দুই কথাশিল্পী
মানুষই মানুষের গা ঘেঁষিয়া বসিয়া থাকে

হাসান আজিজুল হক ও হুমায়ূন আহমেদ
আহমাদ মোস্তফা কামাল
প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৩ | ০০:০৪ | আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২৩ | ০০:০৪
হাসান আজিজুল হকের খুব ভিন্ন ধরনের একটি গল্প ‘সাক্ষাৎকার’-এর কথা বলি। এটি এমন এক গল্প, যা হাসানের ‘সমাজ-সচেতন’ ‘শ্রেণি-সচেতন’ ‘রাজনীতি-সচেতন’ ইমেজের সঙ্গে যায় না, যদিও গল্পটি গভীরভাবে রাজনৈতিক। অবশ্য একে আপনি অস্তিত্বের সংকটজনিত দার্শনিক গল্প হিসেবেও পড়তে পারেন।
যে ‘লোকটা গত শতাব্দীর কায়দামাফিক সূর্যাস্ত দেখছিল’ আর ‘তার চোখে ফুটে উঠেছিল তন্ময় কল্পনা’ তাকে ধরে নিয়ে যায় কতিপয় অচেনা লোক, তাকে ‘রহমান সাহেব’ সম্বোধনে শুরু হয় জেরা, যদিও তার নাম রহমান নয়, হুমায়ুন কাদির। তারা ঠিক কী জানতে চায়, পুরো গল্পে তা পরিষ্কার হয় না, বোঝা যায় তারা তার কাছ থেকে একটি স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করছে, কিন্তু কিসের স্বীকারোক্তি তা-ও বোঝা যায় না। বরং তাদের মুখে শোনা যায়–
বুঝতে পারছি আপনি কিছুই স্বীকার করতে চান না। তাতে কিছুই এসে যায় না অবিশ্যি। কারণ, আমরা সবই জানি কাজেই আর কিছু জানার নেই। কারণ, আমরা কিছুই জানি না। অতএব আর কিছুই জানার নেই।
এ রকম পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা আর রহস্যময় আচার-আচরণ পাঠককে বিমূঢ় করে তোলে। মনে হয়, যেন কোনো অ্যাবসার্ড নাটকের মহড়া চলছে।
গল্পটি লেখাও হয়েছে অ্যাবসার্ড নাটকের ফর্মে, যেখানে মানুষের সবকিছু জুড়ে অর্থহীনতা, সব প্রয়াস তুচ্ছ, অকিঞ্চিৎকর, এমনকি পরস্পরের সঙ্গে ইতিবাচক যোগাযোগ স্থাপনেও অক্ষম। কারণ, আমাদের ভাষা কেবল এক শূন্যগর্ভ স্লোগান, বহু ব্যবহারে জীর্ণ, ক্লিশে, পচে যাওয়া অর্থহীন শব্দাবলির সমষ্টিমাত্র। আমাদের জীবনও ক্লিশে আক্রান্ত, হাস্যকর, অবান্তর, উদ্ভট, তাদের মানবিক অস্তিত্ব নিষ্ফল, লজ্জাকর, ব্যর্থ। পারম্পর্যহীন কথাবার্তার আরেকটি উদাহরণ তুলে দেওয়া যাক–
আমরা নিজেরা নিজেরা একতা আইনশৃঙ্খলা, দাঁড়িয়ে বসে বা মাটিতে শুয়ে যদি তা কোনোদিন দেখিয়ে দিতে পারি একসঙ্গে একসঙ্গে যে যেখানে আছে ঠিকঠাক পরিকল্পনা ঘাসে ভিটামিন জনকল্যাণ বন্যা প্লাবন মহামারি বাঁধ দাও লবণ ঠেকাও যত রকম চালবাজি রকবাজি ঠকবাজি নিলামবাজি জোতদারি মুনাফাখোরি খুন জখম রাহাজানি ভাবনাচিন্তা জাতীয় প্রেস দুই আর দুইয়ে চার আর সাতে ষোলো যার ফলে ছেষট্টি মোট তিনশ তেত্রিশ কোটি দেশি বিদেশি চাল গম আটা সব মিলিয়ে সব।
হুমায়ুন কাদির এসব কথাবার্তা-জিজ্ঞাসাবাদ-আচার-আচরণ কোনোকিছুরই অর্থ উদ্ধার করতে পারে না, পারি না আমরাও। অবশেষে অজানা অপরাধে হুমায়ুন কাদিরের মৃত্যুদণ্ড হয়, এবং দণ্ড কার্যকর করার আগে তাকে দু মিনিট ভাববার সুযোগ দিলে সে ভাবে–
অনেককাল আগে একবার সবুজ ঘাসের মধ্যে শুইয়া আকাশের দিকে চাহিয়াছিলাম। উহার এক প্রান্ত হইতে অন্য প্রান্ত দেখা গিয়াছিল, উহা হালকা নীল ছিল। পরে উহা চুম্বনের দাগের মতো মিলাইয়া যায়। ইহার পর মানুষের জগতে ফিরিয়া আসি– তাহাতে নোনা টক গন্ধ আছে এবং আক্রোশ ও ঘৃণা রহিয়াছে এবং ভালোবাসা ও মমতা রহিয়াছে। মানুষের জীবনে কোথায় অন্ধকার তাহার সন্ধান করিতে গিয়া আমি ঘন নীল একটি ট্যাবলেটের সন্ধান পাই– মানুষ যে সামাজিক, সে নিজের ইতিহাস জানিতে চাহিয়াছে, তাহাতে সর্বদাই অন্ধকার নর্তনকুর্দন করিতেছে। তবু আমি মানুষেরই কাছে প্রার্থনা জানাইব– কারণ মানুষেই মানুষের গা ঘেঁষিয়া বসিয়া থাকে– যদিও ওই দাগ দেখা যায় না। অসংখ্যবার সংগম করিয়াও যেমন আমি নারীতে ঐ দাগ কখনও দেখি নাই। কোথাও কিছু পাই না বলিয়াই বাধ্য হইয়া আমি শেষ পর্যন্ত মানুষের কাছেই প্রার্থনা ও আবেদন জানাইব। ইতিমধ্যে সবকিছু চমৎকার ঘটিয়াছে। অবশ্য অনেক কিছুই বাকিও রহিয়া গেল কারণ কিছুই শেষ হইবার নহে।
আমরা যে অ্যাবসার্ডিটির ভেতরে বাস করি, বিনা কারণে, অজানা অপরাধে আমাদের মৃত্যুদণ্ড হয়ে যায়, আমাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করা হয় কিন্তু আমরা বুঝেই উঠতে পারি না যে, আমাদের কাছে আসলে কী জানতে চাওয়া হচ্ছে– তার একটি প্রতীকী উপস্থাপন রয়েছে এই গল্পে। তবে সান্ত্বনা ওটুকুই– যা কিছুই ঘটুক না কেন, মৃত্যুমুহূর্তেও কোথাও কিছু পাইনি বলে আমরা মানুষের কাছেই প্রার্থনা ও আবেদন জানাব, কারণ মানুষই মানুষের সর্বশেষ আশ্রয়! কারণ মানুষই মানুষের গা ঘেঁষিয়া বসিয়া থাকে!