ঢাকা বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪

আপন দর্পণ

'ইচ্ছে করে রাতভর লিখি মানুষের কথা'

'ইচ্ছে করে রাতভর লিখি মানুষের কথা'

বিমল গুহ [জন্ম :২৭ অক্টোবর ১৯৫২]

বিমল গুহ

প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০

-দূর শৈশবের প্রথম স্মৃতি
--আমাদের প্রথম বিদ্যাপীঠ বাজালিয়া প্রাইমারি স্কুল। তখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে উঠেছি। স্কুলে নিয়ম ছিল- যে ক্লাসে প্রথম, সে-ই ক্লাসের ক্যাপ্টেন। ক্লাস টুতে আমি ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব পালন করতাম। একদিন একজন শিক্ষক এলেন ক্লাসে, আমাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন। আমি উত্তর দিতে পারলাম না। স্যার তখন বললেন- 'তুমি তো দ্বিতীয় শ্রেণিতেই ওঠার উপযুক্ত না। প্রথম শ্রেণিতে পড়ার উপযুক্ত।' শিক্ষকের সম্মানার্থে আমি নাম বলছি না। তিনি আদর করেই বলেছিলেন কিন্তু শুনে আমার খুব অপমান বোধ হলো। বাড়িতে গিয়ে গোঁ ধরলাম আমাকে আবার প্রথম শ্রেণিতেই ভর্তি করিয়ে দিতে হবে, আমি পড়ব না দ্বিতীয় শ্রেণিতে। এবং আমি আবার প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে তবেই শান্ত হলাম।
-শৈশব কৈশোরের বন্ধু যারা-
--আমার ছোট ভাই নির্মল ছিল আমার বন্ধু। তার যারা খেলার সাথী, তাদের সঙ্গেও বন্ধুতা ছিল। আমাদের পাড়ার কাছেই ছিল মগপাড়া। উবামং মগ ছিল আমার বন্ধু। এই ছেলেটা এসএসসিতে স্ট্যান্ড করেছিল। আর বন্ধু ছিল, তাজুল ইসলাম, জ্ঞানেন্দ্র দয়াল, অমল। ওরা যেমন ছিল আমার খেলার সাথি, তেমন প্রতিযোগিতাও হতো ক্লাসে।
-যে ব্যক্তিগত ঘটনা আমাকে কবি করেছে-
--আমাদের বাংলা শিক্ষক ফণীন্দ্রলাল নন্দী আমাদের বাড়িতেই থাকতেন। তখন আমি অষ্টম শ্রেণিতে। একদিন স্যার বললেন, পাঠ্যবইয়ের বাইরে আরও প্রচুর ভালো আউট-বই আছে, বড় হতে হলে সেসব পড়তে হবে। যখন নবম শ্রেণিতে উঠেছি, স্কুলের লাইব্রেরি থেকে ফণীন্দ্র স্যার আমাকে রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা এনে দিলেন। সঞ্চয়িতার ধ্বনিদ্যোতনা আমাকে আচ্ছন্ন করল। এই আচ্ছন্নতার পেছনে আমাদের পারিবারিক আবহের ভূমিকা ছিল। বিশেষ করে আমার নানার কথা বলতে পারি। রজনী সেন। তিনি ছিলেন লোককবি ও লোকসংগীত শিল্পী। তিনি আমাদের বাড়ি এলে আমাকে সঙ্গে নিয়ে জারি, কবিগানের আসর বসাতেন। আমাকে বলতেন, 'আমি এক লাইন বলব, তুই আরেক লাইন বলবি।' আমি বলতাম। কখনও বলতে না পারলে তিনি বলে দিতেন। আমি অবাক হয়ে যেতাম। এর ভেতর পড়ছি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, কখনও ফররুখ আহমদ। ছন্দের দোলা আমাকে টানত। বাবাও ছিলেন সংগীত শিল্পী, বাবার অবর্তমানে তাঁর বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বসতাম। ক্রমশ সুর, ছন্দ, কবিতার পথে এগোতে এগোতে, একদিন খাতা টেনে লিখে ফেললাম প্রথম কবিতা।
-প্রথম বই প্রকাশের স্মৃতি-
