'স্রোতে গা ভাসানোর ইচ্ছা কখনোই ছিল না। পরিচিতি, জনপ্রিয়তা ধরে রাখার জন্য একের পর এক গান প্রকাশ করতে হবে- এ কথাও বিশ্বাস করি না। সমসাময়িক শিল্পীদের চেয়ে আমার গানের সংখ্যা কম না বেশি- সেই হিসাব-নিকাশ নিয়েও কখনও বসিনি। তার মানে এই নয়, আমি অন্য সবার চেয়ে আলাদা। শিল্পীজীবনে আমারও তৃষ্ণা আছে। গান গাওয়ার মধ্য দিয়ে সেই তৃষ্ণা মেটাতে চাই। আজীবন গান গেয়ে যাওয়ার বাসনাও মনের মধ্যে লালন করি। কিন্তু যে গীতিকথা, সুর, সংগীতায়োজনে নিজে তৃপ্ত হব না, তা কণ্ঠ তুলে নেওয়ার ইচ্ছা নেই। সেই ধরনের গানই গাইব, যা আমার শিল্পীসত্তা খুশি করবে আর শ্রোতার মনেও অনুরণন তুলবে দীর্ঘসময় ধরে। হোক না আমার গানের সংখ্যা কম, তবু ভালো কিছু করার চেষ্টা ধরে রাখতে চাই।' শিল্পীজীবনের ভাবনা নিয়ে এক নিঃশ্বাসে এই কথাই বলে গেলেন নিশিতা বড়ূয়া।

অবশ্য তার এই কথার সঙ্গে কাজের অমিল নেই, তার প্রমাণ শ্রোতারা বহুবার পেয়েছেন। দেখছেন গায়কীতে নিজেকে ভেঙে প্রতিবার নতুনভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে। ভার্সেটাইল শিল্পী হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে তার যে প্রচেষ্টা, সেটাও নজরে পড়েছে অনেকের। যেজন্য তার গাওয়া 'বন্ধু তোমায় মনে পড়ে', 'আমায় নিয়ে চলো', 'হিয়ার মাঝারে', 'এমন একদিন আসবে', 'তুমি আমি', 'শ্রাবণ ধারা', 'মন ভালো না', 'হারিয়ে ফেলেছি তাকে', 'মা', 'ভুল', 'সেদিন আমায় খুঁজে পাবে না', 'প্রবারণা', 'তৃতীয় চোখ', 'যখন রাখি চোখ', 'ভাবিনি', 'মন বলাকা', 'রক্তমাখা সিঁড়ি'সহ অন্য গানগুলো সহজেই শ্রোতার মনোযোগ কাড়তে পেরেছে। নিশিতাকে আমরা কখনও পেয়েছি মেলোডি শিল্পী হিসেবে, কখনও ফোক-ফিউশন, টেকনো থেকে শুরু করে ধর্মীয় গানের শিল্পী হিসেবেও। শুধু অ্যালবাম বা একক গান নয়, তাকে প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবেও নানা গানে কণ্ঠ দিতে দেখেছি আমরা। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে প্রতিবেশী দেশের সিনেমায়ও প্লেব্যাক করে শ্রোতার প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি। সাম্প্রতিক সময়ে নিশিতাকে আমরা দেখেছি, বরেণ্য শিল্পীদের কালজয়ী বেশকিছু গান নতুন করে গাইতে।

তাই নিশিতার কাছে জানাতে চাওয়া হয়, মৌলিকের পাশাপাশি কালজয়ী গান নতুন করে গাওয়ার কারণ। নিশিতা বলেন, "মানুষ বেড়ে ওঠার সময়ে যে বিষয়গুলো মনে ছাপ ফেলে, তার মধ্যে সংগীত অন্যতম। অনেক গান যুগের পর যুগ মানুষের মনে অনুরণন তুলে যায়। কারও কাছে সেসব গান একটা নির্দিষ্ট সময়ের চিত্র তুলে ধরে, তেমনি ডুবিয়ে রাখে স্মৃতি রোমন্থনে। কিছু গান শিল্পীজীবনের বেছে নেওয়ারও অনুপ্রেরণা জোগায়। এ জন্য 'সিলন মিউজিক লাউঞ্জ'-এর জন্য পার্থ বড়ূয়া যখন প্রখ্যাত শিল্পীদের কালজয়ী গানগুলো নতুন করে গাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন, তখন আনন্দের সঙ্গে সেই প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেছি। কারণ, যাদের গান শুনে বেড়ে ওঠা, শিল্পীজীবন বেছে নেওয়ার অনুপ্রেরণা পাওয়া, প্রাতঃস্মরণীয় সেই সব শিল্পীর গান কণ্ঠে তুলে নেওয়া সুযোগ কম লোভনীয় নয়। তাই তো 'সিলন মিউজিক লাউঞ্জ'-এ প্রথম যখন আরতি মুখার্জির 'তখন তোমার একুশ বছর' গাওয়ার পর মনে হয়েছে, এমন আরও কিছু কালজয়ী গান যদি নতুন করে গাইতে পারতাম, কী দারুণই না হতো। আমার এই মনের কথাগুলো হয়তো পার্থ বড়ূয়া জেনে ফেলেছিলেন।

