পর্ব ::১১১
[পূর্বে প্রকাশিতের পর]

সমাজতন্ত্রের অর্থ যদি হয় সামাজিক ন্যায়বিচার (সোশ্যাল জাস্টিস), আর সামাজিক ন্যায়বিচারের অর্থ যদি হয় 'ন্যায়ের' বাস্তবায়ন, তাহলে সংগত কারণেই প্রশ্ন ওঠে- ন্যায় কী এবং সেই ন্যায়দর্শনের ভিত্তি কী? নিচের উদাহরণটি প্রমাণ করে, সব সময় এই প্রশ্নের সহজ উত্তর নেই। প্রায়োগিক নীতিমালা অনেক সময় ডগমাটিক হলে চলে না। অবস্থাভেদে নীতিকে বিভিন্ন ধারার ন্যায়দর্শনকে আশ্রয় করে চলতে হয়। অমর্ত্য সেন একটি ছোট্ট উদাহরণের মাধ্যমে এটি বুঝিয়ে দিয়েছেন। 'আইডিয়া অব জাস্টিস' বইতে যে উদাহরণটি দিয়েছেন, সেটি বাংলাদেশে সমাজতন্ত্রের চেহারা কেমন হওয়া উচিত- তা বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের সাহায্য করতে পারে। বইতে পাত্রপাত্রীর নাম তিনি যেভাবে দিয়েছেন, এখানে আমি তা একটু বদলে দিলাম। ধরা যাক, যাদের নিয়ে কথা হচ্ছে, তাদের নাম আসগর, করিম ও শ্যামল। এদের মধ্যে একটি বাঁশি কে পাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আসগর খুব ভালো বাঁশি বাজায়। এটা শ্যামল ও করিম উভয়েই জানে। যেহেতু এটি রাষ্ট্র থেকে দেওয়া হচ্ছে, তাই বাঁশিটা পাওয়ার অধিকার তারই। আবার করিমের জন্ম খুব দরিদ্র পরিবারে। সে কখনও এমন সুন্দর বাঁশি দেখেনি। এমন একটি বাঁশি পাওয়ার আকুতি তার মধ্যে আছে। তারও দাবি, তাকেই এটা দেওয়া হোক। আর এদের মধ্যে শ্যামলের দাবি, বাঁশি বানানো তার পিতৃপুরুষের কাজ, সে-ই এই বাঁশি বানিয়েছে। তার থেকেই রাষ্ট্র নিয়েছে, এখন দিতে চাইছে। তাই এটি তারই প্রাপ্য। এখন কার বাঁশি পাওয়া উচিত, সামাজিক ন্যায়ের দৃষ্টিতে তা দেখতে চাইলে একেক দৃষ্টিকোণ থেকে একেক ধরনের উত্তর পাব। যিনি দক্ষতাকে সম্পদ বণ্টন বা পুনর্বণ্টনের মূল ভিত্তি বলে মনে করেন, তিনি আসগরকে বাঁশি দেওয়ার পক্ষে থাকবেন। কিন্তু যারা হিতবাদী (ইউটিলিটারিয়ান) দর্শনের লোক, যাদের মধ্যে জেরেমি বেন্থাম বা জন স্টুয়ার্ট মিলের মতো উদারনৈতিক বা লিবারেল দর্শনের প্রবক্তারাও পড়েন, তারা বলবেন- করিমকেই এটা দেওয়া সামাজিকভাবে ন্যায়সংগত। আবার মার্ক্সবাদীরা যুক্তি দেবেন, শ্যামলের বানানো জিনিস তাকে না দিয়ে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এটা শ্যামলেরই প্রাপ্য।
ওপরের উদাহরণ থেকে আমরা বুঝতে পারছি, সামাজিক ন্যায়ের কোনো একক বা সর্বাত্মক সংজ্ঞা নেই, যেটা দিয়ে সব রকমের বণ্টন নীতিমালা গ্রহণ করতে পারি। একেক সমস্যা মোকাবিলায় আমাদের একেক রকমের ন্যায়দর্শনের আশ্রয় নিতে হয়। এর তাৎপর্য হচ্ছে, সামাজিক ন্যায়বিচার তথা সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব ও প্রয়োগের ক্ষেত্রেও একমাত্রিক চিন্তার সুযোগ নেই। সমাজতন্ত্রের ধারণার মধ্যে বিভিন্ন ধারার ন্যায়দর্শনের চর্চার ও অবস্থাভেদে তার বিশিষ্ট প্রয়োগের সুযোগ রয়ে গেছে। যেমন :বাঁশিটা আসগর, করিম ও শ্যামল- এই তিনজনার মধ্যে কাকে দেওয়া হবে, এই জটিল ন্যায়সংকটের পাশাপাশি আরও কয়েকটা প্রসঙ্গ অবতারণা করা যায়। বাঁশিটা কে পাবে, এর উত্তর মুলতবি থাকলেও এটা পরিস্কার যে বাঁশিটা অন্তত এমন কাউকে দেওয়া উচিত নয়, যিনি কিনা কেবল বাঁশির 'মজুতদারী' করেছেন। ধরা যাক, তার নাম সোহেল। অর্থাৎ তিনি আসগরের মতো দক্ষ বাঁশিবাদকও নন; করিমের মতো একটা বাঁশি হাতে পাওয়ার অভাববোধজনিত তীব্র আকুতিও তার নেই; আবার শ্যামলের মতো বাঁশিটা তিনি উৎপাদনও করেননি। তার শুধু আগ্রহ, বেশি বেশি করে বাঁশি কিনে 'স্টক' করে রাখা, আর দাম বেশি পেলে সেটা বিক্রি করে 'ব্যক্তিগত মুনাফা' বৃদ্ধি