যরাতে বৃষ্টি থামলেও, ভোরবেলা থেকেই আবার বৃষ্টির তোড় বেড়েছে। বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে দুই পরিবারের লোকজন নৌকায় উঠে পড়াতে বৃষ্টি তোড়ের মধ্যেই নৌকা ছেড়ে দিয়ে আবার দাঁড় টানা। আগের দিনের দাঁড় টানায় পুরুষদের সবার হাতে ফোসকা। হাতের পাতায় আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে কাপড় দিয়ে মুড়ে দাঁড় টানতে হচ্ছে, তাতেও হাতের পাতার ব্যথা না কমে আরও বাড়তে থাকল। সব উপেক্ষা করে দু'জন দু'জন অদলবদল করে একটানা দাঁড় টানতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে চারজন লোক গুণ টেনে আর দু'জন লগি দিয়ে ঠেলে একটু একটু করে উজানে বেয়ে যেতে হচ্ছে। আর মেয়েলোকদের একটানা পানি সেচে ফেলে দিতে হচ্ছে বৃষ্টির আঁশ উপেক্ষা করে। পানি সেচে ফেলতে না ফেলতেই আবার বৃষ্টির পানিতে নৌকায় পানিভর্তি। তাই অনবরত পানি সেচে ফেলে দিতে হচ্ছে।
বাচ্চা ছেলেমেয়েরা বাদে যার যার কাজে সবাই একটানা ব্যস্ত। দুপুরের আগে মাত্র দুরিটানা বাঁকের গোড়ায় এসে সবাই ক্লান্ত শ্রান্ত হওয়ায় পজ্জনীমা ছড়ায় পানি ঢুকে পড়াতে ছড়ার সামান্য ভেতরে একটা ছাউনি থাকায় তাতে গিয়ে মেয়েরা রান্নার কাজে ব্যস্ত হলো। এ ফাঁকে পেদা আর উরিঙে লোরবুয়ার দুটো শিতে কেঁচো গেঁথে দিয়ে পানিতে ফেলে দেওয়ার অল্পক্ষণ পরে একটা শোলমাছ ধরা পড়ল। মাছটা কেটেকুটে পরিস্কার করে তিনটা আকারের মারফা দিয়ে রেঁধে, অর্ধেক রাতের জন্য রেখে, বাকিটা দিয়ে দুপুরের খাবার সেরে ফেলা হলো।
অঝোর ধারার বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সবাই আবার নৌকায় উঠে পড়ে ছড়ার ভেতর থেকে নদীতে বের হওয়ামাত্র দেখতে পেল, বৃষ্টির মধ্য দিয়ে ঝাপসাভাবে বাঁকের অনেক দূরে নদীর দুই পাড়জুড়ে কালো এক অপচ্ছায়া দ্রুতবেগে নিচের দিকে নেমে আসছে। সবাই কালো অপচ্ছায়াটার দিকে কিছুক্ষণ বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকল, হঠাৎ করে সবার বয়স্ক উরিঙে বাপ চিৎকার করে উঠল-
'আরাচাক-, আরাচাক' (বাঁশের ভেলা ও গাছের গুঁড়ি স্রোতের তোড়ে সব একসাথে জড়ো হয়ে যে বিশাল জঞ্জাল সৃষ্টি হয়, সেটাই আরাচাক)।
আচমকা সবার সংবিৎ ফিরল, বাদিমিলে বাপ চিৎকার করে বলে উঠল-
নৌকা কুলের কাছে নিয়ে যাও, গুণ নামাও, গুণ ধরে যুবকরা সবাই নেমে পড়ো গুণ ধরে ঠেনে নিয়ে পজ্জনীমা ছড়ায় ঢুকাও, না হলে সবাই আরাচাকের ভেতর ঢুকে যাব! করো, তাড়াতাড়ি করো! নৌকাটা তখন মাঝ নদীতে, পজ্জনীমা ছড়া যেদিকে তাড়াতাড়ি নৌকার মুখ সে পাড়ের দিকে ঘোরানো হলো। নৌকা পাড়ের কাছাকাছি হওয়ামাত্র টপাটপ তিনজন যুবক উরিঙে, পেদা আর চেবেদা গুণ ধরে পাড়ে নেমে পড়ল।
