- ফিচার
- নিঃসঙ্গ এক প্রিয় কবির কাছ থেকে যা কিছু পাওয়া
প্রচ্ছদ
নিঃসঙ্গ এক প্রিয় কবির কাছ থেকে যা কিছু পাওয়া

এমন কিছু কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি থাকেন, যাদের সান্নিধ্য সহজে পেলেও বারবার পেতে ইচ্ছা করে। তাদের কথা শুনতে ইচ্ছা করে, তাদের কাছ থেকে কিছু পেতে ইচ্ছা করে, তার আগে তাদেরকে কিছু উপহার দিয়ে ধন্য হতে ইচ্ছা করে। আবার এমন কিছু ব্যক্তি থাকেন, দূরে, বহুদূরে, যাদের সান্নিধ্য পাওয়া দুঃসাধ্য হলেও, সেই বাধা ডিঙিয়ে তাদের কাছে যেতে ইচ্ছা করে, আবার তাদের কিছু দিতে ইচ্ছা করে, তাদের কাছ থেকে পেতেও মন চায়। আমার জীবনের এমন কিছু ব্যক্তির অন্যতম হলেন স্মরণীয়-বরণীয় কবি-লেখকগণ। যাদের লেখা পড়ে মুগ্ধ হই, যাদের লেখা বারবার পড়ি, এবং যাদের বই সদা আমার পড়ার টেবিলে থাকে। আবার এমন অনেক কবি কিংবা লেখক আছেন, যাদের বই দীর্ঘদিন না পড়েও বুকশেল্কম্ফ সাজিয়ে রাখতে ভালো লাগে। সেদিকে বারবার তাকাতে ভালো লাগে। মন খারাপ হলে, কিংবা অন্য কোনো বিশেষ মুহূর্তে তাদের বইটা অন্তত বুকশেল্কম্ফ থেকে নামিয়ে ধুলো ঝাড়তে ভালো লাগে; আবার দু'চার পৃষ্ঠা উল্টিয়ে, আবার সযত্নে রেখে দিতে ভালো লাগে। আবার এমনও কাঙ্ক্ষিত লেখক আছেন, যাদের বই নিজের কাছে থাকা সত্ত্বেও কোনো বুকস্টলে দেখলে আবার কিনতে ইচ্ছা করে। তাদের সম্পর্কে লেখা কোনো বই চোখে পড়লে কিনে এনেই গ্রোগ্রাসে পড়তে ইচ্ছা করে।
প্রিয় লেখকদের নিয়ে আরও কত রকম করে কত কথা বলা যায়। প্রিয় কবি-লেখকদের নিয়ে হাজার পৃষ্ঠা লিখেও শেষ করা যায় না। এমন একটি নাতিদীর্ঘ লেখা লিখছি আমি আমার অন্যতম শীর্ষ একজন প্রিয় কবিকে নিয়ে।
প্রথম সমকালীন কবিতার প্রেমে পড়ি 'একতা' পত্রিকায় কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতা পড়ে। তারপর যখন মেসে থাকতাম রাত জেগে মশারির নিচে টেবিলল্যাম্প নিয়ে পড়তাম কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা। তখন চিত্রকল্পটা ঠিক ধরতে পারিনি। লিখতাম ন্যারেটিভ সব। কিন্তু সুনীলের কবিতায় প্রায়ই চোখে পড়ে বাক্যের অস্বাভাবিক সব ব্যাপারস্যাপার। অর্থ করতে গেলে অপরিচিত মনে হয়। পরে জেনেছি, একে চিত্রকল্প বলে। তারপর কবিতায় আমি চিত্রকল্প নির্মাণ শিখতে শুরু করি। এবং অতি দ্রুতই আমি আমার কবিতার পাঠ পরিধি বাড়াতে চেষ্টা করি। ঠিক এমনই এক মুহূর্তে বন্ধুদের মুখে মুখে ফিরত জীবনানন্দ দাশ, জয় গোস্বামী এই সব জনপ্রিয় কবির কবিতা। তারপর এক বন্ধু বলল, উৎপলটা একটু নেড়েচেড়ে দেখিস। আজ থেকে প্রায় ২৭ বছর আগের কথা, শোনামাত্রই আমি শাহবাগ আজিজ মার্কেট থেকে কিনেছিলাম উৎপলকুমার বসুর কবিতা সংগ্রহ। এর মধ্যে গোগ্রাসে পড়েছি শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং বিনয় মজুমদার, শামসুর রাহমান এবং আবুল হাসানসহ বাংলাদেশের পঞ্চাশ-ষাটের প্রায় সব কবির দু-একটা করে বই। তাদের অনেকের মধ্যেই তীব্র্র ভালো লাগা খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু উৎপল আমাকে এমন এক ঝাঁকুনি দিয়ে গেল যে, আমি যেন সত্যি সত্যি এক ঘোর থেকে আরেক ঘোরে ছিটকে পড়ে গেলাম। আপাদমস্তক পড়ে ফেললাম পুরো কবিতাসংগ্রহটি। এরপর, উৎপলের যত বই পাই, নির্বাচিত কিংবা বিচ্ছিন্ন কোনো বই, সমগ্র পড়া হয়ে গেলেও সেগুলো কিনে ফেলি। তার চটি বইগুলোও দেখামাত্র সংগ্রহ করি। একদিন দেখলাম শাহবাগের একটি বইয়ের দোকানে ঝুলছে উৎপলের গদ্যসমগ্র, সেটাও কিনে নিয়ে একটানে শেষ করলাম। আমার ছোটবেলায় দেখা সেই ধূসর আতাগাছ খুঁজে পেলাম। গদ্যের ভেতর দিয়েও যে পরাবাস্তব রাস্তায় হাঁটা যায়, আমার কাছে প্রথম স্পষ্ট হলো উৎপলের ছোট ছোট দু-চারটি গদ্যের ভিতর দিয়ে। তার কয়েকটি গল্প কিংবা ননফিকশনেও এই পরাবাস্তবতার গন্ধ পেয়েছি। আমার তীব্র আগ্রহ হলো আহা, এই কবিকে যদি কাছে পেতাম? দেখতে পেতাম, ছুঁতে পেতাম কিংবা শুনতে পেতাম ইচ্ছামতো, কবিতার কথা, জীবন যাপনের কথা, ভ্রমণের কথা, স্বপ্টেম্নর কথা!
উৎপলকুমার বসু কলকাতায় থাকেন তার গড়িয়াহাটের বাড়িতে। আমার এই ইচ্ছা পূরণের জন্য আর কলকাতায় যেতে হলো না। ২০০৪ সালের ৩১ জানুয়ারি কিংবা ২০০৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি কবি উৎপলকুমার বসু ঢাকায় এলেন জাতীয় কবিতা পরিষদের আমন্ত্রণে। আমি জেনেই অনেক প্রস্তুতি নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ খুঁজতে থাকলাম। ২ ফেব্রুয়ারি তাকে পেয়ে গেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের সামনে। আড্ডারত অবস্থায়। টায় টায় ঢুকে পড়লাম ঐ আড্ডায়। ক্রমে ভিড় কমতে থাকল। এবং আমি তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ খুঁজে পেলাম। খুবই আগ্রহ নিয়ে কথা বলতে বলতে বলতে পুরো একটা সাক্ষাৎকারই নিয়ে ফেললাম (যা পরে 'সংবাদ সাময়িকী'তে এবং কলকাতায় 'অনুষ্টুপ' পত্রিকায় ছাপা হয়)। কত কথা, কবিতা নিয়ে কত জমানো প্রশ্নই না করেছি তাকে! কাটকাট উত্তর দিয়েছেন প্রতিটি প্রশ্নের। শেষমেশ দেখি আমি, কবি ব্রাত্য রাইসু এবং কবি উৎপলকুমার বসু ছাড়া তেমন কেউ নেই সেখানে। আমরা কবির জন্য নির্ধারিত নীলক্ষেতের একটি গেস্টহাউসের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। আমি কবি উৎপলকুমার বসুর রিকশায় উঠে তার গেস্টহাউসে পৌঁছে গেলাম। তিনি আমাকে তার সদ্য প্রকাশিত 'সুখ দুঃখের সাথী' সংকলনটি কাঁপা কাঁপা হাতে লিখে দেন: 'ওবায়েদ আকাশকে / প্রীতি উপহার / উৎপলকুমার বসু'। (যে বইটির জন্য পরে তিনি আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন)। বইটি দিয়ে বললেন, 'বইটি এনেছিলাম ব্রাত্য রাইসুর জন্য, তোমার সঙ্গে নতুন পরিচয় হলো তাই তোমাকে দিয়ে দিলাম।' যার বই আমি গভীর আগ্রহে কিনি, সেই কাঙ্ক্ষিত কবির বই যদি উপহার মেলে, সে আনন্দ বাক্যে ব্যক্ত হয়? আমি তাকে আমার ২০০৪ সালে প্রকাশিত 'তারপরে, তারকার হাসি' কবিতার বইটি এবং একটি 'শালুক' তুলে দেই। তিনি তার সিথানে রেখে দেন। এরপর ২০০৫ সালে প্রকাশিত আমার কবিতার বই 'পাতাল নির্মাণের প্রণালী' প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই তার হাতে পৌঁছে গেল। গভীর উৎকণ্ঠায় আছি, তিনি যদি বলতেন আমার কবিতা নিয়ে কিছু! না কিছুই বললেন না।
