প্রচ্ছদ
অন্য প্রান্তে
নাসিমা আনিস
প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২২ | ১২:০০
মধ্যবিত্তের ইমোশন-সেন্টিমেট বাদ দিলে তারা আসলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়- কথাটা বলতেন আমার এক চাচা; অল্প বয়সে রাজনীতির পাঠ ছিল, সে কারণে কিনা কী জানি! যখন বলতেন, জানপ্রাণ দিয়ে বলতেন, যেন এর বাইরে মধ্যবিত্তের আর কোনো পরিচয় নাই। তখন ভাবতাম চাচার বোধ হয় ভান্ডারে বিশেষ কথা বা বাণী নাই, চান্স পাইলেন তো এই ঝাড়লেন! শেষ পর্যন্ত আমার দশা চাচার কথামতোই হলো, কিছু সেন্টিমেন্ট সারা জীবনের জন্য পুঁজি হয়ে সুদাসলে বেড়েই চলল এবং শেষ পর্যন্ত দেখলাম- সত্যি এর চেয়ে সত্য যেমন নাই, তেমনি একে এড়ানোর কোনো জাদুও জানা নাই!
বাবা নাম রেখেছিল আমার তুলতুল, সময়ের তুলনায় নামটা অধিক সুন্দর। সেই উনিশশ তিপ্পান্ন সালের দম্পতির প্রথম সন্তান ছাপ্পান্নে জন্মে এই নাম! কিন্তু কী বলুন তো, সুন্দর সবাই সহ্য করবে! করবে না, করেনি। তারা আমার নামটাকে তুলায় পর্যবসিত করল। তুলা, ফুঃ উ উ উ! স্কুলে ভর্তি হলে আমার পাড়ার বান্ধবীই ক্লাসের সবাইকে জানাল, জান্নাতুল ফেরদৌসের আসল নাম তুলা। তুলা! ফুঃ উউউ। কয়দিন তো খুব মন খারাপ, কত খুশি হয়ে সবাইকে বলেছি আমার নাম তুলতুল। দু'একজন নাদুসনুদুস গালে হাত দিয়ে টিপে আদর করে পরখ পর্যন্ত করেছে কতটা তুলতুলে। তো পাড়ায় তুলা, স্কুলে তুলা। মা এই নিয়ে কোনো অভিযোগ শুনতে নারাজ- তুলা তো কী হয়েছে, ধুলাও তো আমার গ্রামের একজনের নাম! ভাগ্যিস ধুলা নয়, কিছুক্ষণের জন্য সান্ত্বনা আসে প্রাণে, আবার যেই সেই; নাম নিয়ে মন খারাপ। বাবা তুলতুল রাখল বটে, তুলতুল থেকে তুলাকে কিন্তু অনুমোদনহীন রাখল না। জীবন থেকে চিরতরে তুলতুল হারিয়ে গিয়ে এক পালকহীন বকপক্ষী হয়ে রইলাম। নামই যার প্রতিপক্ষ, তারে দিয়া কী হয় জগতে!
আজিমপুর থাকেন আমার এক খালা, বহু পরে জেনেছিলাম ইনি আমার আপন খালা নন; মায়ের ফুপাতো বোন। তাঁর মেয়েদের নাম কী মধুর! হেনা, বকুল আর জুঁই। তিনটে ভাই তাদের- কাজল, সজল আর রঞ্জন। বকুল আর জুঁই আমারই বয়সী, আসে বেড়াতে, তুলা তুলা করে, বিরক্তের তুলা উড়ে যায় না, তিতা তিতা লাগে, সত্যি। ওদের নামের মতো ওদের জীবনযাপন সুন্দর; বিদেশি খেলনা, আকাশে ওড়া প্রজাপতি, বাক্স ভরা ডল। সত্যি বলতে, ওরা বড়লোক নয়; মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত। ছোট কোয়ার্টারে থাকে, বাবা সচিবালয়ের কেরানি, কাটা ইলিশ কিনে আনে বাজার থেকে। আমার বাবার কাজের লোক গোটা ইলিশ কেনে। টাকা-পয়সা ধরলে আমার বাবারই একটু বেশি, অনেকটাই বেশি। অবশ্য পলাশি বাজারে প্রায় সবাই কাটা ইলিশই কিনতে বাধ্য ছিল স্বাধীনের আগে পরে দুই-তিন দশক।
তো থ্রিতে পড়ার সময় একদিন মা নিয়ে বেড়াতে গেল সেই খালার বাসায়, গিয়ে দেখি জুঁইয়ের এক বাক্স ডল, করাচি থেকে তার বড় মামা এনে দিয়েছেন। ওদের খেলনার জোগানদাতা মামারা, সেটা তো জানিই। তাঁদের আমি দেখেছি, করাচি থেকে এসে একজন আমাদের বাসায় এসেছিলেন দুটো আনারস নিয়ে। তিনি আমারও মামা, ইচ্ছা করলে আনারসের বদলে দু'খানা ডল আমার জন্য কি আমার চেয়ে তিন বছরের ছোট বোনটার জন্যও আনতে পারতেন, কত না খুশি হতাম! আমি বলি, জুঁই, তোমার বারোটা ডল, আমাকে একটা দেবে! সে সবসময় বলে আমি তার বেস্ট ফ্রেন্ড, আমাদের বাসায় বেড়াতে তাঁর খুবই ভালো লাগে, রাতে থাকতে আরও ভালো লাগে। সে সময় এইভাবে বেস্ট ফ্রেন্ড বলা সত্যি সুলভ ছিল না, কিন্তু ও বলত খুব আন্তরিকভাবে। তো সে আমার প্রস্তাব কী অনুরোধ শুনে একটু ভাবল। তারপর বলে, আচ্ছা একটা দিব, একটা তুমি নিও। তারপর আমি বললাম, একটা না দুটো দিও, ওরা দুই বোন আমার জুতার বাক্স ঘরে থাকবে, একা থাকলে তো মরেই যাবে! ও আবারও একটু ভেবে মাথা কাত করে সম্মতি জানাল। মন ভালো নিয়ে সারাদিন রইলাম, ওর মামারা কত ভালো তাই ভাবলাম। সত্যি ভালো, তাই তো তারা আমাদের বাসায় এলে বাবা কী রকম ব্যস্ত হয়ে পলাশি যায়, কেক কেনে, সেমাই কেনে। খুব সম্মানিত মেহমান এলে মা দুধ সেমাই করেন, ঘন দুধে ঘিয়ে ভাজা সেমাই ভাসে, ওপরে কিশমিশ। তখন আমাদের গরু ছিল, মবিন গরু