
: তারা কেউ তোকে দেখতে পারে না।
ভালোবাসতে পারত।
লীলা লিখেছে।
আমি ভেবে পাই না, কারা? কেন?
লীলা আমার মা।
আমার থেকে অনেক ছোট এখন বয়সে।
জন লেনন অন্তর্ভুক্ত বিটলসের যখন 'লেট ইট বি' বানানোর মতো সময় হয়- নিরালাপুরের এক পোস্টম্যান আমাকে লীলার লেখা পোস্টকার্ড দিয়ে যায়। আমি পড়ি।
'দেবযান' পড়ে তোর কীরকম লাগল?
'মরুতীর্থ হিংলাজ?'
'বং থেকে বাংলা?'
'আর কোনোখানে?'
এসব গত লকডাউনে। লীলা পড়ত এমন কিছু বই পড়ব বলে জোগাড় করেছিলাম। এগারোটা বই। আটটাই এখনও পড়া হয় নাই। সময় পাই না। 'দেবযান' পড়ে অভিভূত হয়েছি। তিনবার পড়েছি।
: তুই এখন কী পড়ছিস?
: 'আবদুল রাজাক গুরনাহর প্যারাডাইজ। বাংলা অনুবাদ। প্রচ্ছদ বানানোর জন্য পড়ছি।
: প্রচ্ছদ বানানোর জন্য এখন বই পড়িস তুই?
: মায়া সন্ধান করি। হা! হা! হা!
নিরালাপুরের পোস্টম্যান লীলার কাছে যায়। আমার লেখা পোস্টকার্ড বিলি করতে যায়। আমার কাছে আসে। লীলার লেখা পোস্টকার্ড বিলি করতে আসে।
'তুমি কি সত্যি আছো পোস্টম্যান?'
'আমারে কি দেখা যায় না?'
'দেখা যায়। যা দেখা যায় সব আছে?'
'চিঠি নেন।'
'তুমি একটু বসো পোস্টম্যান। আমার সঙ্গে বসে এক কাপ চা খাও।'
'না, আমার সময় নাই।'
'কেন সময় নাই পোস্টম্যান?'
'চিঠি বিলি করি।'
কত চিঠি? কে কাকে লিখে? পোস্টম্যান বিলি করে সময় পায় না। এখনও? সব লীলা লেখে সব ধ্রুবকে?
: সাতচল্লিশ বছর। কিছু হলো? এত কম বয়সে কেউ মরে যায়, লীলা। কোনোদিন আমরা একসঙ্গে নদীর পাড়ে বসে থাকলাম না। কাটা ধানক্ষেতের আল ধরে হাঁটলাম না ...।
এখন হাঁটি। আমি আর লীলা। আমাদের নিরালাপুরের রাস্তায়। অল্পস্বল্প রোদ, ঝুপঝুপ বৃষ্টি এবং কুয়াশায়। ঘাসের শিশিরে আমাদের পা ভিজে যায়। সব আমরা পোস্টকার্ডে লিখি, পোস্টম্যান আমাদের চিঠি বিলি করে।
নস্টালজিয়া সেই।
: নিরালাপুরে এক পোস্টম্যান হেঁটে যায়
দুপুর এবং ঘুঘুর ডাক নিয়ে
আর সান্ধ্যভাষায় লেখা কিছু চিঠি
পোস্টবক্সে ঢুকে ঘুঘু হয়ে যায়।
পৃথিবীতে পোস্টবক্স আছে এখন কয়টা? কবে থেকে থাকবে না? সব চিঠি ধূসর ঘুঘু হয়ে গেছে, সব চিঠি উড়ে মিলিয়ে যাবে। আগেভাগে কিছু চিঠি পড়ে জাদুঘরে রেখে দিতে হবে। কিংবা জাদুবাস্তবতায়।
লীলার সব চিঠি আমি পড়তে পারি এবং পড়ব।
বসন্ত বাতাসে আর কে চিঠি লিখে?