তখন চিঠিপত্রের চালাচালির রেওয়াজ তেমন একটা নেই। ফেসবুক টুইটারও নয়। মোবাইলে মেসেজ বিনিময় এবং ইমেইল চালাচালিই অধিক প্রাধান্য পাচ্ছে। কিছুদিন পরেই দেখলাম কবি উৎপলকুমার বসুর একটা মেইল। আগ্রহ নিয়ে খুললাম। দেখি মাত্র একটি প্যারায়, অল্প কথায়, অনেক ভারি কথা লিখেছেন তিনি। সেই চিঠিটা বুদ্ধি করে যে প্রিন্ট নিয়ে রাখব তা আর কোনো দিন সম্ভব হয়নি। তবে দু-তিনবার পাঠে ছোট্ট চিঠিটি প্রায় মুখস্থ হয়ে গেল। মহার্ঘ ওই চিঠিতে তিনি যা লিখেছিলেন, তুলে দিচ্ছি স্মৃতি থেকে। সতেরো বছর আগের কথা, দু-একটা শব্দ হয়তো এদিক-ওদিক হতে পারে, ত্রুটি মার্জনীয়। লিখেছিলেন :
''প্রিয় ওবায়েদ,
প্রীতি নিও। আশা করি কুশলে আছ। তোমার সঙ্গে অনেক ভালো সময় কাটল। তোমার নেওয়া সাক্ষাৎকারটা এখানে 'অনুষ্টুপে' ছাপাতে দেব। তোমার কবিতা পড়লাম। অনেক যত্নে লেখা। 'শালুক'টা খুব ভালোবেসে করো বুঝতে পেরেছি। অনেকের কবিতা পড়া হলো। সত্যি কথা বলতে, তুমিসহ তোমাদের সময়ের কবিতায় একটা আত্মপরিচয় অনুসন্ধানের চেষ্টা লক্ষ্য করেছি; যা আমাকে আশান্বিত করেছে। এটা অগ্রজদের জন্য অসম্মানের নয়। কবিতার ধারাবাহিকতা হয়তো এমনই।
শুভেচ্ছা
উৎপলকুমার বসু''
প্রিয় কবির এই চিঠিটা আমার এতটাই ভালো লেগে গেল যে, চিঠিটা আমি ডেস্কটপে সেভ করে রেখে কয়েকবার পড়তে পড়তে মুখস্থ করে ফেলি। যে কারণে আজকে এটুকু লিখতে পারলাম। আমি ফিরতি মেইলে রোমান হরফে বাংলা লিখে তাকে ধন্যবাদ জানালাম। অনুষ্টুপে ইন্টারভিউটা ছাপা হলে সেটাও মেইল করে আমাকে জানালেন। এবং কারও একজনের মারফত তিনি আমার জন্য একটি কপিও পাঠালেন।
উৎপল বসুকে দেওয়া আমার 'পাতাল নির্মাণের প্রণালী' বইটি প্রকাশিত হয়েছিল আগামী প্রকাশনী থেকে, ২০০৫ সালে। ২০০৭ কি ২০০৮ সালে আগামী প্রকাশনী থেকে কেউ একজন আমাকে ফোন করে জানাল কলকাতা থেকে আমার ফোন এসেছিল। যিনি ফোন করেছিলেন তার নাম শুভ্র, শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। আমাকে শুভ্রর ফোন নাম্বার এবং ইমেইল আইডি দেওয়া হলো। আমি শুভ্রকে মেইল করলাম। ও আমাকে জানাল, ও কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাতের পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে আমার একটি বই কিনেছে, বইয়ের নাম 'পাতাল নির্মাণের প্রণালী'। বইটি কবি উৎপলকুমার বসুকে লিখে দেওয়া। হয়তো তিনি তা বিক্রি করে দিয়েছেন। তিনি নাকি সবার বইই এমন বিক্রি করে দেন। শুভ্র বলল বইয়ের কবিতাগুলো ওর খুব ভালো লেগেছে বলে আমার খোঁজ করেছে। এবং বাংলাদেশে এত ভালো কবিতা লেখা হচ্ছে সেটা ওর অজানা ছিল। এরপর থেকে আমাদের নিবিড় বন্ধুত্ব শুরু হলো। শুভ্র ইমেইলে আরও অনেকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। তার মধ্যে অন্যতম সত্তরের দশকের শক্তিমান কবি সুব্রত সরকার।
