- ফিচার
- বঙ্গবন্ধুর কুড়িগ্রাম সফর
বঙ্গবন্ধুর কুড়িগ্রাম সফর

ছয় দফা মানতে হবে, জয় বাংলা, তোমার আমার ঠিকানা- পদ্মা মেঘনা যমুনা... এসব স্লোগান আর মিছিলে আমরা সবাই উলিপুর রেল স্টেশনে গেলাম। বঙ্গবন্ধু উলিপুরে আসছেন। সময়টা ১৯৭০ সাল। মাসের কথা মনে নেই। অতঃপর বঙ্গবন্ধু উলিপুরে এলেন। ট্রেন থেকে নামামাত্র আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল হাফিজ সরকার, কানাইলাল সরকার, সাদাকাত হোসেন ছক্কু মিয়াসহ নেতৃবৃন্দ ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নিলেন। গগণবিদারী স্লোগান উঠল- জয় বাংলা!
তখন উলিপুরে একটা মোটরচালিত বাস ছিল। সেটার নাম ছিল 'হিমালয়'। মোটরের হ্যান্ডেল মারলেন ফজলার হেলপার। হিমালয় সমান মানুষটি রওনা হলেন উলিপুর কাচারি ময়দানের দিকে। পেছনে মুক্তিকামী মানুষের স্রোত। এখন যেটা উলিপুর প্রেস ক্লাব, সেটার সামনে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী গাড়িটা যাচ্ছে। আমার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে- একজন মধ্যবয়সী মানুষ তার শিশুসন্তানকে কাঁধে নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে দেখিয়ে দিয়ে বলছেন, 'দ্যাখ বাবা দ্যাখ। এই মানুষটাক দেইখলে ছওয়াব হইবে।'
এখন যেটা ঈদগাহ মাঠ। তখন সেটা ফাঁকা ছিল। সেখানে একটা লন টেনিস কোর্ট ছিল। সেখানে বানানো মঞ্চে বঙ্গবন্ধু উঠলেন। মুহুর্মুহু করতালি। পায়রা ওড়ালেন তিনি। আমি মাঠে জায়গা পাইনি। লোকে লোকারণ্য। মঞ্চের পেছনে, কাশিমবাজার এস্টেটের একটা দোতলা ভবন ছিল। সেখানে ভূমি অফিসের কর্মকর্তা গোপাল সরকার থাকতেন। সেই দোতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনেছিলাম।
তার বক্তব্য হুবহু মনে নেই। তবে মনে আছে, সোনার বাংলা শ্মশান কোথায় তার বর্ণনা দিচ্ছিলেন। ফাতেমা জিন্নাহ আর কাশেম মিয়ার কথা বলছিলেন। নির্বাচনে ভোট দেওয়ার কথা বলছিলেন। উলিপুরে বিখ্যাত মিষ্টান্ন কারিগর মনমোহন হালাই বঙ্গবন্ধুর জন্য সন্দেশ বানিয়েছিলেন। সেই সন্দেশে লেখা ছিল ৬ দফা আর বঙ্গবন্ধু। প্রয়াত সংসদ সদস্য কানাইলাল সরকার সেই মিষ্টি উলিপুরে খাওয়াতে পারেননি। কুড়িগ্রামে নিয়ে গিয়ে খাইয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'আমি শুধু ৬ দফা সন্দেশটা খাবো।' খেয়েও ছিলেন, উলিপুরের সেই বিখ্যাত সন্দেশ। স্মৃতি থেকে এই কথাগুলো বলছিলেন, সত্তরে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী পরবর্তী জীবনে ভোরের কাগজের উত্তরাঞ্চল প্রতিনিধি ও বর্তমান দেশ রূপান্তর পত্রিকার ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি পরিমল মজুমদার। উলিপুরের কাচারি ময়দানে ওই জনসভায় সভাপতিত্ব করেন সেই সময়কার থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হাফিজ সরকার। ওই সভার একজন প্রত্যক্ষদর্শী অ্যাডভোকেট আইনুল হক তালুকদার তার স্মৃতি থেকে বলেছেন, বঙ্গবন্ধু সেদিন তার জ্বালাময়ী ভাষণে উলিপুর থানার দলদলিয়ার কৃষকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে সরকারের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি জেলা