আমরা পাঁচ মাস যাবৎ ঘুমাতে পারি না, অথচ আমাদের ঝুলন্ত চোখে টইটই করে ঘুমের নদী, আমরা সেই নদীর জলে ডুবসাঁতার দিতে পারি না, ডুব দিতে গেলেই প্রাপ্তবয়স্ক কুমিরের মতো আলগোছে চলে আসে স্বপ্টম্ন, আমরা স্বপ্টেম্নর জালে ফেঁসে যেতে থাকি।
আমরা সংসার পাতার প্রথম রাত থেকেই স্বপ্টম্নজালে আটকা পড়ি, ঘুমিয়ে পড়লে একসঙ্গে স্বপ্টেম্ন ঢুকে পড়ি এবং একসঙ্গে স্বপ্টম্ন থেকে বেরিয়ে আসি, তারপর মনে হয় আমাদের শরীরের ওপর দিয়ে আন্তঃনগর ট্রেন চলে গেছে, আমরা ট্রেনের চাকায় কাটা পড়েছি।
আমরা যখন একটু স্বাভাবিক হই এবং বুঝতে পারি এতক্ষণ স্বপ্টেম্নর মধ্যে বন্দি ছিলাম তখন একে অন্যের কাছে স্বপ্টেম্নর বর্ণনা দিতে থাকি, তখন আবারও বুঝতে পারি আমরা আসলে একই সময়ে একই স্বপ্টম্ন দেখেছি।
আমরা যখন আমাদের ঘর ছাড়ি, কাউকে না জানিয়ে, নিশ্চুপ নিরালা পথে, ভীরু ভীরু পায়ে, পালিয়ে তখন বন্যার পানি নেমে গেছে, আসমান-জমিন হাহাকার করে, খাঁখাঁ করে ফসলের ক্ষেত, ঘরে ঘরে আহাজারি, চাল নেই ডাল নেই কোথাও, গ্রামগঞ্জে লবণের জন্য দুর্ভিক্ষ, আম-কাঁঠালের বাগানে বাদুড়ের উৎসব, শিশুর হাড্ডিসার গালে দাঁত বসিয়ে দেয় ডোরাকাটা মশা; পথে-ঘাটে-মাঠে নেড়ি কুকুরের উৎপাত।
আমরা এসবে মাথা ঘামাই না, হাত ধরাধরি করে পাকা ঘরদোর ফেলে শহরের দক্ষিণ প্রান্তে গলির এক কোনায় আধাপাকা ঘরে সংসার শুরু করি।
কিন্তু প্রথম রাত থেকেই ঘুমাতে পারি না, ঘুম এলেই স্বপ্টম্ন আসে, আর স্বপ্টম্ন মানেই দুঃস্বপ্টম্ন, প্রত্যেক রাতে একই স্বপ্টম্ন দেখি; আমরা দেখি বিশাল এক ফসলের মাঠে কোদাল হাতে একজন কৃষক কী যেন করছেন, কিছুক্ষণ পরে দেখি ফসলের মাঠে একটা ছবির আকার ধারণ করেছে, আমরা বুঝতে পারি কোদালের কোপেও ছবি আঁকা যায়, তখন কৃষকের আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলো কানাকানি করে, আমাদের মনে হয় লোকগুলো কৃষককে সাহায্য করার জন্য দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু ছবিটা যখন আরও স্পষ্ট হতে থাকে তখন লোকগুলো কৃষকের সারা শরীরে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করতে থাকে, মুহূর্তের মধ্যে কৃষক ঢলে পড়েন ছবির ওপর; রক্তে ভেসে যায় সবুজ ঘাস, তখন চিৎকার দিয়ে উঠি, মনে হয় আমাদেরকে কৃষকের ছবির ওপর শুইয়ে দিয়ে জবাই করে ফেলে, হাজার চেষ্টা করেও দম নিতে পারি না, ছটফট করতে করতে একসময় স্বপ্টম্ন থেকে বেরিয়ে আসি।
কিন্তু এটাকে স্বপ্টম্ন মনে হয় না, মনে হয় একটু আগেই বাস্তবে ঘটে গেছে ঘটনাটা। ফলে আমাদের শরীর, মন ও মগজ অত্যন্ত নিস্তেজ হয়ে পড়ে, আমরা মরা ব্যাঙের মতো পড়ে থাকি বিছানার ওপর।
আমরা কোনোভাবেই এই ঘটনার ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারি না, কেন প্রতিদিন একই সময়ে একই স্বপ্টম্ন দেখি? বাসা থেকে টাকাপয়সা নিয়ে পালিয়ে এসেছি বলে? নাকি কোনো অদৃশ্য শক্তি বা কালো জাদু বা অতৃপ্ত আত্মার সঙ্গে বাঁধা পড়েছি?
