অস্থির গরমে আরাধ্য বায়ুচান নিরুদ্দেশ। গাছের পাতা নড়ছে না। জলে টইটম্বুর হরমানি বিল কিংবা কূল উপচানো ধর্মখালের পানিরও কোনো ছপছপানি নেই। অমাবস্যার আঁধার গায়ে ঝিম ধরানো ভয় ছড়িয়ে রাতের প্রথম প্রহরের পরেই এ অন্ধকার জনপদে ভয়ের রাজত্ব কায়েম করেছে। বিলের উল্টো দিকে বহু বছরের পুরোনো কালভার্টের গোড়ায় বুড়ো রেইনট্রি গাছটি ভূতুড়েপনার অনেক মিথ মাথায় নিয়ে অন্ধকারে ঘাপটি মেরে আছে। অমাবস্যার এ রাত ঘিরে একটা অশনি ভাবনা তেলীকুড়ি গ্রামের ছোবান মিয়া আর তার বউয়ের বুকের ভেতর যেন সাঁড়াশি অভিযান চালাচ্ছে। একে তো গা ছমছম করা অন্ধকার, তারপর আবার অসহ্যকর গরম। এমন গরমে লোমকূপ ভিজিয়ে ঘাম বেরিয়ে গেলে শরীরে একটু আরাম পাওয়া যেত। কিন্তু গরম যেন শরীরে গিরগিটির মতো মোচড়াচ্ছে। ঘাম লোমকূপ ভিজিয়ে না শরীর বেয়ে পড়ছে, না তার পীড়াদায়ক কার্যকারিতা বন্ধ রেখেছে। বিচ্ছিরি ঘামে শরীর স্যাঁতসেঁতে লাগছে। এত রাতেও ঘুম যাদের এখনও পরাস্ত করতে পারেনি, তাদের অনেকেই বিছানায় ছটফট করছে। কেউ অস্টম্ফুট স্বরে গাল দিচ্ছে, মরার গরম। খালেক সাহেবের বাড়ির উঁচু শিমুল গাছের মগডালে বাসা বেঁধে থাকা ঈগল পাখিটা অন্যান্য দিন রাতের প্রহর অনুযায়ী ডানা ঝাপটে হাঁক দিত। আজ যেন সেই পাখিটাও গরমে কাবু হয়ে হাঁক দিতে ভুলে গেছে।
তেলীকুড়ির পাশের গ্রাম বেঙ্গালায় দেবেন্দ্র চন্দ্র পালের স্ত্রী স্বামীকে বাতাস করতে করতে সারা দিনের ক্লান্তির দখলে হাতের মুঠোয় তালপাখা রেখেই ঘুমিয়ে গেছেন। গরমে দেবেন্দ্র বাবুর শরীরের অস্থিরতা যখন কিছুটা ঘুমের কাছে পরাভূত হয়, তখন একটু তন্দ্রার ভাব আসে। চোখ বুজে আসতেই দরজায় টোকা পড়ে।
'দাদা, দাদা ... ও দাদা, একটু ওঠেন।'
দরজায় দাঁড়ানো আগন্তুকের কণ্ঠের আকুতি রাতের নির্জনতায় খুব করুণ শোনায়। দেবেন্দ্র বাবু চোখ খোলেন। তিনি আগন্তুকের হাঁপানোর শব্দও শুনতে পান। তার তন্দ্রা কেটে যাওয়ায় একটু বিরক্তি এলেও মুহূর্তের মধ্যে তা মিইয়ে যায়। বারান্দায় দাঁড়ানো আগন্তুকের হাতের হারিকেনের কিছুটা আলো দরজার নিচ দিয়ে দেবেন্দ্র বাবুর ঘরের মেজেতে হামাগুড়ি দেয়।
'কে গো?'