শাখার সভাপতি জ্যোতি আহমদ '৭০-এর স্মৃতি রোমন্থন করে বলেছেন, সকালের ট্রেনে রংপুর থেকে কুড়িগ্রামে আসেন বঙ্গবন্ধু। মাঝপথে টগরাইহাট রেল স্টেশনে থামে ট্রেন। ছোট্ট প্ল্যাটফর্ম তখন লোকে লোকারণ্য। বঙ্গবন্ধু ট্রেনের দরজায় এসে দাঁড়ালেন। পরনে সাদা পাঞ্জাবি ও চেকের লুঙ্গি, লম্বা চুলগুলো অবিন্যস্ত। শত মানুষের করতালি আর স্লোগানে মুখর হয়ে উঠল স্টেশন চত্বর। সমবেত জনতার উদ্দেশে ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিলেন বঙ্গবন্ধু। পশ্চিমাদের শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেতে আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করার আহ্বান জানালেন। গগণবিদারী করতালি আর স্লোগানের জবাবে বঙ্গবন্ধু হাত নাড়লেন। ছোট্ট ট্রেনটি বঙ্গবন্ধু ও সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে কুড়িগ্রামের দিকে চলে গেলেন।
১৯৭৪ সালে দৈনিক সংবাদের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি ও কুড়িগ্রাম প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মমিনুল ইসলাম মঞ্জুর স্মৃতিতে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু নির্বাচনী প্রচারণার জন্য কুড়িগ্রামে আসেন ১৯৭০ সালের অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি। সঙ্গে এসেছিলেন তোফায়েল আহমেদ এবং নীলফামারীর সেই সময়ের নেতা আব্দুর রউফ। তারা সবাই ট্রেনে এসেছিলেন। ট্রেন ছাড়া তখন কুড়িগ্রাম আসার কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। এখানে আসার পরে তারা পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডাকবাংলোয় রাত্রিযাপন করেন। পরের দিন বঙ্গবন্ধু বর্তমান স্টেডিয়াম মাঠের জনসভায় ভাষণ দেন। তখন স্টেডিয়াম ছিল না। সেটা ছিল খেলার মাঠ। মাঠের পূর্ব দিকে একটি গাব গাছ ছিল। ওই গাব গাছের দক্ষিণ পাশেই তৈরি করা হয়েছিল বিশাল মঞ্চ। সেই দিনের সেই বিশাল জনসভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আহাম্মদ হোসেন সরকার। বঙ্গবন্ধু পরের দিন ট্রেনে উলিপুর গেছিলেন। এরপর তিনি নদী পার হয়ে নাগেশ্বরী ও ভূরুঙ্গামারীর নির্বাচনী জনসভায় ভাষণ দেন।
সত্তরে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী কুড়িগ্রাম টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র ইন্সট্রাক্টর (ক্রাফট) মনোরঞ্জন কুমার সিংহ বলেছেন, খবর আসে বঙ্গবন্ধু কুড়িগ্রাম থেকে ট্রেনে করে উলিপুরের জনসভায় যোগ দিতে রওনা হয়েছেন। এই খবরে মুহূর্তে কুড়িগ্রাম ও উলিপুরের মধ্যবর্তী পাঁচপীর রেলওয়ে স্টেশন জনস্রোতে পরিণত হয় বঙ্গবন্ধুকে একনজর দেখার জন্য। অনির্ধারিত যাত্রাবিরতিতে ট্রেন থামে সেখানে। বঙ্গবন্ধু দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সবার সঙ্গে মোলাকাত করেন। মনোরঞ্জন কুমার সিংহ আবেগাপ্লুত হয়ে আরও বলেন, 'আমি আমার জ্যাঠাতো ভাই লক্ষ্মী নারায়ণ সিংহের কাঁধে চড়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মোলাকাত করেছিলাম। যে স্মৃতি আমার কাছে আমৃত্যু স্মরণীয় হয়ে থাকবে।'