দাঁড় বেয়ে, গুণ ধরে রেখে কোনো প্রকারে পজ্জনীমা ছড়ার ভেতরে ঢুকতে না ঢুকতেই নদীর দুই পাড়জুড়ে পাড় ঠেলে ভেঙে আসার শব্দ শোনা গেল। মনে হচ্ছে যমরাজ মৃত্যুর দণ্ডাজ্ঞা নিয়ে তেড়ে আসছে। অল্পক্ষণ পরেই নদীর যমরাজ 'আরাচাকটা' নদীর পাড়ের মৃত্যুর বিভীষিকা নিয়ে হাজির হলো। সে কী বীভৎস তাণ্ডব- না দেখলে বোঝা যায় না, অনুভব করা যায় না। সরে যাবার পরে তার তাণ্ডবলীলার কাণ্ড দুই পাড়জুড়ে দেখলে মানুষ দুঃস্বপ্নে রাতে ঘুমাতে পারে না। তেমনি নৌকায় থাকা মানুষদের আরাচাকের উন্মত্ত তাণ্ডব কাণ্ডের লীলা অনেক রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে।
ওই দিন আর তাদের নৌকা নিয়ে বেরিয়ে উজানে যাবার কারও সাহসে কুলাল না। ভারি বৃষ্টি পড়া যেমন থামছে না, তেমনি নদীর পানি বেড়ে যাওয়াও থামছে না। এভাবে আরও একটানা পাঁচ দিন ভারি বৃষ্টিপাত হলো, ষষ্ঠ দিনে সকালবেলা থেকে বৃষ্টি কমতে কমতে দুপুরের দিকে থেমে গেল। সূর্য ডুবে যাবার আগে পৃথিবীকে একটু হাসি দিয়ে পাহাড়ের আড়ালে হারিয়ে গেল।
নৌকার মানুষজন আট দিনের মাথায় একটুখানির জন্য সূর্যের হাসি দেখতে পেল। এর আগে, নৌকার মানুষগুলো ভাবতে বসেছিল, আকাশ ফুঁড়ে বৃষ্টি নেমে এসে পুরো পৃথিবীটাকে ডুবিয়ে তবেই বৃষ্টি থামবে। পরের দু'দিন আকাশে মেঘবৃষ্টির খেলার মাঝে নদীর পানি বাড়তে বাড়তে, একসময় পানি কমতে শুরু করল। আরও একদিন অপেক্ষা করে এর পরের দিন একটু আলো ফুটতেই একটানা দাঁড় টেনে উজানে নৌকা যাত্রা শুরু করল।
এতদিন কলাপাতা দিয়ে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে খাবার আর রান্নার পানির ব্যবস্থা করে কেটে যাচ্ছিল। বৃষ্টি থামার পরে দু'দিন পরে খাবার আর রান্নার পানির সংকট দেখা দিল। গাঙে বাঁধ দিয়ে বান আসার আগে নদীর পাড়ের যে কুয়ায় মানুষদের সব চাহিদা মেটাত, সব এখন পানির অতলে হারিয়ে গেছে। নদীর পানি, ছড়ার পানি সব ঘোলাটে, তা দিয়ে খাওয়া তো দূরের কথা, রান্নার কোনো কাজেও ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। নদীর দু'পাড়ে অনেক ছড়া রয়েছে, তবে সে সবের অধিকাংশ খাবারের অনুপযোগী হলেও রান্নাবান্নার কাজে ব্যবহারের জন্য চার পাঁচ কলসি সংগ্রহ করে নৌকায় তোলা হয়।
একদিকে দাঁড় টানার ক্লান্তি, অপরদিকে বৃষ্টির পরে ঝাঁঝাঁ রোদের গুমোট গরমে দরদর করে ঘাম ঝরে পড়ায় তৃষ্ণায় সবাই কাতর। সবচেয়ে তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়েছে ছয়জন শিশু। শিশুরা মাঝে মাঝে তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়ায় ঘোলাটে নদীর পানি পান করতে চাইত। অনেক বলেকয়ে, বুঝিয়ে নিরস্ত করা গেলে শিশুরা ক্রমে ক্রমে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। দু'জন শিশু পেত্তো আর গুরিঙ্যে সবার অগোচরে কলসি থেকে পান করার পরে বিকেলবেলায় দু'জনেরই পেটে ব্যথা দেখা দিলো। পেটে ব্যথা দেখা দিতে না দিতেই শুরু হলো নৌকা আর পাড়ে আসা যাওয়া।