দেবেন্দ্র বাবু জিজ্ঞেস করেন।
'আমি তেলীকুড়ি গেরামের পশ্চিমপাড়ার ছোবান মিয়া। আমার পোলাডার শইলডা পুইড়া ছাই অইয়া যাইতেছে। দাদা, একটু উঠেন। তাড়াতাড়ি করেন।'
ছোবান মিয়া ধরা গলায় এক নিশ্বাসে তার পরিচয় আর আগমনের হেতু বলে গেল।
দেবেন্দ্র বাবুর স্ত্রী আগন্তুকের কথা শোনে পাশ ফিরে শোল। তিনি জানেন স্বামী এখন বাইরে থেকে দরজা টেনে আগন্তুকের সাথে চলে যাবেন। অমাবস্যার এই অন্ধকার ও গরমে স্বামী ভাঙা পথ পাড়ি দিয়ে রোগী দেখতে যাবেন। তার মনে হলো স্বামীর কানে কানে বলেন- জ্বরের ওষুধ দিয়া বিদায় কইরা দ্যাও। সাথে সাথে আগন্তুকের কাকুতি-মিনতি তার ভাবনা শোধরে দেয়। এই সংসারে বউ হয়ে আসার প্রথম দিকে স্বামীকে যখন তখন কিংবা রাতবিরাতে রোগী দেখতে যেতে দেখে তার কিছুটা বিরক্তি লাগত। রোগী দেখার ডাক এলে স্বামী নিজেই স্থির থাকতে পারেন না বলে এক সময় বিষয়টা তার গা সওয়া হয়ে গেছে। তা ছাড়া স্বামীর চিকিৎসা ব্রত পালনে বাধা হয়ে অপুণ্যির ভাগীদার না হওয়ার বিষয়টিও তার মাথায় কাজ করত। তত দিনে বিষয়টি তার কাছেও গর্বের ও আনন্দের হয়ে ওঠে।
দেবেন্দ্র বাবু যন্ত্রচালিতের ন্যায় চৌকি থেকে নেমে পাঞ্জাবিটা কাঁধে নেন। তারপর টেবিল হাতড়ে ছাল উঠে যাওয়া কুঁড়েঘর আকৃতির পুরোনো চামড়ার ব্যাগটা হাতে নেন। ব্যাগে স্টেথোস্কোপ, থার্মোমিটার, প্রেসস্ট্ক্রিপশন লেখার কাগজ, কলম আর প্যারাসিটামল জাতীয় কিছু ট্যাবলেট সব সময়ই থাকে। তিনি জ্বরের একটা সিরাপও ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলেন। বাড়িতে ফার্মেসি না থাকলেও দেবেন্দ্র বাবু একটা আলমারিতে সাধারণ রোগের ওষুধ রাখেন।
ছোবান মিয়া দেবেন্দ্র বাবুর সামনে হারিকেন ধরে হাঁটছে। কাঁচা রাস্তার দু'পাশের ক্ষেতই পানিতে ডুবে আছে। পা পিছলে গেলেই ক্ষেতের পানিতে ভিজতে হবে। ছোবান মিয়া দেবেন্দ্র বাবুর হাত থেকে ব্যাগটা নিতে চাইলে তিনি বাধা দিয়ে বললেন-
'অসুবিধা নাই'।
হারিকেনের অপ্রতুল আলোতে কাঁচা রাস্তার অনেক জায়গায় উঁচুনিচু ও কাদা ভালো দেখা যায় না। তবুও সেসব জায়গায় শরীর বাঁচিয়ে চলতে পঞ্চাশোর্ধ্ব দেবেন্দ্র বাবুর অসুবিধা হয় না। এলাকার সব রাস্তাই তার মুখস্থ। তিনি মোটামুটি পা চালিয়েই হাঁটছেন। তবুও ছোবান মিয়ার ভেতরে অস্থিরতা ও আরও জোরে পথ হাঁটার অব্যক্ত তাড়াটা তিনি অনুভব করতে পারছেন। এই অমাবস্যার রাতে তিনটি বাঁশের সাঁকো এবং কোথাও ভাঙা বা পানিতে তলিয়ে যাওয়া তিন মাইল রাস্তা পাড়ি দিয়ে মোহনগঞ্জ সদর হাসপাতালে ছেলেকে নিয়ে যাওয়া ছোবান মিয়ার পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার। হাতে টাকাপয়সাও নেই। তার মতো কম জানাশোনা লোক এই রাতে সদর হাসপাতালে গিয়ে কতটা সুবিধা পাবে তারও নিশ্চয়তা নেই।
কাঁচা রাস্তা পেরিয়ে ছোবান মিয়ার সাথে দেবেন্দ্র বাবু তেলীকুড়ির সফর আলী আকন্দের বাড়ির সামনে ধর্মখালের ওপর বাঁশের সাঁকোর ধারে পৌঁছান। সতর্কতার সাথে তিনি ছোবান মিয়ার সাথে সাঁকো পার হন। আরও অনেকটা কাঁচা রাস্তা মাড়িয়ে হারিকেনের আলোয় অমাবস্যার অন্ধকার ঠেলে তিনি ছোবান মিয়ার কুঁড়েঘরে পৌঁছান।
