ঢাকা শুক্রবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৩

ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে আছেন?

ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে আছেন?

ছবি: সংগৃহীত

ডা. এ হাসনাত শাহীন

প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২৩ | ০০:২৫ | আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০২৩ | ০০:২৫

বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৪৬ কোটির অধিক। অথচ ১৯৮৫ সালে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ কোটি। এক জরিপমতে, বিশ্বে প্রতি সাত সেকেন্ডে একজন মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন।

ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিক ফেডারেশনের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ৮৪ লাখ। যাদের প্রায় অর্ধেকই নারী। ২০৪৫ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে দেড় কোটিতে। এ ছাড়া বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে ১০০ জনের মধ্যে ২০ প্রসূতি নারীই গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন, যাদের ৬৫ শতাংশই পরবর্তী সময়ে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন।

শঙ্কার বিষয় হলো, প্রতি দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে একজন এখনও জানতে পারছেন না যে তার ডায়াবেটিস রয়েছে। ডায়াবেটিস শনাক্ত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শনাক্ত করা না থাকলে ঝুঁকি বহু গুণ বেড়ে যায়। বিশ্বে প্রতিবছর ডায়াবেটিসের কারণে ১০ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। আন্তর্জাতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশে মৃত্যুর কারণ হিসেবে সপ্তম রোগ ডায়াবেটিস।

 ডায়াবেটিস রোগের সাধারণ কিছু লক্ষণ রয়েছে। ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলো হলো–
 ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া; 
 তেষ্টা পাওয়া;
 নিয়মিত খাওয়ার পরও ঘন ঘন খিদে; 
 প্রচণ্ড পরিশ্রান্ত অনুভব করা;
 চোখে ঝাপসা দেখা; 
 শরীরের বিভিন্ন অংশের কাটাছেঁড়া সহজে না সারা;
 কোনো কারণ ছাড়াই ওজন কমে যাওয়া;
 প্রদাহজনিত রোগে বারবার আক্রান্ত হওয়া;
 হাতে-পায়ে ব্যথা বা মাঝেমধ্যে অবশ হয়ে যাওয়া।

কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এই লক্ষণগুলো সব সময় নাও থাকতে পারে। প্রতি দু’জন ডায়াবেটিস রোগীর মধ্যে একজন জানেনই না যে তিনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আর এটাই হচ্ছে ভয়ানক বিপদের কথা। কারণ, ডায়াবেটিসের জটিলতাগুলো রোগের প্রাথমিক ধাপ থেকেই শুরু হয়। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই রোগী চোখের জটিলতা, হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিডনি জটিলতা, পায়ে পচন, খোস-পাঁচড়া প্রভৃতি জটিলতা নিয়ে ডায়াবেটিস শনাক্ত হয়। সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় তাই ডায়াবেটিসের চিকিৎসা ও জটিলতা প্রতিরোধের অন্যতম পূর্বশর্ত। তাই জেনে নিন ডায়াবেটিসের কোনো লক্ষণ না থাকলেও কাদের ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা উচিত।

 বয়স ৪৫ বা তার বেশি হলে।
 স্থূল ব্যক্তি।
 রক্তসম্পর্কীয় নিকটাত্মীয়ের ডায়াবেটিস থাকলে।
 শারীরিক পরিশ্রমের ঘাটতি।
 প্রি-ডায়াবেটিস থাকলে।
 নারীদের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বা অধিক ওজনের সন্তান প্রসবের পূর্ব ইতিহাস।
 পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম থাকলে।
 উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক হলে।
 রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা বেশি এবং এইচডিএলের মাত্রা কম থাকলে।

তা ছাড়া প্রসূতি নারীদের সময়মতো ডায়াবেটিস নির্ণয় না হলে বেশি ওজনের শিশু জন্মদান, অকাল গর্ভপাত, মৃত সন্তান প্রসব, প্রসব-পরবর্তী শিশুমৃত্যু, জন্মগত ত্রুটি বা প্রসব-পরবর্তী মা ও সন্তানের বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয়। তাই প্রথম চেকআপের সময় অথবা গর্ভধারণের ২৪-২৮ সপ্তাহে প্রত্যেক প্রসূতি মায়েদের ডায়াবেটিস শনাক্তকরণ পরীক্ষা করতে হবে।

শিশুদের সাধারণত টাইপ ১ ডায়াবেটিস বেশি দেখা যায়। তবে ১৮ বছরের নিচেও টাইপ ২ ডায়াবেটিস থাকার সম্ভাবনা বেড়ে গেছে। সারাবিশ্বে প্রতি ১০ জনে একজন শিশু স্থূলতা বা অতিরিক্ত শারীরিক ওজনে আক্রান্ত। জীবনপ্রণালির পরিবর্তন তথা খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ও খেলাধুলা বা শারীরিক কসরতের অভাবে শিশুরা অল্প বয়সেই মুটিয়ে যাচ্ছে। আর এই অল্প বয়সে মুটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা শিশুদের ফেলছে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। শিশুদের মাঝে অল্প বয়স থেকেই দেখা দিচ্ছে ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল রোগ। তাই স্থূলকায় বাচ্চা এবং সেই সঙ্গে রক্তসম্পর্কীয় নিকটাত্মীয়ের ডায়াবেটিস বা মায়ের গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ইতিহাস থাকলে অথবা ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের উপসর্গ যেমন– ঘাড়ের কালো দাগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডিসলিপিডেমিয়া, পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম প্রভৃতি থাকলে ১০ বছর বয়সের পর যে কোনো শিশুর ডায়াবেটিস নির্ণয় করার পরীক্ষা করা উচিত। ডায়াবেটিস শনাক্ত করার জন্য সবচেয়ে সঠিক ও বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি হলো ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট বা ওজিটিটি। এ পদ্ধতিতে রোগীকে সকালে খালি পেটে একবার রক্তে গ্লুকোজ পরীক্ষা করতে হয়। তারপর ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ শরবত পানের দুই ঘণ্টা পর আরেকবার রক্তে গ্লুকোজ পরীক্ষা করা হয়। এ পদ্ধতিতে নির্ভুলভাবে ডায়াবেটিস ও প্রি-ডায়াবেটিস নির্ণয় করা যায়।

মনে রাখবেন, কিছু কিছু জটিলতা ডায়াবেটিসের প্রাথমিক পর্যায়েই শুরু হয়, যা পরে মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি করে। কেউ যদি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন, তাহলে তার সঠিক ও সময়মতো চিকিৎসার জন্য নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ওষুধ ও ইনসুলিন গ্রহণ করতে হবে। সঠিক সময়ে ডায়াবেটিস শনাক্ত করে দ্রুত চিকিৎসা নিলে জটিলতা এড়ানো সম্ভব।

[কনসালট্যান্ট, ডায়াবেটিস, থাইরয়েড ও হরমোন রোগ বিভাগ সিডব্লিউসিএসও ইমপালস হাসপাতাল, ঢাকা]

আরও পড়ুন