কেমন হবে ডিজিটাল ব্যাংক

ওবায়দুল্লাহ রনি
প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২৩ | ১৮:০০
সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রচলিত বেশির ভাগ ব্যাংক এখন ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে জোর দিয়েছে। শাখা বা ব্যবসাকেন্দ্রে না এসে গ্রাহকসেবা দিতে অ্যাপসহ প্রযুক্তিনির্ভর নানা সেবা দিচ্ছে তারা। এখন নতুন করে শুধু ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সুযোগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মাত্র ১২৫ কোটি টাকা মূলধন নিয়ে এ ধরনের একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা যাবে। প্রচলিত ধারার একটি ব্যাংক করতে যেখানে লাগে অন্তত ৫০০ কোটি টাকা। ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় আগ্রহীরা বিভিন্ন তথ্যসহ আগামী ৩১ আগস্টের মধ্যে আবেদন করতে পারবেন। প্রাথমিক বাছাই প্রক্রিয়া শেষে কয়েক ধাপ পেরিয়ে লাইসেন্স ইস্যু করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। লাইসেন্সের জন্য অনেকের আগ্রহের কথা শোনা গেলেও এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কেউ আবেদন করেননি। এরই মধ্যে ডিজিটাল ব্যাংক নিয়ে আলোচনা চলছে। কীভাবে চলবে ডিজিটাল ব্যাংক? শাখা না থাকলে আমানত সংগ্রহ, ঋণ বিতরণ কিংবা অন্য সেবা কীভাবে পাওয়া যাবে? এসব নিয়ে আগ্রহ রয়েছে মানুষের।
ডিজিটাল ব্যাংকের ঋণ আবেদনের জন্যও শাখায় যাওয়ার দরকার হবে না। ঋণ আবেদন থেকে শুরু করে সব তথ্যই দিতে হবে ভার্চুয়ালি। তবে গ্রাহকের কাছ থেকে এমন কোনো ব্যক্তিগত তথ্য চাওয়া যাবে না, যা তাঁর গোপনীয়তা লঙ্ঘন করতে পারে। নির্ধারিত ব্যবসা ছাড়া অন্য উদ্দেশ্যে গ্রাহকের তথ্য ব্যবহার করা যাবে না। আবার কোনো উদ্দেশ্যে গ্রাহকের তথ্য নেওয়া হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমতি নিতে হবে। ডিজিটাল ব্যাংকে কেবল একটি প্রধান কার্যালয় থাকবে, যা হবে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা ও সাপোর্ট স্টাফদের দপ্তর। সশরীরে বা ডিজিটাল পদ্ধতিতে গ্রাহকদের অভিযোগ গ্রহণ ও নিষ্পত্তির কেন্দ্রীয় দপ্তর হিসেবেও এটি কাজ করবে। গ্রাহক কিছু বলুক না বলুক, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে প্রযুক্তিনির্ভর স্বয়ংক্রিয় একটি বিবাদ মীমাংসার ব্যবস্থা রাখতে হবে ব্যাংককে। শক্তিশালী আইসিটি অবকাঠামো এবং অ্যাপ্লিকেশন পদ্ধতি থাকতে হবে। এ ব্যবস্থায় কমপক্ষে টিয়ার থ্রি ডাটা সেন্টার থাকতে হবে। ক্লাউড পরিষেবা নিতে পারবে। অবশ্যই তার অবস্থান হবে বাংলাদেশে। সাইবার নিরাপত্তা ও মানি লন্ডারিং বিষয়ে বাড়তি সতর্ক ব্যবস্থা থাকতে হবে ব্যাংকে।
ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন সমকালকে বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাংক ব্যবসার ধরন অনুযায়ী আলাদা আলাদা লাইসেন্স নিতে হয়। আমাদের এখানে একই ব্যাংক ক্ষুদ্র, মাঝারি, করপোরেট, বৈদেশিক বাণিজ্য সবই করে। এখন আলাদা করে ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটিকে সাধুবাদ জানাই। এর ফলে নতুন করে অনেক উদ্যোক্তা ব্যাংক ব্যবসায় যুক্ত হবেন। ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা ও সেবার মান বাড়বে।’ তিনি বলেন, আগামী দিনের ব্যাংকিং হবে ডিজিটাল। তারা সব ধরনের ব্যবসা করবে না। ডিজিটাল ব্যাংক জোর দেবে ক্ষুদ্র, রিটেইল খাতে বিনিয়োগে। তারা করপোরেট ফাইন্যান্স করবে না।
ইসরায়েল, পাকিস্তানসহ কয়েকটি দেশে আলাদাভাবে ডিজিটাল ব্যাংক কার্যক্রম শুরু করেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে আলাদাভাবে এমন কোনো ব্যাংক নেই। তবে প্রচলিত ব্যাংকের ডিজিটাল সেবা ব্যাপকভাবে প্রসার হয়েছে। বিশেষ করে ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর পর লকডাউনে ঘরবন্দি জীবন থেকে মানুষ প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিংয়ের প্রয়োজনীয়তা বেশি বুঝেছে। ব্যাংকগুলোও ডিজিটাল রূপান্তরে দ্রুত বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। শাখা খোলার চেয়ে জোর দিয়েছে কার্ড ও অ্যাপভিত্তিক সেবায়।