করা। মুনাফা অর্জন ছাড়া বাঁশির সুর-লহরী নিয়ে তার কোনো বাড়তি আগ্রহ নেই। এ ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্রের নীতি খুব পরিস্কার :আসগর, করিম বা শ্যামল যাকেই অবশেষে বাঁশিটি দেওয়া হোক না কেন, অন্তত সোহেলকে ওই বাঁশিটি দেওয়া ন্যায়সংগত হবে না। অর্থাৎ সামাজিক ন্যায়বিচারের কোনো কোনো ক্ষেত্রে ন্যায়মীমাংসা জটিল হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। সোহেলের মতো লোকদের কাছে যাতে করে উত্তরোত্তর বাঁশির ঘণীভবন (কনসেন্ট্রেশন) বাড়তে না থাকে- অর্থনীতির পরিভাষায় concentration of economic power, যাতে করে সহনশীল মাত্রার মধ্যে বিরাজ করে- সেদিকে রাষ্ট্র খেয়াল রাখবে। এটি গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের কাছে প্রত্যাশা। ন্যায়দার্শনিক জন রাউলস আরেকটি প্রত্যাশার কথা বলেছেন। 'টু প্রিন্সিপলস্‌ অব জাস্টিস' নীতিতে সমাজে কতটা আয়বৈষম্য গ্রহণযোগ্য, তার একটি ফর্মুলা তিনি বেঁধে দিয়েছেন। মানুষের সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রাথমিক চাহিদা পূরণের (primary goods) দরকার হয়। এই চাহিদাকে যেসব পণ্য প্রয়োজন নির্দিষ্ট করে তার মধ্যে পড়ে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, 'যেমন ইচ্ছে ঘুরে বেড়ানোর' স্বাধীনতা, 'চিন্তার স্বাধীনতা' প্রভৃতি। স্বাধীনতার চাহিদাকেও আমি প্রাইমারি গুডসের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছি, কেননা (রাউলসের মতে) স্বাধীনতা ছাড়া শুধু অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-স্বাস্থ্য প্রভৃতির সংস্থান অনেকখানি নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু এটা বোঝাতেই তার 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'তে লিখেছিলেন, 'স্বাধীনতা ছাড়া মানুষের জীবন পাথরের মতো শুস্ক হয়ে যায়।' যা হোক, রাউলসের ফর্মুলাটি হলো, সমাজের সবচেয়ে অভাবপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের 'মৌলিক চাহিদা' সর্বাগ্রে পূরণ করতে হবে (যাকে অন্যত্র তিনি 'ডিফারেন্স প্রিন্সিপল' বলেছেন)। এদের 'মৌলিক চাহিদা' আগে পূরণের পর সমাজে যেটুকু বৈষম্য থাকবে, তা হয়তো 'গ্রহণযোগ্য'। সমাজতন্ত্রের ন্যায়দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি মনোগ্রাহী হলেও (এ জন্যই এটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে) কতগুলো সমস্যা তার পরও থেকেই যায়।
প্রথমত, এই রাউলসীয় ফর্মুলা থেকে কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছেন যে সমাজ থেকে দারিদ্র্য যদি আগে দূর যায়, তাহলে আপেক্ষিক বৈষম্য নিয়ে দুর্ভাবনার অত দরকার নেই। এটি ন্যায়ের একটি বিশিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি হতে পারে, কিন্তু সমাধানটি সবার ভালো না-ও লাগতে পারে। সমাজ থেকে না হয় দারিদ্র্য মুছে গেল, তারপরও মানুষ আপেক্ষিক বৈষম্য সম্পর্কে আলাদাভাবে সংবেদনশীল। উন্নত দেশের মাল্টিন্যাশনাল করপোরেশনগুলোর সিইও যে বেতন পান, সেই প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে নিচের স্তরের কর্মচারী (যিনি হয়তো দারিদ্র্যসীমার ঊর্ধ্বে দাঁড়ানো) পান তার চেয়েও ৪০ ভাগ কম পারিশ্রমিক। এতটা বৈষম্য সমাজে কি থাকা উচিত? এ প্রশ্নটা সমাজতন্ত্রীরা করবেন। কতটা বৈষম্য সমাজের জন্য গ্রহণযোগ্য, এটি শুধু অর্থনীতিবিদরা ঠিক করতে পারেন না।
