![মিনার মাহমুদ [১০ মার্চ ১৯৫৯-২৯ মার্চ ২০১২]](https://samakal.com/uploads/2022/03/online/photos/Untitled-51-samakal-622a45a682ddc.jpg)
মিনার মাহমুদ [১০ মার্চ ১৯৫৯-২৯ মার্চ ২০১২]
সময়টা তখন স্বৈরাচারের কুৎসিত দাম্ভিকতার! দুপুরচৈত্রের অলসতায় গণমানুষের নিঃসঙ্গতা ভেতরে ভেতরে কেবল ফুঁসে উঠছে। এমন দিনে জীবনানন্দের একাকী চিলও কান্না ভুলে জোনাকির আলোয় সন্ধান করে এক মুক্ত আকাশের। কিশোর বালকেরা ভাতঘুম ভুলে রোমান্টিক বিপ্লবের নতুন এক সমাজ নির্মাণকল্পে বিভোর। সালটা ১৯৮৬। ইতোমধ্যে স্বৈরাচারী সরকার 'ম্যাগালোম্যানিয়া প্যারানোয়া' ব্যাধিতে আসক্ত! ক্ষমতার দৈর্ঘ্য বিস্তৃত করতে করতে তা হত্যা, গুমসহ পেটোয়ার নিত্যনৈমিত্তিক নৃশংস ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়।
হত্যাজীবী, বুদ্ধিজীবী, স্বৈরমিডিয়াসহ, স্বৈররাজাকার বাহিনীর কমতিও ছিল না কোথাও। দেশব্যাপী যেন সব একাকার। তবুও ভেতরে ভেতরে ফুঁসে ওঠা তারুণ্য আর গুটিকয় মিডিয়া যেন কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করে না। এই একটা দিকে স্বৈরাচারও কেমন যেন একটু নরম! প্রেমিক মন। নেপথ্যে অবদান হয়তো ফুলেল ভালোবাসা আর কবিতাপ্রীতি!
সদ্য মাধ্যমিক অতিক্রম করা আমি খেলাধুলার সুযোগে মাঝে মাঝে রাজধানীর সোডিয়াম আলোয় খুঁজে পেতাম জন্ডিস রং। আর অগ্রজ মিনার মাহমুদের কল্যাণে সান্ধ্যকালীন আড্ডার স্পর্শ পেতাম বিভিন্ন পত্রিকার অফিস কিংবা সিনিয়র সাংবাদিকের কক্ষে। দেখেছিলাম স্বৈরমিডিয়া হোক আর যা-ই হোক, তখন সাংবাদিকরাও যেন কেমন! একেকজন বয়োবৃদ্ধ। সাংসারিক পিছুটানের ঘানির ওজন টনকে টন। যদিও পিছুটান না থাকলেও আজও অধিক ওজন বহন করে যাচ্ছে আমাদের নবাগতরা।
আর সে সময় সাংবাদিক মানেই ছিল প্রগাঢ় সমুদ্রজ্ঞানের আধার। তীক্ষ দৃষ্টি; চশমার ভারী লেন্সের ভেতর দিয়ে তাকালে মনে হতো এক-একজন সাক্ষাৎ দেবতা। ভেতরে-বাইরে, এমনকি অন্তরও বুঝি দেখে ফেলেছেন জ্ঞানের আলোয়! এমন একটা পরিস্থিতিতে বিশাল আলোকবর্তিকা হিসেবে জ্বলজ্বল করছিল সরকারি ট্রাস্টের পত্রিকা 'সাপ্তাহিক বিচিত্রা'। চালকের ককপিটে শাহাদাত চৌধুরী; একজন জন্মান্তরের তরুণ সাংবাদিক। বিচিত্রাতেও অধিক বয়সী সাংবাদিক যে ছিলেন না তা নয়; তবে তারাও এই ব্র্যান্ডিং যাত্রায় রক্ষা পেতেন প্রাচীরের মতো সাহস জুগিয়ে যাওয়া ককপিট থেকে। তবে সেসবও ছিল এক উচ্চমাত্রার সাপলুডু খেলামাত্র!