পোস্টম্যান বলে, 'বুলবুল চৌধুরী।'
'অ।'
কিন্তু বুলবুল চৌধুরীর চিঠির একটা অক্ষরও আমি পড়তে পারি না। হিজিবিজি লেখা। জটিল ক্যালিগ্রাফি।
'বুলবুল ভাই, এইসব কী লিখছেন?'
'কোনসব মিয়া?'
'এই যে চিঠি।'
বুলবুল ভাই কিছুক্ষণ দেখেন চিঠিটা। পড়ার চেষ্টা করেন। তার ভাষায় নিরিখ। কূলকিনারা করে উঠতে পারেন না।
'বুঝলাম না মিয়া।'
'আপনি লিখছেন আপনি বুঝতে পারতেছেন না?'
'না রে মিয়া।'
'মনে আছে, কী লিখছেন?'
'না রে মিয়া।'
তবে আর কি!
খুব সুন্দর চিঠি লিখে একজন। মীর সাবু। এখনও লিখে। নিরালাপুরের পোস্টম্যান দিয়ে যায়।
: তুমি কেমন আছো ধ্রুব?
: তোমাকে কেন বলব? তুমি ভালো নাই, আমি জানি। তবে কিছুই করতে পারব না। তুমিও কিছুই করতে পারবে না, সাবু। বার্লি খাও।
কিছু করা কী?
কেউ আমাকে কখনও চিঠিতে লিখেনি। আমিও কাউকে কখনও চিঠিতে লিখি নাই। আমরা কেউ কিছু করি না। বসে থাকি এখনও। বসে থাকি দাওয়ায়। চিঠি দিয়ে যাবে পোস্টম্যান। ভারমিলিয়ন লাল একটা পোস্টবক্স আকাশের এধার ওধার দোলা খায়। দাদামশাইয়ের ঘড়ির পেন্ডুুলামের মতো। পোস্টবক্সের সব চিঠি ঘুঘু। তারা ওড়ে। পোস্টম্যান ওড়ে।
'চিঠি আছে, চিঠি।'
একটা চিঠি পড়ি।
***
: তরঙ্গিনীকে আমি দেখিনি।
তরঙ্গিনী অন্তঃসলিলা।
মাটির নিচে আমার চোখ যায় না।
গাছের কাণ্ড পাতা ফলমূল দেখি, শিকড় বাকড় দেখি না।
অগভীর দৃষ্টি।
সহজ মানুষ একমাত্র অলোকদৃষ্টিসম্পন্ন। তিন কাল দেখে বা মনে করলে দেখতে পায়। ঝক্কি কম না বেবাক দেখাতে। এজন্য তরঙ্গিনীর কথা সে আমাকে বলে না। সুতনুকার কথা বলে। কুরুল্লার নদী সুতনুকা। দৃশ্যমান বানভাসি সমেত। এত কুরুল্লা। সহজ মানুষ বলে, 'এ হলো কুরুল্লা ফোবিয়া।'
কুরুল্লা কী?
'তিতাস একটি নদীর নাম পড়ে নাই শালা!'
কুরুল্লার সঙ্গে কী সম্পর্ক অদ্বৈত মল্লবর্মণের বইয়ের? সহজ মানুষ আর কোনো রূপকথায় ডুবে যায়। বা আর কোনো নদীতে। অবগাহন। সেই নদীর কথাও সে আমাকে বলে না। আর কোনো নদীর কথা বলে। সেই নদী সারি। শারি না সারি। কাকচক্ষুজল নদীর। ছোট ছোট ঢেউ ঝিকমিক করে। নম্র সভ্য রোদে। সব নদী সব ঋতুর না, সারি শুধুই শীতকালের নদী। বেমানান রকম স্নিগ্ধ পারিপার্শ্বিক রুক্ষতায়।
রাঙামাটি আমি যাইনি। মাটিরাঙায় গেছি। সেখানে গণরোষে পড়েছিলাম এবং গণপিটুনিতে হত হতে নিচ্ছিলাম। তবে সেটা ঘটেনি। ত্রাতা সহজ মানুষ। কেন? এই পৃথিবীতে এক সারি আছে বলে? সেই সারির সঙ্গে আমার দেখা হবে বলে?
