ঢাকা রবিবার, ২২ জুন ২০২৫

নয়া উদারবাদী খবরদারি বনাম সুলতানের শিল্প-ইশতেহার

নয়া উদারবাদী খবরদারি বনাম সুলতানের শিল্প-ইশতেহার

পাভেল পার্থ

প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:০০

বরেণ্য চিত্রকর এস এম সুলতানকে নিয়ে বহুজনের বিশ্লেষণ, তিনি কৃষকের ছবি এঁকেছেন ও কৃষির ছবি এঁকেছেন। কিন্তু কী ধরনের কৃষিব্যবস্থার চিত্রভাষ্য নির্মাণ করেছেন? সুলতান মূলত নয়া উদারবাদী কর্তৃত্ব আর জারি থাকা ক্ষমতার ব্যাকরণকে তাঁর চিত্রভাষা দিয়ে প্রশ্ন করেছেন। কৃষিজীবনের চিত্র-প্রমাণ তৈরি করে নয়া উদারবাদের বিরুদ্ধে শিল্প-ইশতেহার ঘোষণা করেছেন। নয়া উদারবাদী চোখ রাঙানির ঘের থেকে মুক্ত কৃষিভুবনের চিত্রভাষ্য নির্মাণ করতে গিয়ে সুলতান নিজেও বেছে নিয়েছেন দেশজ রং, উপকরণ ও লোকায়ত শৈলী। নয়া উদারবাদকে নানাভাবে প্রশ্ন করার এই সুলতানীয় বয়ান আমাদের জন্য জরুরি; যখন কেবল কৃষিকাজ কিংবা শিল্পচর্চা নয়; সামগ্রিক যাপিত জীবন আজ বন্দি নয়া উদারবাদী কর্তৃত্বের খবরদারিতে। জন্মশতবার্ষিকীতে নয়া উদারবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এস এম সুলতানের শিল্প-প্রতিবাদ আমাদের চর্চা ও কলিজায় দুর্বিনীত লাঙলের ফলা হয়ে উঠুক।

পৃথিবীর বহু শিল্পী চারপাশের বাস্তুতন্ত্র থেকে তাদের শিল্পের উপাদান সংগ্রহ করেন। বিশেষ করে ‘লোকশিল্পীদের’ ক্ষেত্রে এই চর্চা বেশি। প্রকৃতিজাত দেশজ উপকরণ এবং চিত্রকর্মে নানা স্থানীয় সমষ্টিগত লোকজ মোটিফের ব্যবহার। এইসব চর্চা একই সঙ্গে বহুজাতিক কোম্পানিনির্ভর বাণিজ্যকে প্রশ্ন করে, প্রকৃতিবান্ধব এবং অবশ্যই রাজনৈতিক। মানুষ, জমিন, ফসল, গৃহ চারধারে একটা মাটিময় রং ছড়াতে পছন্দ করেন সুলতান। সুলতান তাঁর চিত্রকর্মে বহু প্রাকৃতিক উপাদান এবং দেশজ ক্যানভাস ব্যবহার করেছেন এবং এর প্রচলনে সচেষ্ট থেকেছেন। সুলতানের এই প্রচেষ্টাকে নয়া উদারবাদের বিপরীতে এক দৃঢ় শিল্পিত প্রতিবাদ হিসেবে পাঠ করা যায়। নয়া উদারবাদী ব্যবস্থাকে প্রশ্ন না করে, এই কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতাকাঠামো এবং নিপীড়নকে প্রশ্ন না করে কোনোভাবেই কি শিল্পচর্চা এবং কৃষিচর্চার মুক্তি সম্ভব?

