সাক্ষাৎকারে নগদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর এ মিশুক
ডিজিটাল ব্যাংক দেখাবে উন্নত বাংলাদেশের পথ

সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২৩ | ১৮:০০
ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হলে তা দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা উন্নয়নের পাশাপাশি স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রতিষ্ঠান নগদের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর এ মিশুক।
সমকালকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, নগদ যদি ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স পায় তাহলে ব্যাংকে যেতে না পারা মানুষই তাদের গ্রাহক পরিকল্পনায় এগিয়ে থাকবেন। একই সঙ্গে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের দৈনিক ভিত্তিতে সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণ দিয়ে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে তারা কাজ করছেন।
গত দুই থেকে আড়াই বছর ধরে তানভীর এ মিশুক দেশে ডিজিটাল ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা বলছেন। চার বছর আগে মোবাইল আর্থিক সেবা হিসেবে নগদ চালু করার পর থেকেই ডিজিটাল ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন ডিজিটাল সেবার অন্যতম এ উদ্যোক্তা।
তিনি বলেন, ‘যারা প্রথাগত ব্যাংক থেকে ঋণ পান না, তারা হয়তো মহাজনের কাছ থেকে দৈনিক ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করছেন– এসব মানুষের দেওয়ার মতো জামানত নেই, ট্রেড লাইসেন্স নেই বা ব্যাংকে যেতেও তারা ভয় পান। তাই মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা নিয়ে সারাদিন ব্যবসা করে সন্ধ্যায় আবার ফেরত দেন। আমরা এদের জন্য কাজ করতে চাই।’
তানভীর বিশ্বাস করেন, এসব মানুষের সিঙ্গেল ডিজিটে জামানতহীন ঋণ দিলে গোটা অর্থনীতির চেহারাই বদলে যাবে। তাছাড়া এটি ডিজিটাল আর্থিক অন্তর্ভুক্তি যেমন নিশ্চিত করবে, অন্যদিকে সব লেনদেন আনুষ্ঠানিক হিসাবের মধ্যে আনবে। খেলাপি হওয়ার প্রবণতাও থাকবে না। তাঁর মতে, যিনি ১০ লাখ টাকার ক্রেডিট কার্ড নেন, তিনি খেলাপি হন। ১০ হাজার টাকার কার্ড যার, তিনি কখনও খেলাপি হন না। সে কারণে যে কোনো ব্যাংকের ছোট ঋণের খেলাপি নেই। বড় ঋণের খেলাপি বেশি। খেলাপি না হওয়ার ক্ষেত্রে তানভীরের আরও যুক্তি হলো, ৪০ শতাংশ সুদে টাকা নিয়েও যিনি ব্যবসা করেন তিনি সিঙ্গেল ডিজিটে সুদ পেলে নিশ্চয়ই টাকাটা মেরে দেবেন না।
ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) নগদকে বাড়তি সুবিধা দেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এআই দিয়ে ক্রেডিট রেটিং করার নিজস্ব পদ্ধতি ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। গত তিন বছর আমরা এটি নিয়ে কাজ করছি, যা বাংলাদেশে প্রথম। এনআইডি ও মোবাইল নম্বর দিয়ে সার্চ দিলে পাবলিক ডোমেইনে গ্রাহকের যত তথ্য আছে, সব আমাদের সিস্টেম বিশ্লেষণ করে দেবে। ফলে নির্দিষ্ট গ্রাহককে ঋণ দিলে তা নিরাপদ থাকবে কিনা– এআইর তথ্যই আমাদের তা নিশ্চিত করবে।’