পালত, বাজার করত আর পচা মাছ কিনে প্রায়ই চড় খেত বাবার। তো আজিমপুরের এই খালাম্মার তিন ভাই- একজন সিএসপি অফিসার, একজন ডাক্তার আর বড় জন করাচি থাকেন; পাঠান বউ। একবার অপরূপ বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে বেড়াতে এসেছিলেন, পোলাও-মাংস হয়েছিল। তিন ভাইয়ের একমাত্র বোন এই খালাম্মা, তাই আমার বাবা-মা দু'জনের কাছেই খুব সম্মানিত ও আপনজন। স্কুলে ভর্তি হতে হলে খালাম্মাকে নিতে হয়, মায়ের বাচ্চা হওয়ার সময় তিনি আসেন বাবার ভাত বেড়ে খাওয়াতে, আমাদের খাওয়ারও তদারকি করেন। আমি বুয়ার সঙ্গে ভয়াবহ কষ্ট করে রান্না করি, সেটা অবশ্য এইটে পড়তে উনসত্তরে। তো সারাদিন খেলি আর ভাবি কখন সন্ধ্যা হবে আর পুতুল হাতে নিয়ে বাসায় যাব, জুতার বাক্স নতুন করে সাজাব। প্রবল উত্তেজনা নিয়ে জুঁইয়ের পিছন পিছন ঘুরি আর ভাবি, সত্যি দিবে তো! বারোটা ডল দিয়ে ও কী করবে! নিশ্চয়ই দিবে।
সন্ধ্যায় চলে যাব, মায়ের চা খাওয়া-পান খাওয়া হয়ে গেছে। আমি জুঁইয়ের কাছে ছুটে যাই। সারাবাড়িতে জুঁই নাই। খুঁজে খুঁজে যখন আশা ছেড়ে দিলাম, কে যেন বলল, জুঁই তো বারান্দায়। সত্যি ভরা সন্ধ্যায় গিয়ে দেখি একটা গামছার উপর ও বসে আছে, ওর ফ্রকের নিচে কোলের উপর বাক্সটা, যেথায় ডলগুলো ঘুমাচ্ছে, পেটটা মোটা দেখাচ্ছে। ওর চোখ বোজা, দুই হাত দিয়ে জামার ঝুল চেপে ধরে আছে। আমি তো অবাক, এটা কোন জুঁই! আমি তবুও নাছোড়বান্দা। - জুঁই আমাকে ডল দুটো দাও! দুই-তিনবার বলার পর পাশ থেকে বকুল বলে উঠল- তুলা আজ আর কিছু নিতে পারবে না, ও ধ্যানে বসেছে, ধ্যানে বসলে কিছু শুনতে পায় না। সেদিন আমাদের সঙ্গে আমার বয়সী আমার একমাত্র খালা ছিল। গ্রাম থেকে বেড়াতে আসায় তার উপলক্ষেই এবার বেড়ানো। সে আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে- তুলা ও তোমারে পুতলা দিবে না, দেখ না ভং ধরছে! আমি খালাম্মার মুখের কাছ থেকে কান সরিয়ে নিই, আমার অত্যন্ত খারাপ লাগে, ভং শব্দটা আসলেই অশ্নীল। আরও কয়েক মিনিট অপেক্ষা করলেও জুঁইয়ের ধ্যান ভাঙার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না।
দেখতে দেখতে আমরা বড় হয়ে যেতে লাগলাম, বেশি বড় হলাম যুদ্ধের নয় মাসে। ফিরে এসে দেখি জুঁই লম্বা ঢেঙ্গা হয়েছে আরও, আগের মতোই কিছুটা ফ্যাকাশে দুধ-ফরসা মাংস-চর্বিহীন একহারা। আমি বরাবর শ্যামলা স্বাস্থ্যবতী। দশম শ্রেণি আমাদের, নবম অটো, সদাশয় সরকার দিয়েছে যুদ্ধের কারণে। জুঁই ভালো ছাত্রী, সায়েন্স গ্রুপ। আমার আর্টস, কোনো রকমের ছাত্রী আমি, একই স্কুল আজিমপুর। স্কুলে দেখা হয় ছুটির সময়। বাসায় মাঝে মাঝে ও আসে, আমিও যাই। কলেজ আমাদের আলাদা হয়ে গেল- আমি ইডেনে, ও চলে গেল বদরুন্নেসায়। কলেজ পাস করে ও ঢাকা মেডিকেলে পড়তে গেল, আমি ইডেনেই ডিগ্রি পড়ি। এ সময় জুঁইয়ের বিয়ে ঠিক হয়। তার আগের বছর খালুজান দীর্ঘমেয়াদি রোগভোগের পর মারা যান। জুঁইয়ের বিয়ের সময় ওরা শুধু বাবাকে দাওয়াত দিল, ছোট অনুষ্ঠান নাকি! এর আগে দুইটা মুসলমানি কী অন্য কোনোটায় সপরিবার ছাড়া কোনো দাওয়াতের ইতিহাস নাই। আমি জুঁইয়ের বেস্ট ফ্রেন্ড, আমি বাদ। মন বেজায় খারাপ হলো। খবর পেয়েছি এমনকি ধুমধামে হলুদ অনুষ্ঠানও হয়েছে। ছোট বোনের স্কুলবান্ধবী চ্যামনের বড় ভাই জুঁইয়ের ক্লাসমেট, তার সাথে বকুলের প্রেম। চ্যামনের মারফত খবরাখবর আনে ছোট বোন। খবরগুলো এমন ভাবে আসতে লাগল যে বাবাকে আমরা অপরাধী করতে লাগলাম। কেননা মোহাম্মদপুরে জুঁইদের বাড়ি নির্মাণে বাবা বহুদিন তদারকিতে ছিল বছর কয়েক আগে। আবার মায়ের পছন্দ জিগাতলায় ছোট একটা বাড়ি কেনার প্রক্রিয়ায় খালাম্মা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানালে বাবা কেনা থেকে বিরত হয় গভীর আস্থায়। মা খুব মন খারাপ করে থাকলেও খালাম্মার মতামত খুব গ্রহণীয় ছিল দু'জনেরই কাছে।
আরেকটা কথা বলা জরুরি, বাবার কিছু মানসিক অসুস্থতা হঠাৎ দেখা দেওয়ায় আমাদের জীবন তখন কিছুটা হুমকির সম্মুখীন। বাবার আয়-রোজগারও বেশ কমে গিয়ে পরিবার হিমশিম খাচ্ছে। মা একবার শুধু বলল, বোন বুঝি বুঝতে পেরেছে আর ভালো উপহার যাবে না, দাওয়াত দিয়ে লাভ কী!