উরিঙে বাপ আবার একটু একটু বৈদ্যালি (ওঝাগিরি) করে বলে তাকে পাড়ে নামিয়ে দিয়ে ওষুধ সংগ্রহ করে নিয়ে আসতে বলা হলো। উরিঙে বাপ নৌকা থেকে নেমে গিয়ে ছড়ার পাড় আর পাহাড়ের ঢালে খুঁজে খুঁজে ওষুধ নিয়ে এসে শিশু দু'জনকে খাওয়াল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না দেখে কয়েক দিন আগে পাওয়া অজগর সাপের পীত সিদ্ধ পানিতে মিশিয়ে খাওয়ানো হলো।
পীত খাওয়ানোর পরে গুরিঙের একটু একটু উন্নতি দেখা দিলেও পেত্তোর উন্নতির কোনো লক্ষণ পাওয়া যাচ্ছে না। উরিঙে বাপ জোঁক, পোকার কামড় সহ্য করে বনজঙ্গল ঘুরে লতা-পাতা, গাছগাছালির ওষুধ সংগ্রহ করে আপ্রাণ চেষ্টা করে খাওয়াল কিন্তু কোনোভাবেই পেত্তোকে ভালো করতে পারল না। দু'দিনের দিন সন্ধ্যায় সমস্ত মায়া কাটিয়ে ওপারে চলে গেল। সারারাত বাপ-মায়ের কান্না চলল, সাথে নৌকায় থাকা লোকজনেরও বিষাদে মন ভরে গেল। তবে একটাই ভালো যে, গুরিঙ্যে মোটামুটি ভালো হয়ে উঠল। পরের দিন সকালবেলায় পেত্তোকে কাচালং নদীর পাড়ে গোর দিয়ে, কিছু সময়ের জন্য কান্নাকাটি করে, আবার উজানে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে দাঁড় নামিয়ে যাত্রা শুরু হলো।
দুপুরের দিকে নদীর একটা স্রোতের বাঁকে দাঁড় বেয়ে কোনোভাবেই পার হওয়া যাচ্ছিল না। গুণ টেনে স্রোতের বাঁকটা পার হওয়ার জন্য নৌকার দিক বদলাতে গিয়ে একদিকে নৌকাটা কাত হওয়ায় নৌকার কিনারায় যারা বসেছিল তিন-চারজন লোক পানিতে পড়ে গেল। একটুক্ষণ পরে দেখা গেল গুরিঙ্যে নৌকায় নেই। গুরিঙ্যেকে তোলপাড় করে খোঁজা শুরু হলো। কিছুটা ভাটিতে একটা কিছু একবার ডুবে যাচ্ছে আরেকবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। সবার আগে পেদা পাড় ধরে দৌড়ে গিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে গুরিঙ্যেকে পাড়ে ওঠাল। তখনও গুরিঙ্যের প্রাণের স্পন্দন পাওয়াতে পা দুটো উল্টা করে ধরে কিছুক্ষণ রাখায় গলগল করে নাক-মুখ দিয়ে পানি বের হলো। আরও কিছুক্ষণ রেখে গুরিঙ্যে নড়াচড়া শুরু হলে সবাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। এরপর তাকে নৌকায় তুলে ছইয়ের ভেতরে শুইয়ে রাখা হলো।
কিছুদূর উজানে এসে একটা স্বচ্ছ তাগলকের ঝরনা (ভূগর্ভস্থ পানির উৎসমুখে বাঁশের নল দিয়ে ঝরনার পানি অন্যত্র নিয়ে যাওয়া) পেয়ে ওখান থেকে নৌকায় যতগুলো পাত্র ছিল সব দিয়ে পানি সংগ্রহ করে নৌকায় তোলা হলো। এরপর কোনো অঘটন ছাড়াই তাদের গ্রামের জন্য নির্ধারিত স্থানে একটা সুবিধাজনক ঘাটে নৌকা ভিড়ানো হলো। তাদের আগে এসে পৌঁছা লোকজন তাদের দুর্ভোগের কাহিনি শুনে বিমর্ষ হলো।
