ঢাকা শনিবার, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫

সামাজিক মাধ্যম

গুজব, ভুয়া তথ্য এবং আগামী নির্বাচন

গুজব, ভুয়া তথ্য এবং আগামী নির্বাচন

অজিত কুমার সরকার

প্রকাশ: ১৯ জানুয়ারি ২০২২ | ১২:০০

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কি মানুষকে গণতন্ত্রী করছে? নাকি বাকস্বাধীনতার নামে গুজব, মিথ্যা, ভুয়া তথ্য প্রচারের সুযোগ দিয়ে গণতন্ত্রের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে? দায়িত্বজ্ঞানহীন পোস্ট বা মিথ্যা তথ্য শেয়ার কি সমাজে বিভাজন তৈরি করছে? এমন প্রশ্নই এখন ঘুরেফিরে উচ্চারিত হচ্ছে।
এ কথা ঠিক, ইন্টারনেট এবং ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব আবিস্কারের পথ ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোর আবির্ভাবে মানুষ স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের সুযোগ পাচ্ছে। হাতে ইন্টারনেট সংযোগের একটি স্মার্ট ফোন অথবা অন্য কোনো ডিভাইস থাকলে একজন ব্যক্তি তার আইডি থেকে তথ্য, ছবি, অডিও-ভিডিও, চিত্র, ইনফোগ্রাফ আদান-প্রদান করতে পারছেন। ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের প্ল্যাটফর্ম উন্মুক্ত হওয়ায় প্রতিদিন এখানে প্রচুর তথ্য, অডিও-ভিডিও, ছবির সমাহার দেখা যায়। সব তথ্য, অডিও-ভিডিও যে বস্তুনিষ্ঠ ও বিশ্বাসযোগ্য, তা ভাবার কোনো কারণ নেই। কারণ কোনো ফিল্টার বল বা ফ্যাক্ট চেকিং টিম দ্বারা গুজব, মিথ্যা ও ভুয়া তথ্যগুলো চিহ্নিত করে তা সরানো হয় না। উদ্বেগের জায়গাটা এখানেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করেই গুজব ও ভেজাল খবর বিদ্যুতের গতিতে ছড়িয়ে যাচ্ছে, যা সমাজে অস্থিরতা তৈরি করছে। গণতন্ত্রের জন্যও হুমকি তৈরি করছে।
উদ্বেগ শুধু বাংলাদেশের নয়, গোটা বিশ্বের। নির্বাচন ঘিরে ছদ্ম ঘটনা, ভুয়া-মিথ্যা তথ্য ও খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ট্রাম্পের ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান কেমব্রিজ অ্যানালাইটিকাকে ভাড়া করার কথা প্রায় সবারই জানা। এ প্রতিষ্ঠানটি আমেরিকার প্রায় আট কোটি মানুষের ফেসবুক ডেটা বিশ্নেষণ করে ভোটারদের সাইকোগ্রাফি অনুসারে টার্গেটেড মেসেজ তৈরি করে অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়।
বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগটা একটু বেশিই। কারণ ২০২৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখেই ডিজিটাল জগতে ছদ্ম সত্য ঘটনা, ভুয়া ও মিথ্যা তথ্য-খবর তৈরির আলামত দেখা যাচ্ছে। অতি সম্প্রতি অন্যের ছবির সঙ্গে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের মুখমণ্ডলের ছবি ম্যানিপুলেট করে বসিয়ে অনেক পদের খাবার সামনে রেখে খাওয়ার ছবি দিয়ে একটি ছদ্ম ঘটনা তৈরি করা হয় এবং ফেসবুকে তা ভাইরাল হয়। দ্বিতীয় ঘটনাটি তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের যুক্তরাষ্ট্র সফর ঘিরে গুজব রটনা। কবীর আহমদ নামে এক প্রবাসীর আইডি থেকে প্রতিমন্ত্রী পলকের একটি ছবি এবং বাংলাদেশ সরকারের একটি জিও সংযুক্ত করে ফেসবুক পোস্টে তিনি লেখেন, 'প্রতিমন্ত্রী পলককে ঢুকতে দেয়নি আমেরিকা।' ৩ জানুয়ারি ২০২১ জুনাইদ আহমেদ পলক তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ ও আইডিতে সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্র সফরের বেশ কিছু ছবি ও তথ্য উল্লেখ করে পোস্ট করেন। পরে রিউমর স্ক্যানার নামে একটি ফ্যাক্ট চেকিং দল অনুসন্ধানের পর ৬ জানুয়ারি ২০২১ পলকের যুক্তরাষ্ট্র সফরের তথ্য ও ছবি সত্য বলে প্রকাশ করে। ততক্ষণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব রটনার পোস্টটি ভাইরাল হয়। প্রশ্ন হলো, এসব দেখে মানুষের মধ্যে যে সংশয়-সন্দেহের প্রবণতা তৈরি হলো এবং অনেকে মিথ্যাকে সত্য ভাবতে শুরু করল, তা দূর করার দায়িত্ব কার? একবাক্যে হয়তো সবাই বলবেন, ফেসবুক কর্তৃপক্ষের। কিন্তু অভিযোগের ভিত্তিতে গুজব, মিথ্যা ও ভুয়া তথ্য-খবর