সারি সেই ঢেউগুলো, সেই 'ঢেউগুলো যে আমায় নিয়ে করে কেবল খেলা।'
এবং ফুরায় বেলা, ফুরায় খেলা, সন্ধ্যা হয়ে আসে।
সন্ধ্যার অন্ধকার। কালো রঙের বলে কি শোকের?
না। কালো রঙে শোকের চিহ্ন কখনও দেখে না সহজ মানুষ। সমূহ শোক দেখে হরিতে। চিরহরিৎ শোক।
শোকের রং হরিৎ না হলে হলো?
ভুল বানান যেমন 'ভূল' না হলে হয় না।
নীল রঙের তবে কী মানে হয়?
হলুদ রঙের?
কমলা-লাল রঙের?
'দেখা যায় বলে তারা মনে করে তারা সব রঙের মানে বুঝে গেছে। নীল বিষাদের রং, লাল-কমলা উৎসবের রং বলে ফতোয়া দিয়ে রেখেছে। নীল রঙের কনডম তবে কেন বানায়? পিঙ্ক রঙের কনডম না হয় ফুরফুরে ভাবের, নীল রঙের কনডম পরে কি অর্গান বিষাদে আক্রান্ত হবে না? বব ডিলানের মাউথ অর্গানের কথা আমি বলছি না। আরে! এই পৃথিবীতে নদী কি তেরোটা? কত নদী, কত সরোবর। অবগাহন করো। অবগাহন করো?'
দীপ্যমানের বউ কলকাতার মানুষ। তারা বলে ভাটবকা। সহজ মানুষ কখনও কখনও এমন ভাট বকে। কেন? বিরাট শিশু সে? তরঙ্গিনীকে আড়াল করে রাখে কেন?
সব আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।
'সহজ মানুষ, তরঙ্গিনী কে?'
'তরঙ্গিনী এক নদী। সব নদীই তরঙ্গিনী।'
'সব নদী কি এক নদী?'
'সব ঘাস যেহেতু এক। কিংবা সব পাহাড়।'
'অসহ্য! তরঙ্গিনীর জন্ম কোন পাহাড়ে?'
'সব নদীর মা কি পাহাড়?'
'সব কথা এত জটিল, সহজ মানুষ?'
'না। সহজ।'
কে জানে কী? সহজ মানুষ যে হতে পেরেছে আর যে হতে পারেনি, আসমান-জমিন ফারাক দু'জনের। তবে আমি গেছি নদীর কুরুল্লায়, সহজ মানুষ কোন ছলনায় আটকাবে?
তরঙ্গিনীকে আমি দেখি না তবে তরঙ্গিনীর সঙ্গে আমার কথা হয়।
'তরঙ্গিনী, আমার দৃষ্টি অগভীর। তুমি থাকো মাটির কত গভীরে?'
'থাকি না। আমি বয়ে যাই।'
'মাটির কত গভীরে বয়ে যাও?'
'অঙ্ক করি না, আমি বয়ে যাই।'
'অঙ্ক করো না, পৌরনীতি করো?'
তরঙ্গিনী হাসে।
তরঙ্গিনীর হাসি ঝরনার, যদিবা সে নদী।
আমি কেন তাকে দেখতে পাই না?
'তরঙ্গিনী, তুমি আত্রেয়ী? অগ্নির পত্নী? রণচণ্ডী পতির মাথা ঠান্ডা করতে অন্তঃসলিলা হয়ে গেছ? ও তরঙ্গিনী, আমিই সে।'
'সে কে? অগ্নি?'
'না।'
'নৈঋত?'
'না।'
'তবে কে?'
'আমি এক শীতকাল হয়তো।'
'শীতকাল!'
