বাংলা সাহিত্যে ভ্রমণকাহিনির ইতিহাস দীর্ঘ। বাংলাদেশে ভ্রমণ সাহিত্য নিয়ে প্রচুর লেখা হয়েছে ও হচ্ছে। শুধু ভ্রমণপিয়াসী মনকে আনন্দ দিয়ে কখনও কোনো পর্যটক অথবা লেখক ক্ষান্ত থাকেননি। বিস্তারিত তা তুলে ধরেছেন বইয়ের পাতায়। বাংলা সাহিত্যে ভ্রমণকাহিনির তালিকা যেমন বড় তেমনি মানেও অত্যন্ত সমৃদ্ধ।ভ্রমণকাহিনির মাধ্যমে অন্যের চোখ দিয়ে দেখা ও মনের আনন্দ মেটানোর সুযোগ পান পাঠক। এর বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এর বলার ভঙ্গি, উপস্থাপনা পাঠককে নিয়ে যায় বর্ণনার সেই জায়গাটিতে। গল্পপ্প-উপন্যাসের কাহিনির মতো এখানেও আসে বিবরণ। সেখানে থাকে জীবন যাপন, পরিবেশ, ইতিহাস, ভূগোলসহ নানা বিষয়। বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক ফারুক মঈনউদ্দীন তার 'সুদূরের অদূর দুয়ার' বইতে পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন ভূগোলের ছোট ছোট বিষয়কে তুলে এনেছেন এ বইয়ে। লেখকের সৌন্দর্যবোধ, সহজভাবে উপস্থাপনা বইটিকে পাঠকপ্রিয় করে তুলেছে। এখানে চারটি দেশের ভ্রমণ বৃত্তান্ত সংকলিত হয়েছে। মোট ১২টি অধ্যায়ে মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, হংকং ও অস্ট্র্রেলিয়া ভ্রমণের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনার মধ্য দিয়ে পাঠক মানস-ভ্রমণ করে আসতে পারবেন অস্ট্রেলিয়ার স্বর্ণখনি থেকে শুরু করে ঘরের কাছের ইয়াঙ্গুন কিংবা শ্রীলংকার স্বল্প পরিচিত ভ্রমণকেন্দ্রগুলো। বইটি প্রকাশ করেছে সময় প্রকাশন, পৃষ্ঠা সংখ্যা-১৬৫, মূল্য :৩০০ টাকা। এর নান্দনিক প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। বইটির প্রথম অধ্যায় 'বার্মা মুলুক মান্দালয়ে'। মান্দালয় মূলত মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। ইয়াঙ্গুন শহর থেকে উত্তরে ইরাবতী নদীর পূর্বতীরের চমৎকার একটা নগর। মান্দালয় এয়ারপোর্টে নামার পর বার্মিজ তরুণী জিন ওয়াই খাইংয়ের সঙ্গে পরিচয়ের মাধ্যমে বর্ণনা শুরু হয়েছে। মান্দালয় শহরে ঢোকার পথে শহরের বিশেষ সৌন্দর্য, বহুতল হোটেল এবং ইরাবতী নদীর অপার সৌন্দর্যের কথা উঠে এসেছে এ অধ্যায়ে। ইরাবতীর কথা বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক বলেছেন, ইরাবতীর তীরে খুব সাদামাটা এক ঘাটে কয়েকটা লঞ্চ নোঙ্গর করা কোনো প্র্রমোদতরী নয়। একেবারে আমাদের সদরঘাট-কেওড়াকান্দি রুটের লঞ্চের মতো। এভাবে প্রতিটি বিষয় ব্যাখ্যা করেছেন লেখক সুচারুরূপে।
হংকংয়ের গ্রাম নিয়ে অধ্যায় 'হংকংয়ের গ্রামের ইচ্ছাপূরণ বৃক্ষ' সেখানকার শহরতলির মানুষের জীবনযাপন উঠে এসেছে লেখনীতে। তিন হাউ দেবীর নামে এখানে একটি মন্দির তৈরি করা হয়েছিল, যা ছিল প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু। এটি নিয়ে আছে বিশদ বিবরণ। এ রকম ছোট ছোট বিষয় উঠে এসেছে এই পর্বে।