আমার সঙ্গী তাবিজ-কবচের কথা বলে, ওঝার কাছে যেতে বলে, কিন্তু আমি জানি এসবে ওর বিশ্বাস নেই, হয়তো আমাকে আশ্বস্ত করার জন্য বলে।
আমাদের সমস্যা বাড়তে থাকে, আস্তে আস্তে আমাদের জীবন নরকের মতো হতে থাকে, তারপরও বেঁচে থাকার জন্য একটা কায়দা আবিস্কার করি, আমরা ঠিক করি দুইজন একই সময়ে ঘুমাব না, আমি ঘুমানোর সময় ও পাহারা দেবে, আর ও ঘুমানোর সময় আমি পাহারা দেব; যদি দেখি আমি বা ও ঘুমের মধ্যে চিল্লাচিল্লি করছি বা গোঙাচ্ছি বা অস্বাভাবিক কিছু করছি তবে সঙ্গে সঙ্গে ডেকে তুলব।
এইভাবে আমরা একটু মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি, একটু ঘুমাতে পারছি, কিন্তু আমাদের জীবন জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে, জমানো টাকা শেষ হতে থাকে, পকেট খালি হতে থাকে, অথচ আমরা কোনো কাজকর্ম জোগাড় করতে পারি না; আমাদের ঘরের চাল-ডাল কমতে থাকে, ইতোমধ্যে লবণ শেষ হয়ে গেছে।
আমরা অবাক হয়ে দেখি এক কেজি লবণের দাম ৬০ টাকা হয়ে গেছে, অনেক দিন আগে এক পোয়া লবণ কিনেছিলাম, খুব দরকার না পড়লে লবণ খাইনি, সেটাও শেষ হয়ে গেছে, অথচ আমাদের দুইজনের বাসায় ভাত-তরকারি-লবণের কোনো অভাব নেই। কারণ, আমাদের দু'জনেরই বাবা সরকারি কর্মকর্তা।
আমরা শেষ পর্যন্ত কোনো কাজ জোগাড় করতে পারি না, আমাদের ঘরের সব খাবার শেষ হয়ে যায়, আমি ওকে বলি তুমি ফিরে যাও বাসায়, কিন্তু ও বলে ফিরে যাবে না।
আমি জানি ও প্রচণ্ড জেদি ছেলে, তখন ও বলে তুমি ফিরে যাও, কিন্তু ও ভালো করেই জানে ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য ঘর ছাড়িনি আমি, অবশেষে সিদ্ধান্ত নিই আমরা আত্মহত্যা করব।
আমার সঙ্গী আত্মহত্যার জন্য সহজ কোনো পদ্ধতি বেছে নিতে চায়; ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দেওয়া বা গলায় ফাঁস দেওয়ার মতো কঠিন পদ্ধতি নয়; সবচেয়ে সহজ কোনো পদ্ধতি প্রয়োগ করতে চায়। যে পদ্ধতিতে নরকের মতো যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে না, দোজখের অগ্নিকুণ্ডের লেলিহান শিখায় পুড়তে হবে না।
আমি বিষপানের কথা বলি, ও শরীরে আগুন দেওয়ার কথা বলে। কিন্তু কোনো পদ্ধতিই মনঃপূত হয় না আমাদের।
তখন দেখি দুটি পাখি আসমানে উড়ে উড়ে খেলা করছে। ওদের স্বাধীনতা দেখে ওদের সুখ দেখে আমাদেরও পাখি হতে ইচ্ছে করে। মনে মনে বলি, আহা, আমরা যদি পাখি হতে পারতাম!