শীতকালে হলুদ কিছু পাতা উড়ান দেয়।
কোন পাতা উড়ে কোনদিকে যায়?
আমি যদি একটা উড়ান পাতা হই? কোনদিকে যাব?
তরঙ্গিনীর দিকে। আত্রেয়ীর দিকে।
এত সহজ?
জটিল কেন?
তরঙ্গিনী। তরঙ্গিনী! অগ্নি কতটা পোড়ায় জলকে?
'চক্ষুদান ছাড়া তরঙ্গিনী হয় না।'
সহজ মানুষ কেবল জটিল মানুষের মতো কথা বলে যায়। চক্ষুদান কী? চক্ষুর আছে ঘরে। মরচে ধরে গেছে। তবে কাঁটা চামচ। স্টেইনলেস স্টিলের। কাটা চামচ দিয়ে চোখের মণি এত সহজে উপড়ে ফেলা যায়। সহজ মানুষের সহজ তরিকা। আমি চক্ষুদান করি সেই মতো। তরঙ্গিনীর জলৌকা আমার দুই চোখের মণি খুঁড়ে খায়।
এখন আমি দেখি তরঙ্গিনীকে।
সহজ মানুষের কথা অফুরান। তিন কালের কথা। সহজে ফুরায়? তবে আমি দেখি তরঙ্গিনীকে, এটা মনে হয় তাকে ক্লান্ত করে একটু। সে একটা বিজ্ঞাপন বিরতি নেয়। কনডমের বিজ্ঞাপন। পার্পল ভেরিয়েন্ট।
ফার্স!
তরঙ্গিনী আয়, আমরা একটা সন্তান উৎপাদন করি।
***
কে কাকে এই চিঠি লিখেছে?
নিরালাপুরের তরঙ্গিনী কে?
লীলাকে বলব। চিঠি লিখব। রহস্য করব। তরঙ্গিনী-চিঠি লেখা লীলাকে। না হলে আর আমি জন্মাই?
ভালোবাসতে পারত।
লীলা লিখেছে।
আমি ভেবে পাই না, কারা? কেন?
লীলা আমার মা।
আমার থেকে অনেক ছোট এখন বয়সে।
জন লেনন অন্তর্ভুক্ত বিটলসের যখন 'লেট ইট বি' বানানোর মতো সময় হয়- নিরালাপুরের এক পোস্টম্যান আমাকে লীলার লেখা পোস্টকার্ড দিয়ে যায়। আমি পড়ি।
'দেবযান' পড়ে তোর কীরকম লাগল?
'মরুতীর্থ হিংলাজ?'
'বং থেকে বাংলা?'
'আর কোনোখানে?'
এসব গত লকডাউনে। লীলা পড়ত এমন কিছু বই পড়ব বলে জোগাড় করেছিলাম। এগারোটা বই। আটটাই এখনও পড়া হয় নাই। সময় পাই না। 'দেবযান' পড়ে অভিভূত হয়েছি। তিনবার পড়েছি।
: তুই এখন কী পড়ছিস?
: 'আবদুল রাজাক গুরনাহর প্যারাডাইজ। বাংলা অনুবাদ। প্রচ্ছদ বানানোর জন্য পড়ছি।
: প্রচ্ছদ বানানোর জন্য এখন বই পড়িস তুই?
: মায়া সন্ধান করি। হা! হা! হা!
নিরালাপুরের পোস্টম্যান লীলার কাছে যায়। আমার লেখা পোস্টকার্ড বিলি করতে যায়। আমার কাছে আসে। লীলার লেখা পোস্টকার্ড বিলি করতে আসে।
'তুমি কি সত্যি আছো পোস্টম্যান?'
'আমারে কি দেখা যায় না?'
'দেখা যায়। যা দেখা যায় সব আছে?'
'চিঠি নেন।'
'তুমি একটু বসো পোস্টম্যান। আমার সঙ্গে বসে এক কাপ চা খাও।'
'না, আমার সময় নাই।'
'কেন সময় নাই পোস্টম্যান?'