শুভ্র 'পদ্যচর্চা' নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন করে। সেখানে সুব্রত সরকার সংখ্যা হলো। আমাকে লিখতে দিল সুব্রত সরকারের 'তোমাকে মিথ্যে বলেছি' বইটি নিয়ে। কবিতা উদ্ধার করা এত সহজ কাজ নয়। লেখাটি লিখে তৃপ্তি পেলাম না। আমি শুভ্রকে জানালাম, 'পদ্যচর্চা'য় আমার লেখাটিই মনে হয় সবচেয়ে দুর্বল। তোমাদের সবার লেখা খুব ভালো হয়েছে। কিন্তু শুভ্র আমাকে বলল, ঘটনা ঠিক উল্টো। ও আমাকে দেখাল আনন্দবাজারে পত্রিকাটি নিয়ে একটি ছোট্ট রিভিউ ছাপা হয়েছে, সেখানে আমার লেখা থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। যা হোক, সেই থেকে কবি সুব্রত সরকার, শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব প্রগাঢ় হলো। ওরা দু'জনেই এখনও পর্যন্ত 'শালুক'-এর প্রতিটি সংখ্যায় লিখে চলেছে। লিখছে সংবাদেও। শুভ্রর মাধ্যমে পরিচয় হলো স্প্যানিশ ভাষার এক তরুণ কবি ও সাংবাদিক আগুস মোরালেস-এর সঙ্গে। আগুস তখন সাউথ এশিয়ান নিউজ এজেন্সি 'এনা'য় চাকরি করে। আগুস ঢাকায় আসবে, শুভ্র আমাকে ফোন করে জানাল, ও স্পষ্ট করে ইংরেজি বলতে পারে। তার ঠিক ঘণ্টাখানেক পরই আগুস ঢাকায় চলে এলো। তখন সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম সংবাদে আমার সহকর্মী। স্থান সংকুলান না হওয়ায় আমি প্রথম দু'দিন আগুসকে রোজিনার বাসায় রাখলাম। পরে আমার বাসা ফ্রি হলে আমার গুলবাগের বাসায় নিয়ে গেলাম। আগুস ফেব্রুয়ারি মাসে এসেছিল, ওর সঙ্গে বইমেলায় অনেক আড্ডা দিয়েছি।
শুভ্র ভালো স্প্যানিশ জানে, স্প্যানিশ ভাষার শিক্ষক হিসেবে ও দিল্লিতে চলে যাওয়ায় ওর 'পদ্যচর্চা'টাও বন্ধ হয়ে গেল। একটি সুন্দর স্বপ্টেম্নর মৃত্যু হলো নাকি, ঠিক এখনও বুঝতে পারি না। আমার আর 'পদ্যচর্চা'য় লেখা হয় না।
শুভ্র কলকাতায় থাকতে একবার দমদমে একটি কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান ছিল। সেখানে কবি শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি সুব্রত সরকার, কবি উৎপলকুমার বসুসহ আরও অনেকের কবিতা পাঠের আসর ছিল। সেখানে আমাকে নিমন্ত্রণ করা হলেও ভিসা করে আমার আর যাওয়া হয়নি। ওরা আমার জন্য একটা ছোট্ট ক্রেস্টও তৈরি করে রেখেছিল। সেটা ২০০৯ সালে আমি কলকাতা গেলে শুভ্র আমাকে তুলে দেয়। সে বছর আমি কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্র্রেরি ও রিসার্চ সেন্টার থেকে 'শালুক' সম্পাদনার জন্য পুরস্কৃত হই। সেই পুরস্কার গ্রহণ করতে আমার কলকাতায় যাওয়া। এবং সেই প্রথম শুভ্র এবং সুব্রত সরকারের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। সেবার কবি উৎপলকুমার বসুর সঙ্গে দেখা না হলেও, পরেরবার এক নিঃসঙ্গ কবিকে আমি দেখতে পাই কলকাতা কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসে। ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে একা একা বসে আছেন এত বড় কবি। দেখে বিস্মিত হলাম। চারদিকে কবি-লেখকদের এত আড্ডা, অথচ উৎপল বসুর কাছে কেউ আসছেন না। ভাবলাম ঢাকা হলে ঘটনাটা কী ঘটত! আমাকে দেখে তিনি চিনতে পারলেন। আমি এবং মনিরুজ্জামান মিন্টু উৎপলদার সঙ্গে অনেক ছবি তুললাম। তিনি আমার কুশল জিজ্ঞাসা করলেন। কবে এসেছি জানতে চাইলেন। স্মিতহাস্যে বললেন, 'দমদমের কবিতা পাঠের আসরে তোমার আসার কথা ছিল, কিন্তু আসোনি।'
