ঢাকা শুক্রবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৩

সাক্ষাৎকার

উদ্যোক্তাদের শেয়ারবাজারে আসতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে

উদ্যোক্তাদের শেয়ারবাজারে আসতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে

ছায়েদুর রহমান, সভাপতি, বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ)

 সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনোয়ার ইব্রাহীম 

প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২৩ | ০০:৪২ | আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০২৩ | ০০:৪২

সমকাল : বাংলাদেশের আইপিও বাজারের কী অবস্থা এখন?

ছায়েদুর রহমান : সত্যি কথা বলতে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে এখন আইপিও নেই। এ বছর এখন পর্যন্ত চারটি কোম্পানির মাত্র ২৫২ কোটি টাকার আইপিও এসেছে। পাইপলাইনেও খুব বেশি কোম্পানি আছে বলে শুনিনি। আসলে গত দুই বছরে কয়েকটি ব্যাংক ও বীমা কোম্পানির আইপিও হয়েছে। এগুলো আইনি বাধ্যবাধকতা পূরণ করতেই আইপিওতে আসে। ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেওয়ার সময়ই তিন বছরের মধ্যে শেয়ারবাজারে আসার শর্ত দেওয়া হয়। ওই সময়সীমাও কেউ পূরণ করতে পারে না। এর বাইরে উৎপাদনশীল খাত বা সেবা খাতে আইপিওতে আসার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ২০০৬ সালে নিয়ন্ত্রক সংস্থা একটি নিয়ম করেছিল, কোম্পানি দেশি বা বিদেশি, সরকারি বা বেসরকারি যাই হোক না কেন, পরিশোধিত মূলধন ৪০ কোটি টাকায় উন্নীত হওয়ার পরবর্তী এক বছরের মধ্যে আইপিওর জন্য আবেদন করতে হবে। কয়েক বছর আগে ওই নিয়ম নিয়ন্ত্রক সংস্থাই তুলে নিয়েছে। ফলে স্বেচ্ছায় তেমন কোনো কোম্পানি শেয়ারবাজারে আসছে না।

সমকাল : বাংলাদেশে এখন নিবন্ধিত কোম্পানি দুই লাখের বেশি। এর মধ্যে তালিকাভুক্ত মাত্র সাড়ে তিনশ। দু-চারটি ছাড়া দেশের বড় কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজারে আসছে না। কেন?

ছায়েদুর রহমান : আপনি বলছেন, কেন আসছে না। আমার প্রশ্ন হলো, কেন আসবে? আমাদের এখানকার আইনকানুন ও পুরো ব্যবস্থাই এমন যে এখানে কোনো কোম্পানির শেয়ারবাজারে আসার দরকার নেই। প্রথমত, কোনো কোম্পানি শেয়ারবাজারে আসে পুঁজির প্রয়োজনে। এখানে যে কোনো কোম্পানি পুঁজির প্রয়োজনে ব্যাংক থেকে যত ইচ্ছা ঋণ নিতে পারে। আবার ঋণ নিয়ে সময়মতো ফেরত না দিলেও খুব বেশি সমস্যা হচ্ছে না। চাইলে ৫ লাখ টাকার কোম্পানি ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নিতে পারে। এখানে কোম্পানির প্রকৃত মূলধন কত, সম্পদ কত তা বিবেচ্য নয়। ব্যাংক দেখে যতটা ঋণ নিচ্ছে, তার থেকে বেশি জমি বা অন্য কোনো সম্পদ মর্টগেজ দিতে পারছে কিনা। কোম্পানির নিজের সম্পদ মর্টগেজ রাখার বাধ্যবাধকতা নেই। এখানে থার্ড পার্টি মর্টগেজও চলে। মালিক তাঁর নিজের বা পরিবারের বা অন্য কোনো কোম্পানির সম্পদও মর্টগেজ দিতে পারেন। এমনও শোনা যায়, নামমাত্র মর্টগেজ রেখেও ঋণ হচ্ছে। সোজা কথা, উদ্যোক্তারা লাভ দেখেন না বলেই আইপিওতে আসেন না।

সমকাল : শুধু কি এটিই আইপিও কম হওয়ার কারণ?