'চিঠি বিলি করি।'
কত চিঠি? কে কাকে লিখে? পোস্টম্যান বিলি করে সময় পায় না। এখনও? সব লীলা লেখে সব ধ্রুবকে?
: সাতচল্লিশ বছর। কিছু হলো? এত কম বয়সে কেউ মরে যায়, লীলা। কোনোদিন আমরা একসঙ্গে নদীর পাড়ে বসে থাকলাম না। কাটা ধানক্ষেতের আল ধরে হাঁটলাম না ...।
এখন হাঁটি। আমি আর লীলা। আমাদের নিরালাপুরের রাস্তায়। অল্পস্বল্প রোদ, ঝুপঝুপ বৃষ্টি এবং কুয়াশায়। ঘাসের শিশিরে আমাদের পা ভিজে যায়। সব আমরা পোস্টকার্ডে লিখি, পোস্টম্যান আমাদের চিঠি বিলি করে।
নস্টালজিয়া সেই।
: নিরালাপুরে এক পোস্টম্যান হেঁটে যায়
দুপুর এবং ঘুঘুর ডাক নিয়ে
আর সান্ধ্যভাষায় লেখা কিছু চিঠি
পোস্টবক্সে ঢুকে ঘুঘু হয়ে যায়।
পৃথিবীতে পোস্টবক্স আছে এখন কয়টা? কবে থেকে থাকবে না? সব চিঠি ধূসর ঘুঘু হয়ে গেছে, সব চিঠি উড়ে মিলিয়ে যাবে। আগেভাগে কিছু চিঠি পড়ে জাদুঘরে রেখে দিতে হবে। কিংবা জাদুবাস্তবতায়।
লীলার সব চিঠি আমি পড়তে পারি এবং পড়ব।
বসন্ত বাতাসে আর কে চিঠি লিখে?
পোস্টম্যান বলে, 'বুলবুল চৌধুরী।'
'অ।'
কিন্তু বুলবুল চৌধুরীর চিঠির একটা অক্ষরও আমি পড়তে পারি না। হিজিবিজি লেখা। জটিল ক্যালিগ্রাফি।
'বুলবুল ভাই, এইসব কী লিখছেন?'
'কোনসব মিয়া?'
'এই যে চিঠি।'
বুলবুল ভাই কিছুক্ষণ দেখেন চিঠিটা। পড়ার চেষ্টা করেন। তার ভাষায় নিরিখ। কূলকিনারা করে উঠতে পারেন না।
'বুঝলাম না মিয়া।'
'আপনি লিখছেন আপনি বুঝতে পারতেছেন না?'
'না রে মিয়া।'
'মনে আছে, কী লিখছেন?'
'না রে মিয়া।'
তবে আর কি!
খুব সুন্দর চিঠি লিখে একজন। মীর সাবু। এখনও লিখে। নিরালাপুরের পোস্টম্যান দিয়ে যায়।
: তুমি কেমন আছো ধ্রুব?
: তোমাকে কেন বলব? তুমি ভালো নাই, আমি জানি। তবে কিছুই করতে পারব না। তুমিও কিছুই করতে পারবে না, সাবু। বার্লি খাও।
কিছু করা কী?
