ঢাকা শুক্রবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৩

বড় হচ্ছে না আইপিওর বাজার

বড় হচ্ছে না আইপিওর বাজার

গ্রাফ

আনোয়ার ইব্রাহীম

প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২৩ | ০০:৪৬ | আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০২৩ | ০০:৪৬

শুরুতেই কিছু পরিসংখ্যানে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে হংকং ছাড়া শুধু মেইন ল্যান্ড বা মূল চীনের স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর মাধ্যমে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) প্রক্রিয়ায় সে দেশের ২৬৩ কোম্পানি ৪৫ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ পুঁজি সংগ্রহ করেছে। বাকি সময়টায় আরও যেসব কোম্পানি এ প্রক্রিয়ায় পুঁজি তুলবে, তা নিয়ে বছর শেষে এ অংক ৬২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে; যা  বাংলাদেশের বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের তিন গুণের বেশি।

এর মধ্যে চলতি বছর শুধু সাংহাইয়ের প্রযুক্তিকেন্দ্রিক স্টার মার্কেট থেকে ১০ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেছে শতাধিক কোম্পানি, যা বিশ্বের যে কোনো শেয়ারবাজারের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ সময়ে দ্বিতীয় অবস্থানটিও চীনের স্টক এক্সচেঞ্জের। শেনজেন স্টার্টআপ চিনেক্স থেকে ৯ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলারের আইপিও শেয়ার ইস্যু হয়েছে। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে ৫ দশমিক ৪০ ডলারের আইপিও হয়েছে, যা বিশ্বে তৃতীয়।

পশ্চিমা উন্নত বিশ্বকে টেক্কা দিয়ে বর্তমান বিশ্বে চীনের অর্থনৈতিক পরাশক্তি হয়ে ওঠার পেছনে শেয়ারবাজার এভাবে পুঁজি দিয়ে নেপথ্যে বড় ভূমিকা রাখছে। কমিউনিস্ট শাসিত দেশ হয়েও পুঁজির জন্য শেয়ারবাজারের ওপর নির্ভরশীলতা দেশটির কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নেও সহায়ক ভূমিকা রাখছে। তাই সে দেশের সরকারও এ বাজার উন্নয়নে সর্বাত্মক সহায়তা দিচ্ছে।

এ তো গেল চীনের কথা। অপেক্ষাকৃত ছোট অর্থনীতির দেশ প্রতিবেশী ভারতের দিকেও আমরা একটু নজর দিতে পারি। ভারতের বর্তমান  মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার প্রায় পৌনে ৪ ট্রিলিয়ন ডলার। এ বছর এখন পর্যন্ত ১৯৯ কোম্পানি ৬৩ হাজার কোটি রুপির বেশি পুঁজি সংগ্রহ করেছে বোম্বে ও ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ৮৩ হাজার ২০০ কোটি টাকারও বেশি। বছর শেষে তা লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। যেখানে গত বছর ভারতে আইপিও প্রক্রিয়ায় ১১৮ কোম্পানি ১২ হাজার ৬৮১ কোটি রুপি বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৬ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকার পুঁজি সংগ্রহ করেছিল।

বাংলাদেশের তুলনায় ভারত-চীন অনেক বড় দেশ, বড় অর্থনীতি। কিন্তু বাংলাদেশের সমপর্যায়ের অর্থনীতির দেশগুলোর শেয়ারবাজারও বাংলাদেশের তুলনায় অনেক উন্নত। যেমন– থাইল্যান্ডে এ বছর ১ দশমিক ১০ ডলারের সমমূল্যের আইপিও হতে যাচ্ছে। ভিয়েতনামে সাড়ে ২৩৬ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ আইপিও হয়েছে, বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বেশি। 

এবার আসুন বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের দিকে নজর বোলাই। সরকারি হিসাবে বাংলাদেশের জিডিপির আকার ৪৬০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ভারতের তুলনায় আট ভাগের এক ভাগ। দেশে এ বছর এখন পর্যন্ত চার কোম্পানি ২৫২ কোটি টাকা তুলেছে। গত বৃহস্পতিবার এনআরবি ব্যাংক ১০০ কোটি টাকার আইপিওর অনুমোদন পেয়েছে। এটি নিয়ে এ বছরের এখন পর্যন্ত আইপিও ৩৫২ কোটি টাকা। আরও কোম্পানির আইপিও অনুমোদন হলেও এ সংখ্যা কোনোভাবেই ৫০০ কোটি টাকা ছাড়ানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। যেখানে গত বছর মোট সাতটি কোম্পানি আইপিও প্রক্রিয়ায় ১ হাজার ২১ কোটি টাকার পুঁজি সংগ্রহ করেছিল। 

অবশ্য গত দুই বছরে আইপিও যে পরিমাণ পুঁজি সংগ্রহ হয়েছে, তার সিংহভাগ নিয়েছে ব্যাংক এবং বীমা কোম্পানি। আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে এসব কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার শর্ত পূরণ করতে গিয়ে আইপিওতে এসেছে। বাধ্যবাধকতা না থাকলে উৎপাদনমুখী কোম্পানিগুলোর মতো হয়তো এসব কোম্পানিও আইপিওতে আসত না– এমন ধারণা শেয়ারবাজারসংশ্লিষ্টদের।

কেন বাংলাদেশে আইপিওর বাজার ছোট : এ জন্য বাংলাদেশের দুর্বল অর্থনৈতিক এবং নীতি কাঠামো দায়ী বলে মনে করেন শেয়ারবাজারসংশ্লিষ্ট ও বিশেষজ্ঞরা। এর সঙ্গে সুশাসনের অভাব, দুর্নীতি এবং দায়িত্বশীলদের দক্ষতা ও দেশপ্রেমের অভাবও কম দায়ী নয় বলে মনে করছেন তারা।

দেশের শেয়ারবাজারের অন্যতম ব্রোকারেজ হাউস প্রাইম ব্যাংক সিকিউরিটিজের সিইও মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, এখানে কর ফাঁকির সুযোগ অনেক বেশি। বেসরকারি কোম্পানির উদ্যোক্তারা কোম্পানি থেকে কোনো লভ্যাংশ নেন না। যখন যেভাবে ইচ্ছা টাকা নিতে পারেন, খরচের কোনো জবাবদিহিতা নেই। কোম্পানির মালিকানা যেহেতু নিজের ও পরিবারের কাছে থাকে, তাই কেউ এ নিয়ে প্রশ্ন তোলারও থাকে না। কোম্পানি আইপিওতে এসে নতুন শেয়ারহোল্ডার নিলে তারা বছর বছর ভালো লভ্যাংশ চাইবেন। ফলে তারা আয়-ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন– এ ভয় উদ্যোক্তাদের মধ্যে থাকে। তারা জবাবদিহিতার সংস্কৃতিতে যেতে চান না। 

শেয়ারবাজারে আইপিও আনতে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা রাখে মার্চেন্ট ব্যাংক। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বিএমবিএর সভাপতি ছায়েদুর রহমান মনে করেন, কোনো কোম্পানির আইপিওতে আসার প্রধান উদ্দেশ্য থাকে ব্যবসার প্রয়োজনে পুঁজি সংগ্রহ। এখানে কোম্পানিগুলো চাইলে দু-তিন মাসের মধ্যে ব্যাংক থেকে যে কোনো আকারের ঋণ নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে কোম্পানির মূলধন কত, তা বড় বিবেচ্য নয়। ৫ লাখ টাকা মূলধনের কোম্পানি পর্যাপ্ত জামানত দিতে পারলে ৫০০ কোটি টাকার ঋণ নিতে পারে। এমনকি থার্ড পার্টি মর্টগেজও গ্রহণযোগ্য। অন্যদিকে আইপিওতে আসতে কমপক্ষে ৩০ কোটি টাকার মূলধন থাকতে হয়। এরপর মুনাফায় থাকতে হবে। সব কাগজপত্র তৈরি করে আইপিওর অনুমোদন পেতে দুই বছরও লেগে যায়। ফলে কোনো কোনো কোম্পানি আইপিওতে আসতে চাইবে না।

তবে সব উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী যে একই মনোভাব পোষণ করেন, তাও মনে করেন না প্রাইম ব্যাংক সিকিউরিটিজের মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, ভালো কোম্পানির ভালো উদ্যোক্তারা বর্তমান আইনি কাঠামোতে কাঙ্ক্ষিত মূল্য পাবেন না বলে মনে করেন। এটি তাদের শেয়ারবাজারের প্রতি অনীহার আরেকটি কারণ।

এখানে আইপিওতে যে শেয়ারটি ১০ টাকা বা ২০ টাকায় বিক্রি করছেন উদ্যোক্তারা, ওই শেয়ারই কিছুদিনের মধ্যে সেকেন্ডারি বাজারে ৫০ থেকে ১০০ টাকায় কেনাবেচা হচ্ছে। এই বাড়তি দরের কোনো সুফল কোম্পানি বা ওই উদ্যোক্তারা পান না। এটি দেখেও তারা নিরুৎসাহিত হন।

শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অনারারি অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ভালো কোম্পানির উদ্যোক্তারা ভালো মুনাফা যেমন চান, তেমনি ভালো পরিবেশও চান। এ বাজারে তাদের ভালো মূল্য পাওয়ার ব্যবস্থা নেই। তার ওপর সুশাসনের বড় অভাব। যারা আইনকানুন মানতে চান, তাদের ওপর খড়্গ বেশি, হয়রানি বেশি। এখানে দুর্নীতি মাত্রাছাড়া বলে মন্দরা ঘুষ দিয়ে সবকিছু হালাল করে নেয়। আবার শেয়ারবাজারে সুশাসন বলে কিছু নেই, যে ইচ্ছা কারসাজি করছে। ভালো উদ্যোক্তারা এর মধ্যে পারতপক্ষে যেতে চান না।