চিত্রকর্মে ব্যবহৃত দেশজ রং ও ক্যানভাসের উপকরণ তাঁর চারপাশের প্রকৃতি ও সাংস্কৃতিক পরিসর থেকেই সংগ্রহ, গবেষণা ও রপ্ত করবার চেষ্টা করেছেন সুলতান। এখানেই তিনি অনন্য, নির্মাতা ও কারিগর। সুলতান মৎস্যজীবীদের গ্রামে ঘুরেছেন, তাদের কাছে জালে গাব দেওয়ার পদ্ধতি শিখেছেন এবং সেই জ্ঞান নিজের ক্যানভাস তৈরিতে প্রয়োগ করেছেন। বিদেশি দামি ক্যানভাস ব্যবহার না করে তিনি দেশজ পাটের চটকে ক্যানভাসে পরিণত করেছেন। সুলতানের এই দেশজ ক্যানভাস উদ্ভাবন কেবল তাঁর দেশজ প্রেম নয় কিংবা প্রতিরোধী বয়ানমাত্র নয়। বরং প্রকৃতিঘনিষ্ঠ শিল্পচর্চার পাশাপাশি শিল্পচর্চার মাধ্যমে দেশীয় অর্থনীতি বিকাশের একটা সৃজনশীল প্রচেষ্টাও। কারণ যখন বিশ্বায়িত ক্ষমতার চাপে একের পর এক পাটকল বন্ধ হয়ে যায়, তখন সুলতান পাটের চটকে তাঁর সৃজনকর্মের ক্যানভাস হিসেবে গ্রহণ করে পাটশিল্প রক্ষার জন্য দাঁড়ান। একই সঙ্গে গ্রামবাংলার পাটচাষি এবং পাটের নিরন্তর দুঃখগাথাকে আগলে দাঁড়ান। দেশি গাব ও তিসির তেল ব্যবহারের ভেতর দিয়ে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য সুরক্ষা এবং শস্য বহুমুখীকরণের বার্তাও সুলতান আমাদের দেন। তো এইসব দেশজ উপকরণের বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব কতখানি? দীর্ঘস্থায়িত্ব কিংবা প্রয়োজন ও চিত্রবয়ান নির্মাণের জন্য এদের জরুরিত্ব কতখানি? চিত্রশিল্পে দেশজ উপকরণের ব্যবহার নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা কাজ বিষয়ে আমার জানা নেই। সুলতানের ব্যবহৃত কিছু দেশজ প্রাকৃতিক উপকরণ নিয়ে আমরা কিছু আলাপ করতে পারি। যেমন তিসির তেল দীর্ঘ লিনোলেনিক এসিডযুক্ত এক ট্রাইগ্লিসারাইড। এটি দ্রুত শুকানোর কাজে ব্যবহৃত হয় এবং তেল রঙের বাইন্ডার হিসেবে শিল্পীসমাজে বহুল ব্যবহৃত। কিন্তু এই তিসির তেল আসে কোথা থেকে? কৃষকই তিসি চাষ করেন। কিন্তু সবুজবিপ্লব পরবর্তী সময়ে শস্যবৈচিত্র্য যেমন কমেছে, তিসিও হারিয়েছে দেশের নানা প্রান্ত থেকে। বিশেষ করে চরাঞ্চল, বরেন্দ্র এবং পাহাড়ি এলাকায় তিসি চাষের বহু প্রচলন ছিল। তিসি চাষ না হলে তিসির তেল আসবে কোথা থেকে? কীভাবে তৈরি হবে তৈলচিত্র? শস্য বহুমুখীকরণ এবং সহ-ফসল চাষের রবি মৌসুমে (মূলত কার্তিক থেকে চৈত্র মাসে) দেশে বর্তমানে কিছু তিসি আবাদ হচ্ছে আবারও। আমাদের দেশীয় তিসির জাত কতগুলো টিকে আছে এবং কতগুলো হারিয়েছে আমরা জানি না। নীলা (লীন-১) নামে একটি তিসি জাতকে ১৯৮৮ সালে জাতীয় বোর্ড অনুমোদন দিয়েছে। এ জাতের বীজে তেলের পরিমাণ প্রায় ৩৮ শতাংশ। সুলতান হয়তো গ্রাম থেকে তিসির তেল সংগ্রহ করেছেন এবং তাঁর চিত্রকর্মে ব্যবহার করেছেন। দেশীয় জাতের তিসির তেল এবং বাজারে কিনতে পাওয়া বিভিন্ন কোম্পানির তিসির তেলের গুণাগুণ ও পার্থক্য কেবল চিত্র গবেষক আর শিল্পীরাই বলতে পারবেন। এসব বিষয়ে কোনো তুলনামূলক গবেষণা হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। বাংলাদেশে প্রতিবছর শিল্পকর্মে কী পরিমাণ তিসির তেল ব্যবহৃত হয় এবং এর অর্থনৈতিক-রাজনীতি বিষয়ে আমি কোনো গবেষণা দলিলও পাইনি। শিল্পীসমাজ যদি দেশীয় তিসির তেল বিষয়ে আরও গবেষণা করে এবং এর একটি স্থানীয় দেশীয় বাজার তৈরিতে ভূমিকা রাখে তবে শিল্পচর্চার ভেতর দিয়ে তিসি চাষকেও নতুনভাবে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে; যা কৃষকসমাজ এবং শিল্পীসমাজের ভেতর এক যৌথ পরস্পর নির্ভরশীলতা গড়ে উঠতে সহায়ক হবে। সুলতান এমনই পেশাগত কৌমনির্ভর সমষ্টিগত বহুত্ববাদের চিত্রভাষ্য নির্মাণ করেছেন।