যেজন্য ক'দিন পর আবারও সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলেন কালজয়ী আরেকটি গান গাওয়ার। এভাবেই একে একে শ্রাবন্তী মজুমদারের 'আহা কপালে আগুন জ্বলে', চিত্রা সিংয়ের 'কথা ছিল দেখা হবে' থেকে শুরু করে লতা মঙ্গেশকরের 'আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাব', 'অন্তবিহীন কাটে না আর যেন' ও 'রঙিলা বাঁশিতে' গানগুলো গাওয়ার সুযোগ পেয়েছি। অবশ্য প্রতিটি গানই প্রকাশের আগে সংশয়ে ছিলাম। আমার কণ্ঠে কালজয়ী গানগুলো শুনে শ্রোতারা কে কী বলবেন- এই নিয়ে ছিল যত ভয়। কিন্তু যখন দেখলাম আমার কণ্ঠে কালজয়ী গানগুলো শ্রোতার ভালো লাগছে, তখন ভয়, উৎকণ্ঠা যা ছিল সব দূর হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে আগ্রহ বেড়ে গেছে প্রখ্যাত শিল্পীদের কালজয়ী গানগুলো নতুন করে গাওয়ার।"
নিশিতার এই কথায় বোঝা গেল, সংগীতের কালজয়ী সৃষ্টিগুলোর প্রতি তার এক ধরনের দুর্বলতা আছে। যেজন্য ক'দিন আগে লতা মঙ্গেশকরের আরেকটি কালজয়ী গান 'কী লিখি তোমায়' নতুন করে গেয়েছেন। তবে অল্প সময়ের ব্যবধানে একের পর এক রিমেক গাইতে দেখা গেলেও মৌলিক গান থেকে সরে আসেননি নিশিতা। এর মধ্যে কলকাতার সুরকার অভিজিৎ বসুর সুরে নতুন একটি ছবিতে প্লেব্যাকের পাশাপাশি বেশকিছু একক গানের কাজও শেষ করেছেন এই ক্লোজআপ ওয়ান তারকা। তার কথায়, 'পুরোনো জনপ্রিয় গানের প্রতি দুর্বলতা থাকলেও মৌলিক গানের প্রতি মনোযোগ সবসময় ছিল। তাই মৌলিক গানের প্রকাশনা থেকেও কখনও পিছিয়ে আসব না।

কারণ আমি জানি, একজন শিল্পীর নিজস্বতা তুলে ধরার জন্য মৌলিক গানের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু জনপ্রিয়তার দৌড়ে অংশ নিতে গিয়ে যে কোনো ধরনের গান গাওয়া নিয়ে আমার ঘোর আপত্তি আছে। এটা সত্যি, ভালো কিছু করতে গেলে কিছুটা বাড়তি সময় নিতে হয়। নতুন কিছুর জন্য যেটুকু সময় না নিলেই নয়, তা নেব। যাতে করে শিল্পী হিসেবে নিজের এবং শ্রোতাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়। একজন শিল্পী হিসেবে আমি যা করতে পারি তাহলো, সময়োপযোগী এবং ভালো কিছু গান গাওয়ার চেষ্টা করে যাওয়া, যার বিনিময়ে পাওয়া যাবে শ্রোতার ভালোবাসা। তাই ভালো কাজের মধ্য দিয়েই শ্রোতার হৃদয়ে জায়গা করে নিতে চাই।'