তখন আমার চোখ পড়ে ঘরের বেড়ায় সাঁটানো পত্রিকার একটা শিরোনামে। তাতে লেখা- 'জাদুকরের জাদুর ভেলকিতে হিংস্র হায়েনা হয়ে গেল পাঁঠা'।
পত্রিকার নিউজ পড়ে আমরা উৎফুল্ল হয়ে উঠি, আমাদের রক্ত টগবগ করতে থাকে। আমরা জাদুকরের কাছে যাওয়ার পরিকল্পনা করি।
আমরা খোঁজখরব নিয়ে জানতে পারি জাদুকর স্বপ্টেম্নর মতো কাজ করছেন, দুঃস্বপ্টম্নকে সুস্বপ্টম্ন করতে পারেন। ইতিবাচক কাজে ওনার জাদু ব্যবহূত হয়।
আমরা শুনি জাদুকর কঠোর পরিশ্রম করছেন, বাগানে জেঁকে বসা বাদুড়, দুধেল গাইয়ের শরীরে লেগে থাকা জোঁক, পেটে-পিঠে-কাঁধে-মগজে গেড়ে বসা মশা, মাছি ও কৃমির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন; জাদুর ছোঁয়ায় পশ্চিমের বাতাসে ভাসিয়ে দিচ্ছেন সবকয়টা পরজীবীকে; আর জাদুর ভেলকিতে নিরীহ গাধা হয়ে যাচ্ছে শক্তিমান ঘোড়া, পেটমোটা টিকটিকি হয়ে যাচ্ছে হিংস্র কুমির, ভেজা বেড়াল হয়ে যাচ্ছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার।
আমরা জাদুকরের সঙ্গে দেখা করার জন্য পাগল হয়ে যাই। বহু পথ-ঘাট-মাঠ মাড়িয়ে অবশেষে জাদুকরের সাক্ষাৎ পাই এবং আমরা আমাদের ইচ্ছার কথা জানাই।
জাদুকর জানান যে, তিনি পশু-পাখি-কীটপতঙ্গ রূপান্তর করলেও কখনও কোনো রক্ত-মাংসের মানুষকে পাখিতে রূপান্তর করেননি। কিন্তু আমরা যেহেতু বাঁচার মতো কোনো অবস্থা দেখছি না, যেহেতু আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেহেতু যে কোনো মূল্যে পাখি হতে চাই; যদিও জাদুকর জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি এ কাজ করতে পারবেন না।
তখন আমরা অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জাদুকরের কর্মকাণ্ড দেখতে থাকি; আমরা দেখি একটা কুকুরকে সাদা কাপড়ের বাক্সে ঢুকিয়ে ফেলা হয়েছে আর সঙ্গে সঙ্গে কুকুরটা কুনোব্যাঙ হয়ে লাফ শুরু করেছে।
এই দৃশ্য দেখে দারুণ উত্তেজনা নিয়ে মনস্থির করি আমরা পাখি হবোই; আমরা বলি জাদুকর যদি আমাদের পাখি না বানিয়ে দেন তবে জাদুকরের সামনেই বিষপান করে মারা যাব।
এই কথা শুনে জাদুকর বলেন-
'ঠিক আছে, তোমাদের পাখি বানিয়ে দেব, কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তোমরা আবার ফিরে আসবে আমার কাছে, আবার মানুষ হতে চাইবে।'
আমরা আশা ও শঙ্কা নিয়ে অপেক্ষা করি। জাদুকর আমাদের বাক্সে ঢুকিয়ে সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়তে থাকেন; তারপর বাক্সটার মুখ খোলা হলে আমরা বেরিয়ে আসি, জাদুকর তার আয়নায় তাকাতে বলেন, আমরা দেখি আমাদের অবয়ব আর নেই, অদ্ভুত সুন্দর দুটি পাখি হয়ে গেছি। আমরা পাখি হয়ে গেলেও মানুষের মতো কথা বলতে পারছি।
আমরা অবাক হয়ে আমাদের শরীর দেখি, ডানা দেখি, ডানা ঝাপটাই, ওড়ার চেষ্টা করি এবং উড়ে যেতে থাকি সাত আসমানের দিকে।
আমাদের কী যেন হয়, আমরা পাগলের মতো উড়তে থাকি, সাত আসমানের দিকে যেতে থাকি এবং একসময় একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি।
আমি কোনোভাবেই মনে করতে পারি না আমার সঙ্গী ঠিক কোন সময় থেকে আমার সঙ্গে নেই, কিন্তু এই অনুভূতি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। আমার চোখের সামনে তুলোর মতো উড়তে থাকে মেঘ। আমি মেঘের ভিতর দিয়ে উড়তে থাকি। অথচ আমার গায়ে বিন্দুমাত্র আঁচড় পর্যন্ত লাগে না। আমি অদ্ভুত এক মায়ার জগতে ঢুকে পড়ি।
আমি দেখি চারদিকে সাদা আর সাদা, মাথার ওপরে সাদা গালিচা উড়ে যাচ্ছে, নিচেও সাদা পাহাড় উড়ে যাচ্ছে, আর তার মাঝে সারি সারি সবুজ গাছ, সবুজ সব পাতা, লাল লাল ফুল, অদ্ভুত ঘ্রাণ, আমি সবুজ পাতার ঝোপে বসে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে থাকি, আমার চোখ ছোট হতে থাকে, আমি ঘুমিয়ে যেতে থাকি।
হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমি দেখি আমার সামনে টোপরওয়ালা এক পাখি বসে আছে। আমি একটু ধাতস্থ হলে টোপরওয়ালা পাখি বলে-
'মা, তুই এখানে কখন এলি?'