দ্বিতীয়ত, মৌলিক চাহিদা ও তার ভিত্তিতে সংজ্ঞায়িত যে 'দারিদ্র্য', তাকে আরও স্পষ্ট করে চিহ্নিত করতে হবে। এসব চাহিদার কিছু কিছু পূরণ হবে 'প্রাইভেট গুডস'-এর (বা বাজার থেকে অভিরুচি ও সামর্থ্য অনুযায়ী জিনিসপত্র বা সেবা কেনার) দ্বারা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন, বাসস্থান এসব প্রয়োজন কি শুধু 'প্রাইভেট গুডস'-এর বলয়ে থাকবে, নাকি সেগুলো পড়বে 'পাবলিক গুডস'-এর বলয়ে (অথবা প্রাইভেট-পাবলিক 'মিশ্র' খাতে)? কানাডায়-যুক্তরাজ্যে স্বাস্থ্য খাতকে মূলত 'কমন গুডস' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে জার্মানি, সুইডেন, ডেনমার্ক, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড একই পথের অনুসারী। এসব দেশে স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তিগত চিকিৎসাসেবার সুযোগ সীমিত। এর অর্থ দাঁড়ায় যে এসব দেশে অসুখে ভুগলে কোনো পরিবার বা ব্যক্তি বিপন্ন বোধ করেন না। কেননা, তিনি জানেন যে তার চিকিৎসাসেবার প্রায় সব দায়-দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সোভিয়েত পতনের পরও পূর্ব ইউরোপের বেশিরভাগ দেশেই স্বাস্থ্য খাতকে 'কমন গুডস'-এর অংশ হিসেবেই দেখা হয়। বঙ্গবন্ধুর বাহাত্তরের সংবিধানে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি চাহিদার বিষয়টি 'মৌলিক নীতিমালার' অংশ হিসেবে রাখা হয়েছে। কিন্তু এই লক্ষ্যটি এখন 'মৌলিক অধিকারের' মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ভাবনা-চিন্তা করা প্রয়োজন। পক্ষান্তরে, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে স্বাস্থ্যসেবাকে 'কমন গুডস'-এর অংশ করা হয়নি। হালআমলের 'ওবামা কেয়ার'-এর মাধ্যমে কিছু কিছু স্বাস্থ্যসেবাকে কোনো কোনো গ্রুপের জন্য (যেমন- ৬৫-ঊর্ধ্ব লোকেদের জন্য) নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে রাষ্ট্রের তরফে, এটা ঠিক। কিন্তু অধিকাংশ স্বাস্থ্যসেবাই অধিকাংশ মানুষের জন্য এখনও ব্যক্তিগত সামর্থ্যের ওপর নির্ভরশীল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি এ দেশে আমেরিকার পথে (যেখানে স্বাস্থ্যসেবা মূলত ব্যক্তিগত সামর্থ্যের ওপরে নির্ভরশীল) এগোব, নাকি যুক্তরাজ্য-রাশিয়ার পথে এগোব (যেখানে জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র সাধারণভাবে গ্যারান্টি দিচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার)? এই বিতর্কটা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রীরা তুলবেন।
তৃতীয়ত, কোন পণ্য, সেবা বা প্রয়োজন কতটা পরিমাণে ব্যক্তি খাতে বা রাষ্ট্রীয় খাতে থাকবে, তা যুগের হাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলায়। এর অর্থ, আগে থেকেই ঠিক করা যাবে না যে ক, খ, গ, ঘ খাতগুলো শুধু ব্যক্তি খাতে থাকবে; আর য, র, ল, ব খাতগুলো শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে থাকবে। সমাজতন্ত্র মানে ১০০% রাষ্ট্রায়ত্ত খাত- এ ধরনের ধারণার বৈজ্ঞানিক বা অর্থনৈতিক কোনো ভিত্তি নেই। বঙ্গবন্ধুর কালে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বৃহদায়তন শিল্প খাতে কলকারখানা রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে থাকলেও ক্ষুদ্র-মাঝারি খাতগুলো তখন ব্যক্তি খাতে ছিল। ক্রমে ব্যক্তি খাতে নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে 'ইনভেস্টমেন্ট সিলিং' বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গত শতকের আশি-নব্বই দশকে আলোচনাকে অন্য খাতে প্রবাহিত করা হয়েছিল। সে সময়ে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করা হয় যে প্রায় সব খাতের অর্থনৈতিক ইউনিটকেই