সাপ্তাহিক বিচিত্রায় মিনার মাহমুদ কন্ট্রিবিউটর হিসেবে সাংবাদিকতা শুরু করেন ১৯৮৪ সালের শেষ দিকে। তার আগে ফরিদপুরে স্থানীয় পত্রিকায় ব্যতিক্রম ধারার রিপোর্টিং। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে দৈনিক বাংলায় ছোটগল্প লিখে হাত পোড়ানো। ঢাকায় তার সূচনা হয়েছিল তৎকালীন লেখক বিনির্মাণের সম্পাদক কবি আহসান হাবীবের স্টম্ফটিকে। শুরুতে লিখতেন মোহাম্মাদ আলী মিনার নামে। গল্পগুলো সে নামের অক্ষরে প্রামাণ্য দলিল হয়েছিল। তবে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির নামটা সংক্ষিপ্ত করে দেন; জন্ম হয় একজন- মিনার মাহমুদের!
বিচিত্রায় রিপোর্টিংয়ে নতুন নতুন শব্দের ব্যবহার, বাক্যের ব্যতিক্রমী গঠন, উপস্থাপনা আর সাহসী লেখা শাহাদাত চৌধুরীর আশকারায় শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। শুধু কি রিপোর্টিং? সাক্ষাৎকার নেওয়ার প্রক্রিয়াটা ম্যাড়মেড়ে যুগ থেকে ওরিয়ানা ফালাসি যুগে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। দৈনিক ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা, চাঁদপুর-ফরিদগঞ্জের কুখ্যাত রাজাকার মাওলানা এম এ মান্নান। মান্নানের প্রত্যক্ষ যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ অসংখ্য রয়েছে। এম এ মান্নান স্বৈরাচার এরশাদের আশ্রয় এবং প্রশ্রয়ও পেয়েছিল। তথাকথিত মাওলানার সাক্ষাৎকার নেন মিনার মাহমুদ এবং সে লেখা সরকারি পত্রিকা সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ছেপেওছিলেন শাহাদাত চৌধুরী। মিনার মাহমুদ মাওলানা মান্নানকে প্রশ্ন করতে করতে একরকম 'নার্ভাস' করে দেন! অবশেষে মাওলানা আর কোনো উত্তর না পেয়ে উল্টো প্রশ্ন করেছিল, 'খোঁচান ক্যান অ্যা খোঁচান ক্যা?' এ উত্তরই হয়েছিল সে সংখ্যার প্রচ্ছদ হেডলাইন।
এরপর মিনার মাহমুদ নতুন কিছু বিষয় নিয়ে বিচিত্রার প্রচ্ছদ কাহিনি লিখতে থাকেন। বাংলাদেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয় নতুন মাত্রার! যেমন 'অপারেশন মংলা'; এর অনুসন্ধানে মিনার মাহমুদ বিশাল চোরাকারবারির ছদ্মবেশ নেয়। 'বাংলাদেশে হেরোইন'; এটা ছিল মাদকদ্রব্য হেরোইন নিয়ে বাংলাদেশের কোনো পত্রিকার প্রথম লেখা। এখানেও তিনি হেরোইন আসক্ত সেজে অনুসন্ধান চালান। একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাস নিয়ে কাভার স্টোরি করার পর মিনার মাহমুদের একাডেমিক পড়ালেখার ইতি ঘটে। আর কখনও ক্যাম্পাসে যেতে পারেননি তিনি এবং মাস্টার্স পরীক্ষাও আর দেওয়া হয়নি কোনোদিন। কারণ নীরু-বাবলু তখন ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রক!
