সময়ের সঙ্গে অগ্রসরমান আধুনিক বিশ্বে যে কোনো ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য আমাদের প্রতিনিয়ত নতুন নতুন জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে হয়। বিগত দশকে যেসব গুণ একজন তরুণকে কর্মবাজারে সামনের সারিতে জায়গা করে দিতে পারত, তার অনেকগুলোই এখন তুলনামূলক বিচারে 'সাধারণ' বা 'পুরোনো ধাঁচের' বলে বিবেচিত হচ্ছে। এক সময় কম্পিউটার ব্যবহারের সাধারণ দক্ষতাকে ব্যক্তির প্রযুক্তিগত পারদর্শিতা বলে বিবেচনা করা হতো, আর এখন ছোট বাচ্চারাও ইউটিউবে চ্যানেল তৈরি করে রীতিমতো অর্থ উপার্জন করছে। মাতৃভাষার বাইরেও অন্তত দুটি ভাষায় যোগাযোগ দক্ষতা অর্জন করা বর্তমানের বিশ্বমুখী চাকরিবাজারে তরুণদের জন্য অনেকটাই আবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে। এভাবে যতই দিন যাবে, নবতর কার্যক্ষেত্র আর উন্নততর প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ততই এগিয়ে আসবে তরুণদের জন্য নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ।

'ডিজিটাল বাংলাদেশ' এবং 'রূপকল্প ২০২১' বর্তমানে বাংলাদেশে অতি পরিচিত এবং প্রচারিত দুটি ধারণা, যার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আছে একটি ভবিষ্যৎমুখী ও দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরির প্রয়োজনীয়তা। বাংলাদেশকে বিশ্বের উন্নত দেশের তালিকায় সংযুক্ত করার উদ্দেশ্য থেকে বর্তমান সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছে, যার মূলে রয়েছে তরুণদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি ও কৌশলগত বিভিন্ন খাতে দক্ষ করে তোলার চাহিদা। বর্তমানে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ ১৮-৩৫ বছর বয়স সীমার মধ্যে অবস্থান করছে। পাশাপাশি বর্তমানে দেশে বয়স বিবেচনায় কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বয়স্ক বা প্রবীণের চেয়ে বেশি। এই 'ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড'-এর সুফল ভোগ করতে হলে প্রয়োজন কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের পথে নিয়ে আসা।

আমাদের ছেলেমেয়েরাও দারুণ কাজ করছে! 'ফুটস্টেপস বাংলাদেশ' প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মাত্র ২৪ বছর বয়সে পরিবেশবিদ ও সামাজিক উদ্যোক্তা শাহ রাফায়েত চৌধুরী 'গ্লোবাল ইয়াং সিটিজেন' হিসেবে অর্জন করেছিলেন প্রখ্যাত এএফএস প্রাইজ। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ছবি তুলে ফিচার ফটোগ্রাফি বিভাগে পুলিৎজার জয় করা রয়টার্স টিমের অন্যতম সদস্য ছিলেন বাংলাদেশের তরুণ আলোকচিত্রী পনির হোসেন। নভেম্বর মাসেই শিশু-কিশোরদের মধ্যে সাইবার বুলিং বা অনলাইন মাধ্যমে হয়রানির ব্যাপারে সতর্কতামূলক অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করে 'ইন্টারন্যাশনাল চিলড্রেন'স পিস প্রাইজ' জয় করে নিয়েছে নড়াইলের ১৭ বছর বয়সী সাদাত রহমান। রোবটিপ চাম্পিয়নশিপ জিতেছি আমরা। এমন আরও অসংখ্য তরুণ দেশ ও দেশের সীমানার বাইরে পা রেখে নিজ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন প্রতিনিয়তই, যার মূলে রয়েছে ক্যারিয়ারে দক্ষতা বৃদ্ধি ও সাফল্য লাভের অদম্য আগ্রহ। কিন্তু আমার কাছে এই যাত্রা কেবল শুরু। আইসিটি ক্ষেত্রে আমাদের আরও অনেক দূর যেতে হবে।

সম্প্র্রতি বাংলাদেশ আইসিটি ডিভিশন এর সঙ্গে মিলে হুয়াওয়ে বাংলাদেশের শিক্ষার্থী এবং তরুণদের জন্য চারটি ভিন্ন ভিন্ন প্রোগ্রাম শুরু করেছে এবং বেশ কয়েক বছর থেকে বাংলাদেশে 'সিডস ফর দ্য ফিউচার' শীর্ষক একটি প্রকল্পের পরিচালনা করছে হুয়াওয়ে, যার মাধ্যমে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে আগ্রহী ও মেধাবী তরুণরা সরাসরি চীনের প্রশিক্ষক ও বিশেষজ্ঞদের সান্নিধ্যে এসে হাতেকলমে জ্ঞানলাভ করতে সক্ষম হয়েছে।