ছায়েদুর রহমান : এমন আরও অনেক কারণ আছে। অ-তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর কর ফাঁকির প্রবণতা বেশি। তাদের আর্থিক প্রতিবেদনে স্বচ্ছতা কম। এ কারণে কোনো কোম্পানিকে বড় জরিমানা গুনতে হয়েছে, কোনো মালিককে জেলে যেতে হয়েছে বলে শুনিনি। ধরুন, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত নয়, এমন কোম্পানির বয়স ৪০ বছর। অথচ ওই কোম্পানির মালিক জীবনে কোনো দিন এক টাকাও লভ্যাংশ নেননি। তাঁর সব অর্থ ওই কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা। তাহলে তিনি চলেন কী করে? তিনি আসলে যখন ইচ্ছা কোম্পানি থেকে অর্থ নেন। গাড়ি ব্যবহার করেন কোম্পানির। ইচ্ছামতো খরচ দেখান। এভাবে মুনাফা কম দেখিয়ে সরকারকে কম কর দেন। তাতে সরকার ও দেশের লোকসান হলেও ওই কোম্পানির মালিকেরও তো কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তাহলে তিনি কেন এমন এক ব্যবস্থায় আসবেন, যেখানে টাকা নিতে আসার আগে দুই থেকে তিন বছর ধরে কোম্পানির সব সম্পদ ও আয়ের খতিয়ান পাই পাই করে হিসাব করতে হয়। তার ওপর নানা কাঠখড় পুড়িয়ে শেয়ারবাজারে আসতে হয়। শেয়ারবাজারে আসার পর মাসিক, ত্রৈমাসিক, বার্ষিক নানা তথ্য প্রকাশ করতে নয়। সর্বক্ষণ নিয়ন্ত্রক সংস্থা, স্টক এক্সচেঞ্জ, বিনিয়োগকারী, মিডিয়াসহ নানাজনের জবাবদিহিতার মধ্যে থাকতে হয়। তিনি কেন এত ঝুট-ঝামেলায় পড়তে চাইবেন! এ কারণেও তারা শেয়ারবাজারে আসতে চান না।

সমকাল : বাংলাদেশের মতো অন্য দেশেও কি এই অবস্থা?

ছায়েদুর রহমান : অবশ্যই না। ইন্টারনেটে ঢু মারলেই দেখতে পাবেন বাংলাদেশের মতো অর্থনীতির দেশগুলোতেও শেয়ারবাজার কত উন্নত। ওইসব দেশে বছর বছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের আইপিও হয়। ব্যবসায়ীরা যে সেধে পড়ে শেয়ারবাজারে আসেন, তা কিন্তু নয়। সব দেশের ব্যবসায়ীদের ধর্ম একটাই– যেখানে ব্যবসা, মুনাফা ও সুবিধা বেশি, ব্যবসায়ীরাও সেখানে। ওইসব দেশ কর ফাঁকির ব্যবস্থা কমাতে পেরেছে। আবার আইনি বাধ্যবাধকতাও হয়তো আছে। তবে আইনি বাধ্যবাধকতার থেকেও এমন পরিবেশ ও সংস্কৃতি করা দরকার, যেখানে দীর্ঘমেয়াদি পুঁজির প্রয়োজনে উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী নিজেরাই শেয়ারবাজারমুখী হবেন। এ জন্য আমাদের পুরো আর্থিক সংস্কৃতি ও পরিবেশের উন্নতির দরকার আছে।

সমকাল : একটু বুঝিয়ে বলুন।

ছায়েদুর রহমান : আমাদের দেশে আইপিও অনুমোদন করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এই অনুমোদন পাওয়ার আগে প্রায় প্রতিটি কোম্পানি ২-৩ বছর খেটে আগের সব হিসাবপত্র ঠিক করে। কারণ কারও প্রায় সঠিক আর্থিক হিসাব থাকে না। এখন শুধু কর ব্যবস্থা যদি পুরোপুরি দুর্নীতিমুক্ত হতো, আর্থিক প্রতিবেদনে জালজালিয়াতি করার ব্যবস্থা না থাকত, তাহলে সবার এতটা সময় ধরে কাঠখড় পোড়াতে হতো না। এরপর কার কত মূলধন, কার কত লাভ বা লোকসান কত– এটি দেখার দরকার কী। এটি বিনিয়োগকারীরা দেখবেন। তাদের যদি পছন্দ হয় শেয়ার কিনবেন, না হলে কিনবেন না। কোন দামে কোম্পানি শেয়ার বিক্রি করবে, এটাও এখানে ঠিক করে দেওয়া হয়। অথচ বাইরে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসব দেখে না। 

সমকাল : আইপিওর বাজারকে জনপ্রিয় করতে কী করতে হবে?

ছায়েদুর রহমান : উদ্যোক্তাদের বাজারে আসতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তারা পছন্দমতো দরে বা বাজার যে দরে শেয়ার কিনতে চান, সে দর ব্যবস্থায় শেয়ার বিক্রির সুযোগ দিতে হবে। আইনি কাঠামোয় যত পরিবর্তন দরকার, তা আনতে হবে। কোনো উদ্যোক্তা যদি দেখেন, তাঁর ১০ টাকার শেয়ার ৫০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি করতে পারছেন, তিনি নিজে থেকেই বাজারে আসবেন। কিন্তু এখানে সে ব্যবস্থা নেই। আইপিও বাজারের ১০ টাকার শেয়ার সেকেন্ডারি বাজারে ১০০ টাকা হয়। এতে উদ্যোক্তা বা কোম্পানির কী লাভ? উদ্যোক্তা যখন দেখেন, একই শেয়ার ৫-১০ গুণ বেশি দরে ঠিকই বিনিয়োগকারীরা কিনছেন, কিন্তু সে লাভ তিনি পাচ্ছেন না, তখন নিরুৎসাহিত হন।

আরও পড়ুন