দরিদ্র জেলের শিল্পকর্মে মুগ্ধ গ্রামবাসী
নিজের বানানো শিল্পকর্মের সঙ্গে জাকির হোসেন মুন্সি
রুবেল নাহিদ
প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২৩ | ১৯:১৬
দক্ষিণাঞ্চলের সুন্দরবনসংলগ্ন বলেশ্বর নদঘেঁষা বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার সদর ইউনিয়নে রুহিতা গ্রাম। প্রত্যন্ত এ অঞ্চলের খেটে খাওয়া দরিদ্র জেলে জাকির হোসেন মুন্সি। তবে ফাঁকে ফাঁকে দিনমজুরের কাজও করেন। প্রতিনিয়ত টিকে থাকার লড়াই করলেও জাকিরের আছে এক শিল্পীসত্তা। পরিত্যক্ত কাঠ ও গাছের শিকড় খোদাই করে বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করা তাঁর নেশা।
সুন্দরবন ও নদী থেকে পরিত্যক্ত কাঠ এবং শ্বাসমূল তুলে এনে খোদাই করে বানান বিভিন্ন রকমের শিল্পকর্ম। সৃষ্টি করেন উড়োজাহাজ, ট্রলার, নৌকা, হরিণ, মাছসহ নানা আকৃতির শিল্পকর্ম। এলাকাবাসী বলছেন, সংসার টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে চললেও জাকির শিল্পচর্চা থেকে পিছপা হননি। নিভৃত পল্লিতে তাঁর এসব শিল্পকর্ম সব শ্রেণির মানুষকেই মুগ্ধ করছে। অনেকে দূর-দূরান্ত থেকে দেখতে আসছেন জাকিরের শিল্পকর্ম। হঠাৎ যে কারও দেখলে মনে হবে এ যেন চারুকলার প্রদর্শনী, যেখানে সাজিয়ে রাখা হয়েছে কাঠের তৈরি শিল্পকর্ম। জাকির ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন। বন ভালোবাসেন। তিনি এখন পর্যন্ত তিন শতাধিক সাপ উদ্ধার করেছেন। সাপ উদ্ধারসহ বন সংরক্ষণে ভূমিকা রাখায় তিনি এলাকায় পরিচিত ‘টাইগার জাকির’ হিসেবে।
জাকির হোসেন মুন্সি বলেন, ‘গরিবের সংসারে জন্ম নেওয়ায় লেখাপড়ার সুযোগ হয়নি। ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে মাছ ধরার কাজ করেছি। মাছ শিকারের পাশাপাশি বন এবং বন্যপ্রাণীর প্রতি প্রেম ছিল। বন ধ্বংস ও বন্যপ্রাণী হত্যা সহ্য করতে পারতাম না।’
তিনি আরও বলেন, ‘দুই বছর আগে ২২ হাজার টাকায় আমার কিছু শিল্পকর্ম বিক্রি করেছি। অনেক স্বপ্ন ছিল আমি অনেক বড় কিছু হবো। ভাগ্য খারাপ, জেলে ছাড়া আর কিছুই হতে পারিনি। আমি সবসময় আলাদা কিছু নিয়ে ভাবি। একদিন নদীতে মাছ শিকারের জন্য যাই, তখন আমার মনে হঠাৎ ইচ্ছে জাগলো, গাছের শিকড় দিয়ে কিছু তৈরি করা যায় কিনা। পরে সেই চেষ্টাকে কাজে লাগাই। এর সঙ্গে বিভিন্ন রকমের জিনিস, কাঠ খোদাই করেও তৈরি করেছি। আমি চাই আমার এখান থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জাদুঘরে শিল্পকর্ম নেওয়া হোক। মানুষ দেখুক, উপকূলের পরিত্যক্ত জিনিস থেকে কীভাবে সুন্দর শিল্পকর্ম তৈরি হয়।’
পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. রোকনুজ্জামান খান বলেন, ‘প্রত্যন্ত অঞ্চলের জেলে জাকির মুন্সির শিল্পকর্ম সত্যিই প্রশংসনীয়। আমি তাঁর শিল্পকর্ম পরিদর্শন করেছি। আমরা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা করব। মাছ শিকার ও দিনমজুরি করে কোনো রকম দিনযাপন করছে জাকির। এর মধ্যে তাঁর প্রতিভার বিকাশ ঘটাচ্ছে, অনেক আকর্ষণীয় শিল্পকর্ম তৈরি করেছে সে।’
স্থানীয় বাসিন্দা জাকারিয়া আকন বলেন, ‘জাকিরের জেলে পেশার পাশাপাশি এমন কাজ আমাদের মুগ্ধ করেছে। এসব কাজ যদি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পায় তাহলে জাকির আরও এগিয়ে যাবেন। পাশাপাশি এলাকাবাসীও খুশি হবে।’
জাকির হোসেন মুন্সির শিল্পকর্ম দেখতে আসা একজন দর্শনার্থী ইমরান হোসেন বলেন, ‘গাছের শিকড় দিয়ে যে এত সুন্দর ভাস্কর্য তৈরি করা যায়, তা এখানে না এলে বুঝতে পারতাম না। এখানে যে কেউ এলে মুগ্ধ হবেন। আশা করি, একদিন দেশ ও দেশের বাইরেও তাঁর শিল্পকর্ম পরিচিতি পাবে।’