ডিজিটাল ব্যাংকের ধারণা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে প্রথম আলোচনা করেন ব্যাংক এশিয়ার তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী। গত বৃহস্পতিবার তিনি সমকালকে বলেন, প্রচলিত ধারার ব্যাংকের ডিজিটাল সেবা রয়েছে। সময়ের চাহিদা বিবেচনায় এখন প্রযুক্তিনির্ভর আলাদা ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ইতিবাচক। তবে পরিশোধিত মূলধন প্রচলিত ব্যাংকের মতো হলেই ভালো হতো। কেননা ব্যাংকিং ব্যবসা শুরুর আগেই প্রযুক্তিনির্ভর অবকাঠামোতে অনেক বিনিয়োগ করতে হবে। আবার ব্যবসা শুরুর আগে বেতন-ভাতায় খরচ হবে।
প্রচলিত ব্যাংকের মতো ডিজিটাল ব্যাংকও বাংলাদেশ ব্যাংকের সব ধরনের নিয়ম মেনে কার্যক্রম চালাবে। তবে এ ধরনের ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন হবে ১২৫ কোটি টাকা। একজন উদ্যোক্তাকে ন্যূনতম ৫০ লাখ টাকার শেয়ার ধারণ করতে হবে। পরিশোধিত মূলধনে উদ্যোক্তার অংশ এনবিআরে নিট সম্পদ হিসেবে প্রদর্শিত হতে হবে। কোনো ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, এমনকি পরিবারের কোনো সদস্যের থেকে ধার, কর্জ, ঋণ বা অগ্রিম নিয়ে মূলধন দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে লাইসেন্স পাওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের মাধ্যমে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়ে কমপক্ষে সমপরিমাণ মূলধন তুলতে হবে। এ ধরনের ব্যাংক কখনও মূলধন ঘাটতিতে পড়লে উল্লেখযোগ্য শেয়ারধারক তথা ৫ শতাংশের বেশি শেয়ারধারককে এককভাবে ও যৌথভাবে মূলধন সরবরাহ করতে হবে। তারা ব্যর্থ হলে শেয়ার অনুপাতে সব উদ্যোক্তাকে পরিশোধ করতে হবে।
ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি, ব্যক্তি বা তাঁর পরিবারের কোনো সদস্য উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার হতে পারবেন না। কারও বিষয়ে আদালতে রায় অপেক্ষমাণ থাকলেও তিনি শেয়ারহোল্ডারের যোগ্য হবেন না। ব্যাংক ব্যবসা শুরুর পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমতি ছাড়া শেয়ার হস্তান্তর করতে পারবেন না। তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক শেয়ার হস্তান্তরের অনুমোদন দেবে না। দেশের বিদ্যমান আইন লঙ্ঘনকারী বা ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত কেউ পরিচালক হতে পারবেন না। পরিচালনা পর্ষদের কমপক্ষে ৫০ সদস্যের প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যাংকিং, উদীয়মান প্রযুক্তি, সাইবার আইন ও রেগুলেশন বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। বাকি পরিচালকদের ব্যাংকিং, ই-কমার্স এবং ব্যাংকিং আইন ও রেগুলেশন বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। প্রধান নির্বাহী নিয়োগে প্রচলতি ব্যাংকের মতো ব্যাংকিং পেশায় কমপক্ষে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা লাগবে।
ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্সের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে আবেদন চেয়ে গত জুনে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এর আগে ১৫ জুন এ-সংক্রান্ত নীতিমালা জারি হয়। অনলাইনেই গত ২১ জুন থেকে আবেদন নেওয়া হচ্ছে। আবেদনের সঙ্গে ব্যাংকের ব্যবসায়িক পরিকল্পনা, আইসিটি পরিকল্পনাসহ ডিজিটাল ব্যাংকের সম্ভাব্যতা বিষয়ে একটি উপস্থাপনা চাওয়া হয়েছে। আবার প্রত্যেক উদ্যোক্তা পরিচালক, স্পন্সর, প্রধান নির্বাহী, প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা, প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা, ঝুঁকি কর্মকর্তা, প্রধান আইসিটি কর্মকর্তা, তথ্য নিরাপত্তা কর্মকর্তা, হেড অব ইন্টারনাল কন্ট্রোল অ্যান্ড কমপ্লায়েন্সের জীবনবৃত্তান্ত, পাসপোর্ট আকারের ছবি, জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্টের কপি দিতে হবে। সঙ্গে তাদের সবার সিআইবি রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে।
- বিষয় :
- ডিজিটাল ব্যাংক
- ঋণ