ঢাকা রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫

আর কতদিন বাঁচব?

আর কতদিন বাঁচব?

সমকাল

জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত

প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০২৩ | ১৮:৩৩

 

রবিকে বাসায় নিয়ে আসার জন্যে আমি স্টেশনে যাচ্ছিলাম।

রীনা বলল, আর একবার ভেবে দেখলে হতো না? তার স্বর এত নিরুত্তাপ, নির্লিপ্ত যে জবাব দিতে সময় নিতে হলো। আর মুখেও কোনো রেখা নেই। আমি বললাম, ভেবে দেখার সময় নেই রীনা। ট্রেন আসবে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে। আমার স্টেশনে যাওয়া উচিত। আর…। কথা শেষ করার আগে আবার ভেবে নিলাম, আর দেখো, রীনা আরও অনেকদিন কাটাতে হবে, এমনি করে কেউ বাঁচে না। ঘর ছেড়ে বেরোনোর মুখে বললাম, সবকিছু সহজ করে নাও। আগের মতো গাঢ় আলিঙ্গনে আর তাকে ধরা যাবে না জানতাম। তবু প্রফুল্ল মুখে তার হাতে ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম, কী রবি কেমন আছ? গাড়িতে ঘুম হয়েছিল তো? রবি অবাক হবার ভান করছিল, আরে মনি, তুমি কিন্তু দারুণ ভদ্র হয়ে গেছ। আমি চাইছিলাম, এই কষ্টকর ব্যাপারটা যাতে তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। জোর দিয়ে বললাম, বিয়ে করলে সবাই কিছুটা পাল্টায়। তুমিও তো কিছু কম পাল্টে যাওনি। যদি সে আমার ইচ্ছা বুঝতো, যদি সে প্রশ্ন করতো, রীনা কেমন আছে, আমাকে ভালোবাসে কিনা, তার কথা মনে রেখেছে কিনা– তাহলে কী হতো বলা যায় না। হয়তো সহজে বেড়াগুলো পার হয়ে আসা যেত। কিন্তু আমরা কেউ তা করি না। আমরা অনেককাল বাঁচতে চাই। রবি আমার ইচ্ছায় সাড়া দিল না। খানিক ইতস্তত করে বলল, আমার চিঠি পেয়েছিলে তো। কোন হোটেলে? তার দিকে তাকিয়ে বললাম, হোটেল এখনও কিছু ঠিক করিনি। এখন বাসায় চলো। আগে এলেও তো আমার বাসায়ই উঠতে। তার ঠোঁট একবার-দু’বার নড়তে চাইল দেখে আমি আর স্কুটার নিলাম না। শব্দে কারও কোনো কথা শোনা যাবে না। রিকশায় উঠে আমার চাকরির কথা, পুরোনো বন্ধু, যারা এখানে আছে, তাদের কথা জিজ্ঞাসা করলো রবি। বাড়ি তখনও কিছু দূরে। রবি আমার দিকে চাইল, মনি, আমি তোমার মতো নই, তুমি জানো, কিছু ভেবো না, আমাকে নিয়ে যাবে, রীনার আপত্তি হবে না তো? আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, প্রথমেই জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল। আমরা তিনজন লোক– আমি, তুমি আর রীনা। কিছু কিছু জায়গা ছেড়ে দিলে বোধহয় সকলেরই চলে যাবে। রীনা জানে তুমি আসছ, তোমাকে বাসায় নিয়ে যাবো তাকে বলেছি, রীনা স্ত্রীলোক, তুমি কিছু মনে করো না।

 