অপসারণে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ কতটা আগ্রহী? এ ব্যাপারে ফেসবুকের প্রক্রিয়াটি বেশ লম্বা। অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ নিয়ে বোর্ড আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়। ততক্ষণে অনেক সময় পার হয়ে যায়। এতে বড় ধরনের ক্ষতিও হয়ে যায়। যেমন- পার্বত্য চট্টগ্রামের রামুর বৌদ্ধমন্দির, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর এবং কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে হামলা চালানোর আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিয়ে মানুষের মধ্যে সেন্টিমেন্ট তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের এসব ক্ষতিকর পোস্ট ফেসবুক কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিক অপসারণ করতে পারেনি।
আগেই বলেছি, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে গুজব, মিথ্যা, ভুয়া তথ্য ও খবর প্রচারের আলামত পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর নেপথ্যে আছে রাজনীতি। আছে সংগঠিত শক্তি, যারা তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করছে সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট এবং জনমতকে প্রভাবিত করার জন্য। সুসংগঠিত উদ্দেশ্যমূলক এ ধরনের প্রচারণাকে বলা হয় কম্পিউটেশনাল প্রপাগান্ডা বা গণনাভিত্তিক উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা। এ কাজে বিপুল সংখ্যক ভুয়া অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে দেশের বাইরে থেকে এ ধরনের প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়। নির্বাচন এগিয়ে এলে সমাজে বিভাজন তৈরি এবং ভোটারদের মন ঘুরিয়ে দিতে লাখ লাখ ডলার ব্যয় করে ডকুমেন্টারি, অডিও-ভিডিও তৈরি করা এবং তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
ধরেই নেওয়া যায়, আগামী নির্বাচন ঘিরে বাংলাদেশের পাঁচ কোটিরও বেশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীকে টার্গেট করে সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তির গুজব, মিথ্যা ও ভুয়া তথ্য বা খবর ছড়ানো আরও বৃদ্ধি পাবে। সে ক্ষেত্রে অতীতের বাস্তবতায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব, মিথ্যা ও ভুয়া তথ্য বা খবর থেকে সৃষ্ট সংশয়-সন্দেহ ও জনমনে বিভ্রান্তি দূর করার জন্য শুধু ফেসবুক কর্তৃপক্ষের দিকে চেয়ে বসে থাকা কতটা যৌক্তিক? সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
বিশ্বের অনেক দেশের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমগুলো দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা উপহারের দায়বদ্ধতা থেকে অনলাইনের তথ্য যাচাই-বাছাই করার জন্য ইউজার জেনারেটেড কনটেন্ট (ইউজিসি) সাইট খুলেছে। বিবিসি এবং সিএনএনে একজন সোশ্যাল মিডিয়া এডিটরের নেতৃত্বে ডেডিকেটেড উইং রয়েছে। এ উইংয়ের কাজ হলো অনলাইনের মিথ্যা, ভুয়া ও ভেজাল তথ্য-খবরের পরিবর্তে সংবাদের উৎস হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য ও বস্তুনিষ্ঠ কনটেন্ট ব্যবহার করা। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশের স্বার্থে অনলাইনের মিথ্যা, ভুয়া ও ভেজাল তথ্য-খবর চিহ্নিত করে দ্রুততার সঙ্গে প্রকৃত তথ্য জানাতে সরকারেরও দায়িত্ব রয়েছে। এ জন্য প্রয়োজন হলে ডেডিকেটেড উইং খুলতে হবে। আর ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর গণতন্ত্র বিকাশের স্বার্থে গুজব, মিথ্যা ও ভুয়া তথ্য বা খবর রোধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণে নতুন উদ্ভাবনী ও সৃজনশীল উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসা উচিত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো নিজেরা গুজব, মিথ্যা ও ভুয়া তথ্য বা খবর তৈরি করে না বলে তারা তা রোধে কাযর্কর ব্যবস্থা নেবে না; তা হতে পারে না।
অজিত কুমার সরকার: সিনিয়র সাংবাদিক

আরও পড়ুন

×