আপন দর্পণ
‘জীবন এত ছোট ক্যানে?’
ইমদাদুল হক মিলন [জন্ম : ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৫৫]
ইমদাদুল হক মিলন
প্রকাশ: ১৯ জানুয়ারি ২০২৪ | ১২:২৯
শৈশবের প্রিয় মুহূর্ত
আমার নানির আলমারিতে পুরোনো কিছু বই ছিল। যেমন– ‘বিষাদ-সিন্ধু’, ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘দেবদাস’। তখনকার বর্ষাকালগুলো ছিল অনেক লম্বা। দিনরাত বৃষ্টি হচ্ছে তো হচ্ছেই। শরৎ হেমন্ত আমরা সেভাবে অনুভবই করতাম না। শীতকালটা খুব মনে পড়ে। অনেকটা বেলা করে রোদ উঠেছে। শীতের রোদ তীব্র হয়। আলমারির বইগুলো বের করে উঠোনের মাটিতে পাটি বিছিয়ে রোদে দিতেন নানি। বর্ষায় স্যাঁতসেঁতে হওয়া বইগুলো থেকে অদ্ভুত একটা গন্ধ উঠত তখন। সেই ছিল আমার শৈশবের প্রিয় মুহূর্ত।
ভাবনাদর্শনে প্রভাবিত করেছে যে গ্রন্থ, যে ব্যক্তি এবং যে পথ
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ উপন্যাসটি খুব প্রভাবিত করেছে। ব্যক্তি ও লেখক হিসেবে প্রভাবিত করেছেন সমরেশ বসু। আর পথের কথা যদি বলি, সেই পথটি হচ্ছে ‘মানুষের প্রতি ভালোবাসা’।
প্রথম প্রকাশিত বই ঘিরে স্মৃতি
বাংলাবাজার থেকে ‘জোনাকী’ নামে একটি সিনেমা মাসিক বেরোত। সেখানে গল্প জমা দিতে যাই। পাশে ‘বুক সোসাইটি’র বিশাল বইয়ের দোকান। সামনের টেবিলে বসে একজন ছোটখাটো মানুষ সব সময় প্রুফ দেখছেন আর পান খাচ্ছেন। ভদ্রলোকের নাম মোস্তফা কামাল। তিনিও লেখালেখি করেন। হাতের লেখা মুক্তোর মতো। এক বিকেলে আমাকে ডেকে বললেন, ‘তোমার কয়েকটা গল্প দিয়ে যেও তো, পড়ে দেখব।’ বারোটা হালকা ধরনের প্রেমের গল্প একটা ফাইলে করে দিয়ে এলাম। ফাইলের ওপর লিখে দিলাম ‘ভালোবাসার গল্প’। তারপর তিন-চার মাস আর ওদিকে যাইনি। গল্পগুলো যে কামাল ভাইকে পড়তে দিয়েছিলাম, ভুলেই গেছি। এক বিকেলে ‘জোনাকী’ অফিসে যাচ্ছি, কামাল ভাই ডেকে বললেন, “আরে তুমি তো অদ্ভুত ছেলে! মাসখানেক আগে তোমার বই বেরিয়ে গেছে আর তোমার কোনো খবর নেই! বাসার ঠিকানাও তো দাওনি যে, খবর দেব? এই যে তোমার বই ‘ভালোবাসার গল্প’।” এই হচ্ছে প্রথম বইয়ের ইতিহাস।
যেভাবে প্রথম নাটক লেখা হয়
আমার প্রথম নাটক ‘মায়াকানন’, দ্বিতীয় নাটক ‘সখা তুমি সখী তুমি’। দুটোই অন্যের দেওয়া নাট্যরূপ। আমার নিজের লেখা প্রথম নাটক ‘নায়ক’। আফজাল হোসেনের বাসায় বসে বসে লিখেছি। নাটক লেখার ক্ষেত্রে আফজাল খুব সাহায্য করেছে। কারণ, তখনও আমি নাটক লিখতে শিখিনি। ধারাবাহিক নাটক ছিল। অতি আধুনিকতার কারণে ছেলেরা মেয়েবন্ধুদের সঙ্গে তুই তোকারি করছে– এ রকম অদ্ভুত কারণ দেখিয়ে নাটকটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
প্রিয় লেখক যারা এবং যে কারণে তারা প্রিয়
বাংলা সাহিত্য ও বিদেশি সাহিত্যে প্রিয় লেখকের সংখ্যা অনেক। তাদের নাম কেন প্রিয়, সেসব বলতে গেলে এই সাক্ষাৎকার অতি দীর্ঘ হয়ে যাবে। একেকজন বড় লেখক একেক কারণে প্রিয় হন। বাংলায় যেমন রবীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। তাদের গদ্য আমাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করে। বঙ্কিম বা বিদ্যাসাগরের কথা থাক। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন জগৎ ও সমাজ নিয়ে তীক্ষ্ম প্রশ্ন, বিভূতিভূষণের বর্ণনা, তারাশঙ্করের বিশাল পটভূমিকে সাহিত্যে তুলে আনা, সতীনাথ ভাদুড়ীর চরিত্র নির্মাণ (ঢোঁড়াই চরিত মানস), সমরেশ বসুর নব নব দিগন্ত উন্মোচন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘অস্তিত্ব সংকট’, হাসান আজিজুল হকের ‘শ্রেণী বৈষম্য আর দেশভাগের বেদনা’ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘ইতিহাস চেতনার ভেতর নিম্নবর্গের মানুষকে স্থাপন’– এমন সব কারণে, অনেক লেখকই প্রিয়।
এখন যা লিখছি, পড়ছি
আমি একসঙ্গে বেশ কয়েকটা লেখা লিখি। পদ্মার জেগে ওঠা চর নিয়ে উপন্যাস লিখলাম। পাশাপাশি লিখলাম একটা কিশোর থ্রিলার। ’৬৫ সালে একটি হত্যাকাণ্ড নিয়ে একটি উপন্যাসের অনেকখানি লিখেছি। মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস ‘সাড়ে তিন হাত ভূমি’র দ্বিতীয় পর্ব লিখছি আর লিখছি প্রেমে প্রতারিত হওয়া একটি মেয়ের হিংস্র হয়ে ওঠার কাহিনি। থ্রিলারধর্মী উপন্যাস। আর পড়ছি, লেখকদের আত্মজীবনী। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘এ জীবনের যত মধুর ভুলগুলি’ পড়ে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থেকেছি।
প্রিয় উদ্ধৃতি : তারাশঙ্করের ‘কবি’ উপন্যাসের সেই মহান উক্তি ‘জীবন এত ছোট ক্যানে?’
কথোপকথন : ফরিদুল ইসলাম নির্জন