রবি হেসে বলল, পাগল। হাত-মুখ ধুয়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে বসলে চাকরের হাতে চা খাবার পাঠিয়ে দিল রীনা। আমি জানতাম, সে আসবে না। সত্যকে হৃদয়ে ধারণ করার ক্ষমতা আদৌ তাৎক্ষণিক নয়। ব্যক্তিবিশেষে তার পার্থক্যও স্বীকৃত। আমি পারতাম আরও দ্রুত সবকিছু সহজ করার চেষ্টা করতে। কিন্তু সে-সব ফিল্মি কায়দা স্থায়ী হয় না। আমি রীনার হাত ধরে টেনে এই ঘরে এনে বলতে পারতাম, রবি, এই যে রীনা, এতকাল যাকে চিনেছ সেই রীনা নয়, আমার স্ত্রী রীনা। বলতে পারতাম, অনর্থক তোমরা অপরিচিতের ভান করো না। স্মৃতি যে মানুষের কী সম্পদ আমরা সবাই জানি। অথবা রবিকেই সঙ্গে করে নিয়ে সোজা রান্নাঘরে ঢুকে যেতে পারতাম, রীনা রবিকে দেখাও তুমি কী কী রান্না শিখেছ। কিন্তু এই সবই ফিল্মি কায়দা। স্থায়ী হয় না। তাহলে সহজ পথটা কী? আমি কি চাই যে আমার অন্যান্য বন্ধুর মতোই রবিকেও রীনা সৌজন্যে, আপ্যায়নে প্রীত করবে? আমি ভেতরে গিয়ে রীনাকে বললাম, একটা নিঃশ্বাস চেপে রীনাকে বললাম, রবির সঙ্গে তোমার বোধ হয় একবার দেখা করা উচিত ছিল। মুখ না ফিরিয়ে মৃদু গলায় রীনা বলল, দেখা তো হবেই এক সময়। তাড়াতাড়ির কী আছে। চাকরটাকে নিয়ে বাজারে বেরোবার মুখে রবি এসে দাঁড়ালো, চলো আমিও বাজারে যাই । না, না, রাত জেগে এসেছ। তুমি বিশ্রাম করো। আসলে আমার ভয় ছিল একসঙ্গে বাজারে বেরোলে পথে এতক্ষণ কী কথা বলা যাবে। সে আসার আগে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা যেভাবে ভেবে রেখেছিলাম, সেভাবে কিছুই ঘটছে না। এত সহজে যে ঘটবে না, জানতাম। তবু যার সাথে কথা কোনো কালে শেষ হবে না বলে ভাবতাম, তাকে নিয়ে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়াও তো যায় না। পথে প্রচুর ঘুম হয়েছে, বলে পায়ে জুতো গলিয়ে রবি তৈরি হয়ে দাঁড়ালো। আমি ইতস্তত করে বললাম, আমি না হয় রীনাকে বলে যাই– কথা শেষ করার আগেই রবি ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালো। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলল, তোমার মতো মনের জোর তো সবার না-ও থাকতে পারে, এ কথা ভুলে যেও না মনি। আস্তে আস্তে সইয়ে নিতে দাও। পথে নেমে বললাম, মনের জোর-টোর কিছু নয়। সবাইকে বেঁচে থাকতে হবে। গৃহধর্ম সন্তান পালন যা-ই বলো, সবই এর অঙ্গ। কিছু বাড়তি ডালপালা ছেঁটে এই জীবনবৃক্ষটিকে একটু সোজা করে নিতে আপত্তি কী? রবি বলল, ওসব কথা থাক মনি। আপত্তি থাকলে আমি কি আর তোমার কাছে আসতাম? দুপুরে খাওয়ার সময়ে অন্তত রীনা কাছে থাকবে ভেবেছিলাম। সে রকম কোনো আভাস পেলাম না। ফলে ক্রমেই শঙ্কিত হয়ে উঠছিলাম। শঙ্কা এই জন্যে যে, রবিকে যদি এমন অবস্থার মধ্যে পুরোদিন কাটাতে হয়, সে সত্যিই হোটেলে গিয়ে উঠবে। আর আমি যে জন্যে তাকে