দাওয়াতে বাবা গেলেন না, বাবার যাওয়া আমাদের কাম্যও ছিল না। একবার শুধু বলল, তুলতুল একা যাক আমার বদলে, ওর বন্ধু! আমার ভেতরটা কষ্টে ফেটে যেতে লাগল আরও, যখন মা বলল, তোকে অন্তত বলতে পারত! আমার মনে পড়তে লাগল এসএসসি দিয়ে জুঁই এসে এক মাস ছিল, আমি ছিলাম পনেরো দিন। সে সময় আমরা খুব ভালো বন্ধু অনুভব করেছিলাম। ওর বিয়ের দিন আমি সারাদিন কিছু খেলাম না, শুধু মনে হতে লাগল, ওর কি একবারও আমার কথা মনে হচ্ছে না? তুলার কথা! দেড় মাস এক বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমরা বিয়ের গল্পও করেছি কত, কে কেমন ছেলে পছন্দ করি। গ্রাম্য, বেশি কথা বলা লোক আমরা কেউ পছন্দ করি না। রাতে খুব কাঁদলাম; জুঁই, তোমাকে আমি খুব ভালোবাসি, তুমি চলে যাবে আজকে শ্বশুরবাড়ি, তোমাকে কেমন দেখাচ্ছে সাজানোর পর লাল শাড়িতে!
মনে হচ্ছিল খালুজান বেঁচে থাকলে কোনো দিন আমাকে ছাড়া জুঁইয়ের বিয়ে হতো না। খালুজান আমাকে খুব ভালোবাসতেন। লুডু খেলার সময় খালু আমাকে তাঁর জোড়া করতেন। খুব চুরি করে খেলতে ভালোবাসতেন এমন শিশুমন ছিল, আঙুলের ছোঁয়ায় কাঁচা গুটি পাকা। আমার মন এটা মানতে একেবারেই নারাজ যে তিন বছরের মেডিকেল পড়া একটা মেয়ের সার্কেল বড় হয়েছে, অনেক বন্ধু হয়েছে, সেখানে আমি অতি তুচ্ছ ও সাধারণ একটা খালাতো বোন; তাও মায়ের মামাতো বোনের মেয়ে!
বিয়ের সপ্তাহ খানেক পর জুঁই আসে বরের সাথে আমাদের বাসায়। না, মা তাদের দাওয়াত দেননি। দাওয়াত পাওয়া যদিও খুবই উচিত ছিল, আগের পরিস্থিতি থাকলে বাবা-মা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ত, পোলাও-মাংস হতো। ব্যাপারটা সেদিকে গড়াল না; চা-বিস্কুট সেমাইয়ে সীমাবদ্ধ রইল। আমি জুঁইয়ের সাথে কথা বললাম কিন্তু আগের জায়গায় আর ফেরা হলো না।
ওরা বছর কয়েকের মধ্যে সৌদি আরবে ডাক্তারি করতে চলে গেল। খবরাখবর পাই খালাম্মারা কলোনি ছেড়ে মোহাম্মদপুর নিজের বাসায় উঠেছে, আমার বিয়েতে ওদের সবাইকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল; এসেও ছিল খালাম্মাসহ সবাই।
বহু জল গড়াল পদ্মা-মেঘনায়, বয়স ষাট হলো, চুলে পাক ধরল। জুঁই রিটায়ার করে এসে ধানমন্ডিতে কয়েক কোটি টাকায় ফ্ল্যাট কিনে থিতু হতে না হতে ওর কোলন ক্যান্সার ধরা পড়ে। খবরটা শুনে ছোট বোনকে নিয়ে দেখতে গেলাম এক শীতের সকালে। তাও যেতে যেতে এগারোটা। আমরা যাব শুনে হেনা-বকুলও এলো, ওরা কাছাকাছিই থাকে। জুঁইয়ের একটা অপারেশন হয়েছে, কোমরে একটা থলে নিয়ে ঘোরে, ফোনেই জুঁই বলেছে। মনটা খারাপ, জানি না এখন কী পরিস্থিতি। ওর বাসায় ঢুকে সত্যি অবাক হলাম, এত বড় বাসা, দুইটা ড্রইং রুম। জুঁই খুব খুশি হলো এবং তা একটু প্রকাশও করল। আমরা কথা বলতে বলতে ওর কোনো বন্ধু ফোন করলে ও পুরো আধঘণ্টা ধরে ওর রোগের বর্ণনা দিতে লাগল। ওখান থেকেই আমি ওর রোগ বৃত্তান্ত জেনে গেলাম। আমি বলে উঠলাম, আসলে কতদিন পর আমাদের দেখা হলো! আগে এক বিছানায় রাতের পর রাত ঘুমিয়েছি, সস্তায় জিনিস কেনার জন্য মেলায় দু-তিনটা চক্কর দিয়েছি প্রতি বছর। হঠাৎ বকুল বলে ওঠে, আপার বিয়ের পর পুরো দৃশ্যটা পাল্টে গেল তুলা! আসলে বিয়েতে অল্প মানুষ ডাকা হয়েছিল তো, তাই তোমাদের বলা হয়নি! আমাদের এতক্ষণের গল্পটা হঠাৎ থেমে গেল। আমি কী যে বলব ভেবে না পেয়ে ফের ওর রোগের কথাই জানতে চাই- তোমাকে কি আবার বাইরে যেতে হবে চিকিৎসায় জুঁই?
