রওনক জাহান
বিরুদ্ধ স্রোতের যাত্রী
রওনক জাহান, ছবি ::কিছু আলো নীল
শাহেরীন আরাফাত
প্রকাশ: ২৩ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০২২ | ২৩:৫৩
বাবা বদলি হয়ে এলেন ভোলায়। তখন তিনি নবম শ্রেণির ছাত্রী। কিন্তু স্কুলে যাওয়া হলো না তাঁর। কারণ মেয়েদের স্কুল নেই সেখানে। প্রধান শিক্ষকের কক্ষে বসে পরীক্ষা দিতে পারলেন শুধু। এ রকম প্রতিকূল পরিবেশ ডিঙিয়ে এ দেশের প্রথম নারী তিনি, যিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন। রওনক জাহানের জীবনের নানাদিক নিয়ে লিখেছেন শাহেরীন আরাফাত
যখন দেশের আর দশটা পরিবারে মেয়েদের স্কুল-কলেজে যাওয়াটাও ছিল প্রশ্নসাপেক্ষ, তখন রওনক জাহান উচ্চশিক্ষার জন্য গেলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশ যখন পাকিস্তানি শোষণে আবদ্ধ, তখন তিনি গবেষণাকে অস্ত্র হিসেবে তুলে নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের দুই বছর আগেই দেখিয়েছিলেন, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাঙনের পথে যাচ্ছে ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা রাষ্ট্র পাকিস্তান। হার্ভার্ডের সেই গবেষণা বিশ্বের কাছে পরিচিত করেছিল এই তরুণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীকে। এর পরও তাঁর গবেষণা ও বিশ্নেষণ থেমে থাকেনি। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য গড়েছেন সংগঠন। যখন বাংলাদেশ তো বটেই, বিশ্বজুড়েই নারী সংগঠকের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা কয়েকজন, তখন রওনক জাহান বিভিন্ন দেশে ঘুরেছেন নারী অধিকারের বার্তা জানাতে। কাজ করেছেন জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে। ১৯৭৯ সালে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নারীদের অবস্থান তুলে ধরেন 'উইম্যান অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট :পার্সপেক্টিভস ফ্রম সাউথ অ্যান্ড সাউথ-ইস্ট এশিয়া' গ্রন্থে। সেখানে তাঁর সহ-সম্পাদক ছিলেন হানা পাপানেক।
সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না হলেও, রওনক জাহান কখনোই রাজনীতির বাইরে ছিলেন না। বরাবরই তিনি চলমান ঘটনাপ্রবাহের ধারায় তুলে ধরেছেন রাজনীতির বাস্তব চিত্র এবং দেশ কোন পথে যাচ্ছে, তার বিশ্নেষণ। রওনক জাহান বলেন, 'যে কোনো বিষয়ে গবেষণা করার ক্ষেত্রে ওই নির্দিষ্ট বিষয়ে যেসব প্রকাশনা আছে, যা পাওয়া যায়, তা আগে পড়ে নিই। কিছু তত্ত্বগত বিষয়ও পড়তে হয়। আমি তো রাজনীতির ইতিহাস লিখি না, ঘটমান রাজনীতির বিশ্নেষণ থাকে সেখানে। অনেক ঘটনা ঘটছে; কিন্তু সেগুলো কেন ঘটছে, এখানে কী কী বিষয় রয়েছে, এটিকে কীভাবে বিশ্নেষণ করা যায়- এসবই আমার গবেষণার মূল বিষয়। অর্থনীতিতে যেমন কিছু থিওরি বা তত্ত্ব আছে, রাজনীতিতেও কিছু তত্ত্ব আছে। এ তত্ত্বগুলো আমি পড়ে নিই। এসব পড়ার পর দেখা গেল একেকজন বিষয়টিকে একেকভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি একেক রকম ছিল। তখন আসবে- আমি বিষয়টিকে নতুন কোন আঙ্গিকে ব্যাখ্যা করব। যে কোনো গবেষণায় হয় নতুন কোনো তথ্য দিতে হবে অথবা নতুন আঙ্গিকে তাকে তুলে ধরতে হবে। আমি অবশ্যই তথ্যনির্ভর লিখি। আমার আগ্রহের জায়গা হলো- বিষয়টিকে নতুন আঙ্গিকে, নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে ধরা। সেভাবে প্রস্তুতি নিয়ে ফ্রেমওয়ার্কটা সাজিয়ে তারপর আমি লেখার দিকে যাই।'