ডেকে এনেছি, সহজ মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস। নেব বলে আমার যে উদ্যম, তারই-বা কী হবে? অথবা আমি যেভাবে মানুষের অনুভবগুলোকে ওজন করতে চাই, কেউ তা করে না। হয়তো আমি নিজেই যা করছি তার সাফল্যে বিশ্বাসী নই। তবু এভাবে ছেড়ে দেওয়া যায় না। পৃথিবী বিশাল হয়তো। কিন্তু আমাদের এই চারপাশ বন্ধ, ছোট, দম আটাকানো দেশ, খোলা হাওয়া তার কোনো জানালা দিয়েই ঢুকতে চায় না। অতএব, ছোট ফাঁকগুলো বন্ধ করে লাভ কী? আমি আরও ভেবেছিলাম, সবই এমন কিছু দুইয়ে দুইয়ে চার হয়ে যায় না। অঙ্কের বাইরেও কিছু রয়ে গেছে সন্দেহ কী? আরও ভেবেছিলাম, রবি এবং রীনা যদি তাদের অবস্থান মেনে নেয়, তাতে আমারই সুখ। পুরোনো প্রথা, সংস্কার এমনকি পুরোনো ধরনের অনুভূতিগুলোও কি কিছু পাল্টে দেওয়া যায় না? তারও চেয়ে বড়ো কথা, রবির সঙ্গে আমার হৃদ্যতা শেষ হয়ে যাক, আমি চাইনি। এমন ক্ষেত্রে যা হয় তেমন করে দূরে সরে যাওয়া এবং কদাচিৎ মুখোমুখি হলে না দেখার ভান করা, অথবা কষ্টে হাসি ফোটানো, এর কোনোটাই আমি চাইনি। রীনাকে এ কথাই বোঝাতে চেষ্টা করেছি। অতীতকে ভুলে যাও বলবো এত বড়ো মূর্খ নই, তবু মানুষ তো পরিবর্তিত অবস্থার দাস। সব বুঝেও রীনা বলেছে, কী জানি, বুঝি না, মানুষের দুর্বলতার ওপরে তুমি কী করে যাবে। খাওয়ার টেবিলে বসার আগে রীনাকে বললাম, তুমি কি এখনও ওর সামনে যাবে না ভাবছ? রীনা স্থির চোখে কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে রইলো, তুমি খুব স্পষ্টতা পছন্দ করো মনি, তোমার কাছে এসে আমিও করতে শিখছি। আচ্ছা ধরো রবিকে দেখে, তার কথা শুনে, তোমরা যাকে সেলফ বলো সেই পুরোনো সেলফ যদি আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে চায়? বিবর্ণ আমি হেসে বললাম, তাকে বাধা দেবো না– সেই শক্তি কারও থাকে না। রীনা আমার মুখ থেকে চোখ নামালো না, তার দরকারও হবে না, তবু তোমার মতো অতো তাড়াতাড়ি এগোতে আমি পারি না। রীনা কি ইচ্ছা করে আমায় ধুলোয় টেনে নামাতে চাইছে? আর শোনো, এখন আমাদের ব্যক্তিগত কথাবার্তা কিছু কমালে ভালো হতো। আমি মলিন মুখে বললাম, আমিও তোমায় তাই বলবো ভাবছিলাম। বিকেলে, বাইরে বেরোনোর আগে রবি বলল, মনি, হোটেলে একটা জায়গা করে নিলে হতো না? আমি ভেবে বললাম, এত অল্পে ছেড়ে দেবো না রবি, আরও দেখা যাক। তুমি কি খুবই বিব্রত হচ্ছো? রবি আগের দিনের মতো হেসে আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, পাগল। চিয়ার আপ ওন্ড বয়। উইশ ইউ সাকসেস। সারাদিনে একবার হাসতে পেরে আমি বেঁচে গেলাম। পুরোনো দু’একজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে রবি শহরের অন্য মাথায় চলে গেলে আমি একবার বাসায় ফেরার কথা ভেবেছিলাম। রীনার কথা ভেবে অন্য পথে নেমে গেলাম। অথচ হাতে কোনো জরুরি কাজ ছিল না। কারও সঙ্গে দেখা করারও কথা ছিল না। অন্যদিন এমন অবস্থায় হয়তো বাসায়ই ফিরে যেতাম। হয়তো রীনাকে নিয়ে বাইরে বেরোতাম। লক্ষ্যহীন, একা একা সেই সব পথে ঘুরে বেড়ালাম যে-পথে আমি, রবি, রীনা সকলেই পায়ের দাগ রেখে গেছি। রীনার কথা ভাবছিলাম। সে আমাকে কেন ধুলোয় টেনে নামাতে চাইবে? যা স্বাভাবিক, যা ঘটে যায়, যা ঘটবে, যা আমরা সবাই জানি তাকে নিয়ে নাড়াচাড়া করে লাভ কী? রবির ফিরতে রাত হবে, সে বলে গেছিল। আমি আর কাঁহাতক একা একা পথ ঘুরবো? রাস্তায় সেদিন আলো ছিল না। কেবল দু’পাশের বাড়ির জানালায় পরদা দেখা যায়। বাগানের দরজা খোলা ছিল, নিঃশব্দে ঢুকে গেলাম। দেখলাম রবির ঘরে আলো। সে তাহলে আমার আগেই পৌঁছে গেছে। বাগানের ঠান্ডা হাওয়া অকস্মাৎ কয়েকটা ঝাপটা দিয়ে গেল। সমস্ত শরীর ঠান্ডায় কুঁকড়ে আসতে চায়। অথচ বিকেলে বেরোনোর সময় শীত লাগছিল না বলে গরম কাপড় বেশি নিইনি। ওরা আসলে আমার অনুপস্থিতিই চাইছিল। নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে নেবার প্রয়োজন তো আমিও অস্বীকার করিনি, তাহলে আমার অনুপস্থিতি এত কাম্য কেন? খোলা দরজা দিয়ে রীনার পেছন দিক দেখা যাচ্ছিল কেবল। একবার ভাবলাম, ফিরে যাই। না, ফিরবো কেন– যা ঘটে, যা ঘটবে, তাকে তুমি রোধ করতে পারো না, ঘুরে যাওয়া চাকাকে থামাবে কে? দরজার গোড়ায় শব্দ করে ঘরে ঢুকে গেলাম। রীনা চমকে ফিরে দাঁড়ালো। তার হাতের জিনিসপত্র দেখে বুঝলাম সে বিছানা গোছাতে এসেছে। ঘরে রবি নেই। সে তখনও ফেরেনি। কপালে অল্প ঘাম ছিল বোধ হয়। রীনা দ্রুত কাছে এসে, বুকের কাছে এসে, কপালে হাত রাখলো, এ রকম দেখাচ্ছে, শরীর খারাপ করলো না তো? খাটের ওপরে বসলাম। বসে, অনেকক্ষণ বসে থেকে বললাম, না, রীনা, দুর্বলতা সহজে যায় না তো। নিশ্চিন্ত হয়ে রীনা কী একটু ভাবল, বলল, দেখো, ভাবছি, রবি যে ক’দিন আছে তোমরা দু’জন এ ঘরেই শোবে। আমি কৃতজ্ঞতায় তার হাত চেপে ধরে বললাম, আমিও তাই ভেবেছি। রাতে খাওয়ার সময় রীনা আমাদের সঙ্গে ছিল। শিষ্টাচার, কিছু হালকা কথা দিয়ে দ্রুতগামী চাকাকে থামাতে চাইলাম আমরা। তবু কিছুই সহজ হলো না সে-ও বোঝা গেল। শোয়ার সময় লেপ হাতে নিয়ে পাশের খাটে এলে রবি আদৌ বিস্মিত হয় না। তার মুখে হাসির আভাস ছিল। বাতি নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। বললাম, রবি, আজ আর বেশি কথা নয়, ঘুমিয়ে পড়ো। রাতে তোমার ভালো ঘুম হওয়া দরকার। আমারও কাল ভোরে আপিসে ছুটতে হবে। দেয়াল থেকে ঘড়ির আওয়াজ ভেসে আসছিল। অনেক পরে হঠাৎ রবি শব্দ করে হেসে উঠলো। বিস্মিত আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আরে, কী ব্যাপার! অন্ধকারে রবির গলা ভেসে এলো, আচ্ছা, আমরা আর কতদিন বাঁচবো, মনি? 

 

আরও পড়ুন

×