একটা কাজের মহিলা বারবার কাছে আসছে, জুঁই কিছু বলছে ইশারায়, চলে যাচ্ছে। আরও কিছুক্ষণ ওর সন্তানদের পড়ালেখার খবর শুনলাম, সবাই ফুলব্রাইট স্কলার, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ে। এই সব বলার সময় ওর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আমি সন্তানদের কথা কী বলব, ওরা খুব সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে চাকরিবাকরি করছে। নিজেকে হাইলাইট করার তেমন কিছু খুঁজে পাওয়ার কোনো বস্তু কি অবস্তু নাই। ছোটবেলায় আজিমপুর মহররম মেলায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুরে বেড়ানো কী খালাম্মার অসাধারণ ইলিশপাতুড়ি লাউপাতায়- এই তো আমার গল্প! গল্প ঠিক জমে ওঠে না। জুঁই অনেক রকমের নাশতার আয়োজন করেছিল, সুন্দর টেবিলে তা পরিবেশন করল। অনেক ফল নিয়ে গিয়েছিলাম আমরাও। সে সবও দিল। চা-নাশতা খাওয়ার পর ও বাসাটা দেখায়, তিন হাজার স্কয়ার ফিটের বাসার আগা-মাথা পাই না। নতুন সব আসবাব, পরিপাটি, চোখ-মন ছুঁয়ে যায়।
জুঁইয়ের জন্য কষ্ট লাগে বাসায় ফিরতে ফিরতে, দেশে এসে থিতু হতে না হতে কর্কট রোগের কবলে!
মাস ছয়েক পর আবার জুঁইয়ের ফোন, আগের চেয়ে ভালো আছি, সময় পেলে এসো। মনে হলো, যাই দেখে আসি। ভাদ্রের বিকালে একাই গেলাম। অনেক গল্প করে জুঁই, গল্পে এবার সবচেয়ে বেশি ওর সন্তান, মেধাবী দুই ছেলের গল্প। বউ পেয়েছে, তারাও খুব মেধাবী। চারজনের গল্প। আমারও দুই ছেলে, বড়টা কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, জন্ম থেকে বধির। ছোটটা মাইক্রোবায়োলজিস্ট, বিদেশি কোম্পানিতে কাজ করে- এসব গল্প করতে ইচ্ছা করে না, আসলে ওর জানারও আগ্রহ দেখি না।
মুরালি আর চা দেয়। নরম মুরালি, মুখে দিয়ে গেলা যায় না। মুখ থেকে বের করে অনেকক্ষণ হাতে নিয়ে রাখি, এত ঝকঝকে বাড়িতে ফেলার ফুরসত না পেয়ে হাতব্যাগে টিসুতে মুড়িয়ে রাখি। এই কথা লেখার সময় আপনি পাঠক হয়তো ভাববেন, এটা আবার কী গল্প! এসব কি কেউ বলে! আসলে আমার ভয়াবহ ক্ষুধা লেগেছিল, ডায়াবেটিস রোগী হলে যা হয়! খিলক্ষেত থেকে আসতে অনেকটা সময় পথে পড়ে থাকতে হয়েছে।
সন্ধ্যার আগে বিদায় নিই; স্বস্তি, জুঁই আগের চেয়ে অনেক ভালো আছে, কোলন ক্যান্সার সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা হয়েছে বটে এই দুই দিনে সাক্ষাতে এবং ফোনে।
এসি ঘর ছেড়ে বাইরে আসায় গরম লাগে। ঘাম ঝরে দরদর করে, গাড়িটা ছেড়ে দেওয়া ঠিক হয় নাই। জুঁই জিজ্ঞাসা করেছিল- কীভাবে যাবে? বলেছি সিএনজিতে চলে যাব। আমার একটা গাড়ি আছে, সে খবর দিতে ইচ্ছা করেনি। আমার বধির ছেলেকে আমি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার বানিয়েছি, তাকে কথা শেখাতে, পড়াশোনা শেখাতে এক মহাকাব্যিক লড়াই ছিল আমার; সে দিনরাত অনেক বধির সংগঠনের জন্য কাজ করে চলেছে একটা দায়িত্বশীল পদে চাকরি করেও- সে কথাও বলতে ইচ্ছা করেনি। আমার ছোট ছেলে একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির পাঁচটা দেশের কান্ট্রি ম্যানেজার, সারাবছর দেশের বাইরে যাওয়া-আসা করতে হয়- সে কথাও বলতে ইচ্ছা করেনি। বলব কি, ও তো জানতেও চায়নি! তুলার ছেলেদের কি-ইবা খবর থাকতে পারে!
আমি হাঁটতে হাঁটতে একটা কফিশপে বসি। শরীর জুড়িয়ে আসে এসির ঠান্ডায়। ওয়েটার ছেলেটাকে একটা ঠান্ডা পানি দিতে বলি কফি দেওয়ার আগে। পানিটা ঝকঝকে গ্লাসে ঢালতে ঢালতে মনে আসে- আরে, জুঁইকে তো কেবল আমিই বন্ধু মনে করে এসেছি, আজও! ও মনে করছে একটা সাধারণ আত্মীয়, যাকে বিয়েতে দাওয়াত দেওয়ার প্রয়োজন হয় না; পরিবারের কারও খবর আগ্রহ নিয়ে শোনার কোনো প্রয়োজন পড়ে না!
