জিজ্ঞাসা স্তব্ধ করাই বিদ্যাকারখানা ও রাজনীতির মূল কাজ

সমকাল
মানস চৌধুরী
প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০২৩ | ১৮:৩০
প্রশ্ন উত্থাপন করা বা জিজ্ঞাসার প্রবণতা নিয়ে সম্পূর্ণ উল্টা দুইটা মত শুনতে শুনতে বড় হতে হয় আমাদের। বড় হতে হতেও শুনতে হয়। আচ্ছা আমি এমনিতেই সমবেত বা প্লুর্যাল কণ্ঠস্বরে কথাবার্তা বিশেষ পছন্দ করি না। তাই ‘আমাদের’ পদটা বদলে ‘আমার’ করতে চাই। আমার এই অভিজ্ঞতা। এখন আমি কোন কথা কতটা গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করি, কোনটাতে নিজের আচার-আচরণ শোধরানোর চেষ্টা করি তা সম্পূর্ণ আলাদা জিজ্ঞাসা। আজকের আলোচ্য আমি নই। ‘প্রশ্ন করাই জ্ঞানের পথ’ এই মত শুনতে না শুনতেই ‘মুখে মুখে তর্ক করা ভাল নয়’ শোনা লেগেছে। সম্ভবত দ্বিতীয়টাই আগে শুনতে হয়েছে। এই যে সম্পূর্ণ উল্টা দুইটা মতামত কাছাকাছি সময়ে একই লোককে কামান দাগিয়ে শোনানোর ব্যবস্থা আছে, তার নামই সমাজ। আজ যদি শোনেন ‘চির উন্নত মম শির’, তো কালকে শুনবেন ‘ফলবান বৃক্ষ মাথা নুইয়ে থাকে’ (যার ভাবানুবাদ হলো, ‘ওরে আরেকটু আনুগত্য দেখা’!)। সমাজ নানান মতামতের এক কুচকাওয়াজ – কোনো তাল নেই, মিল নেই, সামঞ্জস্য নেই, সঙ্গতি নেই। আছে কেবল আওয়াজ। এমনকি প্রতিটা আওয়াজই নিজ-নিজ প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ঘোরতর ক্রুদ্ধ। আর এর মধ্যকার অজস্র আওয়াজই বাখোয়াজ।
প্রশ্ন-প্রণালী সহজাত তা আমার দাবি নয়। অন্তত আজকে সেই প্রতিপাদ্য সমেত কিছু করবার চেষ্টা করছি না। বরং, প্রশ্ন যে একটা অনুপাত ও কাণ্ডজ্ঞান প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জন্ম নেয়, এমনকি সবচেয়ে অপগণ্ড-অপছন্দনীয়-অবুঝ কারকের কাছ থেকেও, সেটা আমার প্রতিপাদ্য। এখানে বিশেষণগুলোও ধ্রুব অর্থে বলিনি। বলেছি, অন্যেরা বলতে থাকেন সেই প্রবণতাটাকে বিবেচনায় রেখে। আমার মনে হয় না, কোনো বিটকেল বা বেবুঝ শিশুও অভিভাবকদের ‘ইঁদুর কেন বিড়াল খায় না?’ প্রশ্নটা করে বসেন। তাঁরা যে সেটা করেন যে না তা তাঁদের উত্তরদানে পরিশ্রান্ত মা-বাবার প্রতি কোনো অনুকম্পাবশত নয়। বরং সম্ভাবনা আছে যে, ইঁদুর ও বিড়ালের দৈহিক আয়তন সম্বন্ধে একটা অনুপাতবোধ তাঁদের তদ্দিনে গড়ে উঠেছে। বরং, এই প্রশ্নটা খুবই সচরাচর হবার কথা যে, ‘বিড়ালে কেন ইঁদুর খায়’, যদি আদৌ ওই শিশুর বাড়িতে দুইটা প্রাণিরই আসাযাওয়া থেকে থাকে। তখন পিতামাতার বিড়ালের খাদ্যাভ্যাস, চাঞ্চল্য, অধিপতিসুলভ গাম্ভীর্য, ইঁদুর-জাতির