ইতিহাস সাক্ষী হয়ে আছে চেঙ্গিস খান, হালাকু খান, আটিলা দ্য হুন, মঙ্গোল ও হুনদের নৃশংস যুদ্ধ, আলেকজান্ডারের যুদ্ধ, কলিঙ্গ যুদ্ধ, ওয়াটারলুর যুদ্ধ, ক্রিমিয়ার যুদ্ধ, রাশিয়া-জাপান যুদ্ধ, বলকান যুদ্ধ, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, কোরিয়া যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, কম্বোডিয়ার যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় অঞ্চলের বিভিন্ন যুদ্ধ, যুগোস্লাভিয়া-ক্রোয়েশিয়া ও বসনিয়ার যুদ্ধ, রুয়ান্ডা-কঙ্গো-শ্রীলংকা এবং এল সালভাদরের গৃহযুদ্ধ, পূর্ব তিমুরের স্বাধীনতা যুদ্ধ, আফগান যুদ্ধ। পূর্ব ইউরোপ-লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার জাতিগত সংঘাতসহ সব ধরনের যুদ্ধেই পরিলক্ষিত হয়েছে নারীর প্রতি সহিষ্ণুতা এবং ভায়োলেন্স। কিন্তু একজন বাংলাদেশি হিসেবে যে যুদ্ধের ক্ষত আমার হৃদয় থেকে কখনও শুকায় না এবং কখনও শুকাবে না, সেটা আমার মুক্তিযুদ্ধ। বলা প্রয়োজন, '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে জেনেভা কনভেনশনের কোনো বিধিনিষেধই মানা হয়নি। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে জার্মানি, রাশিয়া, চীন ও আর্মেনিয়ার নারী নির্যাতনের কথা বিশ্ববাসী জানে। ওই সময় বন্দি নারীদের ওপর জাপানিদের ভয়ঙ্কর যৌন নির্যাতন, ভিয়েতনামের নারীদের ওপর আমেরিকানদের বর্বরতার কথাও জানে না কে? কিন্তু '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালীন নারীদের ওপর চলা বীভৎস যৌন নির্যাতনের কথা কি আমরা বিশ্ববাসীকে জানাতে পেরেছি? না, জানাইনি। বরং লুকিয়েছি এবং ভেবেছি, পারিবারিক সল্ফ্ভ্রমের সংকটকে আমরা কৌশলের সঙ্গে মোকাবেলা করছি। ড. নীলিমা ইব্রাহিমের 'আমি বীরাঙ্গনা বলছি' এবং শাহীন আখতারের 'তালাশ' সেই ইঙ্গিতই দেয়। সুশান ব্রাউমিলার তার Against our will : Men women and Rape গ্রন্থে একাত্তরের বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের যৌন নির্যাতনকে তুলনা করেছেন নানজিংয়ে সংঘটিত জাপানিদের গণধর্ষণ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রাশান নারীদের ওপর নাৎসিদের ভয়ঙ্কর যৌন নির্যাতনের সঙ্গে। সুশান ব্রাউমিলার তার গবেষণায় তথ্য-উপাত্তসহ প্রমাণ করেছেন- একাত্তরে এ দেশের নারীদের ওপর যৌন নির্যাতনের ব্যাপকতা একক যুদ্ধ ও সময়ের হিসাবে পৃথিবীতে সংঘটিত সব যৌন নির্যাতনের শীর্ষে। ব্রাউমিলার তার গ্রন্থের তিরাশি পাতায় লিখেছেন- ‘Rape in Bangladesh had hardly been restricted to beauty.' Brownmiller writes girls of eight and grandmothers of seventy five had been sexually assaulted... Pakistani soldiers had not only violated Bengali women on the spot : they abducted tens of hundreds and held them by force in their millitary barracks for nightly use. Some women may have been raped as many as eighty times in a night [Brownmiller p.83]. How many died from this atrocious treatment and how many more women were murdered as part of the generalized campaign of destruction and slaughter, can only be guessed at.' ' পরিকল্পিতভাবেই তারা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে Rape, burn and kill কৌশলটি গ্রহণ করে।
'যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ' গ্রন্থে বলা হয়েছে, 'বাঙালি নারীর প্রতি পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতনের ধরন ছিল সভ্যতা বিবর্জিত আচরণের চেয়েও নিকৃষ্ট। তারা নারীদের সবার সামনে বিবস্ত্র করেছে। নারীদের পায়ুপথ ছিন্নভিন্ন করে তাদের সব বর্জ্য ও যৌনাঙ্গ নারীদের মুখে ঢুকিয়ে দিয়েছে। অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় যখন তারা কাতরিয়েছে, তখন বেয়নেটের খোঁচায় ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে তাদের যোনিপথ।
