বন্যায় সব হারানো রাহেলা এখন সফল উদ্যোক্তা

ছবি- সমকাল
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৩ | ০৫:২৫ | আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২৩ | ০৫:২৫
প্রায় ১ সপ্তাহ ঘরের ভেতরে কোমর সমান পানি। ঘরে স্বামী ৪ ছেলে ও এক মেয়েসহ সাতজন মানুষের অনাহারে বা অর্ধাহারে কোন ভাবে বেঁচে থাকা। কোথাও গিয়ে যে ঠাঁই নেবেন সে উপায়ও নেই। বাধ্য হয়ে ঘরেই আটকে থাকতে হয়েছে। দুই বছর আগের বন্যার দুসহ স্মৃতি এভাবেই বর্ণনা করছিলেন সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের বালিছড়ি ইউনিয়নের লোহার চূড়া গ্রামের রাহেলা বেগম। তাঁর বয়স ৫৫ বছর। অনেক বন্যাই তিনি দেখেছেন, কিন্তু দুই বছর আগের বন্যার কথা ভুলতে পারেন না কিছুতেই। রাহেলা বলছিলেন, বন্যায় একে একে গবাদিপশু, ফসলের খেত, ঘর-বাড়ি ডুবে যাওয়ায় রাহেলার পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়। যখন তাঁদের থাকার জীর্ণ ঘর ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। সেই সময় তাঁর পাশে এসে দাঁড়ায় লোকাল গভর্নমেন্ট ইনিশিয়েটিভ অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (লজিক) প্রকল্প।
লজিক প্রকল্পটি মূলত ইউএনডিপি বাংলাদেশ, ইউএনসিডিএফ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, সুইডেন এবং ডেনমার্ক সমর্থিত একটি যৌথ উদ্যোগ। এটির লক্ষ্য হল নির্বাচিত জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন সমাধানের পরিকল্পনা ও অর্থায়নের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান এবং সুশীল সমাজ সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
এই প্রকল্প থেকে নগদ অর্থ সহায়তা ও পশু পালন সম্পর্কিত বেশ কিছু প্রশিক্ষণ পেয়ে রাহেলা ভেড়া কেনেন। সেখান থেকে একটা দুইটা করে সাত আটটা ভেড়া হয়ে যায় তাঁর। সেগুলো বিক্রি করে আবার ছাগল, হাঁস, মুরগি কিনে পালতে থাকেন। লাভের টাকায় জমিতে ধান লাগান। সন্তানদের পড়াশোনা কিছুদিন বাদ থাকলেও টাকা করা আয় শুরুর পর তাঁরা আবার স্কুল ও কলেজে ফিরতে শুরু করে। রাহেলা বলেন, 'ওই সময় হাঁস মুরগির ডিম বেঁইচা ছেলেমেয়েরে লেখাপড়া করাইসি।'
রাহেলা বলেন, 'লজিক প্রকল্প আমারে যেমন টেকা দিল তেমনি আবার বুদ্ধিও দিল। যেমনে কইরা একে একে সব গেছিলো, লজিক প্রকল্পের সাহায্যে সব ফিরতে শুরু করল।' রাহেলা তাঁর ছেলের পরামর্শে হাঁস-মুরগির পাশাপাশি খরগোশ পোষা শুরু করেন। হাওরের ঘাস খেয়ে খরগোশ দ্রুত বাড়তে পারে। আদিবাসী ও কিছু শৌখিন মানুষ নিয়মিত তাঁর কাছে খরগোশ নেওয়া শুরু করেন। ঢাকা থেকেও অর্ডার আসে। রাহেলা জানান, তিনি এ পর্যন্ত ৫০টি খরগোশ বিক্রি করেছেন। একেকটির দাম ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা। এখনো তাঁর বাড়িতে ১২টি খরগোশ আছে। এছাড়া দুটি গাই গরু ও বাছুর আছে। একটি গরু গর্ভবতী, বাচ্চা দেবে। রাহেলার দেখাদেখি আশপাশের অনেকে এখন খরগোশ পালন শুরু করেছে। এ ছাড়া রাহেলা ১০১ জন নারীকে নিয়ে একটি সমবায় সমিতি খুলেছেন লজিক প্রকল্পের সহায়তায়। রাহেলার প্রতিবেশীরা জানান, নারীদের নিয়ে তাঁর এই সমবায় সমিতিও হাওর এলাকায় সাড়া ফেলেছে। সবাই নতুন দিনের স্বপ্নে বিভোর।
রাহেলা বলেন, 'সমিতির রেজিস্ট্রেশন হইসে, শিগগিরই টাকা জমানো শুরু করব আমরা। টাকা জমলে তা দিয়ে নতুন কিছু করা হবে।' রাহেলার ৫ সন্তানের সবাই পড়াশোনা করছেন। চার ছেলে ঢাকায় পড়াশোনা করছে। মেয়ে পড়াশোনা শেষ করে নার্স হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছেন। রাহেলাও স্বপ্ন দেখেন একদিন তাঁর আর কোন অভাব থাকবে না। সব সন্তানদের উচ্চ শিক্ষিত করলে তাঁদের বিয়ে দেবেন তিনি। তাঁর পরিবার হয়ে উঠবে একটি শান্তির জায়গা।
রাহেলার গ্রামের বাসিন্দা কবির আলম বলেন, 'রাহেলা আপার কাছে অনেকে এসে পরামর্শ নেন। তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা। কীভাবে দারিদ্র্যকে জয় করতে হয় তা রাহেলা আপা করে দেখিয়েছেন। খুব কম সময়ে লজিক প্রকল্পের সহায়তায় তিনি যেভাবে নিজে আর্থিকভাবে সচ্ছল হয়েছেন ও ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা চালিয়েছেন তা চোখে পড়ার মতো।'