বললাম, 'আমার আসার পরিস্থিতি অনুকূলে ছিল না।'
প্রিয় লেখকদের নিয়ে আরও কত রকম করে কত কথা বলা যায়। প্রিয় কবি-লেখকদের নিয়ে হাজার পৃষ্ঠা লিখেও শেষ করা যায় না। এমন একটি নাতিদীর্ঘ লেখা লিখছি আমি আমার অন্যতম শীর্ষ একজন প্রিয় কবিকে নিয়ে।
প্রথম সমকালীন কবিতার প্রেমে পড়ি 'একতা' পত্রিকায় কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতা পড়ে। তারপর যখন মেসে থাকতাম রাত জেগে মশারির নিচে টেবিলল্যাম্প নিয়ে পড়তাম কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা। তখন চিত্রকল্পটা ঠিক ধরতে পারিনি। লিখতাম ন্যারেটিভ সব। কিন্তু সুনীলের কবিতায় প্রায়ই চোখে পড়ে বাক্যের অস্বাভাবিক সব ব্যাপারস্যাপার। অর্থ করতে গেলে অপরিচিত মনে হয়। পরে জেনেছি, একে চিত্রকল্প বলে। তারপর কবিতায় আমি চিত্রকল্প নির্মাণ শিখতে শুরু করি। এবং অতি দ্রুতই আমি আমার কবিতার পাঠ পরিধি বাড়াতে চেষ্টা করি। ঠিক এমনই এক মুহূর্তে বন্ধুদের মুখে মুখে ফিরত জীবনানন্দ দাশ, জয় গোস্বামী এই সব জনপ্রিয় কবির কবিতা। তারপর এক বন্ধু বলল, উৎপলটা একটু নেড়েচেড়ে দেখিস। আজ থেকে প্রায় ২৭ বছর আগের কথা, শোনামাত্রই আমি শাহবাগ আজিজ মার্কেট থেকে কিনেছিলাম উৎপলকুমার বসুর কবিতা সংগ্রহ। এর মধ্যে গোগ্রাসে পড়েছি শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং বিনয় মজুমদার, শামসুর রাহমান এবং আবুল হাসানসহ বাংলাদেশের পঞ্চাশ-ষাটের প্রায় সব কবির দু-একটা করে বই। তাদের অনেকের মধ্যেই তীব্র্র ভালো লাগা খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু উৎপল আমাকে এমন এক ঝাঁকুনি দিয়ে গেল যে, আমি যেন সত্যি সত্যি এক ঘোর থেকে আরেক ঘোরে ছিটকে পড়ে গেলাম। আপাদমস্তক পড়ে ফেললাম পুরো কবিতাসংগ্রহটি। এরপর, উৎপলের যত বই পাই, নির্বাচিত কিংবা বিচ্ছিন্ন কোনো বই, সমগ্র পড়া হয়ে গেলেও সেগুলো কিনে ফেলি। তার চটি বইগুলোও দেখামাত্র সংগ্রহ করি। একদিন দেখলাম শাহবাগের একটি বইয়ের দোকানে ঝুলছে উৎপলের গদ্যসমগ্র, সেটাও কিনে নিয়ে একটানে শেষ করলাম। আমার ছোটবেলায় দেখা সেই ধূসর আতাগাছ খুঁজে পেলাম। গদ্যের ভেতর দিয়েও যে পরাবাস্তব রাস্তায় হাঁটা যায়, আমার কাছে প্রথম স্পষ্ট হলো উৎপলের ছোট ছোট দু-চারটি গদ্যের ভিতর দিয়ে। তার কয়েকটি গল্প কিংবা ননফিকশনেও এই পরাবাস্তবতার গন্ধ পেয়েছি। আমার তীব্র আগ্রহ হলো আহা, এই কবিকে যদি কাছে পেতাম? দেখতে পেতাম, ছুঁতে পেতাম কিংবা শুনতে পেতাম ইচ্ছামতো, কবিতার কথা, জীবন যাপনের কথা, ভ্রমণের কথা, স্বপ্টেম্নর কথা!