হুয়াওয়ে আয়োজিত 'সিডস ফর দ্য ফিউচার' অনুষ্ঠানটিতে আমি মেন্টর হিসেবে উপস্থিত থেকে দেখেছি কতটা আধুনিক ও উদ্ভাবনাময় পরিবেশে তাদের আইসিটি সংক্রান্ত নানা বিষয়, ভবিষ্যৎমুখী টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা, জেনারেশন বা 'জি'-এর ক্রমবিবর্তন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিগ ডাটা, ক্লাউড সার্ভিসেসসহ নানা বিষয়ে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের। শিক্ষা যে কেবল পাঠ্যপুস্তকনির্ভর একমুখী যোগাযোগ নয়, বরং শিক্ষক-শিক্ষার্থী-বিষয় এই তিনের আন্তঃযোগাযোগপূর্ণ একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়া- তা এই আয়োজনে লেখক এবং প্রশিক্ষণার্থীদের কাছে নতুন করে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই প্রোগ্রামে এ পর্যন্ত বিশ্বের ১০৮টি দেশ থেকে ৩০,০০০ এরও বেশি শিক্ষার্থী যোগ দিয়েছেন। আর সেই বিষয়টিও তরুণদের সুযোগ করে দেয় অন্যান্য দেশের তরুণদের সঙ্গে শিক্ষা এবং জ্ঞানের আদান-প্রদানের।

নতুন এই চুক্তি অনুযায়ী হুয়াওয়ের প্রযুক্তি ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে 'বাংলাদেশ আইসিটি কম্পিটিশন-২০২০', 'আইসিটি জয়েন্ট ইনোভেশন সেন্টার', 'হুয়াওয়ে আইসিটি অ্যাকাডেমি' ও 'কিউরেটিং বাংলাদেশি স্টার্ট আপস' শীর্ষক এই চারটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশের সরকার, যার কেন্দ্রে রয়েছে দেশের তরুণদের বিশ্বমানের আইসিটি প্রশিক্ষণ দেওয়া ও দেশের আইসিটি স্টার্টআপ গুলোর জন্য প্রবৃদ্ধির পথ উন্মোচন করা। আমার বিশ্বাস, আমাদের তরুণরা এই প্রোগ্রামগুলোয় অংশগ্রহণ করবে। আর শুধু এই প্রোগ্রামগুলোই কেন আমাদের দেশের তরুণদের উচিত নতুন প্রযুক্তি জানার এ রকম যখনই কোনো সুযোগ তৈরি হবে সেই সুযোগকে কাজে লাগানো। কারণ আধুনিক বিশ্বের দেশগুলো আশু চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলায় আর্থ-সামাজিকভাবে নানা প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। এই প্রস্তুতির অন্যতম অংশ হলো কৌশলগতভাবে দক্ষ একটি তরুণ সমাজ গড়ে তোলা। আক্ষরিক রূপে শিল্পবিপ্লব বলা হলেও মূলত এর হাতিয়ার হবে উন্নত প্রযুক্তি ও বিজ্ঞাননির্ভর যোগাযোগ কৌশল। সুতরাং, আমাদের দেশে তরুণরা যদি এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকে তবে তা আগামীতে জাতির উপযুক্ত নেতৃত্ব অনুসন্ধানে বাধার সৃষ্টি করবে। এর ফলে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতাতেও বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে ব্যর্থ হবে।

তরুণদের মনে রাখতে হবে, ইন্টারনেটের বদৌলতে যে কোনো বিষয়ে জ্ঞান ও দক্ষতা লাভ করা আগের তুলনায় এখন অনেক সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় হয়ে পড়েছে। হাতে হাতে ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেট এখন আমাদের জীবনযাত্রায় নিয়ে এসেছে গতিময়তা। উন্নত বিশ্বের তরুণরা এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রতিনিয়ত জন্ম দিচ্ছে অনন্য বিস্ময়ের। প্রতিদ্বন্দ্ব্বিতাপূর্ণ বিশ্বে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকার জন্য বাংলাদেশেরও প্রয়োজন এক দক্ষ তরুণ জনশক্তি, যারা নিজ প্রতিভা ও হাতের নাগালে থাকা প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের সদ্ব্যবহার করে দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।