১৯৮০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর 'বাংলাদেশ পলিটিকস :প্রবলেমস অ্যান্ড ইস্যুজ' গ্রন্থটি। তিন দশকে লেখা ১৬টি নিবন্ধে সাজানো ওই গ্রন্থে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবর্তনের গতি-প্রকৃতি তুলে ধরেছেন। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত 'দ্য ইলিউসিভ অ্যাজেন্ডা :মেইনস্ট্রিমিং উইম্যান ইন ডেভেলপমেন্ট' গ্রন্থে রওনক জাহান দেখিয়েছেন, বিশ্বব্যাংকসহ দাতাগোষ্ঠী যে উন্নয়নের তত্ত্ব হাজির করেছিল, তাতে নারীর অংশগ্রহণ সেভাবে হয়নি। তিনি তাঁর উন্নয়ন ভাবনায় নারীকে কেন্দ্রে নিয়ে এসেছেন। তবে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে তিনি দূরে ছিলেন না, যার প্রমাণ মেলে ২০০০ সালে প্রকাশিত 'বাংলাদেশ :প্রমিস অ্যান্ড পারফরম্যান্স' গ্রন্থে। সেখানে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের প্রভাব বৃদ্ধিকে চিহ্নিত করেন। আরও দেখিয়েছেন, গার্মেন্টস শিল্পে নারীর বিপুল অংশগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ব্যাপকহারে কমে আসে।
২০০৩ সালে দুই সহলেখক কেলকার গোবিন্দ ও দেব নাথনের সঙ্গে মিলে রওনক জাহান বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণের ওপর একটি গবেষণা করেন। 'উই ওয়্যার ইন ফায়ার, নাউ উই আর ইন ওয়াটার :মাইক্রোক্রেডিট অ্যান্ড জেন্ডার রিলেশনস ইন রুরাল বাংলাদেশ' শীর্ষক ওই গবেষণায় ক্ষুদ্রঋণের ফলে সমাজ ও পরিবারে নারীদের পরিবর্তিত বাস্তবতা তুলে ধরেন তাঁরা।
২০১৫ সালে প্রকাশিত হয় 'পলিটিক্যাল পার্টিজ ইন বাংলাদেশ :চ্যালেঞ্জেস অব ডেমোক্র্যাটাইজেশন'। ওই গ্রন্থে তিনি উপস্থাপন করেন, ১৯৯১ সালে নির্বাচনী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর গণতান্ত্রিক চর্চা চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে যে সীমাবদ্ধতা ছিল, এর ফলে অগণতান্ত্রিক উপাদান রাজনীতিতে প্রকট হয়েছে। এটি আরও জটিল আকার ধারণ করতে পারে বলেও ওই গ্রন্থে তিনি লিখেছেন। গবেষণা ও জীবনের প্রতিটি কাজের মধ্য দিয়ে এ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রমাণ করেছেন, তিনি স্রোতের বিপরীতের অসামান্য দ্রোহী যাত্রী।
বাবাই বড় শিক্ষক
পরিবারের সমর্থনই রওনক জাহানকে উচ্চশিক্ষা নিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। তিনি বলেন, 'আমার বাবার নাম আহমদ উল্লাহ। তিনি একজন ব্যতিক্রমী মানুষ ছিলেন। সরকারি চাকরি করতেন। তিনি ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। ছেলেমেয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য করতেন না। ভাবতেন, তাঁর মেয়েরাও সমানভাবে লেখাপড়া করবে। আমার মায়ের নাম রাজিয়া বেগম। এ ক্ষেত্রে আমার বাবার সঙ্গে মায়েরও অনেক সাপোর্ট ছিল।' তাঁরা ছয় ভাই-বোন। ছয়জনই স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা করেছেন। এ সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, 'আমরা সবাই পড়াশোনায় ভালো ছিলাম। ভাই-বোনরা একজন আরেকজনকে সাপোর্ট করতাম। আমার বড় বোন রওশন জাহান ইংরেজিতে পড়াশোনা করেছেন। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে গিয়েছিলেন। তারপর আমি। এরপর আমার ভাই ড. কবির। তিনি ইঞ্জিনিয়ার। বার্কলে থেকে পিএইচডি করে সেখানে দীর্ঘসময় চাকরি করেছেন। এখন অবসর নিয়ে ঢাকায় আছেন। তার পরের ভাই ড. করিম। তিনি উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আমার ছোট বোন নীলুফার। তিনি ওয়ার্ল্ড ব্যাংকে কাজ করতেন; এখন ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এমসিসি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। সবার ছোট ভাই মুনির। তিনি দুবাইয়ে ব্যাংকার ছিলেন। এখন অবসর নিয়ে ঢাকায় চলে এসেছেন।'
ছোটবেলা থেকেই ছিল তাঁর লেখাপড়ায় ক্যারিয়ার গড়ার প্রত্যয়। রওনক জাহান বলেন, '১৯৫০-এর দশকে আমরা যখন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছি, তখন খুব কম মেয়েই লেখাপড়া করত। আমার নিজেরও প্রবল ইচ্ছা ছিল কিছু একটা করার। আমি জানতাম- যদি আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই, তাহলে লেখাপড়ার কোনো বিকল্প নেই এবং লেখাপড়ায় আমাকে খুব ভালো হতে হবে। তা না হলে আমি নিজের পরিচয়ে দাঁড়াতে পারব না। স্কুলে আমি সবসময় প্রথম হতাম। সব ক্লাসেই আমার রেজাল্ট খুব ভালো ছিল। কারণ পরিবারের সে রকম টাকা-পয়সা নেই। স্কলারশিপ নিয়েই আমি উচ্চশিক্ষা লাভ করেছি।'
বাবার বদলি সূত্রে অনেক স্কুলে পড়েছেন রওনক জাহান। কুমিল্লায় ফয়জুন্নেসা স্কুলে তাঁর পড়াশোনার শুরু। এরপর বাগেরহাটে পড়েছেন চার বছর। মেয়েদের স্কুল না থাকায় নবম শ্রেণিতে ক্লাস করতে পারেননি স্কুলে। তিনি বলেন, 'বাবা বদলি হলেন ভোলায়। আমি তখন নবম শ্রেণিতে পড়ি। কিন্তু সেখানে মেয়েদের কোনো স্কুল ছিল না। বাবা যেহেতু সরকারি কর্মচারী ছিলেন, সরকারি কর্মচারীর সন্তান হিসেবে আমাকে সরকারি ছেলেদের স্কুলে ভর্তি করা হয়। তবে সেখানে ক্লাস করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। শুধু পরীক্ষার সময় এসে পরীক্ষা দিয়ে যেতাম হেডমাস্টারের ঘরে বসে। তারপর আমার বাবা বদলি হন মুন্সীগঞ্জে। এরপর নারায়ণগঞ্জে। মুন্সীগঞ্জে স্কুলের স্যাররা জানতেন আমি পড়াশোনায় ভালো। তাই তাঁরা বাবাকে অনুরোধ করলেন, আমি যেন ওই স্কুল থেকেই ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিই। নারায়ণগঞ্জে স্কুলে ভর্তি হইনি। আমার স্কুলজীবনে আমি বিভিন্ন স্কুলে পড়েছি। কিন্তু আমার সবচেয়ে বড় শিক্ষক ছিলেন বাবা। তিনিই আমার লেখাপড়ার মূল তদারকি করতেন। ম্যাট্রিকে রেজাল্ট খুব ভালো হয়েছিল। আমি মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়েছিলাম। সম্মিলিত মেধায় সপ্তম হয়েছিলাম। ইন্টারমিডিয়েটে ইডেন কলেজে ভর্তি হই। সেখানেও ভালো রেজাল্ট করি। সবার মধ্যে তৃতীয় হয়েছিলাম। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলাম। এরপর সরকারি স্কলারশিপে হার্ভার্ডে পড়তে যাই। আমিই ছিলাম হার্ভার্ড থেকে এ দেশের প্রথম মেয়ে যে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করে। আমার পরিবারের সাপোর্ট ও আমার ইচ্ছা থাকায় আমি উচ্চশিক্ষা লাভ করতে পারলাম।'
