ঢাকা বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪

প্রচ্ছদ

নহি দেবী নহি সামান্যা নারী

নহি দেবী নহি সামান্যা নারী

কোলাজ

নবনীতা দেবসেন

প্রকাশ: ১৯ জানুয়ারি ২০২৪ | ১২:৩৯

বিশ-বাইশ বছর আগের কথা। সমরেশ বসু একটি শারদীয় সংখ্যায় লিখলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব পুরুষের সঙ্গে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রীর এক মধুর প্রেমের কাহিনি।
সেইটে পড়ে আমার মনে হলো, বাঃ, পুরুষমানুষ বলে বুঝি যা খুশি তাই লিখতে পারা যায়? আমিও তা হলে লিখি না কেন? ফারাকটা একটু কমিয়ে চল্লিশোর্ধ্ব একজন মেয়ের সঙ্গে দ্বাদশ শ্রেণির কোনো ছাত্রের প্রেমকথা! দেখি, পাঠক কী বলে।

কিন্তু খাবার টেবিলে কথাটা পাড়তেই ঘরের মধ্যে বজ্রপাত হল। ‘সে কী! তুই কী বলছিস? তোর কি মাথা খারাপ হলো?’ মা হতভম্ব হয়ে বলে উঠলেন, ‘ওই সব লিখবি, ছাপাবি, তার পরেও মা-বাপেরা তোদের কাছে কলেজে ছেলেপুলেদের পড়তে পাঠাবে ভেবেছিস? তোকে তো ডাইনি মনে করবে!’

মেয়ে তো দেখি প্রায় কেঁদেই ফেলেছে– তার শিক্ষিকারা, তার বন্ধুরা– সব্বাই ওর মাকে কী মনে করবে? সে আর মুখই তো দেখাতে পারবে না! ‘না, মা, তুমি ও সব কক্ষনও লিখবে না।’ 

আমি তো ঘরের ভিতরের প্রতিক্রিয়া দেখেই হতবাক। মা না হয়ে যদি বাবা হতুম, তা হলে কিন্তু মেয়ের শিক্ষক, সতীর্থ, আমার ছাত্রছাত্রীরা কেউই কিছু মনে করত না। বাবারা মুক্ত প্রাণী। তাদের কলমও মুক্ত। তারা যা প্রাণ চায়, লিখতে পারেন। আমি মেয়ে, আমি পারি না। যেমন, যত গরমই হোক, বাবারা দিব্যি খালি গায়ে পাখা চালিয়ে ঘুমোতে পারেন। আমরা, বেচারি মায়েরা পারি না!
হ্যাঁ, ব্যাপারটা একই। সামাজিক অনুশাসনের কল্যাণে একই অভিজ্ঞতা পুরুষের কাছে এক চেহারা নেয়, স্ত্রীর কাছে অন্য এক। সমাজের শিক্ষানুযায়ী স্ত্রী ও পুরুষের কাছে আমাদের প্রত্যাশা

আলাদা। ফলে আমাদের প্রতিক্রিয়াও হয় অন্যরকম। সাহিত্যক্ষেত্রে তার প্রকাশেরও ভিন্ন স্বরূপ। আমি সেই অসম প্রণয়ের কাহিনি লেখবার কথাটা ভেবেছিলুম পাঠকদের প্রতিক্রিয়ার জন্যই। কিন্তু লেখার আগে ঘরেই যে প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল, জবাব মিলে গেল তাতেই।

যে পিতৃতান্ত্রিক শাসন আমাদের কলমে বেড়ি পরিয়ে রেখেছে, আমাদের পরিবারও সেই শাসনযন্ত্রের অংশ। সবচেয়ে বড় কথা, এই সমাজব্যবস্থা আমাদের নিজেদেরও বাধ্য করে নিজের কলমকে সংযত করতে।