অন্য প্রান্ত নিয়ে তো কোনো দিন ভাবিনি! উচিত ছিল ভাবা। আমি তো ক্ল্যাসিক মধ্যবিত্ত, জুঁই বহু বছর আগেই মধ্যবিত্তের গণ্ডি পেরিয়ে গিয়েছিল বাবার মৃত্যুতে, মামাদের সান্নিধ্যে ডাক্তারি পাঠের প্রাক্কালেই। উচ্চবিত্তের চেতনায় দায় থাকে না, হয়তো দায়িত্বও না। এই বোধের পর অবাক কাণ্ড, কফিটা খেতে খুব ভালো লাগে!
বাবা নাম রেখেছিল আমার তুলতুল, সময়ের তুলনায় নামটা অধিক সুন্দর। সেই উনিশশ তিপ্পান্ন সালের দম্পতির প্রথম সন্তান ছাপ্পান্নে জন্মে এই নাম! কিন্তু কী বলুন তো, সুন্দর সবাই সহ্য করবে! করবে না, করেনি। তারা আমার নামটাকে তুলায় পর্যবসিত করল। তুলা, ফুঃ উ উ উ! স্কুলে ভর্তি হলে আমার পাড়ার বান্ধবীই ক্লাসের সবাইকে জানাল, জান্নাতুল ফেরদৌসের আসল নাম তুলা। তুলা! ফুঃ উউউ। কয়দিন তো খুব মন খারাপ, কত খুশি হয়ে সবাইকে বলেছি আমার নাম তুলতুল। দু'একজন নাদুসনুদুস গালে হাত দিয়ে টিপে আদর করে পরখ পর্যন্ত করেছে কতটা তুলতুলে। তো পাড়ায় তুলা, স্কুলে তুলা। মা এই নিয়ে কোনো অভিযোগ শুনতে নারাজ- তুলা তো কী হয়েছে, ধুলাও তো আমার গ্রামের একজনের নাম! ভাগ্যিস ধুলা নয়, কিছুক্ষণের জন্য সান্ত্বনা আসে প্রাণে, আবার যেই সেই; নাম নিয়ে মন খারাপ। বাবা তুলতুল রাখল বটে, তুলতুল থেকে তুলাকে কিন্তু অনুমোদনহীন রাখল না। জীবন থেকে চিরতরে তুলতুল হারিয়ে গিয়ে এক পালকহীন বকপক্ষী হয়ে রইলাম। নামই যার প্রতিপক্ষ, তারে দিয়া কী হয় জগতে!
আজিমপুর থাকেন আমার এক খালা, বহু পরে জেনেছিলাম ইনি আমার আপন খালা নন; মায়ের ফুপাতো বোন। তাঁর মেয়েদের নাম কী মধুর! হেনা, বকুল আর জুঁই। তিনটে ভাই তাদের- কাজল, সজল আর রঞ্জন। বকুল আর জুঁই আমারই বয়সী, আসে বেড়াতে, তুলা তুলা করে, বিরক্তের তুলা উড়ে যায় না, তিতা তিতা লাগে, সত্যি। ওদের নামের মতো ওদের জীবনযাপন সুন্দর; বিদেশি খেলনা, আকাশে ওড়া প্রজাপতি, বাক্স ভরা ডল। সত্যি বলতে, ওরা বড়লোক নয়; মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত। ছোট কোয়ার্টারে থাকে, বাবা সচিবালয়ের কেরানি, কাটা ইলিশ কিনে আনে বাজার থেকে। আমার বাবার কাজের লোক গোটা ইলিশ কেনে। টাকা-পয়সা ধরলে আমার বাবারই একটু বেশি, অনেকটাই বেশি। অবশ্য পলাশি বাজারে প্রায় সবাই কাটা ইলিশই কিনতে বাধ্য ছিল স্বাধীনের আগে পরে দুই-তিন দশক।
তো থ্রিতে পড়ার সময় একদিন মা নিয়ে বেড়াতে গেল সেই খালার বাসায়, গিয়ে দেখি জুঁইয়ের এক বাক্স ডল, করাচি থেকে তার বড় মামা এনে দিয়েছেন। ওদের খেলনার জোগানদাতা মামারা, সেটা তো জানিই। তাঁদের আমি দেখেছি, করাচি থেকে এসে একজন আমাদের বাসায় এসেছিলেন দুটো আনারস নিয়ে। তিনি আমারও মামা, ইচ্ছা করলে আনারসের বদলে দু'খানা ডল আমার জন্য কি আমার চেয়ে তিন বছরের ছোট বোনটার জন্যও আনতে পারতেন, কত না খুশি হতাম! আমি বলি, জুঁই, তোমার বারোটা ডল, আমাকে একটা দেবে! সে সবসময় বলে আমি তার বেস্ট ফ্রেন্ড, আমাদের বাসায় বেড়াতে তাঁর খুবই ভালো লাগে, রাতে থাকতে আরও ভালো লাগে। সে সময় এইভাবে বেস্ট ফ্রেন্ড বলা সত্যি সুলভ ছিল না, কিন্তু ও বলত খুব আন্তরিকভাবে। তো সে আমার প্রস্তাব কী অনুরোধ শুনে একটু ভাবল। তারপর বলে, আচ্ছা একটা দিব, একটা তুমি নিও। তারপর আমি বললাম, একটা না দুটো দিও, ওরা দুই বোন আমার জুতার বাক্স ঘরে থাকবে, একা থাকলে তো মরেই যাবে! ও আবারও একটু ভেবে মাথা কাত করে সম্মতি জানাল। মন ভালো নিয়ে সারাদিন রইলাম, ওর মামারা কত ভালো তাই ভাবলাম। সত্যি ভালো, তাই তো তারা আমাদের বাসায় এলে বাবা কী রকম ব্যস্ত হয়ে পলাশি যায়, কেক কেনে, সেমাই কেনে। খুব সম্মানিত মেহমান এলে মা দুধ সেমাই করেন, ঘন দুধে ঘিয়ে ভাজা সেমাই ভাসে, ওপরে কিশমিশ। তখন আমাদের গরু ছিল, মবিন গরু পালত, বাজার করত আর পচা মাছ কিনে প্রায়ই চড় খেত বাবার। তো আজিমপুরের এই খালাম্মার তিন ভাই- একজন সিএসপি অফিসার, একজন ডাক্তার আর বড় জন করাচি থাকেন; পাঠান বউ। একবার অপরূপ বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে বেড়াতে এসেছিলেন, পোলাও-মাংস হয়েছিল। তিন ভাইয়ের একমাত্র বোন এই খালাম্মা, তাই আমার বাবা-মা দু'জনের কাছেই খুব সম্মানিত ও আপনজন। স্কুলে ভর্তি হতে হলে খালাম্মাকে নিতে হয়, মায়ের বাচ্চা হওয়ার সময় তিনি আসেন বাবার ভাত বেড়ে খাওয়াতে, আমাদের খাওয়ারও তদারকি করেন। আমি বুয়ার সঙ্গে ভয়াবহ কষ্ট করে রান্না করি, সেটা অবশ্য এইটে পড়তে উনসত্তরে। তো সারাদিন খেলি আর ভাবি কখন সন্ধ্যা হবে আর পুতুল হাতে নিয়ে বাসায় যাব, জুতার বাক্স নতুন করে সাজাব। প্রবল উত্তেজনা নিয়ে জুঁইয়ের পিছন পিছন ঘুরি আর ভাবি, সত্যি দিবে তো! বারোটা ডল দিয়ে ও কী করবে! নিশ্চয়ই দিবে।
সন্ধ্যায় চলে যাব, মায়ের চা খাওয়া-পান খাওয়া হয়ে গেছে। আমি জুঁইয়ের কাছে ছুটে যাই। সারাবাড়িতে জুঁই নাই। খুঁজে খুঁজে যখন আশা ছেড়ে দিলাম, কে যেন বলল, জুঁই তো বারান্দায়। সত্যি ভরা সন্ধ্যায় গিয়ে দেখি একটা গামছার উপর ও বসে আছে, ওর ফ্রকের নিচে কোলের উপর বাক্সটা, যেথায় ডলগুলো ঘুমাচ্ছে, পেটটা মোটা দেখাচ্ছে। ওর চোখ বোজা, দুই হাত দিয়ে জামার ঝুল চেপে ধরে আছে। আমি তো অবাক, এটা কোন জুঁই! আমি তবুও নাছোড়বান্দা। - জুঁই আমাকে ডল দুটো দাও! দুই-তিনবার বলার পর পাশ থেকে বকুল বলে উঠল- তুলা আজ আর কিছু নিতে পারবে না, ও ধ্যানে বসেছে, ধ্যানে বসলে কিছু শুনতে পায় না। সেদিন আমাদের সঙ্গে আমার বয়সী আমার একমাত্র খালা ছিল। গ্রাম থেকে বেড়াতে আসায় তার উপলক্ষেই এবার বেড়ানো। সে আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে- তুলা ও তোমারে পুতলা দিবে না, দেখ না ভং ধরছে! আমি খালাম্মার মুখের কাছ থেকে কান সরিয়ে নিই, আমার অত্যন্ত খারাপ লাগে, ভং শব্দটা আসলেই অশ্নীল। আরও কয়েক মিনিট অপেক্ষা করলেও জুঁইয়ের ধ্যান ভাঙার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না।
দেখতে দেখতে আমরা বড় হয়ে যেতে লাগলাম, বেশি বড় হলাম যুদ্ধের নয় মাসে। ফিরে এসে দেখি জুঁই লম্বা ঢেঙ্গা হয়েছে আরও, আগের মতোই কিছুটা ফ্যাকাশে দুধ-ফরসা মাংস-চর্বিহীন একহারা। আমি বরাবর শ্যামলা স্বাস্থ্যবতী। দশম শ্রেণি আমাদের, নবম অটো, সদাশয় সরকার দিয়েছে যুদ্ধের কারণে। জুঁই ভালো ছাত্রী, সায়েন্স গ্রুপ। আমার আর্টস, কোনো রকমের ছাত্রী আমি, একই স্কুল আজিমপুর। স্কুলে দেখা হয় ছুটির সময়। বাসায় মাঝে মাঝে ও আসে, আমিও যাই। কলেজ আমাদের আলাদা হয়ে গেল- আমি ইডেনে, ও চলে গেল বদরুন্নেসায়। কলেজ পাস করে ও ঢাকা মেডিকেলে পড়তে গেল, আমি ইডেনেই ডিগ্রি পড়ি। এ সময় জুঁইয়ের বিয়ে ঠিক হয়। তার আগের বছর খালুজান দীর্ঘমেয়াদি রোগভোগের পর মারা যান। জুঁইয়ের বিয়ের সময় ওরা শুধু বাবাকে দাওয়াত দিল, ছোট অনুষ্ঠান নাকি! এর আগে দুইটা মুসলমানি কী অন্য কোনোটায় সপরিবার ছাড়া কোনো দাওয়াতের ইতিহাস নাই। আমি জুঁইয়ের বেস্ট ফ্রেন্ড, আমি বাদ। মন বেজায় খারাপ হলো। খবর পেয়েছি এমনকি ধুমধামে হলুদ অনুষ্ঠানও হয়েছে। ছোট বোনের স্কুলবান্ধবী চ্যামনের বড় ভাই জুঁইয়ের ক্লাসমেট, তার সাথে বকুলের প্রেম। চ্যামনের মারফত খবরাখবর আনে ছোট বোন। খবরগুলো এমন ভাবে আসতে লাগল যে বাবাকে আমরা অপরাধী করতে লাগলাম। কেননা মোহাম্মদপুরে জুঁইদের বাড়ি নির্মাণে বাবা বহুদিন তদারকিতে ছিল বছর কয়েক আগে। আবার মায়ের পছন্দ জিগাতলায় ছোট একটা বাড়ি কেনার প্রক্রিয়ায় খালাম্মা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানালে বাবা কেনা থেকে বিরত হয় গভীর আস্থায়। মা খুব মন খারাপ করে থাকলেও খালাম্মার মতামত খুব গ্রহণীয় ছিল দু'জনেরই কাছে।
আরেকটা কথা বলা জরুরি, বাবার কিছু মানসিক অসুস্থতা হঠাৎ দেখা দেওয়ায় আমাদের জীবন তখন কিছুটা হুমকির সম্মুখীন। বাবার আয়-রোজগারও বেশ কমে গিয়ে পরিবার হিমশিম খাচ্ছে। মা একবার শুধু বলল, বোন বুঝি বুঝতে পেরেছে আর ভালো উপহার যাবে না, দাওয়াত দিয়ে লাভ কী!