উৎপলকুমার বসু কলকাতায় থাকেন তার গড়িয়াহাটের বাড়িতে। আমার এই ইচ্ছা পূরণের জন্য আর কলকাতায় যেতে হলো না। ২০০৪ সালের ৩১ জানুয়ারি কিংবা ২০০৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি কবি উৎপলকুমার বসু ঢাকায় এলেন জাতীয় কবিতা পরিষদের আমন্ত্রণে। আমি জেনেই অনেক প্রস্তুতি নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ খুঁজতে থাকলাম। ২ ফেব্রুয়ারি তাকে পেয়ে গেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের সামনে। আড্ডারত অবস্থায়। টায় টায় ঢুকে পড়লাম ঐ আড্ডায়। ক্রমে ভিড় কমতে থাকল। এবং আমি তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ খুঁজে পেলাম। খুবই আগ্রহ নিয়ে কথা বলতে বলতে বলতে পুরো একটা সাক্ষাৎকারই নিয়ে ফেললাম (যা পরে 'সংবাদ সাময়িকী'তে এবং কলকাতায় 'অনুষ্টুপ' পত্রিকায় ছাপা হয়)। কত কথা, কবিতা নিয়ে কত জমানো প্রশ্নই না করেছি তাকে! কাটকাট উত্তর দিয়েছেন প্রতিটি প্রশ্নের। শেষমেশ দেখি আমি, কবি ব্রাত্য রাইসু এবং কবি উৎপলকুমার বসু ছাড়া তেমন কেউ নেই সেখানে। আমরা কবির জন্য নির্ধারিত নীলক্ষেতের একটি গেস্টহাউসের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। আমি কবি উৎপলকুমার বসুর রিকশায় উঠে তার গেস্টহাউসে পৌঁছে গেলাম। তিনি আমাকে তার সদ্য প্রকাশিত 'সুখ দুঃখের সাথী' সংকলনটি কাঁপা কাঁপা হাতে লিখে দেন: 'ওবায়েদ আকাশকে / প্রীতি উপহার / উৎপলকুমার বসু'। (যে বইটির জন্য পরে তিনি আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন)। বইটি দিয়ে বললেন, 'বইটি এনেছিলাম ব্রাত্য রাইসুর জন্য, তোমার সঙ্গে নতুন পরিচয় হলো তাই তোমাকে দিয়ে দিলাম।' যার বই আমি গভীর আগ্রহে কিনি, সেই কাঙ্ক্ষিত কবির বই যদি উপহার মেলে, সে আনন্দ বাক্যে ব্যক্ত হয়? আমি তাকে আমার ২০০৪ সালে প্রকাশিত 'তারপরে, তারকার হাসি' কবিতার বইটি এবং একটি 'শালুক' তুলে দেই। তিনি তার সিথানে রেখে দেন। এরপর ২০০৫ সালে প্রকাশিত আমার কবিতার বই 'পাতাল নির্মাণের প্রণালী' প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই তার হাতে পৌঁছে গেল। গভীর উৎকণ্ঠায় আছি, তিনি যদি বলতেন আমার কবিতা নিয়ে কিছু! না কিছুই বললেন না।
তখন চিঠিপত্রের চালাচালির রেওয়াজ তেমন একটা নেই। ফেসবুক টুইটারও নয়। মোবাইলে মেসেজ বিনিময় এবং ইমেইল চালাচালিই অধিক প্রাধান্য পাচ্ছে। কিছুদিন পরেই দেখলাম কবি উৎপলকুমার বসুর একটা মেইল। আগ্রহ নিয়ে খুললাম। দেখি মাত্র একটি প্যারায়, অল্প কথায়, অনেক ভারি কথা লিখেছেন তিনি। সেই চিঠিটা বুদ্ধি করে যে প্রিন্ট নিয়ে রাখব তা আর কোনো দিন সম্ভব হয়নি। তবে দু-তিনবার পাঠে ছোট্ট চিঠিটি প্রায় মুখস্থ হয়ে গেল। মহার্ঘ ওই চিঠিতে তিনি যা লিখেছিলেন, তুলে দিচ্ছি স্মৃতি থেকে। সতেরো বছর আগের কথা, দু-একটা শব্দ হয়তো এদিক-ওদিক হতে পারে, ত্রুটি মার্জনীয়। লিখেছিলেন :
