দুই কথাশিল্পী
দূরদর্শী চিন্তার জগৎ

হাসান আজিজুল হক ও হুমায়ূন আহমেদ
মোহিত কামাল
প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৩ | ০০:০৩ | আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২৩ | ০০:০৩
শজারু-মুকুটধারী অণুজীব করোনা ভাইরাসের সর্বগ্রাসী ধ্বংস ও মারণছোবল বা বিশ্বমারির কথা আমাদের সময়ে তো মনে রাখতেই হবে, মহাকালও ভুলে যেতে পারবে না বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু আর গৃহবন্দি হয়ে যাওয়ার কথা।
চীন দেশের উহান থেকে ২০১৯ সালে শুরু হয়েছিল এই অদৃশ্য ভাইরাসের ভয়াল যাত্রা। স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারে না তারা। বাঁচার জন্য তাদের আশ্রয় নিতে হয় মানুষের গলায়, ফুসফুসে। করোনা প্রসঙ্গটি কেন তুলে ধরলাম হুমায়ূন আহমেদের গল্পবিষয়ক আলোচনায়? বাংলা কথাসাহিত্যের এই অনন্য কথাকার মারা গেছেন ২০১২ সালে, বিশ্বমারি তিনি দেখেননি, অথচ লিখে রেখে গেছেন একটি অতিপ্রাকৃত গল্প ‘ভাইরাস’। কোভিড মহামারি– পরবর্তী সময়ে ‘ভাইরাস’ গল্পটি আবার পড়তে গিয়ে চমকে গেছি। এর ‘ভ্যাম্পায়ার’ চরিত্রের রূপ আর করোনা-সম্রাটের ধ্বংসলীলার মধ্যে সাদৃশ্য খুঁজে পেয়ে পাঠক হিসেবে অন্য চোখ খুলে গেছে।
ইংরেজ লেখক জন পোলিডোরি রচিত ‘দ্য ভ্যাম্পায়ার’ (১৮১৯) বইটির মাধ্যমেই আধুনিক কথাসাহিত্যের ভ্যাম্পায়ার-ধারণার সূত্রপাত ঘটে। ব্রাম স্টোকার রচিত ‘ড্রাকুলা’ উপন্যাসটি (১৮৯৭) আধুনিক ভ্যাম্পায়ার চরিত্রের মূল ভিত রচনা করেছিল, যা পরবর্তীকালে কথাসাহিত্যে স্বতন্ত্র ধারার জন্ম দেয়। ভ্যাম্পায়ার ইউরোপীয় লোককথার এক আজব চরিত্র; জীবিত মানুষের প্রাণরস বা রক্তরস শোষণ করে জীবনধারণ করে। হুমায়ূন আহমেদ ব্যতিক্রমী সৃজনক্ষমতার অধিকারী। তিনি উক্ত উপন্যাস দুটির তুলনায় একদম ভিন্নভাবে ভ্যাম্পায়ার চরিত্র সৃষ্টি করেছেন ‘ভাইরাস’ গল্পে।
আশ্বিন মাসের এক দুপুরে লালবাগের কেল্লায় দিল্লি রেস্টুরেন্টে ঢুকে ইলিশ মাছ, সবজি এবং ডালের অর্ডার দিয়ে চুপচাপ বসে আছেন বীমা কোম্পানি থেকে অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ নুরুজ্জামান। তখন এক কাস্টমার এসে ঢোকে। তার সামনে এসে বসে। আগন্তুকের চোখে সানগ্লাস। নানা কথোপকথনের মধ্য দিয়ে প্রথমে নুরুজ্জামান সাহেবের মনে হয়েছিল এই কাস্টমার এক ধান্দাবাজ। ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও লোকটির সঙ্গে কথা চলতে থাকে। হুমায়ূন আহমেদের সহজাত সাহিত্যধারার সংলাপ এখানে আকর্ষণীয়ভাবে পাঠকমনে চুম্বক টান তৈরি করে : “...স্যার মনে হচ্ছে আমার প্রতিটি কথায় বিরক্ত হচ্ছেন। আমার পরিচয় পেলে মনে হয় আপনি আর বিরক্ত হবেন না। আমি একজন ভ্যাম্পায়ার।”
‘ভাইরাস’ গল্পে আছে— “লোকজ বিশ্বাস হচ্ছে ভ্যাম্পায়ার রাতে মানুষের রক্ত খেয়ে বেড়াবে, দিনে কফিনের ভেতর শুয়ে থাকবে।
কারণ রোদ গায়ে লাগা মানে তাদের মৃত্যু। আমাকে দেখুন দিনে ঘুরে বেড়াচ্ছি।” লোকটা আরো বলল, ‘শুধু চোখগুলো প্রটেক্ট করতে হয়। চোখে রোদ লাগানো যায় না।” নুরুজ্জামান সাহেব প্রশ্ন করলেন, “এজন্যই সানগ্লাস?”