সুলতানের পাটের ক্যানভাস নিয়েও গবেষণা হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। এটি হওয়া জরুরি। প্রশ্ন উঠতে পারে পাটের ক্যানভাস কতটা টেকসই হবে? গবেষণা বলছে, তুলা-শণ বা অন্যান্য আঁশের তুলনায় পাটের আঁশের অণুজীবঘটিত সংক্রমণ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। যাহোক, সুলতানের ক্যানভাস নিয়ে গবেষণা হতে পারে। সুলতানের ক্যানভাস আমাদের দেশজ শিল্পায়ন এবং শিল্পচর্চা বিকাশে প্রকৃতিবান্ধব বার্তা দিতে পারে। বিশেষ করে জলবায়ুদুর্গত সময়ে আমাদের সব দিক থেকেই ভাবতে হবে। শিল্পচর্চার ক্ষেত্রেও আমাদের প্রকৃতিবান্ধব উপকরণ ব্যবহার করা জরুরি, যেসব উৎপাদনে কম কার্বন নির্গমন হয়। আবার শিল্প উপকরণের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়গুলোও প্রবলভাবে আমাদের খেয়াল করা জরুরি। অ্যাজো-বেজড ডাই কিংবা সিসাদূষিত রং জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, প্রমাণিত হয়েছে ক্যান্সার তৈরি করে। আমরা কোন ধরনের রং ব্যবহার করব এবং সেসব কতটা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য উপযোগী এসব বিষয়ে আমাদের একটা নীতিমালার প্রশ্নকেও উত্থাপন করে সুলতানের শিল্পচর্চা। দেশে প্রতি বছর আমাদের কী পরিমাণ ক্যানভাস লাগে এবং এই অর্থ কোন কোন ক্যানভাস কোম্পানির কাছে যায় তাও আমাদের জানা জরুরি। যদি পাটসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক আঁশ, কাগজ এবং নানা প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে ‘ক্যানভাস-শিল্প’ গড়ে তোলা যায় তবে বহু বেকার যুবককে এই সৃজনশীল কর্ম উদ্যোগে উদ্যোক্তা হিসেবে যুক্ত করা সম্ভব। দেশজ রং, ক্যানভাস এবং দেশজ শিল্পচর্চার উপকরণের মাধ্যমে দেশীয় শিল্প উপকরণের বাজার গড়ে তুলতে পারলে এটি আমাদের জাতীয় অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে এক বিশেষ পরিচয় গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।


পাটের চটের ক্যানভাস অংকন উপযোগী করে তোলার জন্য প্রলেপ হিসেবে এবং রং তৈরিতে সুলতান দেশি গাবের আঠা ব্যবহার করেছেন। জেলেরাই মূলত জালে এই গাবের আঠা ব্যবহার করে। কিন্তু কেন জেলেরাই পাকাকরণ/প্রক্রিয়াজাতকরণে এই দেশি গাবের এমন এক আদি ব্যবহারের চল ধরে রেখেছেন। এর একটি জন-উদ্ভিদতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা আছে, গাব ফলে স্যাপোনিন নামের রাসায়নিক উপাদান থাকে এবং এটি এককালে প্রাকৃতিক মাছ ধরার উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। কোনো জলাধারে কিছু সময়ের জন্য বাঁধ দিয়ে গাবের মতো এমন গাছের ফল-শিকড়-পাতার রস দিয়ে মাছ ধরার রেওয়াজ থেকেই গাবের ব্যবহার এখনও জেলেসমাজে জাল পাকাকরণের কাজে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু কী আছে গাবে, কেন তা সুলতানের ক্যানভাসকে টেকসই করে তুলল? আমরা এর কিছু কার্যকারণ বিষয়ে অতি সাধারণ ধারণা করতে পারি। ঈবিনেসী পরিবারভুক্ত গাবের বেশ কিছু প্রজাতি বাংলাদেশে জন্মে। এর ভেতর ‘দেশি গাব’ গ্রামীণ বন, নিম্নভূমি, ঝোপঝাড় এবং পাহাড়ি বনেও দেখা যায়। গাবের কিছু ভেষজ ব্যবহার এবং পাখি ও বুনো প্রাণীদের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার থাকলেও মূলত মৎস্যজীবী সমাজে এর ব্যবহার অনেক। বিশেষ করে গাব ফলের আঠা ও কষ দিয়ে জাল মজবুত করা হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে রং টেকসই করার জন্যও ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের বহুস্থানে প্রতিমা কারিগরদের ভেতর রঙের প্রলেপ এবং রং টেকসই করার জন্য গাবের আঠা ও তেঁতুল ফলের ক্বাথ ব্যবহার করা হয়। একটি গবেষণায় (২০১৩) গাব ফল থেকে টেরাজেরন, সাইটোস্টেরল, গ্যালিক এসিড, পেরিগ্রিনল এসব রাসায়নিক উপাদান শনাক্ত করা হয়েছে এবং গাব ফলের ক্বাথ থেকে হেক্সাকোসান, হেক্সাকোসানল, বিটা-সাইটোস্টেরল, মনো-হাইড্রক্সি ট্রাইটারপিন কিটোন, বিটুলিন, বিটা গ্লাইকোসাইড, বিটুলিনিক এসিড, মিথাইল এস্টার এসিটেট, মিথাইল এস্টার গ্লাইকোসাইড পৃথক করা হয়েছে। আরেকটি বৈজ্ঞানিক গবেষণায় (২০২২) দেশি গাব থেকে ফ্ল্যাভোনয়েড, টারপিনয়েড, স্যাপেনয়েড, ট্যানিন এসব রাসায়নিক উপাদান পৃথক করে দেখা গেছে গাবের আঠা ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়াসহ বহু সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারে। আরেকটি গবেষণা (২০১২) থেকে জানা যায়, যেসব উদ্ভিদ থেকে আমরা প্রাকৃতিক রং এবং সহায়ক উপাদান পাই তার ভেতর গাবের কাঁচা ফল অন্যতম। বাংলাদেশে করা একটি গবেষণা (২০১৯) জানায়, গাব ফলের ক্বাথ থেকেও বীজে ফ্ল্যাভোনয়েড বেশি এবং স্যাপোনিন আবার বীজ থেকে ফলে বেশি। অন্য আরেকটি পরীক্ষায় (২০২০) বুনো গাব থেকেও একটি নতুন ফ্ল্যাভোনল এবং ১২টি রাসায়নিক উপাদান শনাক্ত করা হয়েছে। মাছ ধরার জালে কাঁচা-আধা পাকা গাব ফলের আঠা ও কষের ব্যবহার বাংলাদেশের মৎস্যজীবী সমাজের এক লোকায়ত বিজ্ঞানচর্চা। নড়াইল, সাতক্ষীরা, নওগাঁ, দিনাজপুর, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, রাজশাহী, মানিকগঞ্জ, কক্সবাজার অঞ্চলের জেলেদের সঙ্গে গাবের ব্যবহার ও লোকায়ত চর্চা নিয়ে নানা সময়ে আলাপ করেছি। তাদের ভাষ্য, গাবের আঠা দ্রুত জমাট বাঁধে এবং এটি জালের সুতার আঁশকে টেকসই করে এবং দীর্ঘদিন পানিতে থাকার ফলে জালের সুতা নষ্ট হয় না এবং পোকামাকড় ক্ষতি করতে পারে না। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে গাবের এই ‘জমাট বাঁধার প্রভাব’ বিষয়ে বিস্তর প্রমাণ আছে এবং এ নিয়ে পরে গবেষণাও হয়েছে। ধারণা করছি সুলতান দেশি বুনো গাবের আঠা ব্যবহার করেছেন। পাটের চটে গাবের আঠার বিশেষ সম্মিলনী তাঁর ক্যানভাসকে প্রতিরোধী এবং প্রতিবাদী করে তুলেছে। তবে সুলতানের দেশজ রং, ক্যানভাস এবং শিল্প উপকরণ বিষয়ে আমাদের বহুমুখী গবেষণা জরুরি। দেশে টিকে থাকা দেশজ শিল্প উপকরণ বিষয়ে আমাদের পূর্ণাঙ্গ বৈজ্ঞানিক নথিভুক্তকরণ জরুরি। কারণ এসব শিল্প উপকরণ যেহেতু প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে জড়িত তাই লাগাতার প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের আঘাতে এমন শিল্প উপকরণের সংকটগুলোও জানা-বোঝা জরুরি। সুলতান এই জানা-বোঝার প্রচেষ্টায় রত ছিলেন, এই প্রচেষ্টাকে জাগিয়ে রাখা আমাদের কাজ। একজন চিত্রকরের শিল্পচর্চার কারণে যদি একটি গাব গাছ বাঁচে, কিছু জমিনে তিসি ও পাট চাষ হয় বা প্রাকৃতিক রঙের উৎসগুলো সুরক্ষিত থাকে, তবে চিত্রকর হিসেবে এর থেকে বেশি আর কী উদযাপনের হতে পারে এই দুনিয়ায়? সুলতান কৃষি চিত্রকর্মের ভেতর দিয়ে এই পরস্পরনির্ভর উদযাপনের দৃশ্য আমাদের সামনে প্রমাণ হিসেবে রেখে গেছেন।