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বাংলাদেশে ঔষধনীতি বাস্তবায়নের জন্য স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের সঙ্গে আঁতাত করেছিলেন। যাকে ইংরেজিতে বলা হয় : Successful Retreat। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী Successful Retreat-এর সুন্দর একটা বাংলা অনুবাদও করেছিলেন- 'সন্মানজনক পশ্চাদপসরণ'। হয়তো বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার ভালোর জন্যই ডা. জাফরুল্লাহ এটা করেছিলেন। শোনা গিয়েছিল মি. চৌধুরীর ওষুধনীতির অবলম্ব্বনে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী নিজ দেশে তা বাস্তবায়ন করেছিলেন। তবে বাংলাদেশে পরে বাস্তবায়িত হয় এবং ওষুধনীতির সুফলতা আজও মানুষ পাচ্ছে।
মিনার মাহমুদ সাপ্তাহিক বিচিত্রার পাশাপাশি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পত্রিকাতেও লেখালেখি করেছেন; এমনকি ঔষধনীতি বাস্তবায়নেও অনুসন্ধানী পর্যায়ে ভূমিকা রেখেছিলেন। তবে এ ঘটনা জন্ম দিয়েছিল আরেক নতুন ইতিহাসের। ওষুধ নিয়ে কাজ করার সময় মিনার মাহমুদের সঙ্গে পরিচয় হয় শিল্পপতি লতা হোসেনের। মিস লতা হোসেনকে মিনার মাহমুদ পরবর্তী সময়ে 'জীবনের বন্ধু' হিসেবে লেখায় উল্লেখ করেছিলেন। আমরা ডাকতাম লতা আপা বলে। আপা ছিলেন মূলত একটা ওষুধ শিল্পের মালিক। তার সঙ্গে কিছু কাজে মিনার মাহমুদ জড়িয়ে পড়লে ব্যাপারটা ডা. জাফরুল্লাহ স্বাভাবিকভাবে নেননি এবং শাহাদাত চৌধুরীর কাছে নালিশ করেন বলে জানা যায়। শাহাদাত চৌধুরী ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বিচিত্রায় মিনার মাহমুদের অবস্থা নড়বড়ে হয়ে পড়ে। এ ঘটনার পর মিনার মাহমুদ সিদ্ধান্ত নেন সাপ্তাহিক বিচিত্রা ছেড়ে দেওয়ার এবং দেনও!
বাংলাদেশে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন ১৯৮৬ সালের ৭ মে অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে মোট এক হাজার ৫২৭ জন প্রার্থী অংশগ্রহণ করেন। এতে জাতীয় পার্টি ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টা আসনে জয়ী হয়। সে নির্বাচনে কেন্দ্রগুলোতে সাধারণ ভোটার উপস্থিতি তেমন না হলেও মোট ভোটারের ৬১.১ শতাংশ ভোট সংগৃহীত হয়েছিল বলে কাগজে-কলমে রেকর্ডভুক্ত হয়। তবে ভোট রাজনীতির সহজ উত্তর পাওয়া যায় সাপ্তাহিক বিচিন্তার প্রথম সংখ্যায়। 'টেন ইন ওয়ান' এটা ছিল বিচিন্তার প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ হেডলাইন। আর শিল্পী মাসুক হেলালের আঁকা কার্টুনে ছিল একটা ভোটের ব্যালট বাক্স। বাক্সের সামনে দাঁড়ানো একজন ১০ হাত দিয়ে একসঙ্গে ১০টা করে ব্যালট পেপার সিল মেরে বাক্সে ফেলছে। ব্যালট পেপারে ছিল লাঙ্গলের সিল!
সাপ্তাহিক বিচিন্তার সবকিছুতেই ছিল চমক। প্রথম সংখ্যা থেকেই সার্কুলেশন হুহু করে বাড়তে থাকে। শুধু তাই নয়; ১৯৮৭ সালে বিচিন্তার একটা সংখ্যা বিক্রি হয়েছিল এক লাখ ৭৯ হাজার কপি। আর সে সময়ের তুমুল জনপ্রিয় পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাক ছাপা হতো এক লাখ ৬৮ হাজার কপির মতো। শুধু কি তাই, আর একটা তথ্য আজকাল অনেককে আরও চমকে দিতে পারে! সে সময় মিনার মাহমুদ ব্যতীত বিচিন্তার আর কোনো কর্মীর সাংবাদিকতার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। আর মিনার মাহমুদ মাত্র ২৭ বছর বয়সে হয়ে যান বাংলাদেশের তুমুল