ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫

সবিশেষ

যখন আমি তরুণ চিত্রশিল্পী

যখন আমি তরুণ চিত্রশিল্পী

মোহাম্মদ ইউনুস [জন্ম : ১৬ জানুয়ারি ১৯৫৪]

মোহাম্মদ ইউনুস

প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:০০

একজন সাইনবোর্ড পেইন্টারের আঁকা দেখতাম আর ভাবতাম যদি কোনোদিন তার মতো আঁকতে পারতাম। অবশ্য সেই সাধ পূরণ হয়েছিল। ৯ মাসের যুদ্ধ শেষে ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর রেজাল্ট হওয়া পর্যন্ত নিজেদের একটি দোকানে সাইনবোর্ডের দোকান খুলে বসি, নাম দিই মডার্ন আর্ট গ্যালারি। সাইনবোর্ড, যাত্রাপালার ব্যানার, সিনেমা স্লাইড, বিয়ের অনুষ্ঠানের আলপনা, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কত কী, অবশ্য সবই ছিল গ্রাফ করে করা। এর মাঝে একদিন ঢাকা চারুকলায় অধ্যয়নরত সাইফুর রহমান আমার সাইনবোর্ডের দোকানে এসে বলল, তুমি আর্ট কলেজে ভর্তি হলে ভালো করবে। বাবা মেডিকেলে পড়ানোর জন্য দিনাজপুরে পাঠালে আমি নাম লেখা টিনের সুটকেস নিয়ে সোজা চলে আসি ঢাকায়, আর্ট কলেজে পড়ব বলে। এরপর ভর্তি পরীক্ষায় পাস, ক্লাস শুরু– সবকিছুই নিয়মমাফিক চলছে। বাবার অমতে আসায় কিছুদিন টাকা পাঠানো বন্ধ থাকলেও রেজাল্ট ভালো করার সুবাদে আবার অর্থ জোগান শুরু হয়। দ্বিতীয় বর্ষ থেকে ছাত্রলীগের এবং অন্যান্য ফরমায়েশি কাজ করে প্রচুর অর্থ পাওয়ার পর বাবার টাকা নেওয়া বন্ধ করে দিই। প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে প্রি ডিগ্রিতে সবাইকে একসঙ্গে ক্লাস করতে হতো, তৃতীয় বর্ষ থেকে সাবজেক্ট চুজ করে যার যার ডিপার্টমেন্টে চলে যেতে হতো, প্রি ডিগ্রিতে অনেক ভালো রেজাল্ট করা সত্ত্বেও কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত কারণে আমাকে তৎকালীন ব্যবহারিক শিল্পকলা (বর্তমানে গ্রাফিক ডিজাইন) বিভাগে ভর্তি হতে হয়। ছবি আঁকায় আমার ভাটা পড়েনি বরং গ্রাফিক ডিজাইন এবং পেইন্টিং সমানতালে চালিয়ে যাওয়ায় পেইন্টিংয়ে ১৯৭৬ সালে শ্রেষ্ঠ এবং ‘সর্বশ্রেষ্ঠ জয়নুল আবেদিন’ পুরস্কার পাই। ১৯৭৯ সালে পাস করার পর ১৯৮০ সালে সাজু আর্ট গ্যালারিতে প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী বেশ আলোড়িত হয়। দেশের বিভিন্ন দৈনিকে ফলাও করে রিভিউ করা হয়। একই বছর বাংলাদেশ টেলিভিশনে সিনিক পেইন্টার হিসেবে যোগদান করি। ১৯৮১ সালে সিরামিক বিভাগে অধ্যয়নরত ছাত্রী রিফফাতের সঙ্গে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হই। চাকরিরত অবস্থায় কর্তৃপক্ষের অনুমোদনে চারুকলায় গ্রাফিক ডিজাইনেই মাস্টার্সে ভর্তি হই এবং এক্সপেরিমেন্টাল পোস্টার ডিজাইন করি। একই বছর প্রথম এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে প্রথমবারের মতো এক্সপেরিমেন্টাল কাজ প্রদর্শিত হয়। ১৯৮২ সালে জাপান সরকারের মনবুশো বৃত্তি পাই এবং চাকরি ছেড়ে ১৯৮৪ সালে জাপানে চলে যাই। ছয় মাস জাপানি ভাষা শিক্ষা শেষে টোকিওর তামা আর্ট ইউনিভর্সিটিতে মাস্টার্সে ভর্তি হই এবং সেখানে জাপানের মডার্ন আর্টের পাইয়নিয়ারিং শিল্পী অধ্যাপক ইয়ামাজাকি সুসুমির গাইডে পড়াশোনা শুরু করি। প্রথম বছর উল্লেখযোগ্য কোনো সাফল্য না পেলেও দ্বিতীয় বছর আমার জীবনের শিল্পকলায় ছিল এক স্বর্ণযুগ।

পড়াশোনা করা অবস্থাতেই কোদো আর্ট এক্সিবিশন থেকে নিউ কামার পুরস্কার লাভ করি এবং শিক্ষা সমাপনী বর্ষে দ্বিতীয় একক চিত্র প্রদর্শনী হয় টোকিওর গিঞ্জায় অবস্থিত গ্যালারি সেন্টার পয়েন্টে। এরপর ১৯৮৭ সালে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করে দেশে ফিরে এসে চারুকলা ইনস্টিটিউটে অ্যাডহক ভিত্তিতে ছয় মাস শিক্ষকতা করার পর আবার জাপানে চলে যাই এবং পরবর্তী সময়ে ১৯৯২ সালে চারুকলা ইনস্টিটিউটে স্থায়ী প্রভাষক পদে নিযুক্তি লাভ করি। ১৯৮৮ সালে শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত নবীন চারুকলা প্রদর্শনীতে সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার ও একই বছর বিজয় দিবস সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার লাভ করি। এরপর দেশে-বিদেশে বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হই। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য শিল্পকলা সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার, ইরানে প্রথম ইসলামিক আর্ট বিয়েনাল, দুবাইয়ে এমার আর্ট সিম্পোজিয়াম, যুক্তরাষ্ট্রের মনটানা, জর্জিয়ায় আন্তর্জাতিক মিনিয়েচার আর্ট প্রতিযোগিতা এবং জাপানের কোদো আর্টের গ্র্যান্ড পুরস্কারসহ বিভিন্ন সময়ে আরও অনেক পুরস্কার লাভে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা পাই। এ পর্যন্ত দেশে ও বিদেশে মোট ৪২টি একক ও শতাধিক যৌথ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছি। ব্রিটিশ মিউজিয়ামসহ পৃথিবীর বহু দেশে মিউজিয়াম, গ্যালারি ও ব্যক্তিগত সংগ্রহে বহু কাজ সংরক্ষিত আছে। 

আরও পড়ুন

×