সুলতান নয়া উদারবাদী কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে গ্রামীণ-নিম্নবর্গের প্রতিবাদী চিত্রবয়ান আমাদের সামনে প্রমাণ হিসেবে রেখে গেছেন। দশ হাজার বছর বয়সী কৃষিকর্ম মাত্র কয়েকশ বছরের ইতিহাসের পরিক্রমায় আজ নয়া উদারবাদী উপনিবেশের অংশ হয়ে কোনো রকমে টিকে আছে। কৃষিকর্ম এখন কোনোভাবেই কৃষকের সার্বভৌম সিদ্ধান্ত, অংশগ্রহণ, চিন্তা, অনুশীলন এবং উপকরণ নির্ভরতার কোনো আখ্যান নয়। এখানে নয়া উদারবাদী কর্তৃত্ব আছে, বহুজাতিক কোম্পানির বাহাদুরি আছে। শিল্পচর্চাও আজ এই নয়া উদারবাদী কর্তৃত্বের বাইরে কি? শিল্পী কি তাঁর চিন্তা, উপকরণ, সিদ্ধান্ত সবকিছু মিলিয়ে সার্বভৌম, নাকি কৃষকের মতো চিত্রকরও আজ করপোরেট বাজারে নিজের সৃষ্টিকর্ম কি উৎপাদনকে ‘পণ্য’ হিসেবেই বিক্রি করতে বাধ্য হন? সুলতানের চিত্রকর্মে তাহলে আমরা কেন জমিনে কোনো আইল দেখি না, দেখি সর্বজনীন উৎপাদনশীলতা ও সৃষ্টিশীলতার জমিন। দেখি সমবায় এবং বিনিময়ের এক সমষ্টিগত তৎপরতা। সুলতানের চিত্রকর্মে ‘উৎপাদনশীলতা’ কোনো ‘পণ্য’ নয়, বেঁচে থাকা এবং জাগিয়ে রাখার সম্ভাবনার শক্তিচক্র। কৃষির ওপর নয়া উদারবাদী কর্তৃত্বের মতো শিল্পভুবনে এই কর্তৃত্ব কতখানি তা আমার জানা নেই। বিজ্ঞ শিল্পীসমাজ হয়তো এর একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারবে। আমরা সমকালীন শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে দেখতে পাই কোনো না কোনো বহুজাতিক কোম্পানি কিংবা করপোরেট কোনো না কোনো শিল্পচর্চাকে নানাভাবে সহায়তা করছে। স্মরণে রাখা জরুরি এসব করপোরেট কর্তৃত্বের মাধ্যমেই নয়া উদারবাদী ব্যবস্থা টিকে আছে এবং এই নয়া উদারবাদী ব্যবস্থাকে প্রশ্ন না করে কি কোনো সার্বভৌম শিল্পচর্চা বা কৃষিচর্চা সম্ভব? সুলতানের চিত্রকর্ম আমাদের কাছে নানাভাবে এই প্রশ্নকেই হাজির করেছে। শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত কৃত্রিম রাসায়নিক উপাদান নিয়ে আলাপ বহুদিন আড়ালে ছিল। বহুদিন ধরে শিল্পীরা বিভিন্ন কোম্পানির বিপজ্জনক সিসাদূষিত রং দিয়ে ছবি এঁকেছেন। পরিবেশ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রসঙ্গ আইনত ওঠার ফলে রং থেকে সিসা, ক্যাডমিয়াম, আর্সেনিক ও সেলেনিয়ামের মতো ভারী ধাতুকে বাদ দেওয়ার প্রচলন শুরু হয়েছে।