প্রতি বিড়াল-জাতির ঐতিহাসিক বিদ্বেষ ইত্যাদি নিয়ে কথা বলা লাগতে পারে। আরও ক্রিয়েটিভ ধরনের মা-বাবা, এবং বিশেষে যদি অহিংসাকেই প্রতিষ্ঠা করতে চান, তাহলে খুঁজে পেতে টিভিতে টম-জেরি চ্যানেল চালিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু প্রশ্ন কখনোই নিছক শিশুশান্তকরণের বিষয়বস্তু ছিল না। তা সত্ত্বেও, শিশুদের নিয়ে আসার, যা আমার এই ‘সাহিত্য’ পাতায় প্রায় নৈমিত্তিক অভ্যাস, কারণ হচ্ছে জিজ্ঞাসাকারীদের মধ্যে মোটের উপর এই বয়সবর্গের মানুষকুল প্রিমাইজশাসিত থাকেন কম। কোন প্রশ্ন করা যাবে আর কোন প্রশ্ন করা যাবে না তার সামাজিক প্রশিক্ষণ কম থাকার কারণে প্রশ্নকারী হিসাবে এঁদের সার্বভৌমত্ব গড়ে বেশি থাকতে পারে। এসব কথা বলার মাধ্যমে জগতে শিশুদের একটা অটুট-অখণ্ড হিসাবে দেখার কোনোই আগ্রহ নাই আমার। আমি একটা তুলনামূলক সুবিধা নিয়ে কথা বললাম মাত্র। নাহলে শিশুরা ততভাবেই বর্গীকৃত যতভাবে বয়স্করা। শিশুদের সামাজিক শ্রেণী ঠিক সেটাই যেটাতে শিশুদের মালিক অভিভাবকদের অধিবাস। শ্রেণীবিচারে শিশুদের প্রশ্নাবলী গুরুত্বপূর্ণভাবে ভিন্ন হয়ে থাকে। বিড়াল-ইঁদুরের মতো শ্রেণী-নিরপেক্ষ উদাহরণের কারণে সেটা হয়তো ততটা ধরা পড়ল না। কোনো ছায়াছবিতে গরিব শিশুর ‘মা আমাদের টাকা নাই কেন?’ প্রশ্নটা আমাদের এই পত্রিকার পাঠকের শিল্পরসঘন মনে আর্দ্ররস সৃষ্টি করবে তাতে কোনো সন্দেহ নাই, কিন্তু রাস্তাঘাটে এরকম প্রশ্ন করতে-করতে মায়ের বা বাবার সাথে হাঁটতে-থাকা শিশু দেখার জন্য কেবল আমাদের তাকানোই যথেষ্ট হবে। গুরুভার আলাপের ক্ষেত্রে প্রশ্ন আর জিজ্ঞাসা শব্দদুটোর মধ্যে আমার, যদি আদৌ গুরুভার আলাপ আমি পারি বলে আপনারা গণ্য করেন, জিজ্ঞাসার প্রতি পক্ষপাত কেন তা নিয়ে আমি ভেবেছি। হতে পারে ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন পরীক্ষায় ওই লেটারপ্রেসের কাগজগুলোতে ৮-১০টা করে প্রশ্ন দেখে দেখে বিদ্বান হবার চাপে (বা ভারে) আমার প্রশ্ন শব্দটার প্রতি মায়া কেটে গেছে। তুলনায় জিজ্ঞাসা শব্দটিকে ভারসম্পন্ন মনে হয়। দুটোতেই যুক্তাক্ষর আছে তা সত্য। কিন্তু তালব্য ‘শ’-এর সাথে নিছক দন্ত্য ‘ন’-এর সঙ্গম আর বর্গীয় ‘জ’-এর সাথে এর নিকট প্রতিবেশী ‘ঞ’-এর সঙ্গমের ধ্বনিগত ফলাফল গুরুতর ভিন্ন। ওই ভারটা ছাড়াও কাব্যজগতে ‘জিজ্ঞাসা’ বেশ গুরুত্ব নিয়ে আমার কানে ধরা পড়েছিল। হতে পারে সবচেয়ে বেশি ঘটেছে ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন’ পদটি পড়ে এবং শুনে। ততদিনে যতবার