যুদ্ধে যতই তারা পরাভূত হচ্ছিল ততই তারা নিষ্ঠুর যৌন নির্যাতক, বিকারগ্রস্ত এবং ধর্ষকামী হয়ে উঠছিল। পাকিস্তানি সেনাদের এই Sociopathic Personality  জায়েজ এবং নির্দোষ জাহির করতে জেনারেল নিয়াজি লিখেছিলেন- The psychopath is one whose conduct is satisfactory to himself and to one else [G. D. Part ridge]. তবে পাকিস্তানিদের চারিত্রিক এবং আচরণগত বিকারের পেছনে যে নিষ্ঠুর অবদমনেচ্ছা, জাতিগত প্রেরণা এবং অসহিষ্ণুতা অত্যন্ত শক্তভাবে কাজ করেছে সেই sadism-এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ডা. এমএ হাসান তার যুদ্ধ ও নারী বইয়ে লিখেছেন- The attainment of sexual gratification through the infliction of bodily or mental pain on others by physical or verbal means ... In a broader, nonsexual sense, sadism refers to any type of cruelty or extreme aggression. The term is derived from the Marquisde sade [1740-1814] who practiced or fantasied a wide variety of perversions which he recorded in a novel entitled justine and juliette or the curse of virtue and the blessing of vice. নিজেদের নিষ্ঠুর প্রেরণার বিফলতা, হতাশা এবং অন্যান্য জটিল মনোবিকৃতি ও মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয়ের কারণে ন'মাসের যুদ্ধ শেষে অনেক নারী বন্দিকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি সেনারা। বেয়নেটের আঘাতে তারা কারও কারও যোনি ও পেট চিরে দেয়, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিন্নভিন্ন করে কেটে ফেলে মেয়েদের স্তন। খুলনার গল্লামারীতে [বধ্যভূমি] পাঁচ ট্রাক হাড়গোড় ও মাথার খুলি পাওয়া গিয়েছিল নারীদের।
ভারত সরকারের বিদেশ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত Bangladesh Documents থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, একাত্তরের মার্চ থেকে ৩১ আগস্টের মধ্যে শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের ৬৯ দশমিক ৭১ লাখ মানুষ শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। এদের মধ্যে এপ্রিলের পর যেসব পরিবার শরণার্থী হয়েছে, তাদের প্রতিটি পরিবারের নারী সদস্যই পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক ধর্ষিত হয়েছেন। ওই সময় ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন প্রায় আট লাখ ৭১ হাজার হিন্দু পরিবার। প্রতিটি পরিবারের নারীর সংখ্যা সর্বনিম্ন তিনজন অথবা শতকরা ৩৭ ভাগ অনুমান করলে দশোর্ধ্ব বয়সসীমার মোট নারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ২৬ লাখ ২৫ হাজার। এর মধ্যে মাত্র পাঁচ শতাংশ কিংবা প্রতি ২০ জনে একজন নির্যাতিত হয়েছেন- এমনটি ধরে নিলেও ধর্ষিত হিন্দু শরণার্থী নারীর সংখ্যাই হয় এক লাখ ৩০ হাজারের বেশি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নারীর ৭১ বইয়ে বলা হয়েছে, '৭১-এ সবচেয়ে বেশি নারী ধর্ষিত হয়েছে সিলেট শহর, বালাগঞ্জের বুরুঙ্গা, আদিত্যপুর, শ্রীরামসী, শেরপুর, পীরপুর, পীরনগর, করিমগঞ্জ সীমান্ত ও হাওর এলাকা, সুনামগঞ্জের হাওর এলাকা, মৌলভীবাজার, রাজনগর, সাধুহাটি, কমলগঞ্জ থানার শমসেরনগর, মণিপুরিদের বিভিন্ন গ্রামের অধিকাংশ, হবিগঞ্জের চুনারুঘাট ও শায়েস্তাগঞ্জ এলাকায়। বলা প্রয়োজন, বৃহত্তর সিলেট অর্থাৎ সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলায় গবেষণা চালিয়ে ৩০ হাজার [স্বীকৃত] বীরাঙ্গনার সন্ধান পাওয়া গেছে। এ ছাড়া টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর থানার ছাব্বিশাসহ বিভিন্ন গ্রাম, বরিশালের গৌরনদী থানার প্রায় সব গ্রাম, আগৈলঝাড়ার রাজিহার কেআর কোলাসহ পুরো বরিশাল, পটুয়াখালী শহরের প্রায় প্রতিটি বাড়ি; বরগুনা, ঝালকাঠি, ফরিদপুর, খুলনার গল্লামারী, কাস্টমঘাট, দৌলতপুর জুট মিল, যশোর ক্যান্টনমেন্ট, চাঁচড়া, ঝিনাইদহ সদর, শৈলকুপাসহ বিভিন্ন থানার গ্রাম, মাগুরার সব থানা, রাজশাহী শহর, চারঘাটের থানাপাড়া, দুর্গাপুর থানার যোগীশো, বাগমারা থানা, বগুড়া, জয়পুরহাট, পাগলা দেওয়ান, ঠাকুরগাঁওয়ের খুনিয়াদীঘি, দিনাজপুর, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট, লাকসাম সিগারেট ফ্যাক্টরি এবং লালমাই এলাকায় ধর্ষণের সংখ্যা ও ভয়াবহতা নজিরবিহীন।