১৯৭৩ সালে কুড়িগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এবং কুড়িগ্রাম কলেজ সংসদের ভিপি, বর্তমান রাজারহাট উপজেলার উমর মজিদ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী সরদার বলেন, '৭৩-এর ২৬ ফেব্রুয়ারি হেলিকপ্টারে কুড়িগ্রামে আসেন বঙ্গবন্ধু। হেলিকপ্টার অবতরণ করে বর্তমান স্টেডিয়াম মাঠে। সেদিন ছিল প্রচণ্ড শীত। বর্তমান কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ মাঠের সোজা দক্ষিণে এবং বিজিবি ক্যাম্পের উত্তরে তৈরি করা হয়েছিল বিশাল মঞ্চ। পুরো মাঠ কানায় কানায় ভর্তি। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে দু'দিন আগে থেকে জড়ো হতে থাকে মানুষ। তৎকালীন জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রোকনুদ্দৌলা রুকু, সাংগঠনিক সম্পাদক (বর্তমান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি) মো. জাফর আলী, ক্রীড়া সম্পাদক (বর্তমান জেলা ইউনিট কমান্ডার, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ) মো. সিরাজুল ইসলাম টুকুসহ ছাত্রলীগের কর্মীরা স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করে কলেজ মাঠ। ওই জনসভায় সভাপতিত্ব করেন অ্যাডভোকেট আহমদ হোসেন সরকার।
তিয়াত্তরে কুড়িগ্রাম কলেজের (বর্তমান কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ) বিএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ও তৎকালীন জেলা ছাত্রলীগের সক্রিয় সদস্য এবং বর্তমান কুড়িগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি মোহাম্মদ আকবর আলী সরকার সেদিনের সেই জনসভার একজন সাক্ষী। তিনি বলেছেন, নদী বিচ্ছিন্নতা ও ভঙ্গুর যোগাযোগ ব্যবস্থা উপেক্ষা করে রৌমারী, রাজীবপুর, নাগেশ্বরী, ভূরুঙ্গামারী ও ফুলবাড়ী উপজেলাসহ দুর্গম অঞ্চলের হাজারো বিভিন্ন বয়সী মানুষ বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য হেঁটে দু'দিন আগ থেকে জড়ো হতে থাকে জেলা শহরে। উমর মজিদ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী সরদার বলেছেন, আমার যতটুকু মনে পড়ে, ওই মঞ্চে দু'জন কুড়িগ্রামের শিল্পী গান গেয়েছিলেন। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ভাওয়াইয়া যুবরাজ মরহুম কছিম উদ্দিন, আরেকজন হলেন এসএম মজিবর রহমান।
রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়াল ডাঙ্গা ইউনিয়নের পশ্চিম দেবত্তর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা (মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেননি) এসএম মজিবর রহমান বলেছেন, আমি সেদিন বঙ্গবন্ধুর ওই মঞ্চে খালি গলায় গেয়েছিলাম- 'মুজিব বাইয়া যাও রে/ নির্যাতিত দ্যাশের মাঝে/ জনগণের নাও রে মুজিব/ বাইয়া যাও রে ...। বঙ্গবন্ধু সেখানে ভাষণ দেন। কুড়িগ্রাম কলেজ মাঠে (বর্তমান কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ) ৫ মিনিট ১৫ সেকেন্ড স্থিতিসম্পন্ন ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বললেন, 'কুড়িগ্রামের ভাই ও বোনেরা, আমি জানি যে, অনেক দূরে থেকে আপনারা কষ্ট করে আসছেন। অনেকে দূরদূরান্ত থেকে কালকে থেকে এসে বসে আছেন। আপনারা আমাকে