দেখা যায়, অধিকাংশ সময়ই চিত্রকর্মের ক্রয়-বিক্রয়কে এক বহুজাতিক বিশ্বায়িত ক্ষমতার বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এমনকি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর প্রবর্তিত বৃত্তি, গবেষণা ফেলোশিপ, অনুদান নিয়েই শিল্পশিক্ষা করতে হয়। প্রাণ-প্রকৃতিসংহারি বহুজাতিক কৃষিবিষ কোম্পানিগুলো শিল্প-সংস্কৃতির পাতানো ‘ধারক’ হিসেবে বহু ‘পুরস্কার’ ও সম্মাননা প্রবর্তন করেছে, এসব পুরস্কার পাওয়ার জন্য বহু শিল্পী তাদের শিল্পকর্ম নিয়ে ‘মুখিয়ে অপেক্ষা’ করেন। বৃহৎ কৃষিবিষ কোম্পানি মনসান্টো, জার্মান কৃষিবিষ কোম্পানি বায়ার কিংবা সুইস কোম্পানি সিনজেন্টা প্রবর্তিত পুরস্কার ও বৃত্তিগুলো এ ক্ষেত্রে বেশ আলোচিত। সুলতানের কৃষি চিত্রভাষ্য এবং শিল্পভুবন আমাদের নয়া উদারবাদী কর্তৃত্বকে প্রমাণসমেত প্রশ্ন করতে শেখায়। সুলতান কেবল ক্যানভাসে নয়, যাপিত জীবনের ভেতর দিয়েও নয়া উদারবাদের বিরুদ্ধে শিল্পকুসুম টানটান রেখে গেছেন। 

আরও পড়ুন

×