The uppsala programme for holocaust and genocide 'Genocide Studies'-এ trocities against Bengali women শিরোনামে বলা হয়েছে,  'Susan Brownmiller likened the 1971 events in Bangladesh to the Japanese repes in Nanjing and German rapes in Russia during world war II.' ... 200,000, 300,000 or possibly 4,00,000 women [Three sets of statistics have been variously quoted] were raped. Eighty percent of the raped women were Moslems. Reflecting the population of Bangladesh. But Hindu and Christian were not exemt ... Hit and run rape of large numbers of Bengali women was brutally simple in terms of Logistics as the Pakistani regulars swept through and occupied the tiny populous land... [p.81] typical was the description offered by reporter Aubrey Menen of one such assault which targeted a recently- married woman. Two [Pakistani soldiers] went into the room that had been built for the bridal couple. The others stayed behind with the room that had been built for the bridal couple. The others stayed behind with the family. One of then convering them with his gun. They heard a barked order, and the bridegroom's voice protesting. Then there was silence until the bride screamed. Then there was silence again, except for some muffled cries that soon subsided. In a few minutes one of the soldiers came out his uniform in disarry. He grinned to his companions. Another soldier took his place in the extra room. And soon, until all the six had raped the belle of the village. Then all six left, hurriedly. The father found his daughter lying on the string cot unconscious and bleeding. Her husband was crouched on the floor, kneeling over his vomit. Rape in Bangladesh had hardly been restricted to beauty. Girls of eight and grandmothers of seventy five had been sexually assaulted .... Pakistany soldiers had not only violated Bengali women on the spot. They abducted tens of hundreds and held then by force in their military barracks for nightly use. Some women may have been raped as many as eighty times in a night. How many died from this atrocious treatment and how many more women were murdered as part of the generalized campaign of destruction and slaughter, can only be guessed at despite government efforts at amelioration the torment and persecution of the survivors, continued long after Bangladesh had won its independence... Rape, abduction and forcible prostitution during the nine month war proved to be only the first round of humiliation for the Bengali women. এত কিছুর পরও মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন আর তার নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার তখনও আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন যেভাবেই হোক পাকিস্তানের বিভক্তি ঠেকাতে। প্রায় একই সময় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের মার্কিন প্রতিনিধি জর্জ বুশ ভারতের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনাপূর্ণ বক্তব্য রেখে চলেছেন। ঠিক সে অবস্থাতেই ইন্দিরা গান্ধী লিখলেন-