ছোবান মিয়ার বউ ছেলের মাথায় পানি ঢালছে। চোখেমুখে দুশ্চিন্তার স্পষ্ট ছাপ। চৌকির বিছানাপত্র প্রায় ভিজে গেছে। দেবেন্দ্র বাবু থার্মোমিটারে ছেলের জ্বর মেপে দেখেন, একশ চার ডিগ্রি। স্টেথোস্কোপ দিয়ে ছেলেটির বুক ও পেট পরীক্ষার সময় ছোবান মিয়া ও তার বউয়ের হূৎস্পন্দনে যেন শরীর কাঁপছিল। দেবেন্দ্র বাবু ব্যাগ খুলে একটা সিরাপ ও জ্বরের ট্যাবলেট দিয়ে এক্ষুনি খাইয়ে দিতে বললেন। কাগজে একটা ওষুধ লিখে দিয়ে বললেন সকাল হলে সদর থেকে যেন আনিয়ে নেয় হয়। ছোবান মিয়া ও তার বউ মাথা নেড়ে সায় দিল। তাদের উদগ্রীব চেহারা দেখে দেবেন্দ্র বাবু বললেন-
'ভয়ের কোনো কারণ নেই। সেরে যাবে।'
জ্বরে কাবু ছেলে মুখে ওষুধ নিচ্ছিল না। তখন দেবেন্দ্র বাবু ওষুধ নিয়ে বললেন-
'বাবা, ওষুধ না খেলে তো জ্বর সারবে না। দেখি, হাঁ করো তো।'
ছোবান মিয়ার ছেলে এবার সুবোধ বালকের মতো হাঁ করে দেবেন্দ্র বাবুর হাতে জ্বরের ট্যাবলেট ও দু'চামচ সিরাপ খেয়ে নিল।
কিছুক্ষণ পর প্রতিবেশী হারিছ মিয়া এসে হারিকেনটা নিয়ে গেল। ডাক্তার বাবুকে আনার জন্য ছোবান মিয়া হারিকেনটা এনেছিল।
তেলীকুড়ির মসজিদ থেকে ফজরের আজানের ধ্বনি শোনা গেল। ছোবান মিয়ার ছেলের জ্বর কিছুটা কমেছে। কিছুটা আরাম বোধ করায় সে চোখ বুজল। রক্তিম আভা ছড়িয়ে পূর্বাকাশ ফর্সা হতে লাগল। দেবেন্দ্র বাবু উঠে দাঁড়ালেন। ছোবান মিয়া লজ্জায় আনত হয়ে একটা পাঁচ টাকার নোট দেবেন্দ্র বাবুর দিকে বাড়িয়ে ধরল।
'দাদা অনেক কষ্ট করলেন। আইজ তো ঘরে কোনো টেকা-পয়সা নাই। আরেক দিন দিয়ামনে।'
ছোবান মিয়া বলল।
তার বউ ঘোমটায় মুখ আড়াল করে নত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেবেন্দ্র জ্বরের ট্যাবলেট ও সিরাপের দামের কথা ভুলে গিয়ে নিজেই যেন লজ্জা পেলেন।
'আইচ্ছা।'
দেবেন্দ্র বাবু বললেন।
ওষুধের টাকাটা তিনি কবে পাবেন সেই চিন্তা না করে বাড়ির উদ্দেশে পা রাখলেন। ছোবান মিয়া তাকে পৌঁছে দিতে চাইলে তিনি বারণ করলেন। অমাবস্যার অন্ধকারের মোড়ক থেকে বেরিয়ে আসা তেলীকুড়িসহ আশপাশের গ্রামগুলো ভোরের মায়াবী আলোয় খুব নিরীহ দেখাচ্ছে। রাতের গরম অনেকটা ম্রিয়মাণ। মৃদুভাষী দেবেন্দ্র বাবু অতিচেনা মাটির পথ ধরে বাড়ি ফিরছেন। এলাকার বেশির ভাগ রোগীকেই বাড়িতে গিয়ে তার দেখতে হয়। রোগী দেখতে তার নির্ধারিত কোনো ফি নেই। যে যা দেয় তাই নেন। তার মনে পড়ে না এখন পর্যন্ত দশ টাকার বেশি তাকে কেউ দিয়েছে কিনা। বেশির ভাগ বাড়িতেই রোগী দেখে আসার সময় তাকে পাঁচ টাকা দিয়েছে। সেই টাকাটা পাঞ্জাবির পকেটে নেওয়ার সময় কোনো দিন তার মুখ কালো হয়নি। অনেকে হাসিমুখে বলেছে-
'দাদা আইজ নাই। আরেকবার এই দিকে আপনি আসলে কিংবা আপনার বাড়িত গিয়া দিয়া আইবাম নে।'