দেখতে চান, তাই সামনের দিকে এগিয়ে আসতে চান, সেটা আমি বুঝি। আপনাদের কাছে আমার বলার কী আছে? যখন আমি দেখি, দূরদূরান্ত থেকে আপনারা শুধু আমাকে একটু দেখবার জন্য ছুটে আসেন- যে ভালোবাসা আপনারা জীবন ভরে আমাকে দিয়েছেন, সেই ভালোবাসা যে কত বড় জিনিস যা জীবনে কেউ পেয়েছে কি না, কোনো নেতা পেয়েছে কি না, আমার জানা নাই ! কুড়িগ্রামের ভাইয়েরা বোনেরা, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়, আপনারা যে কষ্ট স্বীকার করেছেন, যে অত্যাচার সহ্য করেছেন, যে গ্রামকে-গ্রাম পাকিস্তানের বর্বর বাহিনী জ্বালিয়ে দিয়েছিল, তখন এই কুড়িগ্রামের ভাইয়েরাও সাড়ে সাত কোটি মানুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাকিস্তান বর্বরদের বিরুদ্ধে আপনারা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। ২৫ বছর পর্যন্ত পাকিস্তানের বর্বর শোষকরা আমার সোনার বাংলাকে লুট করে শেষ করে দিয়েছে। আমার সম্পদ লুট করেছে, আমার অর্থ লুট করেছে, আমার যা কিছু লুট করেছিল তা লুট করেছে। তারপরে যুদ্ধের সময় আমার সমস্ত জ্বালিয়ে পোড়ায়ে ছারখার করে দিয়ে গেছে।’
‘হ্যাঁ, সব নিতে পারে কিন্তু বাংলার মাটি নিবার পারে নাই। সব নিতে পারে, বাংলার সোনার মানুষকে ধ্বংস করতে পারে নাই। সব নিতে পারে, বাংলার মানুষের আদর্শকে ধ্বংস করতে পারে নাই। ইনশাআল্লাহ, দেশ যখন স্বাধীন হয়েছে, দেশ যখন মুক্ত হয়েছে, পঙ্গপালের দলকে যখন আমরা শেষ করতে পেরেছি, দুঃখ-কষ্ট আমাদের আছে- কারণ কিছুই নাই। জেল থেকে বের হয়ে এসে যখন আমি দেখলাম যে কিছুই নাই, কী করে আমার সাড়ে সাত কোটি লোক বাঁচবে! কোথায় কাপড়, কোথায় তেল, কোথায় খাবার, কোথায় পেট্রোল, কোথায় বীজ, কোথায় আমার মানুষের লাঙল, কোথায় আমাদের গরু- যা যেখানে পেয়েছে, সবকিছু শেষ করে দিয়ে গেছে। তবুও মানুষকে বাঁচাতে হবে। কী করে যে আল্লাহ আপনাদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছে, সত্যি আমি বলতে পারি না! বোধহয়, আল্লাহর মেহেরবানি ছিল। তাই কোনোমতে দু'মুঠো করে এনে বাংলার গ্রামের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি। ১শ’ কোটি টাকার রিলিফ আমি গ্রামে দিয়েছি।
তিনি বলেন, ‘দুঃখ হয়! চরিত্রের পরিবর্তন হয় নাই! এখনও একদল লোক আছে, যারা গরিবকে লুট করে খায়, রিলিফের মাল চুরি করে খায়, এদের আমি বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে চাই। ধ্বংস করতে চাই। এরা মানুষ না। এরা মানুষের অযোগ্য, এরা পশুর চেয়েও অধম। মানুষকে ভালোবাসতে হবে। মানুষকে ভালো না বেসে মানুষের সেবা করা যায় না। মানুষকে ভালোবাসার মধ্যে যদি কৃপণতা আর স্বার্থ থাকে, সে স্বার্থ নিয়ে মানুষকে ভালোবাসা যায় না আর ভালোবাসা পাওয়াও যায় না। আমার দুঃখ হয় যে, আজও পাকিস্তানি বর্বররা আমার ৩-৪ লক্ষ বাঙালিকে আটকায় রেখেছে, ওরা ছাড়ছে না। তারা ৩০ লক্ষ লোকের জীবন নিয়েও শান্তি পায় নাই। আমি বারবার অনুরোধ করেছি। আমি বিশ্ব দুনিয়ার বিবেকের কাছে অনুরোধ করেছি। সমস্ত দুনিয়ার দেশের কাছে আমি অনুরোধ করেছি এবং বলেছি, তোমরা আমার বাংলার মানুষকে ফেরত আনবার বন্দোবন্ত করে