“ঠিক ধরেছেন।”
“মানুষের রক্ত আপনি কখন খান? দিনে না রাতে? মানুষের রক্ত খান তো?”
“জি খাই। বাধ্য হয়ে খেতে হয়। ভ্যাম্পায়ারদের জন্য কিছু এসেনশিয়াল ভিটামিন মানুষের রক্ত ছাড়া পাওয়া যায় না।’
লোকটার কথা থেকে ক্রমশ উঠে আসে, “ভ্যাম্পায়ার আসলে ভাইরাসঘটিত এক ধরনের অসুখ।” লোকটি বলে যায়, “ভাইরাসগুলো অতি দীর্ঘজীবী। এরা বিশেষ ধরনের মৃত্যুহীন ভাইরাস। মানুষের শরীরে একবার ঢুকতে পারলে তারা আর মরে না। এবং যার শরীরে তারা ঢুকছে তাকে বাঁচিয়ে রাখে নিজেদের বাঁচার স্বার্থে।” আরো বলে, আগে ভ্যাম্পায়ার ভাইরাসাক্রান্তরা সরাসরি মানুষের শরীর থেকে রক্তপান করতো বলে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ত। এখন তারা ব্লাডব্যাংক থেকে রক্ত সংগ্রহ করে পান করে, তাই এই ভাইরাসের সংক্রমণ কম।
“আপনি কতদিন ধরে বেঁচে আছেন?”
“প্রায় তিনশ বছর।”
কথোপকথন এগিয়ে যায়। এক পর্যায়ে নুরুজ্জামানকে ভ্যাম্পায়ার ভদ্রলোক বলেন, “আজ যখন আপনাকে লালবাগের কেল্লায় দেখলাম তখন আপনাকে ভ্যাম্পায়ার ভেবেছিলাম।” হতভম্ব নুরুজ্জামান ক্ষেপে উঠলেন।
“ভ্যাম্পায়ারের লক্ষণ কী?”
“লক্ষণ খুব সহজ। ভ্যাম্পায়ারদের রোদের ছায়া পড়ে না।”
নুরুজ্জামান সাহেবের সঙ্গে রেস্টুরেন্টে আসা অদ্ভুত কাস্টমারের আলাপচারিতার শেষ পর্যায়ে পাঠক দেখেন : লোকটা চলে যাওয়ার পর নুরুজ্জামান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে যখন হোটেলের বিল মিটিয়ে বাইরে এলেন, কৌতূহল থেকেই নিজের ছায়ার দিকে তাকিয়ে দেখেন– আশ্চর্য, তার কোনো ছায়া নেই! অন্যদের দিকে তাকালেন– সবার ছায়া আছে। শুধু তার নেই।
করোনাভাইরাসের তাণ্ডব চলাকালে আমরা দেখেছি, ট্রান্সমিশন বা রোগছড়ানো বন্ধ করার জন্য বিশ্বের সমস্ত মানুষ মূলত গৃহবন্দি হয়ে গিয়েছিল। মানুষের দেহটাকে আশ্রয় করে বাঁচে বিধায় দেহ না-পেলে তাদের মৃত্যু অবধারিত। ভ্যাম্পায়ারও মানুষের রক্ত না-খেতে পারলে, মানুষের দেহে আশ্রয় না-নিতে পারলে বিলীন হতে বাধ্য। গল্পটি সরল রেখায় তাঁর দূরদর্শী চিন্তার জগৎ আমাদের সামনে উন্মোচিত করে এবং এর ভেতরে রয়েছে গভীরতর দর্শন। নিজের মধ্যেও ভ্যাম্পায়ারের বৈশিষ্ট্যের আলামত দেখেছেন কি তিনি? প্রতিটি মানুষের মধ্যেই কি তবে রয়েছে ভাইরাসজনিত ভ্যাম্পায়ার অসুখ? ছোট্ট আখ্যানটুকুনকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করা যায়; মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতা আর নির্মমতার প্রতিচিত্র পাওয়া যায়, যে বৈশিষ্ট্যগুলো লুকিয়ে থাকে অতলে-অবচেতনে। মানুষের ভেতরের এই হিংস্র গোপন ভাইরাস সুযোগ পেলেই প্রকাশ পেয়ে যায়, চারপাশকে লন্ডভন্ড করে দেয়, যা আমরা দেখছি বিশ্বজুড়ে।
অসাধারণ রূপকল্প। জীবন জিজ্ঞাসার ভেতর থেকে লেখক বিজ্ঞান আর দর্শনচিত্র উপহার দিয়ে গেছেন।