এরপর সবাই বলত পরঙে আসার সময় গুরিঙ্যে আঘারা পিড়ায় (কলেরা) আক্রান্ত হওয়ায় ও পানিতে ডুবে যাওয়ায় মা গঙ্গিমা তাকে নাবানিচুবানি খাওয়ানোতে সবার চেয়ে খাটো আর আকারে ছোট বলে তার নাম গুরিঙ্যে বলে প্রতিষ্ঠিত।
ঝিমিত ঝিমিত চাকমা
জন্ম ২৭ এপ্রিল ১৯৫৮।
রাঙামাটি জেলার লংগদু উপজেলার থুলাবান গ্রামে।
মনগড় আবাসিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি একাধারে নাট্যকার ও অভিনেতা। সাহিত্যচর্চায় নিবেদিত।
সবাই বলে, বড় গাঙের ওপর কোথায় জানি একটা বাঁধ দেওয়ায় বানের কারণে উজানে গ্রামকে-গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে যায়। তাদের গ্রামটাও পানির নিচে ডুবে যায়। গ্রামের যে নারিকেল গাছটা অনেক উঁচু হওয়ায় কেউই গাছটাতে উঠতে চাইত না, শুধু এমনি ঝরে পড়লে তবেই নারিকেল পাওয়া যেত, সেটাও পানির অনেক নিচে নিঃশ্বাস বন্ধ করে ডুব দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গুরিঙ্যেদের গ্রামটা যে সময় ডুবে যায়, সবাই বলত তার বয়স তখন পাঁচ-ছয় বছর। তবে গ্রামের অধিকাংশ লোক বিশ্বাস করত তাদের গ্রামটা পানি থেকে আবার উঠে দাঁড়াবে। গ্রামের সব পরিবারকে পরিবারপিছু সরকারের লোকজন এসে কিছু অর্থকড়ি হাতে তুলে দিয়ে কাচালং নদীর উজানে বনজঙ্গল, সাপখোপ, জন্তুজানোয়ারে ভর্তি, ডোবা-নালায় পূর্ণ এক স্যাঁতসেঁতে জায়গায় নতুন বসতি করে থাকতে হবে। এমনকি তাদের জন্য পরিবারপিছু কিছু জায়গাজমিও বন্দোবস্ত করা হয়েছে, যা বর্তমানের তুলনায় একেবারে নগণ্য।
তাই কেউ কেউ দেখি কী হয়, তা দেখার জন্য একটু উঁচু পাহাড়ে আস্তানা বানিয়ে থাকল। বাদিমিলে বাপের পরিবার আর উরিঙে বাপের পরিবার হাতের কাছে একটা নৌকা রেখে, দুই পরিবার একটা পাহাড়ের চূড়ায় মাথা গোঁজার আস্তানা বানিয়ে, তারাও তা দেখতে থেকে গেল। আবার হরহামেশা পাহাড়ের ছোট ছোট ছড়ায় গিয়ে তাতে বাঁধ দিয়ে ছড়ার মাছ চিংড়ি, কাঁকড়া নিয়ে আসার সময় দেখেছে ঘণ্টাখানেক যেতে না যেতেই ওই বাঁধ ভেঙে গিয়ে সব ভাসিয়ে নিয়ে যেত। অনেক লোকজন তাই ভাবত, সরকার যত শক্তিশালীই হোক, অত গাঙে বাঁধ দিয়ে পানি আটকে রাখতে কোনোভাবেই পারবে না।
হঠাৎ ওই বছর বর্ষায় তুমুল বৃষ্টিপাত হওয়ায় আস্তানা গেড়ে থাকা পাহাড়টাও রাতের অন্ধকারে তলিয়ে যেতে থাকে। হাতের কাছে নৌকা থাকায় সামনে যে যা পেরেছে হাতে তুলে নিয়ে নৌকায় এসে আশ্রয় নিলো। নৌকার একপাশে ছই থাকায় তাতে মেয়েছেলেরা কোনো প্রকারে মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়েছে। আর পুরুষদের সারারাত বানরভেজা ভিজে সারাক্ষণ নৌকার পানি সেচতে হয়েছে।
সকাল হলে কিছু সময়ের জন্য বৃষ্টি থামলে সামান্য ভাত আর সবজি রেঁধে সবাই একটুখানি পেটে দিয়ে নৌকায় দাঁড় টানা শুরু করল পুরুষরা। দাঁড় টানা শুরু করতে না করতেই আবার মুষলধারে শুরু হয়ে যায় বৃষ্টিপাত। সে যে কী বৃষ্টিপাত, সাতপুরুষের জীবনে তা কেউই দেখেনি। আর দেখেনি কাচালং নদী স্রোতের টান আর প্রবল স্রোতের টানে সৃষ্টি হওয়া পানির ঘূর্ণি। স্রোতের টানের বিপরীতে আর প্রবল ঘূর্ণিকে পাশ কাটিয়ে দাঁড় বেয়ে উজানে বেয়ে উঠে যাওয়া সে যে কী কষ্টকর, যে করেনি আর যে দেখেনি, কল্পনা করেও বুঝতে পারবে না। স্বাভাবিক অবস্থায় এর আগে কাত্তনে যেতে তিন-চার ঘণ্টায় যতদূর যাওয়া যেত, সেই ভোর থেকে সন্ধ্যা অবধি একটানা দাঁড় বেয়ে মাত্র পুংখেয়ে্য ছড়া দোর পর্যন্ত উজানে আসা সম্ভব হয়েছে। পুংখেয়ে্য ছড়া দোরে অনেক আগে তৈরি করা একটা মাঝারি আকারের আলকঘর (মাচাঙঘর) রয়েছে। ঘাটে ছাদ খোলা তিন দাঁড়ের একটা নৌকা বাঁধা। আলকঘরটাতে রাত কাটানোর আশায় বরখুলো আর উরিঙে বাদে বাকি পনেরো-ষোলোজন পুরুষ, মেয়ে বাচ্চাকাচ্চারা বৃষ্টি উপেক্ষা করে খাড়া পাহাড়ি পথ বেয়ে আশ্রয় নিতে ছুটল। সবাই গিয়ে পৌঁছে দেখল, আগে থেকেই বাচ্চাকাচ্চাসহ বিশ-পঁচিশজন মানুষে ঘরভর্তি হয়ে রয়েছে। তারাও আঁটাআঁটি করে ঘরটাতে গিয়ে ঢুকল। ঢুকেই দেখতে পেল পুরো ঘরটা ডাবার (বাঁশের হুক্কা) ধোঁয়ায় পূর্ণ। বয়স্ক মেয়ে-পুরুষ প্রায় সবার হাতে ডাবা আর ডাবার প-ল-লৎ প-ল-লৎ আওয়াজ। তাদেরও কয়েকজন ডাবা চেয়ে নিয়ে টানা শুরু করল।
সারাদিন কারোর ডাবা টানার কপালে জোটেনি একটানা কাজের চাপে। উরিঙে বাপের কাশির টান, তা সত্ত্বেও ডাবা টানা শুরু করতে না করতেই কাশির দমকে দম আটকে মরে যাবার অবস্থা। তা দেখে পেদা উরিঙে বাপের হাত থেকে ডাবাটা কেড়ে নিয়ে নতুন করে তামাক সেজে সে আরাম করে টেনে, আরেকজনের হাতে তুলে দিয়ে, বাঁশের লাকড়ির মশাল জ্বালিয়ে, আলকঘরের নিচে গিয়ে দেখতে পেল, একটা অজগর একটা ছাগলের বাচ্চাকে পেঁচিয়ে চেপে ধরেছে। পেদা সা-প সা-প বলে চেঁচিয়ে ওঠায় আলকঘরের ওপর থেকে পাঁচ-ছয়জন লোক নিচে নেমে এসে অজগর সাপটাকে মেরে সাবারাং দিয়ে রান্না করল। ঘরে আশ্রয় নেওয়া সবার রাতের ভোজটা খুব ভালোমতো হলো। সবচেয়ে তৃপ্ত হলো বরখুলো আর উরিঙে। বরখুলো সবার অগোচরে নিয়ে আসা দুচুয়ানি নৌকার পানি সেচে ফেলছিল। দু'জনেই ফুরফুরে মেজাজে। তাদের দু'জনের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া সাবারাং দিয়ে অজগর সাপের তরকারি আর ভাত- খাওয়া শুরু করামাত্রই নিমেষে হাওয়া!
