ঢাকা মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫

বন্যায় দুবার বাড়ি হারানো পারুল যেভাবে ঘুরে দাঁড়ালেন

বন্যায় দুবার বাড়ি হারানো পারুল যেভাবে ঘুরে দাঁড়ালেন

নিজের দোকানে সাহসী পারুল

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৩ | ১০:১৫ | আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০২৩ | ১০:১৮

সর্বগ্রাসী বন্যা আর নদীভাঙনে পারুল ইয়াসমিনের বাবার বাড়ি ভেঙেছে ছয়বার। বিয়ের পর তাঁর স্বামীর বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে দুবার। কুড়িগ্রামের রৌমারির ইটালুকান্দা নামের যে চরে পারুলরা এখন বাড়ি করেছেন সেখানেও নদী খুব কাছে চলে এসেছে। সামনের বছর নদীর বুকে চলে যেতে পারে তাদের ঘরবাড়ি, এ শঙ্কায় দিন কাটে পারুলের।

গত রোববার পারুল ইয়াসমিনের সঙ্গে যখন কথা হয় তখন তিনি তাঁর দোকানের পণ্য বিক্রি করছিলেন। পণ্য বিক্রির ফাঁকে ফাঁকে শোনালেন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বারবার নদীভাঙনে সবকিছু হারানোর পর কীভাবে উদ্যোক্তা হয়ে উঠলেন। তিনি বলেন, কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বাবা বিয়ে দিয়ে দেন। বিয়ের পর নদীভাঙনে সবকিছু হারানো আরেক পরিবারে এসে পড়ি। স্বামীর আয়ে সংসার চলে না। নিজে কিছু করার চেষ্টা করি। এসময় খোঁজ পাই লজিক প্রকল্পের।

লোকাল গভর্নমেন্ট ইনিশিয়েটিভ অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (লজিক) প্রকল্প থেকে ২০১৯ সালে পারুলকে জলবায়ু সহনশীল জীৱিকায়নের জন্য ৩০ হাজার টাকা দেয় বলে জানান তিনি। পারুল বলেন, ২০১৯ সালে লজিক প্রকল্পের উপকারভোগী হিসেবে নির্বাচিত হই। ব্যাংক অ্যাকউন্ট খুলতে বলা হয়। কিন্তু ব্যাংক অ্যাকাউন্ট কি জানতাম না। লজিক প্রকল্পের আপাদের সহযোগিতায় আমি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলি এবং সেখান থেকে ১২ হাজার টাকা দিয়ে তিনটি ভেড়া কিনি। ভেড়া দ্রুত বাচ্চা দেয়। কয়েক মাসের মধ্যে তিনটা থেকে সাতটা ভেড়া হয়ে যায়। তিনটি ভেড়া বিক্রি করে ৬ হাজার টাকা দিয়ে হাঁস-মুরগি পালন ও সবজি চাষ শুরু করি।

এরপর ইউএনডিপি থেকে একটি স্মার্টফোনও দেওয়া হয় তাকে। সেটি তার ব্যবসা প্রসারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বলে জানান পারুল। চরগুলোতে কিশোরী মেয়েদের ঋতুস্রাব নিয়ে সঠিক জ্ঞান না থাকায় তারা নানা সমস্যায় ভোগে বলে জানান তিনি। ঋতুস্রাবের সময় কাপড় ব্যবহারের কারণে বিভিন্ন অসুখে আক্রান্ত হন মেয়েরা। কাপড়ের বদলে স্যানেটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের সচেতনা বাড়াতে কাজ শুরু করেন পারুল। লজিক প্রকল্পের আপাদের সঙ্গে পরামর্শ করে স্যানেটারি ন্যাপকিন বিক্রির দোকান দেন তিনি। গ্রামে ঘুরে ঘুরে স্যানেটারি ন্যাপকিন বিক্রি শুরু করেন। কিশোরী মেয়ে এবং তাঁদের মায়েদের বোঝান ঋতুস্রাবের সময় কাপড় ব্যবহার করলে পেট ব্যাথা হয়। কিন্তু স্যানেটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করলে পেটব্যথা হবে না। এভাবে আসতে আসতে বিক্রি বাড়তে থাকে পারুলের। স্মার্টফোনের মাধ্যমে তিনি পণ্যসামগ্রী অর্ডার দেন ডিলারদের কাছ থেকে এবং ফোন করে কেউ পণ্য অর্ডার করলে বাড়ি গিয়ে পৌঁছেও দেন পারুল।

তবে স্যানেটারি ন্যাপকিন বিক্রি করতে গিয়ে গ্রামবাসীর অনেক কটু কথা শুনতে হয়েছে পারুলকে। ঋতুস্রাব নিয়ে খোলামেলা কথা বলায় অনেকে বেয়াদব মেয়ে বলতেন। কিন্তু যখন মেয়েরা স্যানেটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের সুফল পাওয়া শুরু করেন তখন পারুলের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদল হয় গ্রামবাসীর। পারুল শুধু স্যানেটারি ন্যাপকিনই নয়, বাচ্চারা যেন অপুষ্টির শিকার না হয় এজন্য পুষ্টিকর খাবার বিক্রি করেন তাঁর দোকানে। এখন পারুলের দোকানে প্রায় এক লাখ টাকার পণ্যসামগ্রী রয়েছে। প্রতি মাসে প্রায় ২০ হাজার টাকা আয় হয়। এই আয় থেকে টাকা জমিয়ে পারুল একটা জমিও ইজারা নিয়েছে। সেখানে সে একাই মৌসুমী সবজি চাষ করে এবং তা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে। সবজি বিক্রি করেও সে বেশ ভালো লাভবান হচ্ছে। এ ছাড়াও লজিক প্রকল্প থেকে জলবায়ু সহনশীল কৃষিকাজ সম্পর্কিত বিভিন্ন ট্রেনিং পেয়ে তিনি এলাকার অনেক নারীকে এ বিষয়ে পরামর্শ ও সহযোগিতা করেন।

পারুল বলেন, ভালো স্যানেটারি ন্যাপকিন এ এলাকায় শুধু আমি বিক্রি করি। তাই বিভিন্ন চর থেকে কিশোরী মেয়েদের ফোন আসে ন্যাপকিনের জন্য। ফোনে অর্ডার নেওয়ার পর আমি নিজে এক-দেড় ঘণ্টা হেঁটে যায় স্যানেটারি ন্যাপকিন পৌঁছে দিতে। ব্যবসাও চলছে, কৃষিকাজ হচ্ছে আবার হাস মুরগি পালনও চলছে। এখন আর সংসার চালাতে আগের মতো কষ্ট হয় না। চরের অনেক মেয়ে আমার মতো হতে চায়।


আরও পড়ুন

×