কলমের মুখে জালি পরিয়ে দেবার মতো সেই সংযম, যেমন করে কুকুরের মুখে জালি পরিয়ে আমরা তাকে কামড়ানো বা চেঁচানো থেকে বিরত করি। জগতে, জীবনে কত কিছুই তো আমি লিখতে চেয়েছি, কিন্তু লিখিনি। কত গল্প না লেখা রয়ে গেছে, কত কবিতা জন্ম নেয়নি। কারণ, আমার কলমে সীতার লক্ষ্মণরেখা টানা আছে। এবং এ দেশের অধিকাংশ মেয়েই আমার মতো। তসলিমার মতো নয়।

আমার মা বা মেয়ের প্রতিক্রিয়ার কারণ খুব একটা দুর্বোধ্য নয়। মা ভাবছেন, ‘সবাই ভাববে ওটা বুঝি আমার ডিভোর্সি মেয়েরই কথা।’

মেয়েও ভাবছে, ‘সবাই ভাববে ওটা নিশ্চয়ই আমার মায়ের জীবন।’ এহেন উদ্বেগে তারা আকুল হয়ে আমাকে লিখতে নিষেধ করছেন। এও তো ‘নিষিদ্ধ’ করাই? কিন্তু কেন সকলের মনে হবে গল্পটা আমারই জীবনের? কেননা, সেইটাই প্রথা। বেশির ভাগ সময়েই লেখিকাকে তাঁর লেখার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ করে দেখা হয়। সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে স্রষ্টীও হয়ে ওঠেন তাঁর সৃষ্টির অঙ্গ।

সুচিত্রা ভট্টাচার্যের কাছে শুনেছি, ওঁর ‘হেমন্তের পাখি’ পড়ে বুদ্ধদেব গুহ তাঁকে ফোন করেন। সুচিত্রার স্বামী ধরলে বলেন, ‘সুপ্রতিম? অদিতিকে ডেকে দাও তো?’ উপন্যাসটি সুচিত্রার আত্মজীবনী হয়ে উঠল তাঁর পাঠক-নয়নে। এবং আরও অনেকের।

আমার প্রথম উপন্যাস ‘আমি, অনুপম’ প্রকাশিত হবার পর অনেকেই ভেবেছিলেন, অনুপম নির্ঘাত ‘অমর্ত্য সেন’ আর ‘সুধা’ আমি স্বয়ং। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও এটা দেখা গেছে। ‘ফায়ার’ ছবির পরিচালক দীপা মেহতাকে অনেকবার একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে– ‘আপনি কি সমকামী?’

সমস্যা কি একটা? কী লিখব, কেমন ভাষায় লিখব, সেটা সবারই যেন দায়িত্ব।

পনেরো-বিশ বছর আগে, প্রতুল গুপ্ত মশাইয়ের বাড়িতে সমরেশ মজুমদার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “নবনীতা, আপনাকে আমরা ভালোবাসি। কিন্তু আপনি এটা কী করলেন? ‘অজাচার’ বলে গল্প লিখলেন? তাতে ‘পাল খাওয়ানো’– এই গ্রাম্য ভাষাটি ব্যবহার করলেন? এ কি ভদ্রমহিলার কলমের ভাষা?”

তার অনেক বছর বাদে সম্প্রতি অনুজা কবি কাবেরী রায়চৌধুরীর ‘তালা ও চাবি’ কবিতাটির (যাতে ‘নষ্ট পুরুষকে’ আহ্বান জানানো হচ্ছে ‘সতীত্বের তালা খুলে’ ফেলতে) প্রসঙ্গে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় কাবেরীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘এই কবিতা তুমি প্রকাশ্যে পড়তে পারবে?’