মধ্যরাতে বৃষ্টি থামলেও, ভোরবেলা থেকেই আবার বৃষ্টির তোড় বেড়েছে। বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে দুই পরিবারের লোকজন নৌকায় উঠে পড়াতে বৃষ্টি তোড়ের মধ্যেই নৌকা ছেড়ে দিয়ে আবার দাঁড় টানা। আগের দিনের দাঁড় টানায় পুরুষদের সবার হাতে ফোসকা। হাতের পাতায় আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে কাপড় দিয়ে মুড়ে দাঁড় টানতে হচ্ছে, তাতেও হাতের পাতার ব্যথা না কমে আরও বাড়তে থাকল। সব উপেক্ষা করে দু'জন দু'জন অদলবদল করে একটানা দাঁড় টানতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে চারজন লোক গুণ টেনে আর দু'জন লগি দিয়ে ঠেলে একটু একটু করে উজানে বেয়ে যেতে হচ্ছে। আর মেয়েলোকদের একটানা পানি সেচে ফেলে দিতে হচ্ছে বৃষ্টির আঁশ উপেক্ষা করে। পানি সেচে ফেলতে না ফেলতেই আবার বৃষ্টির পানিতে নৌকায় পানিভর্তি। তাই অনবরত পানি সেচে ফেলে দিতে হচ্ছে।
বাচ্চা ছেলেমেয়েরা বাদে যার যার কাজে সবাই একটানা ব্যস্ত। দুপুরের আগে মাত্র দুরিটানা বাঁকের গোড়ায় এসে সবাই ক্লান্ত শ্রান্ত হওয়ায় পজ্জনীমা ছড়ায় পানি ঢুকে পড়াতে ছড়ার সামান্য ভেতরে একটা ছাউনি থাকায় তাতে গিয়ে মেয়েরা রান্নার কাজে ব্যস্ত হলো। এ ফাঁকে পেদা আর উরিঙে লোরবুয়ার দুটো শিতে কেঁচো গেঁথে দিয়ে পানিতে ফেলে দেওয়ার অল্পক্ষণ পরে একটা শোলমাছ ধরা পড়ল। মাছটা কেটেকুটে পরিস্কার করে তিনটা আকারের মারফা দিয়ে রেঁধে, অর্ধেক রাতের জন্য রেখে, বাকিটা দিয়ে দুপুরের খাবার সেরে ফেলা হলো।
অঝোর ধারার বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সবাই আবার নৌকায় উঠে পড়ে ছড়ার ভেতর থেকে নদীতে বের হওয়ামাত্র দেখতে পেল, বৃষ্টির মধ্য দিয়ে ঝাপসাভাবে বাঁকের অনেক দূরে নদীর দুই পাড়জুড়ে কালো এক অপচ্ছায়া দ্রুতবেগে নিচের দিকে নেমে আসছে। সবাই কালো অপচ্ছায়াটার দিকে কিছুক্ষণ বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকল, হঠাৎ করে সবার বয়স্ক উরিঙে বাপ চিৎকার করে উঠল-
'আরাচাক-, আরাচাক' (বাঁশের ভেলা ও গাছের গুঁড়ি স্রোতের তোড়ে সব একসাথে জড়ো হয়ে যে বিশাল জঞ্জাল সৃষ্টি হয়, সেটাই আরাচাক)।
আচমকা সবার সংবিৎ ফিরল, বাদিমিলে বাপ চিৎকার করে বলে উঠল-
নৌকা কুলের কাছে নিয়ে যাও, গুণ নামাও, গুণ ধরে যুবকরা সবাই নেমে পড়ো গুণ ধরে ঠেনে নিয়ে পজ্জনীমা ছড়ায় ঢুকাও, না হলে সবাই আরাচাকের ভেতর ঢুকে যাব! করো, তাড়াতাড়ি করো! নৌকাটা তখন মাঝ নদীতে, পজ্জনীমা ছড়া যেদিকে তাড়াতাড়ি নৌকার মুখ সে পাড়ের দিকে ঘোরানো হলো। নৌকা পাড়ের কাছাকাছি হওয়ামাত্র টপাটপ তিনজন যুবক উরিঙে, পেদা আর চেবেদা গুণ ধরে পাড়ে নেমে পড়ল।