''প্রিয় ওবায়েদ,
প্রীতি নিও। আশা করি কুশলে আছ। তোমার সঙ্গে অনেক ভালো সময় কাটল। তোমার নেওয়া সাক্ষাৎকারটা এখানে 'অনুষ্টুপে' ছাপাতে দেব। তোমার কবিতা পড়লাম। অনেক যত্নে লেখা। 'শালুক'টা খুব ভালোবেসে করো বুঝতে পেরেছি। অনেকের কবিতা পড়া হলো। সত্যি কথা বলতে, তুমিসহ তোমাদের সময়ের কবিতায় একটা আত্মপরিচয় অনুসন্ধানের চেষ্টা লক্ষ্য করেছি; যা আমাকে আশান্বিত করেছে। এটা অগ্রজদের জন্য অসম্মানের নয়। কবিতার ধারাবাহিকতা হয়তো এমনই।
শুভেচ্ছা
উৎপলকুমার বসু''
প্রিয় কবির এই চিঠিটা আমার এতটাই ভালো লেগে গেল যে, চিঠিটা আমি ডেস্কটপে সেভ করে রেখে কয়েকবার পড়তে পড়তে মুখস্থ করে ফেলি। যে কারণে আজকে এটুকু লিখতে পারলাম। আমি ফিরতি মেইলে রোমান হরফে বাংলা লিখে তাকে ধন্যবাদ জানালাম। অনুষ্টুপে ইন্টারভিউটা ছাপা হলে সেটাও মেইল করে আমাকে জানালেন। এবং কারও একজনের মারফত তিনি আমার জন্য একটি কপিও পাঠালেন।
উৎপল বসুকে দেওয়া আমার 'পাতাল নির্মাণের প্রণালী' বইটি প্রকাশিত হয়েছিল আগামী প্রকাশনী থেকে, ২০০৫ সালে। ২০০৭ কি ২০০৮ সালে আগামী প্রকাশনী থেকে কেউ একজন আমাকে ফোন করে জানাল কলকাতা থেকে আমার ফোন এসেছিল। যিনি ফোন করেছিলেন তার নাম শুভ্র, শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। আমাকে শুভ্রর ফোন নাম্বার এবং ইমেইল আইডি দেওয়া হলো। আমি শুভ্রকে মেইল করলাম। ও আমাকে জানাল, ও কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাতের পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে আমার একটি বই কিনেছে, বইয়ের নাম 'পাতাল নির্মাণের প্রণালী'। বইটি কবি উৎপলকুমার বসুকে লিখে দেওয়া। হয়তো তিনি তা বিক্রি করে দিয়েছেন। তিনি নাকি সবার বইই এমন বিক্রি করে দেন। শুভ্র বলল বইয়ের কবিতাগুলো ওর খুব ভালো লেগেছে বলে আমার খোঁজ করেছে। এবং বাংলাদেশে এত ভালো কবিতা লেখা হচ্ছে সেটা ওর অজানা ছিল। এরপর থেকে আমাদের নিবিড় বন্ধুত্ব শুরু হলো। শুভ্র ইমেইলে আরও অনেকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। তার মধ্যে অন্যতম সত্তরের দশকের শক্তিমান কবি সুব্রত সরকার।
শুভ্র 'পদ্যচর্চা' নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন করে। সেখানে সুব্রত সরকার সংখ্যা হলো। আমাকে লিখতে দিল সুব্রত সরকারের 'তোমাকে মিথ্যে বলেছি' বইটি নিয়ে। কবিতা উদ্ধার করা এত সহজ কাজ নয়। লেখাটি লিখে তৃপ্তি পেলাম না। আমি শুভ্রকে জানালাম, 'পদ্যচর্চা'য় আমার লেখাটিই মনে হয় সবচেয়ে দুর্বল। তোমাদের সবার লেখা খুব ভালো হয়েছে। কিন্তু শুভ্র আমাকে বলল, ঘটনা ঠিক উল্টো। ও আমাকে দেখাল আনন্দবাজারে পত্রিকাটি নিয়ে একটি ছোট্ট রিভিউ ছাপা হয়েছে, সেখানে আমার লেখা থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। যা হোক, সেই থেকে কবি সুব্রত সরকার, শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব প্রগাঢ় হলো। ওরা দু'জনেই এখনও পর্যন্ত 'শালুক'-এর প্রতিটি সংখ্যায় লিখে চলেছে। লিখছে সংবাদেও। শুভ্রর মাধ্যমে পরিচয় হলো স্প্যানিশ ভাষার এক তরুণ কবি ও সাংবাদিক আগুস মোরালেস-এর সঙ্গে। আগুস তখন সাউথ এশিয়ান নিউজ এজেন্সি 'এনা'য় চাকরি করে। আগুস ঢাকায় আসবে, শুভ্র আমাকে ফোন করে জানাল, ও স্পষ্ট করে ইংরেজি বলতে পারে। তার ঠিক ঘণ্টাখানেক পরই আগুস ঢাকায় চলে এলো। তখন সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম সংবাদে আমার সহকর্মী। স্থান সংকুলান না হওয়ায় আমি প্রথম দু'দিন আগুসকে রোজিনার বাসায় রাখলাম। পরে আমার বাসা ফ্রি হলে আমার গুলবাগের বাসায় নিয়ে গেলাম। আগুস ফেব্রুয়ারি মাসে এসেছিল, ওর সঙ্গে বইমেলায় অনেক আড্ডা দিয়েছি।
শুভ্র ভালো স্প্যানিশ জানে, স্প্যানিশ ভাষার শিক্ষক হিসেবে ও দিল্লিতে চলে যাওয়ায় ওর 'পদ্যচর্চা'টাও বন্ধ হয়ে গেল। একটি সুন্দর স্বপ্টেম্নর মৃত্যু হলো নাকি, ঠিক এখনও বুঝতে পারি না। আমার আর 'পদ্যচর্চা'য় লেখা হয় না।
শুভ্র কলকাতায় থাকতে একবার দমদমে একটি কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান ছিল। সেখানে কবি শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি সুব্রত সরকার, কবি উৎপলকুমার বসুসহ আরও অনেকের কবিতা পাঠের আসর ছিল। সেখানে আমাকে নিমন্ত্রণ করা হলেও ভিসা করে আমার আর যাওয়া হয়নি। ওরা আমার জন্য একটা ছোট্ট ক্রেস্টও তৈরি করে রেখেছিল। সেটা ২০০৯ সালে আমি কলকাতা গেলে শুভ্র আমাকে তুলে দেয়। সে বছর আমি কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্র্রেরি ও রিসার্চ সেন্টার থেকে 'শালুক' সম্পাদনার জন্য পুরস্কৃত হই। সেই পুরস্কার গ্রহণ করতে আমার কলকাতায় যাওয়া। এবং সেই প্রথম শুভ্র এবং সুব্রত সরকারের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। সেবার কবি উৎপলকুমার বসুর সঙ্গে দেখা না হলেও, পরেরবার এক নিঃসঙ্গ কবিকে আমি দেখতে পাই কলকাতা কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসে। ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে একা একা বসে আছেন এত বড় কবি। দেখে বিস্মিত হলাম। চারদিকে কবি-লেখকদের এত আড্ডা, অথচ উৎপল বসুর কাছে কেউ আসছেন না। ভাবলাম ঢাকা হলে ঘটনাটা কী ঘটত! আমাকে দেখে তিনি চিনতে পারলেন। আমি এবং মনিরুজ্জামান মিন্টু উৎপলদার সঙ্গে অনেক ছবি তুললাম। তিনি আমার কুশল জিজ্ঞাসা করলেন। কবে এসেছি জানতে চাইলেন। স্মিতহাস্যে বললেন, 'দমদমের কবিতা পাঠের আসরে তোমার আসার কথা ছিল, কিন্তু আসোনি।'
বললাম, 'আমার আসার পরিস্থিতি অনুকূলে ছিল না।'
বিষয় : প্রচ্ছদ ওবায়েদ আকাশ
মন্তব্য করুন