দাওয়াতে বাবা গেলেন না, বাবার যাওয়া আমাদের কাম্যও ছিল না। একবার শুধু বলল, তুলতুল একা যাক আমার বদলে, ওর বন্ধু! আমার ভেতরটা কষ্টে ফেটে যেতে লাগল আরও, যখন মা বলল, তোকে অন্তত বলতে পারত! আমার মনে পড়তে লাগল এসএসসি দিয়ে জুঁই এসে এক মাস ছিল, আমি ছিলাম পনেরো দিন। সে সময় আমরা খুব ভালো বন্ধু অনুভব করেছিলাম। ওর বিয়ের দিন আমি সারাদিন কিছু খেলাম না, শুধু মনে হতে লাগল, ওর কি একবারও আমার কথা মনে হচ্ছে না? তুলার কথা! দেড় মাস এক বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমরা বিয়ের গল্পও করেছি কত, কে কেমন ছেলে পছন্দ করি। গ্রাম্য, বেশি কথা বলা লোক আমরা কেউ পছন্দ করি না। রাতে খুব কাঁদলাম; জুঁই, তোমাকে আমি খুব ভালোবাসি, তুমি চলে যাবে আজকে শ্বশুরবাড়ি, তোমাকে কেমন দেখাচ্ছে সাজানোর পর লাল শাড়িতে!
মনে হচ্ছিল খালুজান বেঁচে থাকলে কোনো দিন আমাকে ছাড়া জুঁইয়ের বিয়ে হতো না। খালুজান আমাকে খুব ভালোবাসতেন। লুডু খেলার সময় খালু আমাকে তাঁর জোড়া করতেন। খুব চুরি করে খেলতে ভালোবাসতেন এমন শিশুমন ছিল, আঙুলের ছোঁয়ায় কাঁচা গুটি পাকা। আমার মন এটা মানতে একেবারেই নারাজ যে তিন বছরের মেডিকেল পড়া একটা মেয়ের সার্কেল বড় হয়েছে, অনেক বন্ধু হয়েছে, সেখানে আমি অতি তুচ্ছ ও সাধারণ একটা খালাতো বোন; তাও মায়ের মামাতো বোনের মেয়ে!
বিয়ের সপ্তাহ খানেক পর জুঁই আসে বরের সাথে আমাদের বাসায়। না, মা তাদের দাওয়াত দেননি। দাওয়াত পাওয়া যদিও খুবই উচিত ছিল, আগের পরিস্থিতি থাকলে বাবা-মা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ত, পোলাও-মাংস হতো। ব্যাপারটা সেদিকে গড়াল না; চা-বিস্কুট সেমাইয়ে সীমাবদ্ধ রইল। আমি জুঁইয়ের সাথে কথা বললাম কিন্তু আগের জায়গায় আর ফেরা হলো না।
ওরা বছর কয়েকের মধ্যে সৌদি আরবে ডাক্তারি করতে চলে গেল। খবরাখবর পাই খালাম্মারা কলোনি ছেড়ে মোহাম্মদপুর নিজের বাসায় উঠেছে, আমার বিয়েতে ওদের সবাইকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল; এসেও ছিল খালাম্মাসহ সবাই।
বহু জল গড়াল পদ্মা-মেঘনায়, বয়স ষাট হলো, চুলে পাক ধরল। জুঁই রিটায়ার করে এসে ধানমন্ডিতে কয়েক কোটি টাকায় ফ্ল্যাট কিনে থিতু হতে না হতে ওর কোলন ক্যান্সার ধরা পড়ে। খবরটা শুনে ছোট বোনকে নিয়ে দেখতে গেলাম এক শীতের সকালে। তাও যেতে যেতে এগারোটা। আমরা যাব শুনে হেনা-বকুলও এলো, ওরা কাছাকাছিই থাকে। জুঁইয়ের একটা অপারেশন হয়েছে, কোমরে একটা থলে নিয়ে ঘোরে, ফোনেই জুঁই বলেছে। মনটা খারাপ, জানি না এখন কী পরিস্থিতি। ওর বাসায় ঢুকে সত্যি অবাক হলাম, এত বড় বাসা, দুইটা ড্রইং রুম। জুঁই খুব খুশি হলো এবং তা একটু প্রকাশও করল। আমরা কথা বলতে বলতে ওর কোনো বন্ধু ফোন করলে ও পুরো আধঘণ্টা ধরে ওর রোগের বর্ণনা দিতে লাগল। ওখান থেকেই আমি ওর রোগ বৃত্তান্ত জেনে গেলাম। আমি বলে উঠলাম, আসলে কতদিন পর আমাদের দেখা হলো! আগে এক বিছানায় রাতের পর রাত ঘুমিয়েছি, সস্তায় জিনিস কেনার জন্য মেলায় দু-তিনটা চক্কর দিয়েছি প্রতি বছর। হঠাৎ বকুল বলে ওঠে, আপার বিয়ের পর পুরো দৃশ্যটা পাল্টে গেল তুলা! আসলে বিয়েতে অল্প মানুষ ডাকা হয়েছিল তো, তাই তোমাদের বলা হয়নি! আমাদের এতক্ষণের গল্পটা হঠাৎ থেমে গেল। আমি কী যে বলব ভেবে না পেয়ে ফের ওর রোগের কথাই জানতে চাই- তোমাকে কি আবার বাইরে যেতে হবে চিকিৎসায় জুঁই?