জনপ্রিয় একজন সম্পাদক। কিন্তু কীভাবে এই অসম্ভব কাজটা সম্ভব হয়েছিল? ১৯৮৬ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রা থেকে পদত্যাগ করার আগেই মিনার মাহমুদ নতুন পত্রিকা করার পরিকল্পনা করেছিলেন। তার পাশে এগিয়ে আসেন শিল্পপতি লতা হোসেন। মাত্র তিন মাসের মধ্যে প্রকাশনা প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হয়। পরিকল্পনামতো তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরপরই প্রথম সংখ্যা প্রকাশের সিদ্ধান্ত। ইস্কাটন দিলু রোডে অফিস নেওয়ার পরে দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় সাংবাদিকতায় আগ্রহীদের জন্য। বিজ্ঞাপনটা তেমন কিছু না, শুধু আহ্বান করা হয় সাংবাদিকতার জন্য প্রবল ইচ্ছাশক্তির। আর দেওয়া হয় ছোটখাটো এবং সাধারণ মানের দৃশ্যত অপ্রয়োজনীয় কিছু প্রশ্ন। যেমন শুদ্ধভাবে বাংলা লিখতে পারা, বয়সে তরুণ আর একটা নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর তিনশ শব্দের একটা লেখা। ব্যস, এটুকুই! সে সময় সাংবাদিকতার আগ্রহ দেখিয়ে ৭৬ হাজারের বেশি আবেদন জমা হয়েছিল। এদের মধ্য থেকে ১৫ জনের মতো একটা দল বাছাই করেন মিনার মাহমুদ। মূলত তারুণ্যকে উস্কে দিয়ে মিনার মাহমুদ সফল হয়েছিলেন। আর সাপ্তাহিক বিচিন্তা প্রকাশের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে শুরু হয় তারুণ্যনির্ভর সাংবাদিকতার। এ যেন ছিল বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতোন বিপ্লব!
সে সময় ঢাকার দিলু রোডে এক ভোরে দেখেছিলাম নিচতলার গ্যারেজে সাপ্তাহিক বিচিন্তার পাহাড়। একদিকে পত্রিকা প্যাকেট হচ্ছে। অন্যদিকে চলে যাচ্ছে, ছড়িয়ে যাচ্ছে ঢাকার বাইরে। আর পাহাড়ের স্তূপের ওপর তাকিয়ে দেখি সেখানে ঘুমাচ্ছে ছাপার দায়িত্বে থাকা আক্তার। দোতলায় যেতেই দেখি এখনকার হোটেল-রেস্তোরাঁর কর্মীরা যেমন করে রাত কাটায় সে ব্যবস্থা বিচিন্তার অফিসেও। যাদের ঢাকায় থাকার জায়গা ছিল না তাদের আবাসন ব্যবস্থা পত্রিকা অফিসেই। পত্রিকা বাজারে গিয়েছে। বিচিন্তার কর্মীরা আড্ডায় মত্ত। সব টগবগে তরুণ। কেউ কেউ আবার নতুন কাজেও চলে যায়। এ যেন আর এক ককপিট; এখানে সবাই সমান। মিনার মাহমুদ কেবল এদের মধ্য থেকে নতুন নতুন চিন্তা বের করছেন আর তা প্রকাশ করছেন শুধু।
দেখেছিলাম এরা আমার চেয়ে আর কতইবা বড় হবে? আসিফ নজরুল, আনোয়ার শাহাদাত, ফজলুল বারী, আনিস আলমগীর, দিপু হাসান বড়জোর আমার চেয়ে চার-পাঁচ বছরের বড়। তখন আমিও মনে মনে অনুভব করেছিলাম- হ্যাঁ, আমি তো একদিন সাংবাদিক হতে পারি; এজন্য বয়োবৃদ্ধ হতে হবে কেন?
অভ্যুত্থান দিবসে চট্টগ্রামে গণহত্যা এবং নিরোর বাঁশি! এই প্রচ্ছদ হেডলাইনের কার্টুন ছিল গণহত্যার লাশ পড়ে আছে ইতস্তত! আগুন জ্বলছে। আগুনের ওপর সিংহাসন পেতে স্বৈরাচার এরশাদ বাঁশি বাজাচ্ছে। তার পেছনে একটা গাধা! এটাই ছিল প্রথম কিস্তির সাপ্তাহিক বিচিন্তার শেষ স্যংখ্যা। পত্রিকাটা বাজারে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এরশাদ সরকার তা নিষিদ্ধ করে এবং বিচিন্তার প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। আর মিনার মাহমুদকে কোমরে দঁড়ি বেঁধে কারাগারে বন্দি করা হয়!
মিনার মাহমুদ বন্দি হলেও তার কর্মপদ্ধতিতে প্রায় সব মিডিয়া এবং নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকরা প্রভাবিত হয়েছিল। যা আজও অব্যাহত!
মন্তব্য করুন