দাও। যখন এই যুদ্ধ হয়, যখন আমার বাংলার মানুষকে হত্যা করে, তখন তোমরা অনেকেই দেখেও দেখো নাই। কিন্তু এই সাউথ ইস্ট এশিয়ায়, এই উপমহাদেশে শান্তি বজায় করতে হলে, আমি শান্তিতে বাস করতে চাই। কারও সঙ্গে আমি দুশমনি করতে চাই না। আমি চাই আমার এই সোনার দেশের মানুষ কাজ করুক-খাক, কারও সঙ্গে কোনো দুশমনি নাই। যদি আমার গায়ে এসে কেউ পড়ে, যদি আমাকে আঘাত করার চেষ্টা করে, আমার দেশ এত ছোট নয়, মানুষ যতটুকু মনে করুক না কেন, আমার দেশের সাড়ে সাত কোটি লোক, আমার দেশ দুনিয়ার অষ্টম বৃহৎ রাষ্ট্র। আমার মানুষ একতাবদ্ধ। আমার দেশ সংগঠিত। আমার দেশ-দেশের জনসাধারণ যা আমি বলি তাই তারা শোনে, বাংলার মানুষকে নিয়ে ভুট্টো সাহেব আর খেলার চেষ্টা করো না।’
‘আপনাদের কাছে আমিও আবেদন করব যে, আপনারা সত্য পথে চলবেন, ন্যায়ের পথে চলবেন, অন্যায়ের মোকাবিলা করবেন, দেশকে ভালোবাসবেন এবং দেশকে গড়বেন এবং আপনারা যদি পয়দা করতে পারেন তা সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করতে পারবেন। ভবিষ্যৎ আমরা যারা আছি আমাদের বয়স হয়েছে, আমরা ভোগ করতে না পারি, কিন্তু এমন কিছু করে যাই, যাতে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধররা, আর মানুষের কাছে হাত পাততে না হয়, ওরা সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করতে পারে, সোনার দেশ সোনার বাংলা হয়ে যায়। খোদা হাফেজ। জয় বাংলা।'
১৯৭৩ সালে কুড়িগ্রাম কলেজ মাঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া এ ভাষণটি সংগ্রহ করা হয় উত্তরবঙ্গ জাদুঘর থেকে। এ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকন বলেন, 'আমি যেহেতু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভিন্ন সময় আলোচনায় অংশ নেই বা ইতিহাসের প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধুকে বারবার আলোচনায় আনতেই তাতে আমার স্মরণে আসে, বঙ্গবন্ধু তো স্বাধীনতা-পূর্ব ও পরবর্তী কুড়িগ্রামে এসে ভাষণ দিয়েছিলেন। এই বক্তব্যগুলো আমি অনেক দিন ধরে খোঁজাখুঁজি করি, কিন্তু পাই না। বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন আর্কাইভে খুঁজি, বিভিন্ন পরিচিতজনের কাছে খুঁজি। এখানে যারা তথ্য অফিসার ছিলেন, তথ্যের দায়িত্বে ছিলেন, তাদের কাছেও চেয়েছি, কিন্তু আমি এটা পাইনি। পরবর্তীকালে খুবই একটা আশাব্যঞ্জক ঘটনা ছিল যে, পিপলস ভয়েস নামে একটা প্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটিসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় দেওয়া ভাষণ সংরক্ষণ করেছে। আমি এই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া বিভিন্ন সময়কার মোট ৩২ ঘণ্টা স্থিতির ভাষণ সংগ্রহ করে জাদুঘরে সংরক্ষণ করে রেখেছি।'
আব্রাহাম লিংকন বলেন, 'বঙ্গবন্ধু যে কুড়িগ্রামেও এসেছেন, কুড়িগ্রামের মানুষের জন্য সুনির্দিষ্ট করে নাম উচ্চারণ করে বলেছেন- কুড়িগ্রামের ভাই ও বোনেরা, এটি কুড়িগ্রামের নতুন প্রজন্ম জানে না। এটি যখন শোনে, তখন কিন্তু অবাক হয়ে যায়! তখন তাদের ভালো লাগে যে, বঙ্গবন্ধু কুড়িগ্রামে এসেছেন, এই মাটিকে স্পর্শ করেছেন!'