দাঁড় বেয়ে, গুণ ধরে রেখে কোনো প্রকারে পজ্জনীমা ছড়ার ভেতরে ঢুকতে না ঢুকতেই নদীর দুই পাড়জুড়ে পাড় ঠেলে ভেঙে আসার শব্দ শোনা গেল। মনে হচ্ছে যমরাজ মৃত্যুর দণ্ডাজ্ঞা নিয়ে তেড়ে আসছে। অল্পক্ষণ পরেই নদীর যমরাজ 'আরাচাকটা' নদীর পাড়ের মৃত্যুর বিভীষিকা নিয়ে হাজির হলো। সে কী বীভৎস তাণ্ডব- না দেখলে বোঝা যায় না, অনুভব করা যায় না। সরে যাবার পরে তার তাণ্ডবলীলার কাণ্ড দুই পাড়জুড়ে দেখলে মানুষ দুঃস্বপ্নে রাতে ঘুমাতে পারে না। তেমনি নৌকায় থাকা মানুষদের আরাচাকের উন্মত্ত তাণ্ডব কাণ্ডের লীলা অনেক রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে।
ওই দিন আর তাদের নৌকা নিয়ে বেরিয়ে উজানে যাবার কারও সাহসে কুলাল না। ভারি বৃষ্টি পড়া যেমন থামছে না, তেমনি নদীর পানি বেড়ে যাওয়াও থামছে না। এভাবে আরও একটানা পাঁচ দিন ভারি বৃষ্টিপাত হলো, ষষ্ঠ দিনে সকালবেলা থেকে বৃষ্টি কমতে কমতে দুপুরের দিকে থেমে গেল। সূর্য ডুবে যাবার আগে পৃথিবীকে একটু হাসি দিয়ে পাহাড়ের আড়ালে হারিয়ে গেল।
নৌকার মানুষজন আট দিনের মাথায় একটুখানির জন্য সূর্যের হাসি দেখতে পেল। এর আগে, নৌকার মানুষগুলো ভাবতে বসেছিল, আকাশ ফুঁড়ে বৃষ্টি নেমে এসে পুরো পৃথিবীটাকে ডুবিয়ে তবেই বৃষ্টি থামবে। পরের দু'দিন আকাশে মেঘবৃষ্টির খেলার মাঝে নদীর পানি বাড়তে বাড়তে, একসময় পানি কমতে শুরু করল। আরও একদিন অপেক্ষা করে এর পরের দিন একটু আলো ফুটতেই একটানা দাঁড় টেনে উজানে নৌকা যাত্রা শুরু করল।
এতদিন কলাপাতা দিয়ে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে খাবার আর রান্নার পানির ব্যবস্থা করে কেটে যাচ্ছিল। বৃষ্টি থামার পরে দু'দিন পরে খাবার আর রান্নার পানির সংকট দেখা দিল। গাঙে বাঁধ দিয়ে বান আসার আগে নদীর পাড়ের যে কুয়ায় মানুষদের সব চাহিদা মেটাত, সব এখন পানির অতলে হারিয়ে গেছে। নদীর পানি, ছড়ার পানি সব ঘোলাটে, তা দিয়ে খাওয়া তো দূরের কথা, রান্নার কোনো কাজেও ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। নদীর দু'পাড়ে অনেক ছড়া রয়েছে, তবে সে সবের অধিকাংশ খাবারের অনুপযোগী হলেও রান্নাবান্নার কাজে ব্যবহারের জন্য চার পাঁচ কলসি সংগ্রহ করে নৌকায় তোলা হয়।
একদিকে দাঁড় টানার ক্লান্তি, অপরদিকে বৃষ্টির পরে ঝাঁঝাঁ রোদের গুমোট গরমে দরদর করে ঘাম ঝরে পড়ায় তৃষ্ণায় সবাই কাতর। সবচেয়ে তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়েছে ছয়জন শিশু। শিশুরা মাঝে মাঝে তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়ায় ঘোলাটে নদীর পানি পান করতে চাইত। অনেক বলেকয়ে, বুঝিয়ে নিরস্ত করা গেলে শিশুরা ক্রমে ক্রমে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। দু'জন শিশু পেত্তো আর গুরিঙ্যে সবার অগোচরে কলসি থেকে পান করার পরে বিকেলবেলায় দু'জনেরই পেটে ব্যথা দেখা দিলো। পেটে ব্যথা দেখা দিতে না দিতেই শুরু হলো নৌকা আর পাড়ে আসা যাওয়া।