তখনও দেবেন্দ্র বাবুর মুখ ভার করেছেন এমনটা কেউ বলতে পারবে না। যারা পরে দেবেন বলেছিলেন তাদের কেউ কেউ দেবেন্দ্র বাবু দ্বিতীয়বার রোগী দেখতে আসার সময় কিংবা বাড়িতে গিয়ে বা পথে দেখা হলে তার যৎসামান্য ফিটা দিয়েছেন ঠিকই। আবার কতজন দেননি তার হিসাব তিনি রাখেন না। তার মনেও নেই। কখনও মনে করার চেষ্টাও করেননি। সত্যিকার অর্থে এলাকায় তার ডাক্তারি করাটা পেশা হয়ে ওঠেনি। ব্রতই রয়ে গেছে।
দেবেন্দ্র বাবু ডাক্তারি বিদ্যায় কী পাস দিয়েছেন তা এলাকার মানুষ জানে না। এ নিয়ে কাউকে কখনও আলোচনা করতেও শোনা যায়নি। তিনি জেলা সদরে ডাক্তারি বিদ্যার ওপর কিছু ট্রেনিং নিয়েছিলেন। সেই ট্রেনিং আর ব্যবহারিক জ্ঞানে তিনি জ্বর, টাইফয়েড ও আমাশয় জাতীয় রোগের চিকিৎসা করেন। তাকে কখনও চিসিকৎসা বিজ্ঞানে বড় পাস দেওয়া কোনো ডাক্তারের সাথে তুলনা কিংবা খাটো চোখে এলাকার লোকজন দেখে না। দেবেন্দ্র বাবুও কোনো জটিল রোগের ক্ষেত্রে রোগীকে যে কোনোভাবেই হোক দ্রুত সদর হাসপাতালে পাঠাতে তাগাদা দিতে দেরি করেননি।
অনেক দিন পর বাড়ি এসে এলাকায় ঘুরতে বেরিয়ে আরমান হরমানি বিল থেকে বেরিয়ে আসা খালের ওপর পাকা সেতুর রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে তেলীকুড়ি, সামনে সিংধা, ডান দিকে আলোকদিয়া, আর বাঁ দিকে বেঙ্গালা গ্রাম। এসব গ্রামের লাগোয়া আরও কয়েকটি গ্রামেও ব্যাগ হাতে দেবেন্দ্র বাবুর বিচরণ ছিল। বেঙ্গালায় পথের ধারে দেবেন্দ্র বাবুর বাড়ি দেখা যাচ্ছে। ঢাকায় বসে আরমান দেবেন্দ্র বাবুর ইহধাম ত্যাগ করার সংবাদটা পেয়েছিল। আশপাশের এলাকায় কোনো বাড়িতেই এখন আর কুপিবাতি বা হারিকেন জ্বলে না। সৌরবিদ্যুৎ ও পল্লী বিদ্যুতের আলোয় সন্ধ্যার পর এলাকার প্রায় সব বাড়িঘরই জ্বলজ্বল করে। সব রাস্তাঘাটই পাকা। অটোরিকশা ও মোটরসাইকেলের গজরানোতে এলাকা সরগরম থাকে। লোকজন চাইলেই অটো কিংবা নিজস্ব বাহনে উঠে ভোঁ করে মোহনগঞ্জ, বারহাট্টা ও ধরমপাশা সদরে চলে যাচ্ছে। সেতুর পাশে রাখা অটোরিকশায় একজন মোবাইল ফোনে বলছিল-
'আম্মা, টেনশন করবাইন না। এক টান দিয়া রোগী লইয়া মমিসিং চইলা যাইয়াম।'
কথাটা আরমানের কানে খুব বাজে। সে বুঝতে পারে এলাকার লোকজনের জীবনে আয়বৈচিত্র্য এসেছে। তার চোখে ভাসে এক সময় যখন এ জনপদ প্রায় অন্ধকার ছিল, তখনকার দৃশ্য। তখন এলাকার অধিকাংশ লোকের পক্ষে কোনো রোগী নিয়ে একটানে নব্বই কিলোমিটার দূরের ময়মনসিংহ নিয়ে যাওয়া ছিল প্রায় কল্পনাতীত ব্যাপার। ভাঙা ও তলিয়ে যাওয়া কাঁচা রাস্তা ও কয়েকটি বাঁশের সাঁকো পার হয়ে মোহনগঞ্জসহ পার্শ্ববর্তী তিন থানা সদর হাসপাতালে রোগী নেওয়াই ছিল কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তখন আশপাশে কয়েক গ্রামের মানুষের কাছে প্রাথমিক ভরসা ছিলেন দেবেন্দ্র বাবু। দেবেন্দ্র বাবুর থার্মোমিটার ও স্টেথোস্কোপের সন্তোষজনক রিডিংয়ে এই নিভৃত নিস্তরঙ্গ জনপদে অনেকের মুখে হাসি ফুটত।