তিনি বলেন, একজন গ্রাহক সপ্তাহে কত টাকার মোবাইল রিচার্জ করেন, ডিজিটালি পেমেন্ট কেমন করেন, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন কিনা বা করলেও সময়মতো বিল দেন কিনা– এসবই গ্রাহকের ক্রেডিট রেটিং তৈরিতে ভূমিকা রাখে। তাছাড়া যখন কোনো ব্যবসায়ী নগদের ডিজিটাল ব্যাংকে ঋণ চাইবেন তখন তাঁর ব্যবসার ধরন এবং লেনদেন বিশ্লেষণ করে এআই বলে দেবে, ওই ব্যবসায়ীকে কতটা ধার দেওয়া নিরাপদ।
তানভীর এ মিশুক জানান, তিন বছর ধরে এসব বিষয় নিয়ে কাজ করার পর নগদ এখন পরিপূর্ণভাবে প্রস্তুত। ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স পেতে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে তারা আবেদন করবেন। লাইসেন্স পেলে এক সপ্তাহের মধ্যেই তারা ডিজিটাল ব্যাংকের সেবা চালু করতে পারবেন। ডিজিটাল ব্যাংকের মাধ্যমে যেসব কাজ করা যাবে বলে বলা হয়েছে তার কিছুটা এখনই মোবাইল আর্থিক সেবার মাধ্যমে করা যায়। এই লেনদেনের মাসিক সীমা মাত্র ৩ লাখ টাকা, যা একজন ব্যবসায়ীর তেমন কোনো কাজেই আসে না। ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা এমএফএসে লেনদেন করতে আগ্রহী হন না।
নিজের দেখা অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, কারওয়ান বাজারের একজন সবজি ব্যবসায়ীর দিনে লেনদেন দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। কিন্তু লুঙ্গি পরে ব্যাংকে যেতে তিনি অস্বস্তি অনুভব করেন। ব্যাংকগুলোও তাকে ভালোভাবে নেয় না। ডিজিটাল ব্যাংকে যেহেতু হাতের মোবাইলেই সব কাজ করা যাবে, ফলে ওই ব্যবসায়ী সহজেই এ সেবা নিতে আগ্রহী হবেন। তাছাড়া এ প্রক্রিয়ায় একই টাকা দিনে কয়েকবার লেনদেন করেও ব্যবসার গতি বাড়ানো সম্ভব। তাঁর বিশ্বাস, যেসব ব্যবসায়ী এখন রাতে বালিশের নিচে টাকা রেখে দুশ্চিন্তা নিয়ে ঘুমান তারাও ডিজিটাল ব্যাংকে টাকা রেখে নিরাপদ থাকবেন। ফলে এখনও দেশের যে ৫২ শতাংশ মানুষ অপ্রচলিত অর্থনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে আছেন তারা তখন আনুষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে চলে আসবেন।
ডিজিটাল ব্যাংকের যে নীতিমালা প্রকাশ করা হয়েছে সেখানে বলা হয়েছে, এই ধরনের ব্যাংকের কোনো বাণিজ্যিক শাখা থাকবে না। এটি নিঃখরচায় গ্রাহকসেবা নিশ্চিত করতে সহায়তা দেবে বলে মনে করেন তানভীর। ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, এখন গড়ে ব্যাংকের প্রতিটি লেনদেনের জন্য খরচ হয় ১৩৭ টাকা। ব্যাংকের অবকাঠামো, বৈদ্যুতিক বিল, জনশক্তি সব মিলেই এই খরচ। এই খরচ তারা গ্রাহকদের কাছ থেকেই তোলে। ডিজিটাল ব্যাংকে এসব খরচ থাকবে না এবং নিঃখরচায় ব্যাংকের ব্যবসা করার এই সুবিধা দ্রুতই গ্রাহক পর্যায়েও চলে যাবে। তাছাড়া ডিজিটাল ব্যাংক ক্ষুদ্র পর্যায়ে ক্রসবর্ডার লেনদেনে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমাবে এবং রেমিট্যান্সের প্রবাহ দ্রুত করতে সহায়তা করবে। সব মিলিয়ে ডিজিটাল ব্যাংকে এক একটা ক্লিক সাধারণ গ্রাহকের জীবন মানোন্নয়নে একেকটি পদক্ষেপ হবে।