ঢাকা বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

প্রচ্ছদ

আনাড়ি বইচোরের জবানবন্দি

আনাড়ি বইচোরের জবানবন্দি

মজনু শাহ

প্রকাশ: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০

আজকের কাগজে কাজের সূত্রে শামীম রেজার সঙ্গে অনেক লেখকের বাসায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। কখনও বিশেষ কোনো সংখ্যার জন্য নতুন লেখা নিয়ে আসা, পুরোনো লেখার বিল পৌঁছে দেওয়া বা সাক্ষাৎকার, এসবই ছিল উপলক্ষ। অধিকাংশ তরুণ লেখক এমনিতেই আড্ডা দিতে আসতেন পত্রিকা অফিসে। সে একটা হইহই রইরই ব্যাপার। যেন চাকরি না, এখন পেছনে তাকালে মনে হয়, ছুটির মেজাজে কিছু প্রিয়জনের সঙ্গে প্রতিদিন দেখাসাক্ষাৎ, চা-সিগারেট-সাহিত্য-আড্ডা, ফাঁকে ফাঁকে অফিসের কিছু কাজ। বেতন অতি সামান্য। তা নিয়ে সবারই উষ্ফ্মা ছিল বটে, কিন্তু হয়ে যেত, আমরা যারা কেবলই ঢুকেছি কাজে, অবিবাহিত, একভাবে চালিয়ে নেওয়া যেত ঢাকা শহরে, তখনও সবকিছু এতটা দুর্মূল্য হয়ে যায়নি। পত্রিকায় কাজ করার সবচেয়ে বড় সুযোগগুলোর একটা হচ্ছে, সারাক্ষণ পড়ার মধ্যেই ইচ্ছে করলে কাটানো যায়।
সম্ভবত ঈদসংখ্যার একটা লেখা চাইবার জন্য শামীমের সঙ্গে প্রথম শামসুর রাহমানের বাসায় গিয়েছিলাম। তিনি সেই সময় কিছুটা অসুস্থও ছিলেন, তাঁকে দেখতে যাওয়াও একটা অন্যতম উদ্দেশ্য। তাঁর বাসায় পৌঁছে, প্রথমে একটু থতমত অবস্থা হলো। গেট দিয়ে ঢুকতেই দেখা গেল কয়েকজন পুলিশের একটা ছোট্ট চেকিং রুম। সেখানে নাম লিখতে হলো, কেন এসেছি আমরা, ইত্যাদি। মনে পড়ল হুজির সেই হামলার পর থেকে এই ব্যবস্থা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, হুজির সদস্যরা এ বাড়িতে এসেছিল ছাত্রলীগের পরিচয় দিয়ে, কবির কোনো একটা লেখা নিতেই।
পুলিশ-পর্ব শেষ করে সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই ওপর থেকে একটা কুকুর তেড়ে এলো। পুলিশ এবং কুকুরের এই ঝঞ্ঝাট বিব্রতকর লাগছিল। তড়িঘড়ি তাঁর পুত্রবধূ এসে বলতে থাকলেন-
ভয় নাই ভয় নাই, কিছু করবে না।
তারপর তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন কবির বসার ঘরে। এটি মূলত লাইব্রেরি আর বেডরুমের একটা মিশেল। আমার জন্য একটা বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। দেখলাম তাঁর টেবিলে, আমার লীলাচূর্ণ বইটা, আধপড়া অবস্থায় পেজ মার্কার দিয়ে রাখা। রাহমান ভাই একটু পরে এসে বসলেন। হাসিমুখে এটা-ওটা জিজ্ঞেস করলেন। বার্ধ্যকের ছাপ খুব স্পষ্ট, তবু সুন্দর লাগছিল তাঁকে দেখতে। শামীমের সঙ্গেই তাঁর অন্তরঙ্গতা বেশি, পুরোনো পরিচয় তাঁদের। আমি এক ফাঁকে জানতে চাইলাম, বইটা এখানে কী করে এলো। তিনি জানালেন আবু হাসান শাহরিয়ার তাঁকে পড়তে দিয়েছেন।
তাঁরা দু'জন গল্পে মত্ত, আমি ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম তাঁর ব্যবহূত জিনিসপত্র, বই। একজন কবি কী কী পড়েন, তাঁর লেখার মতোই, সেটাও বিশেষ একটা কৌতূহলের ব্যাপার। বইগুলোর ওপর চোখ বোলাতে বোলাতে রোমাঞ্চ অনুভব করছিলাম। বুকশেল্কম্ফ এমনভাবে রাখা, অনেকখানি আড়াল অবধি যাওয়া যায়, দেয়াল আর পেছনের সারির বইগুলো দেখতে দেখতে পুরোনো প্রবৃত্তি মনে চাগাড় দিয়ে উঠল। অন্তত একটা বইও যদি না চুরি করা যায়, তাহলে দিনটাই মাটি, এই এক চিন্তায় কোন বই নেব, ভাবছিলাম। এ বই বলে আমাকে নে, ও বলে আমাকে! শেষে অরি মিশোর কবিতার একটা অনুবাদের বই যা-হয়-হবে-ভঙ্গিতে কোমরে গুঁজলাম। আর আফসোস হচ্ছিল খুব, কেন যে আজ ব্যাগ নিয়ে আসিনি, কেন যে আজকেই বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় ব্যাগটা ছাড়া পড়ল, এত ভালো ভালো বই ...
বইটা হাপিস করার পর একটু অস্বস্তিও লাগছিল। তিনি কি বুঝতে পারলেন এই অস্বস্তি! নিজেকে একটা যুক্তি দিচ্ছিলাম মনে মনে, তিনি তো গ্লুকোমায় কাহিল হয়ে চোখে দেখছেন না ঠিকমতো, পড়ার সেই শক্তি আর ইচ্ছে এই বয়সে আর আছে কি তাঁর! যুক্তি হিসেবে যে এটা খুব খোঁড়া টাইপের, সেটাও মনে হচ্ছিল। একজনের সংগ্রহে যত বই থাকে, তারা কেবল বই তো নয়, স্মৃতি, অভিজ্ঞতা আর প্রজ্ঞার ছায়ায় মাখামাখি হয়ে এ কেবলই নিজের জিনিস। তাকে চুরি করা মানে বিশ্বাসভঙ্গ শুধু না, একটা বই আরও যা কিছু দিতে পারে পরবর্তী পাঠের সময়, সেই সম্ভাবনাকেও নষ্ট করা।
চোরের মন পুলিশ পুলিশ। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময়, আবার সেই কুকুরটা আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে ছুটে এলো। এ বাড়ির আর কেউ না হোক, মনে হয় কুকুরটা বুঝতে পাচ্ছিল, তার চোখের সামনে দিয়ে একটা কিছু চুরি হয়ে যাচ্ছে গৃহকর্তার! শামীমের চেয়ে, কুকুরটা আমার দিকেই তেড়ে আসছিল বেশি, তা থেকে আমার সন্দেহ হচ্ছিল, কুকুরটার ঠিক ঠিক আন্দাজ। একটু পরে, আবার সেই পুলিশ চেকিং। এবার আরেক দফা চেক করলে কেলেঙ্কারিটা তখনই ধরা পড়ে যেত।