মাননীয় প্রেসিডেন্ট,
পাকিস্তানি শাসকদের দ্বারা জনজীবনের মৌলিক শর্তসমূহ [বাংলাদেশের] লঙ্ঘিত হওয়ার পরও যুদ্ধ ঠেকানো যেত। জিজ্ঞেস করা হয়েছে- আমরা কী চাই। নিজেদের জন্য আমরা কিছুই চাই না। পূর্ব পাকিস্তান- তথা আজকের বাংলাদেশের- এক টুকরো জমিও আমরা চাই না। পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো জমিও আমাদের চাই না। বাংলাদেশে ২৫ মার্চ '৭১-এর পরে যে নির্মম ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, ভারত কেবল সে দেশের ৭৫ মিলিয়ন মানুষের বিদ্রোহের স্বীকৃতি দিয়েছে। [ইন্দিরা গান্ধী :স্পিচেস অ্যান্ড রাইটিংস, হারপার অ্যান্ড রো, নিউইয়র্ক ১৯৭৫ পৃ. ১৭১]
নিক্সন তার আত্মজীবনী দি মেমোয়ার্স অব রিচার্ড নিক্সন, গ্রোসেট অ্যান্ড ডানলোপ নিউইয়র্ক ১৯৭৮ এবং কিসিঞ্জার তার স্মৃতিচারণমূলক হোয়াইট হাউস ইয়ার্স [লিটল ব্রাউন অ্যান্ড কোম্পানি, বোস্টন ১৯৭৯] গ্রন্থে দাবি করেছেন, বাংলাদেশ যুদ্ধের সূত্র ধরে ইন্দিরা গান্ধী শুধু যে পাকিস্তানকে বিভক্ত করতে চাইছিলেন- তাই নয়, তার আসল উদ্দেশ্য ছিল পুরো পাকিস্তানকেই গিলে খাওয়া।
কিসিঞ্জার তার গ্রন্থে সুস্পষ্টভাবেই বলেছেন, বন্ধু পাকিস্তানকে বাঁচানোর জন্য ভারতের ওপর সর্বাত্মক চাপ প্রয়োগ করতে হবে। এ ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করবে যারা; জর্ডান থেকে আসবে চারটি যুদ্ধবিমান; গোলাবারুদ ও অন্যান্য যুদ্ধসামগ্রী দেবে ইরান; তুরস্ক দেবে ৬টি বিমান। ১৯৭৫ সালে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি নিয়ে শুনানির সময় নিক্সন নিজে স্বীকার করেছেন, '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে প্রয়োজনে তিনি আণবিক অস্ত্র ব্যবহারেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আমেরিকার চাপে জাতিসংঘে '৭১-এর যুদ্ধ বিরতির যে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল; ১০৪টি দেশ তার পক্ষে ভোট দেয়। বিপক্ষে ছিল মাত্র ১১টি দেশ। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন কার্যতই একা হয়ে পড়েছিল। এই প্রস্তাব গৃহীত হলে বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধ চলত যুগ যুগ ধরে [ফিলিস্তিন-ইসরায়েল]।
বাংলাদেশের গণহত্যার বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনাকে তিনি [কিসিঞ্জার] জাস্টিফায়েড আউটরেজ বলে মেনে নিয়ে লিখেছেন, 'পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শক্তি ব্যবহার করেছিল- তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু পাকিস্তান ছিল আমাদের জন্য চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে একমাত্র পথ। একবার সে পথ বন্ধ হয়ে গেলে বিকল্প পথ নির্মাণে হয়তো মাসের পর মাস লেগে যেত।' সেইমোর হার্শ লিখেছেন, 'নিক্সন বা কিসিঞ্জার কেউই বাংলাদেশের সৃষ্টি চাননি। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নিতেও পারেননি। বাংলাদেশের সৃষ্টি ঠেকাতে ব্যর্থতার চেয়েও তাদের বড় ব্যর্থতা ছিল নৈতিক ভারসাম্য প্রদর্শনে ব্যর্থতা। একটি আণবিক যুদ্ধ বাধিয়ে দেওয়ার মতো হঠকারিতা যারা দেখাতে পারে, তাদের আর যাই হোক, রাষ্ট্রনায়ক বলা যায় না। [হার্শ পৃ. ৪৫৬] রিচার্ড সিমন ও লিও রোজ পাকিস্তান, ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ [ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯০] গ্রন্থে লিখেছেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাটি পাকিস্তানকে বিভক্ত ও দুর্বল করতে অজুহাত হিসেবে ভারত ব্যবহার করেছে- এমন একটি অভিযোগ পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবীরা বারবার করে