আবু আহমেদ বলেন, এর থেকেও বড় সমস্যা হলো– এখানে যে কেউ তাঁর কোম্পানিকে যত ইচ্ছা নিজের মালিকানায় রেখে বড় করতে পারেন। ব্যাংক থেকে ধার করে ফেরত দেওয়া লাগে না। কোম্পানি বড় হলে বা বড় অংকের পুঁজির প্রয়োজনে শেয়ারবাজারে আসতে হবে, এমন আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। তিনি বলেন, ২০০৬ সালে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসি ৪০ কোটি টাকার বেশি মূলধনি কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে আসা বাধ্যতামূলক করেছিল। কিন্তু বিগত কমিশন তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। অথচ ভারতেও বিদেশি কোম্পানিকে নিবন্ধন নেওয়ার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেয়ারবাজারে আসার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এখানে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বলছে, এমন শর্ত থাকলে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না। তাহলে ভারতে কেন আসছে– এমন প্রশ্নও রাখেন তিনি।

শেয়ারবাজারকে বর্তমান অবস্থায় রেখে দেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব নয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বেসরকারি বিনিয়োগের প্রধান উৎস দুটি। প্রথমটি ব্যাংক খাত এবং দ্বিতীয়টি শেয়ারবাজার। আমাদের ব্যাংক খাত তার শক্তি হারিয়েছে। কিছু বড় ব্যবসায়ী টাকা নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না, খেলাপি ঋণ অনেক বেড়েছে। ফলে এ খাত এখন তারল্য সংকটে। বাকি থাকল শেয়ারবাজার। এ বাজারের প্রতি কারও আস্থা নেই। গত ১০-১২ বছরে যত কোম্পানি এসেছে, সেগুলোর কয়টি ঠিকভাবে চলছে– এটি দেখতে হবে। এখানে সুশাসনের তীব্র অভাব। নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও স্টক এক্সচেঞ্জ তাদের অর্পিত দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করছে– এমনটা মনে হয় না। কারসাজি হচ্ছে, তার বিচার হচ্ছে না। ফলে এ বাজার থেকেও কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। 

করণীয় কী: সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, লক্ষ্য যদি ঠিক থাকে, তবে তা বাস্তবায়নের জন্য সুষ্ঠু ও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা লাগবে। তার সঙ্গে লাগবে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দক্ষ ও সৎ কর্মী। উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন করতে এ পরিকল্পনায় শেয়ারবাজারকে কোনোভাবেই বাইরে রাখা চলবে না। কারণ উন্নত বিশ্বে দেখেছি অর্থনীতি যত বড় হয়েছে, বেসরকারি অর্থায়নে ব্যাংকের তুলনায় শেয়ারবাজারের নির্ভরতা বেড়েছে। এর বিকল্প নেই। আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে ভালো শেয়ারবাজার গড়তে হবে।

বিএমবিএর সভাপতি ছায়েদুর রহমান বলেন, কোম্পানিগুলোকে শেয়ারবাজারমুখী করতে প্রয়োজনে আইনি বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে হবে। তার আগে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সীমা আরোপ করতে হবে। আইপিও প্রক্রিয়ায় কোম্পানির মূলধন উত্তোলনের পথ সহজ ও দ্রুততর করতে হবে। উদ্যোক্তারা যেখানে বেশি মুনাফা সেখানেই যান। তারা যদি দেখেন শেয়ারবাজারে আসা লাভজনক, তাহলে তারা নিজেরাই আসবেন। এ জন্য অতালিকাভুক্ত কোম্পানির সঙ্গে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহারের ব্যবধান বাড়াতে হবে। 

প্রাইম ব্যাংক সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুজ্জামান বলেন, অন্যান্য দেশের মতো কোম্পানিগুলোকে ভালো দরে শেয়ার বিক্রির সুযোগ দিতে হবে। এখানে আইন করে শেয়ারদর সর্বোচ্চ কত হতে পারবে, তার সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হচ্ছে। এ ধারা তুলে নিতে হবে। বাজারকেই আইপিও শেয়ারের দর নির্ধারণের সুযোগ দিতে হবে। শুধু এটুকু বলতে হবে, কোম্পানি যে সম্পদ ও আয়ের তথ্য দেবে, তা ঠিক আছে। এর কোনো ব্যত্যয় পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেবে, তাও আবার কেতাবি ব্যবস্থা নয়। একের শাস্তি দেখে অন্যরা যেন ভয় পায়। সেকেন্ডারি মার্কেটে যেন কেউ কারসাজি করতে না পারে, তা কঠোরভাবে নজরদারি করতে হবে। 

শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ আবু আহমেদের মত হলো, বাজারকে নিজের মতো করে চলতে দিতে হবে। আইনের সঠিক ও বাস্তব প্রয়োগ হলে এ বাজারের প্রতি উদ্যোক্তা-বিনিয়োগকারী সবাই আকৃষ্ট হবেন। তখন এ বাজার অর্থনীতির অগ্রগতির জন্য অবদান রাখবে। 

আরও পড়ুন