বই চুরি কেন করে একজন পাঠক? এটা কি শুধুই একটা বাজে অভ্যেস? এই দুর্দমনীয় লোভ, একজন বইচোরকে কী দেয়? যে পড়তে চায়, তার তো চুরি করে আনা বইয়ে চলবে না। তাহলে?
অনেক বই আমরা স্বেচ্ছায়, ফেরত পাওয়া যাবে না, আবার সংগ্রহ করে নিতে হবে, এটা ধরে নিয়েই ধার দেই কাউকে। আবার এই ধার দিতে দিতেই বই হারিয়ে যায়। কোনো পাঠক, একেবারে টার্গেট করে কোথাও থেকে সরিয়ে নেয় তার দরকারি বই। সেটা বইয়ের দোকান, লাইব্রেরি বা ব্যক্তিগত কোনো সংগ্রহ- সমস্ত জায়গা থেকেই হয়। এই অভিজ্ঞতা ভালোমন্দ পাঠকমাত্রেরই কমবেশি আছে। বই চুরিকে একটুখানি ছাড় দিয়ে মহৎ ভাবার একটা চেষ্টা আছে সমাজে, এর পেছনে অবশ্য ভালো কোনো যুক্তি দাঁড় করা কঠিন। চুরি, চুরিই।

কিছু বই, পত্রিকা, আমি সরিয়ে ছিলাম বন্ধুদের বাড়ি থেকে। সেসবের জন্য অনুশোচনা নিশ্চয় হয়। টাকাপয়সা না থাকাটা যে স্বভাব নষ্টের গোড়ার কারণ, অন্যের বই নিজের করে তুলতে গিয়েই বুঝেছিলাম জীবনে প্রথম। একটা সময় পরে, যখন সামান্য একটু সামর্থ্য হয়েছে, এসবের আর প্রয়োজন হয়নি। সাধ্য অনুযায়ী প্রচুর বই কিনেছি। দেশ থেকে চলে আসার আগে আমার সংগ্রহের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কাছের পড়ুয়াদের দিয়ে এসেছি। হারিয়েও ফেলেছি অনেক বই। কোনো কোনো হারিয়ে যাওয়া বইয়ের জন্য একটু অন্যরকম ভালোবাসাও যে দূর থেকে অনুভব করি, তাতে বুঝি যে, বই জড় পদার্থ ধরনের কিছু নয়, ওটা জ্যান্ত জিনিস।
অরি মিশোর বইটা এনে পড়েছিলাম কয়েকবার। খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিল। কাকে যেন পড়তে দিয়েছিলাম তারপর। যাকে দিয়েছি, তার কাছ থেকে ওটা চলে গিয়েছে আরেক হাতে। জগতে চোর থাকবে, তার ওপর বাটপাড়ও যে থাকবে, বইটা আমাকে তেমন ইশারাই করেছিল।

আরও পড়ুন

×