তিনি বলেন, 'অনেক মেয়ের ক্ষেত্রে যেটা হয়, পরিবারের ভেতর থেকে তাঁরা সহযোগিতা পান না, বাধাপ্রাপ্ত হন। সে ক্ষেত্রে আমি বলব, আমার ভাগ্য ভালো যে আমি পরিবার থেকে সবরকম সহযোগিতা পেয়েছি। যদি ছোটবেলায় আমার বাবা মেয়েকে পড়াশোনা করানোর কথা না ভাবতেন, তাহলে আমি আজকের অবস্থানে আসার কথা চিন্তাও করতে পারতাম না। এমনকি আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয়রাও অনেক সাপোর্টিভ ছিলেন। যদিও আমার জীবন অনেক ব্যতিক্রমী ছিল। আমি দীর্ঘসময় বিয়ে করিনি, বিভিন্ন দেশে যাচ্ছি, ক্যারিয়ার গড়ছি- এ নিয়ে কিন্তু আমার পরিবারের সবাই গর্বিত ছিল। কেউ এসব নিয়ে কিছু বলেনি। মেয়েদের জন্য পরিবারের সহযোগিতা-সহমর্মিতা পাওয়াটা অতি জরুরি। যেসব মেয়ে পরিবার থেকে সাপোর্ট পাচ্ছেন না, তাঁদের জন্য তো ঘরে-বাইরে দু'দিকেই যুদ্ধ করতে হয় নিজের পরিচয়ের জন্য। এখন আমি যে পরিবারে আছি, এখানেও সবাই খুব সহযোগিতাপ্রবণ। অধ্যাপক রেহমান সোবহান নিজেও আমাকে কাজ করার ক্ষেত্রে প্রচুর সাপোর্ট দেন। এ ক্ষেত্রে আমি ভাগ্যবান।'
পাকিস্তান যেভাবে ভাঙল
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দুই বছর আগে, ১৯৬৯ সালেই তাঁর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের থিসিসে লিখেছেন- ভাঙনের দ্বারপ্রান্তে পাকিস্তান। পরবর্তী সময়ে ১৯৭২ সালে তাঁর থিসিসটি গ্রন্থ আকারে 'পাকিস্তান :ফেইলিউর ইন ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশন' নামে প্রকাশিত হয় কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে। গবেষণাটি পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা এবং বাংলাদেশের জন্মের প্রথম সুনির্দিষ্ট বিশ্নেষণ হিসেবে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। পাণ্ডিত্যপূর্ণ ব্যাখ্যা উপস্থাপন করে রওনক জাহান দেখান, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর নীতি, বিশেষ করে ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত আইয়ুব শাসনের নীতি এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক বৈষম্যের বিপরীতে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকশিত হচ্ছিল; যা অবধারিত ভাঙনের পথে এগিয়ে চলে।
অর্থনীতি ও রাজনীতি কীভাবে একে-অপরকে প্রভাবিত করে, কীভাবে একে-অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, তা নিয়ে মূলত গবেষণা করেছেন রওনক জাহান। তাঁর মতে, ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৮ সাল- এই তিন বছরেই দেশের মানুষের চিন্তায় কিছু মৌলিক পরিবর্তন এসেছিল। জনগণ স্বাধীনতার কথা বলছিল। এতে সে সময়ের তরুণ বাঙালি গবেষক রওনক জাহানও ভীষণ অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তবে তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাঁকে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অর্থনৈতিক বৈষম্য নিয়ে কিছু গবেষণা হলেও রাজনৈতিক বৈষম্য নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা হয়নি।