উরিঙে বাপ আবার একটু একটু বৈদ্যালি (ওঝাগিরি) করে বলে তাকে পাড়ে নামিয়ে দিয়ে ওষুধ সংগ্রহ করে নিয়ে আসতে বলা হলো। উরিঙে বাপ নৌকা থেকে নেমে গিয়ে ছড়ার পাড় আর পাহাড়ের ঢালে খুঁজে খুঁজে ওষুধ নিয়ে এসে শিশু দু'জনকে খাওয়াল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না দেখে কয়েক দিন আগে পাওয়া অজগর সাপের পীত সিদ্ধ পানিতে মিশিয়ে খাওয়ানো হলো।
পীত খাওয়ানোর পরে গুরিঙের একটু একটু উন্নতি দেখা দিলেও পেত্তোর উন্নতির কোনো লক্ষণ পাওয়া যাচ্ছে না। উরিঙে বাপ জোঁক, পোকার কামড় সহ্য করে বনজঙ্গল ঘুরে লতা-পাতা, গাছগাছালির ওষুধ সংগ্রহ করে আপ্রাণ চেষ্টা করে খাওয়াল কিন্তু কোনোভাবেই পেত্তোকে ভালো করতে পারল না। দু'দিনের দিন সন্ধ্যায় সমস্ত মায়া কাটিয়ে ওপারে চলে গেল। সারারাত বাপ-মায়ের কান্না চলল, সাথে নৌকায় থাকা লোকজনেরও বিষাদে মন ভরে গেল। তবে একটাই ভালো যে, গুরিঙ্যে মোটামুটি ভালো হয়ে উঠল। পরের দিন সকালবেলায় পেত্তোকে কাচালং নদীর পাড়ে গোর দিয়ে, কিছু সময়ের জন্য কান্নাকাটি করে, আবার উজানে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে দাঁড় নামিয়ে যাত্রা শুরু হলো।
দুপুরের দিকে নদীর একটা স্রোতের বাঁকে দাঁড় বেয়ে কোনোভাবেই পার হওয়া যাচ্ছিল না। গুণ টেনে স্রোতের বাঁকটা পার হওয়ার জন্য নৌকার দিক বদলাতে গিয়ে একদিকে নৌকাটা কাত হওয়ায় নৌকার কিনারায় যারা বসেছিল তিন-চারজন লোক পানিতে পড়ে গেল। একটুক্ষণ পরে দেখা গেল গুরিঙ্যে নৌকায় নেই। গুরিঙ্যেকে তোলপাড় করে খোঁজা শুরু হলো। কিছুটা ভাটিতে একটা কিছু একবার ডুবে যাচ্ছে আরেকবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। সবার আগে পেদা পাড় ধরে দৌড়ে গিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে গুরিঙ্যেকে পাড়ে ওঠাল। তখনও গুরিঙ্যের প্রাণের স্পন্দন পাওয়াতে পা দুটো উল্টা করে ধরে কিছুক্ষণ রাখায় গলগল করে নাক-মুখ দিয়ে পানি বের হলো। আরও কিছুক্ষণ রেখে গুরিঙ্যে নড়াচড়া শুরু হলে সবাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। এরপর তাকে নৌকায় তুলে ছইয়ের ভেতরে শুইয়ে রাখা হলো।
কিছুদূর উজানে এসে একটা স্বচ্ছ তাগলকের ঝরনা (ভূগর্ভস্থ পানির উৎসমুখে বাঁশের নল দিয়ে ঝরনার পানি অন্যত্র নিয়ে যাওয়া) পেয়ে ওখান থেকে নৌকায় যতগুলো পাত্র ছিল সব দিয়ে পানি সংগ্রহ করে নৌকায় তোলা হলো। এরপর কোনো অঘটন ছাড়াই তাদের গ্রামের জন্য নির্ধারিত স্থানে একটা সুবিধাজনক ঘাটে নৌকা ভিড়ানো হলো। তাদের আগে এসে পৌঁছা লোকজন তাদের দুর্ভোগের কাহিনি শুনে বিমর্ষ হলো।
এরপর সবাই বলত পরঙে আসার সময় গুরিঙ্যে আঘারা পিড়ায় (কলেরা) আক্রান্ত হওয়ায় ও পানিতে ডুবে যাওয়ায় মা গঙ্গিমা তাকে নাবানিচুবানি খাওয়ানোতে সবার চেয়ে খাটো আর আকারে ছোট বলে তার নাম গুরিঙ্যে বলে প্রতিষ্ঠিত।
ঝিমিত ঝিমিত চাকমা
জন্ম ২৭ এপ্রিল ১৯৫৮।
রাঙামাটি জেলার লংগদু উপজেলার থুলাবান গ্রামে।
মনগড় আবাসিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি একাধারে নাট্যকার ও অভিনেতা। সাহিত্যচর্চায় নিবেদিত।