পুরুষমানুষ প্রকাশ্যে অনেক কিছুই বলতে-কইতে সক্ষম। সত্যিই তো, মেয়েরা কে-ই-বা কতটা কী পারে? লেখার বিষয়বস্তু, লেখার ভাষা, সবকিছুতেই একটা করে গণ্ডি টানা আছে আমাদের। আমাদের লেখা আমাদেরই সামগ্রিক অভিব্যক্তির অঙ্গ হয়ে পড়ে– আমাদের থেকে আলাদা হয়ে নিজস্ব পরিচয়ে দাঁড়িয়ে ওঠে না। সমাজে চলতে ফিরতে আমাদের ওপরে যে প্রচলিত নিষেধাজ্ঞাগুলি জারি আছে, কলমেও সেইগুলি আপনা থেকে উড়ে এসে চেপে বসে।

কিন্তু পুরুষের বেলায় সেটা ঘটে না। চিত্রা লাহিড়ীর একটি কবিতায় ‘বুকের বোতাম খুলি’ এই কথাগুলি ছিল। সেটি টিভির কবিতাপাঠের আসরে তাঁকে পড়তে দেওয়া হয়নি। মেয়েমানুষের বুকের বোতাম কবিতাতেও খোলা যাবে না! আর একটা ঘটনা বলি। ষাটের শেষদিকে বা সত্তরের গোড়াতে ‘কৃত্তিবাস’-এ দেবারতি মিত্রের একটা কবিতা প্রকাশিত হলো ওরাল সেক্স বিষয়ে (‘পৃথিবীর সৌন্দর্য ও একাকী তারা দুজন’)। সেই কবিতা নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল। উঠেছিল রুচির প্রশ্ন, কুমারী মেয়ের দুঃসাহসের প্রশ্ন। কবিতাটিকে পড়তে হয়েছিল বিরূপ সমালোচনার মুখে। অথচ ওই একই বিষয়ে ওই পত্রিকাতেই অনেক আগে প্রকাশিত হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্পষ্টভাষী কবিতা। তা নিয়ে কিন্তু তরুণ কবির দুঃসাহসিকতায় প্রশংসারই ঢেউ উঠেছিল পাঠকমহলে।

আশির দশকে, খুব কাছাকাছি সময়ে বাংলায় দুটি ছবি তৈরি হয়েছিল। একটি অপর্ণা সেনের ‘পরমা’, অন্যটি সত্যজিৎ রায়ের ‘পিকু’। দুটিরই বিষয়বস্তু ছিল বিবাহবহির্ভূত প্রেম। অপর্ণা বিষয়ে অনেক ফিসফাস শোনা গেল যে, ওটা ওঁরই নিজস্ব জীবনের কথা। কিন্তু সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে এ ধরনের একটা কথাও কেউ বললেন না।

কেন এমন হয়? কেননা, আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারী যখন মননসমৃদ্ধ সৃজনের কাজে আসে, তখন সে জোর করে পুরুষের এলাকায় অনুপ্রবেশ করে। শিল্পের জগতে তার গতিবিধিতে সমাজের সংশয়, এবং প্রতিরোধ আপনা-আপনিই গড়ে ওঠে। মননজগতে নারী অনধিকারী। অনধিকারীর শাস্তি আছে। সেই শাস্তির রকমফেরও আছে। নারীর সৃষ্টি, যা সে লোকসমক্ষে উপস্থাপিত করছে, তা সাহিত্যই হোক বা চলচ্চিত্র– সেই পণ্যদ্রব্য তাকেও গ্রাস করে নেয়। নারীর মননশীলতাকে প্রতিরোধ করবার এটি একটি শক্তিশালী গুপ্ত অস্ত্র। 

পর্নোগ্রাফিতে যেমন একটা অলিখিত চুক্তি থাকে লেখক, প্রকাশক ও পুরুষ পাঠকের মধ্যে– সেখানে নারীকে পাঠক-বাজারে ভোগ্যপণ্য হিসেবে বিক্রি করা হয়– এখানেও তেমনই সামাজিক পটভূমিকায় একটা অলিখিত চুক্তি থাকে, যেখানে মেয়ে-লেখক, মেয়ে-পরিচালকরা নিজেই ভোগ্যপণ্য হিসেবে তাঁর সৃষ্টির অঙ্গ হয়ে বিক্রি হয়ে যান।