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ হওয়ার মাত্র দুই বছর তিন মাসের মাথায় দেখা দেয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে রংপুর অঞ্চলে। এপ্রিল থেকে জুলাই এই সময়টাতে বাংলাদেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এবং ব্রহ্মপুত্র নদে বিধ্বংসী বন্যা দেখা দেয়, যা মে-জুলাইয়ের দিকে ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। প্লাবনে ধানক্ষেত ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় চালের দাম অসম্ভবভাবে বেড়ে যায়। জনশ্রুতি পাওয়া যায়, আগস্ট মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কুড়িগ্রামের বুভুক্ষু মানুষকে দেখতে হেলিকপ্টারে চিলমারী আসেন।
১৯৭৪-এ রানীগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, বর্তমান চিলমারী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও চিলমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শওকত আলী সরকার বীরবিক্রম দুর্ভিক্ষকালের স্মৃতি রোমন্থন করে বলেছেন, '৭৪ সালের ভয়াবহ বন্যার পর পরেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চিলমারীতে এসেছিলেন বন্যাদুর্গত মানুষদের দেখার জন্য। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু থানাহাট হাইস্কুল মাঠে (বর্তমান থানাহাট সরকারি এইউ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়) যখন হেলিকপ্টার থেকে নামলেন, তখন তাকে গার্ড অব অনার দেওয়ার জন্য একদল পুলিশ প্রস্তুত ছিল। কিন্তু তিনি গার্ড অব অনার না নিয়ে সরাসরি লোকজনের ভেতরে ঢুকে পড়লেন, আর লোকজন তাকে পেয়ে যে কী উচ্ছ্বসিত হলো! সেই সময় মাঠে ছিপ ছিপানি পানি ও কাদাও ছিল। সবাই জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করছে, হাত মেলাচ্ছে। এভাবে সারা মাঠ তিনি ঘুরলেন। সেই এক অন্যরকম পরিবেশ। অভূতপূর্ব পরিবেশ!'
তিনি আরও বলেন, পরে বঙ্গবন্ধু থানাহাট হাইস্কুল মাঠে একটি রুমে বসেন। সেখানে তিনি আঞ্চলিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ও ত্রাণ তৎপরতা নিয়ে আলোচনা ও নির্দেশনা প্রদান করে থানাহাট হাইস্কুল মাঠে ভাষণ দেন। সেই জনসভা ছিল লোকে ছয়লাভ, মানে তাকে দেখার জন্য সবাই উৎসুক। তিনি যে বক্তব্য দিলেন, তখন মাইক সিস্টেম সেরকম বড় ছিল না, তার পরও এত লোকের মধ্যে একটা যে পিন পড়লে শব্দ হয়, এ রকম শব্দও হয়নি। নেতার বক্তব্য সবাই গভীর মনোযোগসহ এবং আগ্রহ ভরে শুনলেন।
মন্তব্য করুন