রওনক জাহানের গবেষণায় জানা যায়, পূর্ব পাকিস্তান শুরু থেকেই বিভক্ত ছিল, শুধু পৃথক ভূখণ্ড মূল বিষয় ছিল না। এটি প্রমাণ করার জন্য, তিনি অবিশ্বাস্য যত্নের সঙ্গে পাকিস্তানের ইতিহাসের প্রতিটি ঘটনা পরম্পরা ধাপে ধাপে বিশ্নেষণ করে বস্তুনিষ্ঠভাবে উপস্থাপন করেন এবং প্রতিটি ঘটনার জন্য যৌক্তিক যুক্তি আঁকেন। রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে যে বৈষম্য বিদ্যমান ছিল, তিনি গভীর অধ্যয়নের সঙ্গে তা উপস্থাপন করেছেন। এসব বিষয়ের ভিত্তিমূলে আঘাত করেছিল তাঁর গবেষণা।
এই বইটিতে ঐতিহাসিক সত্যের সমসাময়িক অধ্যয়ন রয়েছে। গবেষণাটি ভাষার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্য এবং পশ্চিম পাকিস্তানের এক বিভক্ত বাস্তবতা আমাদের সামনে তুলে ধরে- এ দুই অংশের মধ্যে সামান্যই মিল ছিল এবং কীভাবে নবজাত দেশ পাকিস্তানের মুসলিম লীগ নেতারা ওই দশকটি (১৯৫৮-১৯৬৮) অতিবাহিত করেছিলেন, যেখানে ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত এক দেশকে একত্র করার চেষ্টা করেছেন তাঁরা। রওনক জাহান পর্যবেক্ষণ করেছেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা একটি ভারতীয় মুসলিম সমাজ ও সংস্কৃতির অস্তিত্বকে সামনে এনেছিল এবং আঞ্চলিক বৈচিত্র্যকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করেছিল।
রওনক জাহান যুক্তি দিয়েছেন, পাকিস্তান সরকার, তথা সেনাশাসক আইয়ুব খান রাষ্ট্র গঠনের যে নীতি গ্রহণ করেছিলেন, তা পাকিস্তানের ভাঙনকে ত্বরান্বিত করে। তিনি দেখিয়েছেন, আইয়ুব খান তখন দেশ গঠনকে গুরুত্ব না দিয়ে রাষ্ট্র গঠনকে প্রাধান্যে এনেছিলেন। যে কারণে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। আমলাতন্ত্র ও সেনাবাহিনীকে ক্ষমতার কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। অপরদিকে, দেশ গঠনের মূল উপাদান- গণতন্ত্র, রাজনৈতিক অংশগ্রহণকে শক্তিশালী করতে জোর দেওয়া হয়নি। এতে বৈষম্য বেড়েছে। রওনক জাহান দেখান, কীভাবে দেশ গঠনের বিষয়ে তাদের বিরোধপূর্ণ দর্শন এবং নেতৃত্বের অস্থির পরিবর্তন কেবল দেশটির অনিবার্য বিপর্যয়কেই ত্বরান্বিত করেছিল।
'কঠোর পরিশ্রমের বিকল্প নেই'
হার্ভার্ডে কাটানো চার বছর রওনক জাহানের চিন্তা-চেতনাকে পূর্ণ করে তোলে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'যে চার বছর আমি হার্ভার্ডে পড়েছি, সেটাই ছিল আমার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। সেখানে পড়তে গিয়েই আমি আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠতে পারলাম। প্রথমত, সেখানে যাওয়ার পর অনেক নতুন কোর্স, অনেক নতুন কিছু শেখার সুযোগ আমার হলো। দ্বিতীয়ত, ওই জায়গাটা খুবই চ্যালেঞ্জিং ছিল, খুবই প্রতিযোগিতামূলক ছিল। যেহেতু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম যে, আমি সেখান থেকে পিএইচডি করবই; অতএব হার্ভার্ডের চ্যালেঞ্জটা আমার জন্য খুব ভালো কাজ করেছে। তখন নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যদিও আমি ভালো ছাত্রী ছিলাম; কিন্তু তখন লেকচারের পর এ নিয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে আলোচনা করার কোনো সুযোগ ছিল না। অংশগ্রহণমূলক শিক্ষা কার্যক্রম ছিল না। আমরা লিখছি, পড়ছি; কিন্তু সবার সামনে বসে কথা বলাও যে জরুরি, সেটার গুরুত্ব আমি হার্ভার্ডে গিয়ে বুঝতে শিখেছি। তারপর টিমওয়ার্ক- সবার সঙ্গে বসে আলোচনা-বিতর্ক করে হয়তো একটা পেপার লিখছি, সে সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনটা করার সুযোগ হয়নি। হার্ভার্ডে যাওয়ার পর আমি সবার সঙ্গে মিলে কাজ করা বা সবার সামনে নিজের মত উপস্থাপন করতে শিখলাম। কীভাবে অ্যানালিসিস বা বিশ্নেষণ করতে হয়, তা শিখলাম। আজকের আমি যা করেছি, তা হার্ভার্ডের ওই চার বছরে আমি যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলাম, তার কারণেই সম্ভব হয়েছে।'
দেশের প্রথম নারীবাদী সংগঠন 'উইম্যান ফর উইম্যান' গঠন করেন রওনক জাহান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ''ছোটবেলা থেকেই আমি নিশ্চয়ই মনে মনে নারীবাদী ছিলাম। মেয়ে হয়ে জন্ম নিলেও, অন্য মেয়েদের মতো আমার জীবন হবে- এমনটা আমি কখনও চিন্তা করিনি। ১৯৭১ সালের পর বিষয়গুলো অনেক বদলে যায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশের নারীর ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালানো হয়, তাঁরা সহিংসতার শিকার হন। অথচ পরিবার ওই নারীদের পাশে না দাঁড়িয়ে, তাঁদের পরিত্যাগ করে। ১৯৭২ সাল। আমি তখন যুক্তরাষ্ট্রে, হার্ভার্ডে পড়াচ্ছিলাম ও গবেষণা করছিলাম। নারীদের জন্য একটা প্রকাশনা বের করার জন্য দেশে ফিরে আমিও খুঁজতে শুরু করলাম সমমনাদের। আমার বাসাতেই সংগঠনের কাজ শুরু করি। বছর দু'এক এভাবেই কাজ করলাম। এভাবেই শুরু হয় 'উইম্যান ফর উইম্যান'। ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত হয় আমার 'উইম্যান ফর উইম্যান' গ্রন্থটি। বই প্রকাশের সময় ফোর্ড ফাউন্ডেশন আর্থিক সহায়তা করে। তখন উইম্যান ফর উইম্যান এনজিও হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।'' রওনক জাহান আরও বলেন, 'আমি ১৯৭৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক নারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। এ সময়ে আমি বিভিন্ন দেশে কাজ করেছি। যেখানেই গিয়েছি, সেখানে আমার ভালো নারী বন্ধু বা সহকর্মী ছিল। কারণ আমরা সবাই একই পথের যাত্রী ছিলাম।'
এখন রওনক জাহানের ব্যস্ত সময় কাটছে বইয়ের কাজে। বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরের ওপর একটি সম্পাদনার কাজ করছেন, যা প্রকাশিত হবে লন্ডনের রুটলেজ থেকে। এরপর লিখবেন তাঁর স্মৃতিকথা। লেখা শেষ করে গায়ে জোর থাকলে অন্য কোনো কাজে হাত দেবেন বলে জানান এ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। জীবন ভাবনা সম্পর্কে তিনি বলেন, 'আমি কখনও জীবনে সহজ চলার পথ বেছে নিইনি। এখনও আমার হাতে অনেক কাজ পড়ে আছে। এখনও আমি প্রতিদিন বহু ঘণ্টা কাজ করি। কঠোর পরিশ্রমের কোনো বিকুংুল্প নেই।'