ছড়ড়া এখন কড়ড়া ভারী; রইবো না আর বন্দি
ঘুরবে নাকি রাজ্যি জুড়ে সব করেছে ফন্দি।
হাসির ছড়া দ্রোহের ছড়া প্রেমের ছড়া যততো
একসাথে সব দাঁড়িয়ে বলে: আমরা দেখো কততো।
কড়ড়া ছাঁচের ছড়ড়ারা সব; বেরিয়ে এসে আজ
আনবে নাকি নতুন সময় তাইতো এতো সাজ।
এই ছড়াটার নিচে তারিখ লেখা- ১২.০৪.১৯৭৭। আসলেই কি ৭৭ সালে লেখা? নাকি তারও আগের? নাকি কাল রাতে লেখা একেবারে কড়কড়ে? এটাই হয়তো ছড়ার শক্তি। শত বছর আগের ছড়া পড়লেও যেন মনে হয়, এই তো, একটু আগেই লেখা। এই সময়েরই লেখা। ছড়ার এই আবেদনই তাকে কালজয়ী করে তোলে। তা নাহলে আমরা আজও কেন সভা-সমাবেশে ছড়া না বলে জমাতে পারি না! এখনও আমরা বলি-তেলের শিশি ভাঙল বলে/খুকুর 'পরে রাগ করো/তোমরা যে সব বুড়ো খোকা/ভারত ভেঙে ভাগ করো!/তার বেলা?
অন্নদাশঙ্করের এই ছড়াটাও তো সময়ের আয়না। আজ-কালেরই যেন লেখা! আজ থেকে একশ বাইশ বছর আগে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী শিশুসাহিত্য কথাটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন যোগীন্দ্রনাথ সরকার সংকলিত 'খুকুমণির ছড়া' (১৩০৬) বইয়ের ভূমিকা লিখতে গিয়ে। শিশুসাহিত্য কথাটি আসায় মনে পড়ে গেলো ছোটবেলার কথা। সেই এইটুকুন বয়স থেকেই আমরা ঘুম পাড়ানি ছড়ায় অভ্যস্ত হয়ে যাই। ছড়াই যেন আমাদের প্রথম পাঠ। ছড়ার ছন্দেই আমাদের হেলেদুলে উঠে দাঁড়ানো। তাই ছোটবেলায় ছড়ার যেই বীজ বাবা-মা কিংবা দাদি-নানিরা আমাদের ভেতর পুঁতে দেন তা আস্তে আস্তে পল্লবিত হতে থাকে। শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতির রূপ ধারণ করে। তাই ছড়া আমাদের সহজে টেনে নিয়ে যায় তার রাজ্যে। খুব সহজেই আবেগাপ্লুত করতে পারে। আবার স্লোগান মুখর করে রাজপথে নামিয়ে দিতে পারে। তখন আমরা আর নিজের মধ্যে স্থির থাকতে পারি না। ছড়ার শরীরে ভর করি। ছড়ার দেখানো পথে ছুটে চলি! এই বইয়ের ছড়াগুলোও পাঠককে টেনে নেওয়ার অদ্ভুত এক ক্ষমতা রাখে; তার রাজ্যে। এই ছড়াগুলোরও আছে আবেগী করে তোলার, রাজপথে নামিয়ে দেওয়ার, অথবা প্রেমিকার কাছ থেকে ভালোবাসা আদায় করে নেওয়ার ক্ষমতা। আর এখানেই তো ছড়ার সার্থকতা। জাতি হিসেবে আমরা যেমন অদ্ভুত, তেমনি সাহিত্যের ক্যাটাগরিতে ছড়াও কিছুটা অদ্ভুত। ছড়া, মূলত প্রকাশ করে সব বয়সীদের দৃষ্টিকোণ! ছড়ার মধ্যেই সমাজের পরিবর্তনের ইশারা উঠে আসে। এইভাবে দেখলে ছড়ার ভিতর দিয়ে খুব সহজেই একটি জাতির মনোজাগতিক চালচিত্র যেমন বোঝা যায়, তেমনি তার মানবসম্পদের পথ-চলার ঐতিহাসিক চিত্রও ফুটে ওঠে। বাংলা ভাষায় রচিত ছড়ার জরিপ চালালে তাই দৃশ্যমান হওয়ার কথা। মনজুরুল আহসান বুলবুল সাংবাদিক। রাজনৈতিক ভাষ্যকার। টেলিভিশন টকশোর পরিচিত ব্যক্তিত্ব। শুধু তাই নয়; তিনি সাহিত্যে নিবেদিত প্রাণ। অন্তত তার এই ছড়াগ্রন্থ পড়ে তা বুঝতে পারবেন সচেতন পাঠক। একসময় সমাজ সচেতন ও রাজনৈতিক ছড়া লিখে আলোচনায় উঠে এসেছিলেন মনজুরুল আহসান বুলবুল। সাংবাদিক পরিচয় ছাপিয়ে নতুন আরেকটি পরিচয়ে তিনি পরিচিতি পান। তা হলো প্রতিশ্রুতিশীল মেধাবী ছড়াকার পরিচয়। বলা যায়, এই পরিচয় এখনও ধরে রেখেছেন তিনি। লিখছেন নিয়মিত! শক্তিমান এই ছড়াকারের ছড়া নিয়ে খেলার যেই মেধা ও সাহস তা তার ''দুইশ' ছড়ার ঝিলিক'' গ্রন্থ পড়ে আবিস্কার করতে পারবেন অনায়াসে। নামেই বুঝতে পারছেন ছড়াগ্রন্থটি সাজানো হয়েছে লেখকের দুইশ ছড়া দিয়ে। যেই ছড়া দিয়ে গ্রন্থ শুরু তা লেখা হয়েছে ১৯৭৭ সালে। পরবর্তী ১৯৯টি ছড়ার বেশিরভাগই লেখা হয়েছে ১৯৭৮ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে। এসব ছড়ার তারিখ দেখে তার সঙ্গে রাজনীতির চিত্র মেলালে কিছুটা হলেও বোঝা যাবে স্বাধীন বাংলাদেশ একসময় কী কাল পার করেছে। তাই বলা যায়, এই ছড়াগুলো কেবল ছড়া নয়, কালের চিত্রও বটে। কিছু ছড়ার দিন-তারিখ লেখা না থাকলেও পড়ে বোঝা যায়, সেগুলোও একই সময়ে বা কিছু আগে-পরে লেখা। ছড়াকার মনজুরুল আহসান বুলবুলের ছড়াগুলোর বিষয় ভাবনা, বাক্যরীতি, গঠনশৈলী, ছন্দ-শিল্প- সব মিলিয়ে অন্যরকম এক দ্যুতি ছড়ায়। ছড়ামনস্ক পাঠকের অনন্য এক খোরাক হয়ে উঠুক ''দুইশ' ছড়ার ঝিলিক''!