কেউ আমাকে কখনও চিঠিতে লিখেনি। আমিও কাউকে কখনও চিঠিতে লিখি নাই। আমরা কেউ কিছু করি না। বসে থাকি এখনও। বসে থাকি দাওয়ায়। চিঠি দিয়ে যাবে পোস্টম্যান। ভারমিলিয়ন লাল একটা পোস্টবক্স আকাশের এধার ওধার দোলা খায়। দাদামশাইয়ের ঘড়ির পেন্ডুুলামের মতো। পোস্টবক্সের সব চিঠি ঘুঘু। তারা ওড়ে। পোস্টম্যান ওড়ে।
'চিঠি আছে, চিঠি।'
একটা চিঠি পড়ি।
***
: তরঙ্গিনীকে আমি দেখিনি।
তরঙ্গিনী অন্তঃসলিলা।
মাটির নিচে আমার চোখ যায় না।
গাছের কাণ্ড পাতা ফলমূল দেখি, শিকড় বাকড় দেখি না।
অগভীর দৃষ্টি।
সহজ মানুষ একমাত্র অলোকদৃষ্টিসম্পন্ন। তিন কাল দেখে বা মনে করলে দেখতে পায়। ঝক্কি কম না বেবাক দেখাতে। এজন্য তরঙ্গিনীর কথা সে আমাকে বলে না। সুতনুকার কথা বলে। কুরুল্লার নদী সুতনুকা। দৃশ্যমান বানভাসি সমেত। এত কুরুল্লা। সহজ মানুষ বলে, 'এ হলো কুরুল্লা ফোবিয়া।'
কুরুল্লা কী?
'তিতাস একটি নদীর নাম পড়ে নাই শালা!'
কুরুল্লার সঙ্গে কী সম্পর্ক অদ্বৈত মল্লবর্মণের বইয়ের? সহজ মানুষ আর কোনো রূপকথায় ডুবে যায়। বা আর কোনো নদীতে। অবগাহন। সেই নদীর কথাও সে আমাকে বলে না। আর কোনো নদীর কথা বলে। সেই নদী সারি। শারি না সারি। কাকচক্ষুজল নদীর। ছোট ছোট ঢেউ ঝিকমিক করে। নম্র সভ্য রোদে। সব নদী সব ঋতুর না, সারি শুধুই শীতকালের নদী। বেমানান রকম স্নিগ্ধ পারিপার্শ্বিক রুক্ষতায়।
রাঙামাটি আমি যাইনি। মাটিরাঙায় গেছি। সেখানে গণরোষে পড়েছিলাম এবং গণপিটুনিতে হত হতে নিচ্ছিলাম। তবে সেটা ঘটেনি। ত্রাতা সহজ মানুষ। কেন? এই পৃথিবীতে এক সারি আছে বলে? সেই সারির সঙ্গে আমার দেখা হবে বলে?
সারি সেই ঢেউগুলো, সেই 'ঢেউগুলো যে আমায় নিয়ে করে কেবল খেলা।'
এবং ফুরায় বেলা, ফুরায় খেলা, সন্ধ্যা হয়ে আসে।
সন্ধ্যার অন্ধকার। কালো রঙের বলে কি শোকের?
না। কালো রঙে শোকের চিহ্ন কখনও দেখে না সহজ মানুষ। সমূহ শোক দেখে হরিতে। চিরহরিৎ শোক।
শোকের রং হরিৎ না হলে হলো?
ভুল বানান যেমন 'ভূল' না হলে হয় না।
নীল রঙের তবে কী মানে হয়?
হলুদ রঙের?
কমলা-লাল রঙের?
'দেখা যায় বলে তারা মনে করে তারা সব রঙের মানে বুঝে গেছে। নীল বিষাদের রং, লাল-কমলা উৎসবের রং বলে ফতোয়া দিয়ে রেখেছে। নীল রঙের কনডম তবে কেন বানায়? পিঙ্ক রঙের কনডম না হয় ফুরফুরে ভাবের, নীল রঙের কনডম পরে কি অর্গান বিষাদে আক্রান্ত হবে না? বব ডিলানের মাউথ অর্গানের কথা আমি বলছি না। আরে! এই পৃথিবীতে নদী কি তেরোটা? কত নদী, কত সরোবর। অবগাহন করো। অবগাহন করো?'
দীপ্যমানের বউ কলকাতার মানুষ। তারা বলে ভাটবকা। সহজ মানুষ কখনও কখনও এমন ভাট বকে। কেন? বিরাট শিশু সে? তরঙ্গিনীকে আড়াল করে রাখে কেন?
