দুই কথাশিল্পী
উত্তর বসন্ত পেরিয়ে

হাসান আজিজুল হক ও হুমায়ূন আহমেদ
মাসউদ আহমাদ
প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৩ | ০০:০৬ | আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২৩ | ০০:০৬
বাংলা ভাষার অন্যতম
প্রধান কথাশিল্পী
হাসান আজিজুল হক
[২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯–
১৫ নভেম্বর ২০২১] ও হুমায়ূন আহমেদ
[১৩ নভেম্বর ১৯৪৮–
১৯ জুলাই ২০১২]।
দুই কথাশিল্পীর গল্প নিয়ে উত্তর প্রজন্মের ছয় কথাশিল্পীর গদ্য...
হাসান আজিজুল হকের সাহিত্যের বড় অংশজুড়ে আছে দেশভাগের যন্ত্রণা ও পটভূমি আর তার আলো-অন্ধকার। বড় বলতে কেবল আকারেই বড় নয়, প্রকারেও বিপুল, বিস্ময়কর। দেশভাগের কথা ও ভাবনা নিয়ে হাসান সুপ্রচুর লিখছেন, তা নয়। কিন্তু বিষয়টি এক আশ্চর্য নিয়তির মতো তাঁর করোটিতে ঘাপটি মেরে থেকেছে।
দেশভাগের পটভূমিতে হাসান প্রথম লেখেন ‘উত্তর বসন্তে’ গল্প, ১৯৬২ সালে। এটা খুব আলোচিত নয়। ১৯৬৬ সালে লিখলেন ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’। এই গল্পটি এমন বিপুল ও বিস্ময়করভাবে তাঁর প্রধানতম গল্প এবং সাহিত্যিক ভিত্তি হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে, আরও নানা ধরনের চমৎকার গল্প তিনি লিখেছেন, কিন্তু আত্মজাকে ছাপিয়ে কোনো গল্পই সেভাবে উচ্চকিত হয়নি। একমাত্র ‘আমৃত্যু আজীবন’ ছাড়া।
‘উত্তর বসন্তে’ গল্পটি দেশভাগের প্রেক্ষিতে তাঁর প্রথম গল্প। বুঝতে অসুবিধে হয় না, দেশভাগের মর্মন্তুদ দহন ও দায়কে গল্পের ক্যানভাসে ধরতে তিনি চেয়েছেন গভীর ও তীব্র ব্যঞ্জনায়। এ নিয়ে তাঁর দীর্ঘ প্রস্তুতি ও একরোখা ভাবনা জিইয়ে ছিল। ১৯৬২ থেকে শুরু করে ১৯৬৯ সময়ের মধ্যে তিনি পাঁচটি গল্প লিখেছেন। কিন্তু হাসানের ভাবনা ও রক্তক্ষরণ ফুরোয়নি। ২০০৬-এ দেশভাগের পটভূমিতেই তিনি লিখলেন উপন্যাস ‘আগুনপাখি’। বোঝা যায়, দেশভাগ তাঁর স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে এমন জাপটে ধরে রেখেছিল, কখনও বেরোতে পারেননি। বেরোতে হয়তো চানওনি।
ভাদ্র মাসের অন্ধকার রাতের তুমুল বৃষ্টি, ঝড়, গর্জন আর অনিশ্চয়তার ভেতর একটা বাড়ির বর্ণনা দিয়ে শুরু হয় গল্পটি। এখানে জীবন, সময় ও পরিস্থিতির আর একরকম উন্মোচন দেখতে পাই। দেশভাগের ফলে সৃষ্ট উদ্ভট বাস্তবতার ভেতর আটকা পড়া একটা পরিবার নিজেদের বাড়িতেই কী আশ্চর্য রকম জীবনকে যাপন করছেন, হাসান চমৎকার ও বিশ্বস্ত রেখাচিত্র তৈরি করেছেন। এমন অন্ধকার বাড়ি, যেখানে দিনের বেলায়ও অন্ধকার কাটে না। বাড়ির এক-একটা ঘর এত বড় ও বিদঘুটে, হারিকেনের আলো ঘরের এক কোণের অন্ধকারই দূর করতে পারে না। মা সারাক্ষণ অসন্তুষ্ট গলায় সংসারের সব কাজ করে চলেছেন আর বলছেন, আমার কেন মরণ হয় না।
একঘেয়ে বিমর্ষ ভেজা গলায় মৃদুস্বরে তিনি বকবক করতে থাকেন– এই জঙ্গলে মানুষ বাস করে, ছি! বুড়ো বয়সে এত নাকাল আমার ছিল? কেন আমার মরণ হয় না?
বাবার মূর্তিটা আরেক রকম। সারাক্ষণ ঘরে শুয়ে থাকেন। এমনকি দিনের বেলায়ও ঘরের দরজা-জানালা খোলেন না এবং মশারির ভেতরে বিছানায় ঘাপটি মেরে বসে থাকেন। সারাক্ষণ রেগে থাকেন। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে রাগ করেন। কিছু খেতে দিলে রাগ দেখান। শব্দ করে কেউ কথা বললে ক্ষেপে যান। তাঁর ঘরটা নীরব ও স্তব্ধ হয়ে থাকে। সেই স্তব্ধ ঘরের ভেতর থেকে বৃদ্ধের রুগ্ণ গলা শোনা যায়– মহাপাপ করেছি জীবনে, মহাপাপ করেছি, না হলে এত কষ্ট হয় আমার? আর আমার ভাগ্যেই যত সব অপদার্থ জন্মায়?
ছেলেমেয়েরাও বিব্রত ও কুণ্ঠিত। অচেনা পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে পারছে না। তারই মধ্যে বাবা ও মায়ের একটানা নির্দয় ও উদ্ভট ব্যবহার। ‘উত্তর বসন্তে’তে দেশভাগের বিধিলিপিতে পরিবারটা এমন এক বাড়িতে এসে পড়েছে, যেখানে বাঁচার কোনো আনন্দ নেই, অর্থ নেই। চারপাশে ম্যাড়মেড়ে অন্ধকার।
গল্পের এই বাড়ির লোকজনের কথা ও জীবনযাপনের ধরন রহস্যময়। তারচেয়ে রহস্যময় বাড়িটাই। এক-একটা ঘর এমন বড়, অন্ধকার; গোলকধাঁধার মতোন। সব ঘর খোলাও হয় না। বাবার অনুমতি নেই। একসময় অন্ধকার কাটতে শুরু করে। অন্ধকার সরিয়ে বাড়িতে আলোর রেখা নিয়ে আসে মেয়েটা, বাণী। সে এ বাড়ির বড় মেয়ে।
নিঃসঙ্গ এক বাড়ি, যেখানে কেউ বেশিদিন থাকতে চায় না। এমনকি কাজের লোকও নয়।
বড় মেয়েটাই কেবল দিনযাপনের গ্লানি ও মন্দ সময়ের ভেতর দিয়েও কলেজে যায়। স্বপ্ন দেখে, পড়ালেখাটা শেষ করে বাবা-মার জন্য কিছু করবে। সে বিএ স্নাতক পড়ে। কলেজের শিক্ষক একদিন বাড়িতে এলে বাবা হুলস্থুল ব্যবহার করেন। গল্প শেষ হয়, কিন্তু পাঠকের আর্ত ও উদাসীন মন আরও কাতর হয়ে পড়ে।