আজকাল অনেক টিভি নাটকে পল্লিচিকিৎসকের চরিত্র মানেই ভাঁড়ামো আর মূর্খামির নির্লজ্জ বড়াই। আরমানের দেখা বিভিন্ন নাটকে পল্লিচিকিৎসকের চরিত্রগুলোর কোনোটাই দেবেন্দ্র বাবুর সঙ্গে মিলে না। কিংবা দেবেন্দ্র বাবুর চরিত্র তার অদেখা কোনো নাটকে আছে কিনা তার জানা নেই। হাতুড়ে ডাক্তার আর পল্লিচিকিৎসক দেবেন্দ্র বাবু এক নন। তাই নাটকে পল্লিচিকিৎসকের ভাঁড়ামো সংলাপ শোনার পর একটা অশ্রাব্য গালি আরমানের ঠোঁটের ব্যারিকেড ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়। দেবেন্দ্র বাবুর মৃত্যুর পর এলাকায় তার জন্য কোনো স্মরণসভার আয়োজন হয়েছিল কিনা তা আরমানের জানা নেই। গ্রামের বাড়িতে বসে মোবাইল ফোনে দূরের সাইনবোর্ড ভারী ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়ার এই সময়টাতে দেবেন্দ্রবাবুর কথা এলাকার কতজনের মনে পড়ে কিনা তাও তার জানা নেই।
সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে আরমানের মনে পড়ে একবার একটা অনুষ্ঠানে দেবেন্দ্র বাবুকে একটু সম্মান জানানো হয়েছিল। এলাকার কিছু শিক্ষিত ছেলেপেলে আবালবৃদ্ধবনিতাকে নিয়ে একটা 'ইউনিয়ন ক্লাব' করেছিল। ক্লাবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আনা মাইক ও ভিসিআরের কথা শোনে অনেক কৌতূহলী লোকজন জড়ো হয়েছিল। সদর থেকে আমন্ত্রিত দু'জন অতিথির সাথে এলাকার কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি চৌকি পেতে তৈরি করা মঞ্চে বসে ছিলেন। যুবকরা মাইকে তাদের বক্তৃতায় ক্লাব ঘিরে অনেক স্বপ্নের কথা বলছিল। সেই সময়ে অনাহূত দেবেন্দ্র বাবু চন্দ্রপুর গ্রামের এক রোগী দেখে সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। একটু দূরে একটা কড়ই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে তিনি মনোযোগ সহকারে বক্তৃতা শুনতে লাগলেন। তার খুব ভালো লাগছিল। অনুষ্ঠানের উপস্থাপক সেই দৃশ্য দেখতে পেলেন।
'যে মানুষটি রোদ, বৃষ্টি আর ঝড় উপেক্ষা করে সেবার প্রদীপ নিয়ে আমাদের দোরে হাজির হন তিনি দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। এই দৃশ্য আমাদের অসম্মানিত করে। আমরা দেবেন্দ্র চন্দ্র পাল বাবুকে অনুরোধ করছি মঞ্চে এসে আসন গ্রহণ করার জন্য।'
সবাই তাকাল কড়ই গাছে নিচে দাঁড়িয়ে থাকা দেবেন্দ্র বাবুর দিকে। আয়োজকরা ভেতরে ভেতরে একটু লজ্জা বোধ করেন। গেরোয়া রঙের পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরিহিতি অনাহূত নিরহংকার দেবেন্দ্র বাবু ধীর পায়ে চৌকিমঞ্চের দিকে এগিয়ে গেলেন। চেহারায় লাজুক হাসি। এ জমায়েতের সিংহভাগ মানুষের বাড়িতে তার ডাক পড়েছে। সেটাই তার সৌভাগ্য। তাই তাকে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানিয়ে কিংবা চোখের সামনে পেয়ে মঞ্চে তুলে সম্মান না জানালেও তার মনে কোনো খেদ থাকত না। দূরে দাঁড়িয়ে থেকে তিনি এলাকার শিক্ষিত ছেলেদের স্বপ্নের কথা শোনে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বাড়ি চলে যেতেন। দেবেন্দ্র বাবু চৌকিমঞ্চে উঠে ব্যাগটা সামনে রেখে বসলেন। অনুষ্ঠান ঘিরে সমবেত লোকজনের পেছন থেকে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বলে উঠল-
'এই লোকটাই তো আমরার আসল লোক।'