হিন্দু পরিচয়সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে, ওই শিশুকালেই, তাতে কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও আবেগেও জিজ্ঞাসা শব্দটির তুল্য গুরুভার গ্রহণ করে থাকতে পারি। হয়তো! যাঁরা প্রশ্নের জ্ঞানপ্রবাহমূলক শক্তিকে দেখেন তাঁরা মহৎ তাতে সন্দেহের অবকাশ কম। কিন্তু জগতে প্রশ্নের বহুবিধ চরিত্র। ওই বিভিন্ন ক্লাসের পরীক্ষায় করা প্রশ্ন তো আছেই। বিসিএসের প্রশ্ন নিয়ে কিছু রঙ্গতামাশা করার কারণে আমি খুবই সাইবার-নিন্দিত। সেগুলো নিয়ে আর নতুন করে বিপদ না-ডাকি বরং। ইন্টারোগেশনের বাংলা করা হয়েছে জিজ্ঞাসাবাদ। এতে আমার প্রিয় জিজ্ঞাসার কিছু নিষ্ঠুরাকৃতি তৈরি হলেও, ভাল তর্জমা বলে মানতে হবে। এখানে ‘আবাদ’ শব্দটির অর্থগত কোনো সম্পর্ক আছে কিনা আমার খোঁজ নিতে হবে, কিন্তু শুনতে ধ্বনিতে যে আবাদ আছে সেটার কারণেই খুব ভাল তর্জমা মনে হয়। এই ‘আবাদ’টা চটকানিসম। শুনলেই যেন বোঝা যায় ‘হুমম চলতেছে ধোলাই’। বস্তুত, পুলিশ মিলিটারি ও অধুনা র্যাবের এই আবাদে ফসলও কম হচ্ছে না। তবে এটা খুবই দুঃখজনক যে এত রকমের এটা-ওটা ফাঁস হলেও কোনো একটা ‘পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের’ অডিও-ভিডিও ফাঁস হচ্ছে না। অন্তত বস্তুটার যাঁরা মুখোমুখি হননি (বিধাতা সহায় হোন) তাঁদের জন্য একটা ডেমো থাকেত পারত। ইন্টারভ্যুর বাংলা সাক্ষাৎকার করা হয়েছে। আমার কোনো সমস্যা লাগে না এতে। ইদানীং আন্তর্জালিক ও ফোনাফুনিমূলক ইন্টারভ্যু এসে বাংলা ‘সাক্ষাৎ’ শব্দটির সাক্ষাৎ বিপর্যয় ঘটিয়েছে। এছাড়া ঠিকঠাকই। কিন্তু চাকরির ইন্টারভ্যু আর পত্রিকাতে ছাপা হবে বলে জীবনযাপন-জ্ঞানদর্শন-সাফল্যমাপন ইত্যাদির ইন্টারভ্যুকে ইংরাজরাও কীভাবে এক শব্দ দিয়ে চালালেন সেটা একটা রহস্য। হতে পারে এই শব্দটার আবিষ্কর্তাদের নিজেদের কখনো কোনো চাকরির ইন্টারভ্যুতে চাকরি পাবার আশায় বসা লাগেনি। আর যাই হোক, ওরকম অভিজ্ঞতার পর সংস্কৃতিচর্চামূলক সাক্ষাৎকার আর চাকুরিপ্রার্থীর সাক্ষাৎকারকে এক শব্দে চালানোর দুর্মতি কারো হবার কথা নয়। সেই দিক থেকে আমার খুবই ঠিকঠাক লাগে যখন দেখি নতুন স্নাতকদের অনেকেই চাকরির ইন্টারভ্যুকে ‘ভায়ভা’ বলেন। আমার ধারণা ‘ভায়ভা’ বা মৌখিক পরীক্ষার মধ্যে তাঁরা অন্তত সদ্য অভিজ্ঞাত স্নাতকের বোর্ডগুলোতে হাস্যরসবিবর্জিত অধ্যাপকদের পৌনঃপুনিক প্রশ্ননিক্ষেপ (এবং প্রায়শই প্রশ্ন খুঁজে না পেয়ে পরীক্ষার লিখিত প্রশ্নের দিকে দৃকপাতকরণ) অভ্যাসের মধ্যকার যে নিগ্রহ ও হাবলাপনা আছে সেটার দ্যোতনা খুঁজে পান। আমি নতুন স্নাতকদেরকে আর জিজ্ঞাসাও করি না ‘তা আপনার চাকুরির ইন্টারভ্যু কবে?’, বরং ‘মৌখিক হয়েছে?’ এরকম একটা প্রশ্ন দায়িত্বশীল শিক্ষক হিসাবেও সঙ্গত মনে হয়। কিন্তু এতেই সব শেষ হচ্ছে না। গুরুজন আর লঘুজনের প্রশ্ন সবিশেষ আলাদা। বলাই বাহুল্য, লঘু আর গুরু সকল সময়েই রাজনৈতিক; এমনকি বাংলা শাস্ত্রীয় ব্যাকরণে গুরুচণ্ডালীও পরিশেষে রাজনৈতিক এলাকাই। এখানে লঘুজনের প্রশ্ন অবধারিতভাবে অজ্ঞতাপ্রসূত কিংবা আপত্তি/চ্যালেঞ্জপ্রসূত হিসাবেই বিবেচিত হবে। মানে ইংরাজিতে যাকে বলে মোর অফেন দ্যান নট, এই মূল্যেই লঘুজনের প্রশ্নকে গুরুজন বা গুরুজন-প্রণালী/ব্যবস্থা/নেক্সাস গ্রহণ করে থাকেন, কমবেশি। অজ্ঞতাপ্রসূত হলে তো এর পর ৩৩ বইয়ের হদিশ শোনানোর ব্যবস্থা করবেন গুরুজন। আর যদি আপত্তি হিসাবে দেখেন, তখন যদি গাম্ভীর্যহেতু মুখে নাও বলেন, অধিকাংশ গুরুর মস্তিষ্কেই এসব প্রশ্ন বিরাজে: ‘তুই আমার থেকে বেশি বুঝস?’, কিংবা ‘তর পাংখা গজাইছে?’, ‘এত সাহস পাইলি কই?’, ‘মুখে খই ফুটছে?’, ‘এখন তোমারে আমার ব্যাখ্যা করতে হবে, এত খারাপ দিন আসছে আমার?’ ইত্যাদি। এখন কোন গুরু এটা উচ্চারণ করছেন আর কোন গুরু করছেন না সেটা সম্পূর্ণ আলাদা প্রসঙ্গ; আর সেখানেই রয়েছে গুরুর রুচি ও কর্মপদ্ধতির বিষয়। গুরু রুচিদার হলে উচ্চারণে না বলতে পারেন, গুরু চামেচিকনে-সাইজ-করা পদ্ধতির হলেও না বলতে পারেন। কিন্তু মোটের উপর লঘুজনের প্রশ্নকে আপত্তি হিসাবে দেখা এবং সেই আপত্তিতে মাথাভর্তি রাগে-কিলবিল পাল্টা-প্রশ্ন সৃষ্টি খুবই সাধারণ ঘটনা। আগে যদি কেউ লক্ষ্য করে নাও থাকেন, নিশ্চয়ই এটুকু পড়ার পর একদম সহজেই বুঝতে পারলেন। আমি এত কিছু বুঝলাম কীভাবে? খুবই সহজ। আমি আগে বোকা ও ‘প্রকৃত শিশু’ প্রশ্নকারী ছিলাম। পরে আমি পাকা ও প্রায়-পদ্ধতিগত প্রশ্নকারী ছিলাম। এরপর আমি অতিপাকা ও মহাচ্যালেঞ্জার প্রশ্নকারী হলাম। এরপর প্রশ্ন নিয়ে আমি যে কই কই কীভাবে কীভাবে যে আরও আরও বিকশিত হব তা বুঝতে না পেরে মৃদুহাস্য প্রশ্নহীন কালও কিছুকাল কাটিয়েছি। সব মিলে প্রশ্নের দুনিয়ার ঘোরপ্যাঁচ ও কারিগরি আমার নখদর্পণে চলে এসেছে। প্রশ্নকারীবৃন্দের প্রতি গাঢ় মমত্ব ও সংবেদ সৃষ্টি হয়েছে। আর দর্শন ও জ্ঞানের দুনিয়ায় (এমনকি আধ্যাত্মদর্শন সমেতই বলছি) বাহাস/বিতর্ক/জিজ্ঞাসার প্রতি যেসব পক্ষপাতের ঘোষণা আছে সেগুলোকে ফালতু হিসাবে সাব্যস্ত করেছি। প্রশ্নহীন থেকে আপত্তি জারি রাখার ভঙ্গিও এখন আমার মজ্জাগত। এই হলো বিষয়!