একটা কাজের মহিলা বারবার কাছে আসছে, জুঁই কিছু বলছে ইশারায়, চলে যাচ্ছে। আরও কিছুক্ষণ ওর সন্তানদের পড়ালেখার খবর শুনলাম, সবাই ফুলব্রাইট স্কলার, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ে। এই সব বলার সময় ওর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আমি সন্তানদের কথা কী বলব, ওরা খুব সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে চাকরিবাকরি করছে। নিজেকে হাইলাইট করার তেমন কিছু খুঁজে পাওয়ার কোনো বস্তু কি অবস্তু নাই। ছোটবেলায় আজিমপুর মহররম মেলায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুরে বেড়ানো কী খালাম্মার অসাধারণ ইলিশপাতুড়ি লাউপাতায়- এই তো আমার গল্প! গল্প ঠিক জমে ওঠে না। জুঁই অনেক রকমের নাশতার আয়োজন করেছিল, সুন্দর টেবিলে তা পরিবেশন করল। অনেক ফল নিয়ে গিয়েছিলাম আমরাও। সে সবও দিল। চা-নাশতা খাওয়ার পর ও বাসাটা দেখায়, তিন হাজার স্কয়ার ফিটের বাসার আগা-মাথা পাই না। নতুন সব আসবাব, পরিপাটি, চোখ-মন ছুঁয়ে যায়।
জুঁইয়ের জন্য কষ্ট লাগে বাসায় ফিরতে ফিরতে, দেশে এসে থিতু হতে না হতে কর্কট রোগের কবলে!
মাস ছয়েক পর আবার জুঁইয়ের ফোন, আগের চেয়ে ভালো আছি, সময় পেলে এসো। মনে হলো, যাই দেখে আসি। ভাদ্রের বিকালে একাই গেলাম। অনেক গল্প করে জুঁই, গল্পে এবার সবচেয়ে বেশি ওর সন্তান, মেধাবী দুই ছেলের গল্প। বউ পেয়েছে, তারাও খুব মেধাবী। চারজনের গল্প। আমারও দুই ছেলে, বড়টা কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, জন্ম থেকে বধির। ছোটটা মাইক্রোবায়োলজিস্ট, বিদেশি কোম্পানিতে কাজ করে- এসব গল্প করতে ইচ্ছা করে না, আসলে ওর জানারও আগ্রহ দেখি না।
মুরালি আর চা দেয়। নরম মুরালি, মুখে দিয়ে গেলা যায় না। মুখ থেকে বের করে অনেকক্ষণ হাতে নিয়ে রাখি, এত ঝকঝকে বাড়িতে ফেলার ফুরসত না পেয়ে হাতব্যাগে টিসুতে মুড়িয়ে রাখি। এই কথা লেখার সময় আপনি পাঠক হয়তো ভাববেন, এটা আবার কী গল্প! এসব কি কেউ বলে! আসলে আমার ভয়াবহ ক্ষুধা লেগেছিল, ডায়াবেটিস রোগী হলে যা হয়! খিলক্ষেত থেকে আসতে অনেকটা সময় পথে পড়ে থাকতে হয়েছে।
সন্ধ্যার আগে বিদায় নিই; স্বস্তি, জুঁই আগের চেয়ে অনেক ভালো আছে, কোলন ক্যান্সার সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা হয়েছে বটে এই দুই দিনে সাক্ষাতে এবং ফোনে।
এসি ঘর ছেড়ে বাইরে আসায় গরম লাগে। ঘাম ঝরে দরদর করে, গাড়িটা ছেড়ে দেওয়া ঠিক হয় নাই। জুঁই জিজ্ঞাসা করেছিল- কীভাবে যাবে? বলেছি সিএনজিতে চলে যাব। আমার একটা গাড়ি আছে, সে খবর দিতে ইচ্ছা করেনি। আমার বধির ছেলেকে আমি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার বানিয়েছি, তাকে কথা শেখাতে, পড়াশোনা শেখাতে এক মহাকাব্যিক লড়াই ছিল আমার; সে দিনরাত অনেক বধির সংগঠনের জন্য কাজ করে চলেছে একটা দায়িত্বশীল পদে চাকরি করেও- সে কথাও বলতে ইচ্ছা করেনি। আমার ছোট ছেলে একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির পাঁচটা দেশের কান্ট্রি ম্যানেজার, সারাবছর দেশের বাইরে যাওয়া-আসা করতে হয়- সে কথাও বলতে ইচ্ছা করেনি। বলব কি, ও তো জানতেও চায়নি! তুলার ছেলেদের কি-ইবা খবর থাকতে পারে!
আমি হাঁটতে হাঁটতে একটা কফিশপে বসি। শরীর জুড়িয়ে আসে এসির ঠান্ডায়। ওয়েটার ছেলেটাকে একটা ঠান্ডা পানি দিতে বলি কফি দেওয়ার আগে। পানিটা ঝকঝকে গ্লাসে ঢালতে ঢালতে মনে আসে- আরে, জুঁইকে তো কেবল আমিই বন্ধু মনে করে এসেছি, আজও! ও মনে করছে একটা সাধারণ আত্মীয়, যাকে বিয়েতে দাওয়াত দেওয়ার প্রয়োজন হয় না; পরিবারের কারও খবর আগ্রহ নিয়ে শোনার কোনো প্রয়োজন পড়ে না!
অন্য প্রান্ত নিয়ে তো কোনো দিন ভাবিনি! উচিত ছিল ভাবা। আমি তো ক্ল্যাসিক মধ্যবিত্ত, জুঁই বহু বছর আগেই মধ্যবিত্তের গণ্ডি পেরিয়ে গিয়েছিল বাবার মৃত্যুতে, মামাদের সান্নিধ্যে ডাক্তারি পাঠের প্রাক্কালেই। উচ্চবিত্তের চেতনায় দায় থাকে না, হয়তো দায়িত্বও না। এই বোধের পর অবাক কাণ্ড, কফিটা খেতে খুব ভালো লাগে!
- বিষয় :
- প্রচ্ছদ
- নাসিমা আনিস