সব আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।
'সহজ মানুষ, তরঙ্গিনী কে?'
'তরঙ্গিনী এক নদী। সব নদীই তরঙ্গিনী।'
'সব নদী কি এক নদী?'
'সব ঘাস যেহেতু এক। কিংবা সব পাহাড়।'
'অসহ্য! তরঙ্গিনীর জন্ম কোন পাহাড়ে?'
'সব নদীর মা কি পাহাড়?'
'সব কথা এত জটিল, সহজ মানুষ?'
'না। সহজ।'
কে জানে কী? সহজ মানুষ যে হতে পেরেছে আর যে হতে পারেনি, আসমান-জমিন ফারাক দু'জনের। তবে আমি গেছি নদীর কুরুল্লায়, সহজ মানুষ কোন ছলনায় আটকাবে?
তরঙ্গিনীকে আমি দেখি না তবে তরঙ্গিনীর সঙ্গে আমার কথা হয়।
'তরঙ্গিনী, আমার দৃষ্টি অগভীর। তুমি থাকো মাটির কত গভীরে?'
'থাকি না। আমি বয়ে যাই।'
'মাটির কত গভীরে বয়ে যাও?'
'অঙ্ক করি না, আমি বয়ে যাই।'
'অঙ্ক করো না, পৌরনীতি করো?'
তরঙ্গিনী হাসে।
তরঙ্গিনীর হাসি ঝরনার, যদিবা সে নদী।
আমি কেন তাকে দেখতে পাই না?
'তরঙ্গিনী, তুমি আত্রেয়ী? অগ্নির পত্নী? রণচণ্ডী পতির মাথা ঠান্ডা করতে অন্তঃসলিলা হয়ে গেছ? ও তরঙ্গিনী, আমিই সে।'
'সে কে? অগ্নি?'
'না।'
'নৈঋত?'
'না।'
'তবে কে?'
'আমি এক শীতকাল হয়তো।'
'শীতকাল!'
শীতকালে হলুদ কিছু পাতা উড়ান দেয়।
কোন পাতা উড়ে কোনদিকে যায়?
আমি যদি একটা উড়ান পাতা হই? কোনদিকে যাব?
তরঙ্গিনীর দিকে। আত্রেয়ীর দিকে।
এত সহজ?
জটিল কেন?
তরঙ্গিনী। তরঙ্গিনী! অগ্নি কতটা পোড়ায় জলকে?
'চক্ষুদান ছাড়া তরঙ্গিনী হয় না।'
সহজ মানুষ কেবল জটিল মানুষের মতো কথা বলে যায়। চক্ষুদান কী? চক্ষুর আছে ঘরে। মরচে ধরে গেছে। তবে কাঁটা চামচ। স্টেইনলেস স্টিলের। কাটা চামচ দিয়ে চোখের মণি এত সহজে উপড়ে ফেলা যায়। সহজ মানুষের সহজ তরিকা। আমি চক্ষুদান করি সেই মতো। তরঙ্গিনীর জলৌকা আমার দুই চোখের মণি খুঁড়ে খায়।
এখন আমি দেখি তরঙ্গিনীকে।
সহজ মানুষের কথা অফুরান। তিন কালের কথা। সহজে ফুরায়? তবে আমি দেখি তরঙ্গিনীকে, এটা মনে হয় তাকে ক্লান্ত করে একটু। সে একটা বিজ্ঞাপন বিরতি নেয়। কনডমের বিজ্ঞাপন। পার্পল ভেরিয়েন্ট।
ফার্স!
তরঙ্গিনী আয়, আমরা একটা সন্তান উৎপাদন করি।
***
কে কাকে এই চিঠি লিখেছে?
নিরালাপুরের তরঙ্গিনী কে?
লীলাকে বলব। চিঠি লিখব। রহস্য করব। তরঙ্গিনী-চিঠি লেখা লীলাকে। না হলে আর আমি জন্মাই?
মন্তব্য করুন