সার্কাস পার্টি ডক্টর জনসন কি আর সাধে বলেছিলেন যে, স্ত্রীলোক কলম ধরলেই তাঁর মনে হয় অহো! কী অদ্ভুত কৌতুক! ঠিক যেন কুকুরটি পিছনের দুই পায়ে খাড়া হয়ে হাঁটছে! আড়াইশ বছর পরে, এখনও সেই কুকুর তেমনই করে হাঁটছে। স্ত্রীলোকের লেখালেখি ওই সার্কাস দেখানোর মতো। নকল করা চলন। অনুকরণের খেলা। লেখা তো মননের শিল্প। যুক্তি, বুদ্ধি, মেধা– এ সবই পুরুষের নিজস্ব সম্পত্তি। নারীর আছে শরীর আর আবেগ। রমণীর রমণযোগ্যতা। নারীও শিল্পচর্চা করবে? 

বেশ তো নৃত্যগীতাদি করুক না! নয়ন ভরে দিক, শ্রবণ ভরে দিক, ভরুক হৃদয়। 

কিন্তু মনন? পঞ্চেন্দ্রিয়ের সীমার বাইরে ঝুলছে মননের চাবিকাঠি। ভাষা, যা দিয়ে সাহিত্য গড়া হয়, সেও তো ইন্দ্রিয়ের বেড়া পেরিয়ে কিছু শব্দের সংকেতের খেলা!

কলমে অধিকার মগজের, আর মগজে অধিকার পুরুষের। এমন একটা সাবেকি হিসাব চলে আসছে। কিন্তু মেয়েরা যখনই কলম ধরে, তখনই সেই হিসাবটা গুলিয়ে যায়। তাই একটা নিঃশব্দ বাধা, নিঃশব্দ প্রতিরোধ আপনা-আপনিই গড়ে ওঠে; পৃথিবীজুড়েই। কখনও সচেতন, কখনও-বা অসচেতন। এখানে এই অসচেতন প্রতিরোধের কয়েকটা উদাহরণ দিচ্ছি, আমরা সর্বক্ষণই যার মুখোমুখি হচ্ছি। মনে হয়, মেয়েদের লেখা ছেলেরা বড় একটা মন দিয়ে পড়েন না। অথবা পড়ে ফেললেও সেটা চট করে স্বীকার করেন না। অনেক দিন আগে আমি লিখেছিলুম, ‘‘প্রায়ই দয়ালু ভদ্রলোকেরা আমাকে বলেন, ‘আমার মা আপনার লেখার খুব ভক্ত’ কিংবা ‘আমার স্ত্রী আপনার সব বই পড়েন’, অর্থাৎ, তারা নিজেরা কেউ ওসব পড়েন না।’’ মেয়েদের লেখা মেয়েরাই পড়বে, মেয়েদের গান মেয়েরাই শুনবে বা মেয়েদের নাচ মেয়েরাই দেখবে, এমন নিয়ম নেই। ‘আমি পুরুষ, আমি আপনাদের লেখা পড়ি না’– ঘুরিয়ে এটা বলতে কারও সংকোচ হয় না। মেয়েদের লেখাকে অস্বীকার করবার এটা একটা উপায়। আশাপূর্ণা দেবী জ্ঞানপীঠ পাওয়ার পরে একজন যুবক সমালোচক ‘দেশ’-এ লিখেছিলেন, ‘শুনেছি, তিনি খুব ভালো লেখেন, আমার এখনও অবশ্য ওঁকে পড়া হয়ে ওঠেনি। কিন্তু আপনাদের বলব, পড়ে দেখুন।’

এও একরকম অস্বীকার করার ধরন। কেন, পড়া হয়নি কেন? ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ তো না পড়েই বলা হয় ‘পড়েছি’। যেমন– যাকে চিনতে চাই না, পথে মুখোমুখি হলেও আমরা তাকে চিনি না। এও তেমনই।” 

lনবনীতা দেবসেন [১৩ জানুয়ারি ১৯৩৮–৭ ডিসেম্বর ২০১৯] রচিত ‘নবনীতা’ গ্রন্থ থেকে।

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×