--১৯৭৭ সালে মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়ে ফলাফল প্রকাশের আগে আমি ঢাকা চলে আসি। ৭৭ থেকে ৮২ সাল অবধি আমি খুব নিয়মিত লেখক। সবকটি জাতীয় পত্রিকায় নিয়মিত ছাপা হতো। একদিন শিশু একাডেমিতে গেলাম বেড়াতে। সেখানে আমার বন্ধু আবু সাঈদ জুবেরী, কথাসাহিত্যিক, বললেন- 'বিমল আপনার প্রথম বইটা আমি করব।' তিনি শব্দদেশ প্রকাশনী নামে একটি প্রকাশনী করেছিলেন। তাঁর হাতেই বেরোল আমার প্রথম কবিতার বই, 'অহংকার, তোমার শব্দ'।
-প্রিয় লেখক যাঁরা-
--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সমর সেন, সুকান্ত ভট্টাচার্য, শামসুর রাহমান, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদ, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, মুহম্মদ নূরুল হুদা। প্রিয় ব্রিটিশ কবি বেনজামিন জাপানিয়া, স্টিভেন ওয়েলস- মারা গেছেন বছর কয়েক আগে। জন কুপার ক্লার্ক। তাঁরা সমসাময়িক, বড় কবি, প্রিয় কবি।
-যে বই বারবার পড়ি-
--রবীন্দ্রনাথের 'গীতবিতান'। পড়েও শেষ হয় না, শুনেও শেষ হয় না। রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গান দ্বিতীয়বার শুনলে দ্বিতীয় অর্থ ধরা দেয়। গীতবিতানের লেখাগুলো আমার কাছে মহৎ কবিতা।
-শিল্পের পথে অন্য যা হতে পারতাম-
--সংগীতশিল্পী হতে পারতাম। আমার বাবা সংগীতশিল্পী ছিলেন, বাড়িতে সংগীতের আবহ ছিল। আমার নানা, যাঁকে আমরা দাদু বলতাম, আগেই বলেছি, তিনি লোককবি, লোকগীতির শিল্পী ছিলেন। অন্য প্রসঙ্গে একটি কথা- আমার এই দাদুকে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনারা মুখে গুলি করে মেরেছিল।
-অন্য ধারার প্রিয় শিল্পী যাঁরা-
--চারুশিল্পে প্রিয় যাঁরা এবং যে কারণে প্রিয়; জয়নুল আবেদিন- সময়কে তুলে এনেছেন, এস এম সুলতান- বলিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠা করেছেন, কাইয়ুম চৌধুরী- আপন ব্যক্তিত্ব প্রতিফলিত হয় তাঁর চিত্রে, সমরজিৎ রায়চৌধুরী- সমাজ তুলে এনেছেন, শাহাবুদ্দিন- তিনিও বলিষ্ঠ শিল্প করেছেন, আবদুস শাকুর শাহ- লোকজ বিষয় তুলে এনেছেন।
-ব্যক্তিগত যে সীমাবদ্ধতা কষ্ট দেয়-
--ইচ্ছে করে রাতভর লিখে মানুষের কথা, জীবনবোধের কথা তুলে আনি। পেরে উঠি না। তারপর যা লিখতে চাই, তা হয় না, অন্য একটা হয়। এসব কষ্ট দেয়।
-আমার চরিত্রের শক্তিশালী দিক-
--সততা ও নিষ্ঠা। কথা দিয়ে কথা রাখা। নিবেদনের সঙ্গে মেনে চলার চেষ্টা করি।
-সবচেয়ে বেশি শোনা প্রশংসা-
--ভালো মানুষ। যদিও ভালো মানুষের সংজ্ঞা আমি জানি না।
-সবচেয়ে বেশি শোনা অভিযোগবাক্য-
--পারিবারিক সামাজিকতা মেনে চলতে পারি না।
-মানুষের ব্যক্তিত্বের যে দিক আগ্রহী করে তোলে-
--কৃতজ্ঞতাবোধ।
-প্রিয় উদ্ধৃতি
--উইলিয়াম ব্লেকের একটা কথা- Wisdom is sold in the desolate market, where none come to buy.

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×