কেবল ব্যক্তি খাতের জন্য সংরক্ষিত করা হতে থাকে। এতে করে বাধাবন্ধনহীন ব্যক্তিগত মুনাফাচালিত ও সংকীর্ণ স্বার্থের বেসরকারীকরণ প্রক্রিয়া চালু করা হয়। মুখে ব্যক্তি খাত বলা হলেও প্রক্রিয়াটি শেষ পর্যন্ত করপোরেট ক্যাপিটালিজমের দিকেই ধাবিত হয়। ব্যাংক-বীমা খাতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিরাষ্ট্রীয়করণ ও অবাধ ঋণপ্রবাহের মাধ্যমে রাতারাতি এক বৃহৎ ধনিক গোষ্ঠীর আত্মপ্রকাশ ঘটে আশি-নব্বইয়ের দশকে এবং পরেও তা অব্যাহত থাকে। ব্যাংকিং খাতের জন্য এই বেসরকারীকরণ প্রক্রিয়ার প্রভাব সর্বত্র সুফলদায়ী হয়নি। অনাদায়ী ও মন্দ ঋণের পরিমাণ আনুপাতিক হারে বেড়েছে তা-ই নয়, দেশের আনাচে-কানাচে 'নিচে থেকে' গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোগের ব্যবসায়িক প্রয়োজন মেটাতেও ব্যর্থ হয় অধিকাংশ বেসরকারি ব্যাংক ও অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান। এককথায়, আমরা সে সময়ে অতিমাত্রায় বিরাষ্ট্রীয়করণের দিকে ঝুঁকে পড়েছি। বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র- যেটি একটি জনকল্যাণধর্মী মিশ্র খাতের সমর্থক- এই বল্কগ্দাহীন মুনাফাকেন্দ্রিক পুঁজিবাদের বিকাশকে প্রশ্নের সম্মুখীন করবে।
চতুর্থত, বৈষম্য শুধু আয়ের ক্ষেত্রে নয়, জীবনযাত্রার অন্যান্য আয়বহির্ভূত সূচকেও একে বিচার করতে হবে। রাউলস যখন দরিদ্রতমদের জন্য মৌলিক চাহিদা পূরণের কথা বলেছিলেন, তিনি গরিব ও ধনীর জন্য আলাদা শিক্ষাব্যবস্থার কথা ভাবেননি। প্রত্যেকের জন্যই শিক্ষা একটি পাবলিক বা কমন গুড। প্রাথমিক, মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষা হবে প্রায় সবার জন্য সমান মানসম্পন্ন। উন্নত দেশে এসব স্তরে কোনো বৈষম্য করা হয় না। পাবলিক এডুকেশন (দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত) সবার জন্য সমান গুণসম্পন্ন এবং অবৈতনিক। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রেও এই ব্যবস্থা বিদ্যমান। পশ্চিম ইউরোপ ও পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশে এবং রাশিয়ায় উচ্চ শিক্ষা গ্রহণও অনেক ক্ষেত্রে অবৈতনিক- শিক্ষার্থীদের মেধা ও প্রতিভার সঙ্গে সংগতি রেখে সেখানে টিউশন ফি নির্ধারণ করা হয়। অথচ আমাদের দেশে বাহাত্তরের সংবিধান অনুযায়ী 'বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার' কথা বললেও এখন পর্যন্ত একটি 'কমন স্কুল সিস্টেম' আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। যার মাধ্যমে ধনী, মধ্যবিত্ত ও গরিব মানুষের ছেলেমেয়েরা গা ঘষাঘষি করে এক শ্রেণিতে পড়ালেখা করতে পারবে। এখন মাদ্রাসায় যায় মূলত অতিদরিদ্রদের ছেলেমেয়েরা; বাংলা মিডিয়াম স্কুলে যায় গরিব-নিম্ন মধ্যবিত্তের ছেলেমেয়েরা; আর ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে যায় উচ্চ মধ্যবিত্ত-ধনী ঘরের ছেলেমেয়েরা। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে এ রকম আরও সূক্ষ্ণ প্রভেদ করা সম্ভব। এর ফলে চাকরিজীবনে প্রবেশের আগেই বিভিন্ন আয়ের মানুষের মধ্যে গভীর শ্রেণিবিভাজন ঘটে যায়। কমন স্কুল না থাকার জন্য সামাজিক (ঊর্ধ্বমুখী) সচলতা কমে যায়। নিচের আয়ের মানুষ ওপরের আয়ের স্তরে প্রবেশ লাভ করতে ব্যর্থ হয় প্রাথমিক-মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থায় নানা স্তরের মধ্যে পাঠদানের গুণে-মানে বৈষম্যের কারণে। সংগত কারণেই এই বিষয়টি বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র আলোচনার একটি মুখ্য বিষয়বস্তু।
[ক্রমশ]