এসেছেন। প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও পাক-ভারত যুদ্ধ প্রসঙ্গে তার স্মৃতিকথায় সে যুক্তি দেখিয়ে পাকিস্তানের প্রতি মার্কিন সমর্থনের সাফাই গেয়েছেন। তার নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল, পূর্ব পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে ভারত শুধু পূর্ব পাকিস্তানকেই বিচ্ছিন্ন করবে না, পশ্চিম পাকিস্তানকেও গিলে খাবে। পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের ওপর ভারতের নজর দীর্ঘদিনের। এই যুদ্ধের সুবাদে তার যে লক্ষ্য পূরণ সম্ভব হবে। কিসিঞ্জার তার হোয়াইট হাউস ইয়ার্স [লিটল ব্রাউন, বোস্টন ১৯৭৯] গ্রন্থে একটি অজ্ঞাতনামা সূত্রের উদ্ৃব্দতি দিয়ে লিখেছেন, পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ শুরুর পরপর সম্পূর্ণ বিশ্বস্ত এক সূত্র থেকে আমরা জানতে পারি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানকে সম্পূর্ণ নপুংসক করে ফেলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তার পরিকল্পনামাফিক বাংলাদেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত কোনো যুদ্ধবিরতি ভারত মানবে না। মূলত এই অজ্ঞাতনামা সূত্রটি ছিল ইন্দিরা মন্ত্রিসভার সিনিয়র সদস্য এবং পরে প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই [দ্য প্রাইস অব পাওয়ার, হার্শ]
২৫ মার্চ মধ্যরাতে সামরিক বাহিনীর হাতে গণহত্যার সূচনা এবং নতুন করে সামরিক শাসন প্রবর্তনের পর আওয়ামী লীগকে দেশদ্রোহের দায়ে অভিযুক্ত করে। কারণ ছিল, এই আওয়ামী লীগ নাকি উদ্দেশ্যমূলকভাবে শুরুতেই পাকিস্তানের দুই অংশ পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করে। উদ্দেশ্য পাকিস্তান ভেঙে দ্বিখণ্ডিত করা। পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের শ্বেতপত্রের অভিযোগ সম্পর্কে রবার্ট জ্যাকসন তার গ্রন্থে লেখেন- ' 'As the Pakistan Government's white paper pointed out, this proposal differed from the earlier suggestion that after the assembly had met it should divide into committees made up of members from each wing. the Awami League's proposal was later represented by the authorities a virtually constitutional formula for secession [P.32]
Nearly everywhere there was widespread destruction and heavy casualties ... in the tumult which followed the Pakistani army directed its fire against the Bangalis, and inturn the Bangalis whenever they could murdered members of the Urdu speaking minorities including both West Pakistanis and Biharis. [Jackson Robert, South Asian crisis : INDIA-PAKISTAN-BANGLADESH]
পূর্ব পাকিস্তানে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার নামে যে গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী, সেখানে তাদের দর্শনই ছিল 'আদমি নেহি মাংতা হম্‌, মিট্টি মাংতা।' আদমির বিনিময়ে মিট্টির [মাটির] ওপর কর্তৃত্ব। এ বিষয়ে ম্যাসকারেনহাস তার 'দি রেপ অব বাংলাদেশ' গ্রন্থে লিখেছেন-
'For six days as I travelled with the officers of the 9th division headquarters at Comilla. I witnessed at close quarters the extent of the killing. I saw Hindus hunted from village to village and door to door shot off hand... I have heard the screams of men bludgeoned to death in the compound of the circuit house in Comilla. I have seen truckloads of human targets and those who had the humanity to try to help them hauled off for disposal under the cover of darkness and curfew. I have witnessed the brutality of kill and burn missions as the army units. After clearing out the rebels pursued the program in the towns and the villages.’

মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় স্তরে যে রাজাকারদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সে বিষয়ে ম্যাসকারেনহাস লিখেছেন- 'Relatives of missing persons believe that the Razakars and junior army officers are working independently in leave with non-Bengalis... The Razakars have now extended their operation from murder and extortion to prostitution in Agrabad in Chittagong they run a camp of young girls who are allocated nightly to senior officers. They have also kidnapped girls for their parties.’ জেনারেল নিয়াজি নিজেই ঠাকুরগাঁও-বগুড়ায় সেনা ইউনিট পরিদর্শনের সময় জানতে চান ক'জন হিন্দু নাগরিককে হত্যা করা হয়েছে? পিন্ডি থেকে ঢাকায় এসে বাহিনী পরিদর্শনের সময় প্রতিবারই জেনারেল গুল হাসানের প্রশ্ন থাকত- 'ক'জন বাঙালিকে হত্যা করেছ?' [Lt. Gen. Gul Hasan while visiting troops used to routinely ask 'How many Bengalis have you shot']

যুদ্ধাপরাধী ১৯৫ জনকে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো, সাড়ে চার লাখেরও বেশি বাঙালি নারীর ধর্ষণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ বিরোধিতা এবং পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিষয়গুলোকে অন্য ভাষিক লেখকরা কীভাবে দেখেছেন তার কিছুমাত্র [তিলার্ধ পরিমাণ] প্রামাণ্যায়নের চেষ্টা করা হলো। মুক্তিযুদ্ধের অগণনমাত্রিকতার একটিকেও স্পর্শ করা পর্যন্ত হলো না তাতে। তবে এটুকু অন্তত পরিস্কার যে, পাকিস্তান নামের দেশটি যা তৈরিই হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে, সৃষ্টির পরপরই তা আর কাজ করেনি। এটাও পরিস্কার যে, পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলাকে শোষণ করেছে নির্মমতার সঙ্গে এবং তারা সেই রাষ্ট্রটিকে একটি চরম নিপীড়নমূলক যন্ত্রে পরিণত করেছিল। স্পষ্ট এটাও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধের বৃহৎ স্রোতের পাশাপাশি সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্যও যে সমান্তরাল স্রোতধারা ছিল তা-ও ক্রমশ ক্ষীণ হতে হতে বিলীয়মান। সমাজতন্ত্রকে এখন দেখা হচ্ছে ছিন্ন পাদুকার মতো। যতদিন পর্যন্ত এই ভূমি থেকে সাম্প্রদায়িকতার প্রচ্ছন্ন হুমকি অবসিত না হয়, যতদিন পর্যন্ত রাষ্ট্র শাসনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে সামরিক বাহিনীর অধিগ্রহণের হুমকি দূরীভূত না হয় ততদিন তিল তিল পায়েই এগোতে হবে আমাদের সেই '৭১-এর প্রামাণ্যে। কেননা, গন্তব্য তো সেখানেই।