'ভিক্টোরিয়ার স্বর্ণখনির সন্ধানে' পর্বে স্বর্ণখনির কথা বলতে গিয়ে লেখক তুলে এনেছেন ১৮৪৮ সালের আমেরিকার সোনা তোলার কাহিনি। লিখেছেন খামারের জন্য যে বিশাল পরিমাণ কাঠ প্রয়োজন, তা সরবরাহে নিজস্ব্ব একটা করাতকল দরকার হয়ে পড়ে সাটারের। তাই তার দুর্গ থেকে ৫০ মাইল উত্তর-পূর্বে আমেরিকা নদীর তীরে একটি করাতকল বসানোর জন্য তার কর্মচারী গেমস মার্শালের অধীনে ২০ জন লোক লাগিয়ে দেন। করাতকল যখন বসানোর জন্য কাজ শেষের পথে; হঠাৎ নদীতীরে চকচকে কিছু একটা মার্শালের চোখে ঝিলিক দিয়ে যায়। মার্শালের জবানিতে জানা যায়, 'আমি আমার হাত ডুবিয়ে ওটা তুলে আনি, জিনিসটা দেখে আমার বুকের ভিতর লাফ দিয়ে ওঠে। কারণ আমি নিশ্চিত ছিলাম যে ওটা ছিল ছিল সোনা।' এ অধ্যায়জুড়ে আছে রোমাঞ্চ।
স্ব্বর্ণখনির রক্তঝরা বিদ্রোহ ভ্রমণবৃত্তান্ত সেই সেভরন হিলকে নিয়েই। 'সিডনিতে একদিন' অধ্যায়টি অস্ট্রেলিয়ার গল্প। একদিকে যেমন সিডনির নৈসর্গিক সৌর্ন্দয, ঠিক অন্যদিকে আদিবাসীদের নানা বর্ণনা উঠে এসেছে এ পর্বে। সেখানকার লোককাহিনি বর্ণিত হয়েছে বিশদভাবে।
পুরোনো এক লোককাহিনি বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক লিখেছেন- তিন বোনের বাবা। তাওয়া ওয়েন ডাকিনী বিদ্যা চর্চা করতেন। সেখানে এক বানিয়াপ (অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের কল্পকথার দানব) গভীর গর্তের মধ্যে থাকত। সবাই এটিকে ভয় পায়। তাওয়া ওয়েনকে এই গহ্বরের পাশ দিয়ে খাবারের সন্ধানে যেতে হতো। যাওয়ার সময় তিনি তার মেয়ে তিনটিকে খাড়া পাহাড়ের মাথায় পাথরের আড়ালে লুকিয়ে রেখে যেতেন। এমনই এক দিন ওদের বাবা যখন বাইরে গেছেন তখন মিনি এক বিশাল কেন্নেম্না দেখে ভয় পেয়ে যায়। ওটাকে তাড়ানোর জন্য জন্য ও যে পাথর ছুড়ে মারে, সেটি গড়াতে গড়াতে সশব্দে নিচে পড়ে গেলে বানিয়াপের ঘুম ভেঙে যায়। এর মধ্যে পাথরটি নিচে পড়ার ঝাঁকুনিতে তিন বোনের পেছনের দেওয়াল চিরে ফাঁক হয়ে যায়। ওরা পাহাড়ের গায়ে এক চিলতে তাকের ওপর সভয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বানিয়াপ ক্রুদ্ধ হয়ে যখন ওদের দিকে এগিয়ে আসে, বনের পশুপাখিও ভয়ে নিশ্চল হয়ে পড়ে। মেয়েদের দানবটির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তার বাবা তাওয়া ওয়েন জাদুর হাড় দিয়ে পাথর বানিয়ে দেন তিন বোনকে। এভাবে চমৎকার বর্ণনা আর উপস্থাপনা আছে এই পর্বে, যা পাঠককে এক নিমেষে পুরোটা পড়ে ফেলতে ইচ্ছে হবে।
এর বাইরে আরও কয়েকটি ভ্রমণকাহিনিতে যে কোনো পাঠককে টেনে নিয়ে যাবে প্রতিটি পৃষ্ঠায়। যেমন মঠের সোনাল শহর বাগান, রঙ্গিলা রেঙ্গুন, হংকংয়ের গ্রামের তিন হাউ পরব, গ্রেট ওশেন ড্রাইভের বারো শিষ্য, সিংহল সমুদ্রে তিমি দর্শন, মাদু গঙ্গার দারুচিনি দ্বীপের ভিতর।