আমি অবাক হয়ে বলি-
'আপনি কে?'
টোপরওয়ালা পাখি বলে-
'আমি তোর মা।'
আমি চিনতে পারি না।
টোপরওয়ালা পাখি বলে-
'আমরা যখন মানুষ ছিলাম তখন তুই আমার মেয়ে ছিলি।'
এইবার আমি আগ্রহ নিয়ে শুনতে থাকি।
টোপরওয়ালা পাখি মানুষ জন্মের অনেক গল্প করে, অনেক সংগ্রামের কথা, অনেক যুদ্ধের কথা, অনেক সল্ফ্ভ্রম হারানোর কথা, অনেক রক্তের কথা, দাউ দাউ করা আগুনের কথা।
আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে ঝাপসা হয়ে যাওয়া কিছু ছবি এবং ছবিগুলো আস্তে আস্তে পরিস্কার হতে থাকে, আমার মনে পড়তে থাকে অনেক কথা।
আমার মনে পড়ে আমি মানুষজন্মে বাবাকে প্রচণ্ড ভয় পেতাম কিংবা ঘৃণা করতাম।
আমি কিশোরী বয়স থেকেই শুনে আসছি আমি যখন ছোট তখন আমার মা মারা গেছেন, আমার শুধু এইটুকুই মনে পড়ে, একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি মাকে বারান্দায় খাটিয়ায় শুয়ে রাখা হয়েছে, আমাকে ধরে রেখেছেন আমার বড় ফুপু।
আমি যখন একটু বড় হই তখন আশেপাশের মানুষকে বলতে শুনি আমার মা নাকি আত্মহত্যা করেননি। বাবাই নাকি মার মৃত্যুর জন্য দায়ী। বাবা তার ক্ষমতাবলে সবকিছু ধামাচাপা দিয়েছেন!
এইসব যখন মনে আসে তখন মা আমাকে আদর করার জন্য আমার ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁয়ে দেন, এত বছর পরে মায়ের আদর ও মাকে পেয়ে আমি খুশি ধরে রাখতে পারি না।
আমার মা অনেকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। আমি অন্যদের জিজ্ঞেস করি তারা কীভাবে মানুষ থেকে পাখি হয়েছেন।
আমার মা বলেন-
'মানুষ জন্মে যারা মহামারিতে মরে, সংগ্রামে মরে, পুড়ে মরে, শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরে, গুলিতে মরে, অস্ত্রতে মরে, পানিতে মরে তারা পাখি হয়ে যায়।'
আমি বলি-
'এইসব মৃত্যু ছাড়া আর কেউ কি পাখি হতে পারে না?'
মা বলেন-
'হ্যাঁ, হতে পারে, যারা মানুষ জন্মে মানুষ থাকে।'
আমি বলি-
'মানুষ তো মানুষই থাকে।'
মা বলেন-
'না, খুব কম মানুষই মানুষ থাকে, তাই তারা পাখি হতে পারে না।'
আমি যখন মায়ের সঙ্গে এসব কথা বলছি তখন আমার প্রচণ্ড ক্ষুধা লাগে। আমি মাকে বলি-
'মা, আমার খিদা লাগছে, খেতে দাও কিছু।'
আমার কথা শুনে মা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করেন-
'তুমি এসব কী বলছ? মাথা ঠিক আছে তোমার?'
মার কথা শুনে আমিই বিস্মিত হই, এখানে মাথা ঠিক না থাকার প্রসঙ্গ আসছে কেন, আমি শুধু খেতে চেয়েছি।
তখন মা আমার হাবভাব দেখে আবারও জিজ্ঞেস করেন-
'মা, তুমি সত্যি বলছ তো?'
এইবার আমি একটু রেগে দিয়ে বলি-
'এখানে মিথ্যে বলার কী আছে মা, নাকি তোমরা খাও না? নাকি তোমাদের খিদা লাগে না?'
মা অত্যন্ত বিচলিত হয়ে জানান যে এখানে কারও ক্ষুুধা লাগে না, কারও তৃষ্ণা হয় না, প্রাকৃতিক কর্মও করে না কেউ।
আমরা মা-মেয়ে গভীর চিন্তার মধ্যে পড়ি। তখন আমি মার কাছে সব খুলে বলি। বলি যে-
আমি এখনও মারা যাইনি।
মা বৃত্তান্ত শুনে প্রচণ্ড ক্ষুুব্ধ হয়ে বলেন-
'তুমি আমাদের সাথে থাকার যোগ্য নও, তুমি অন্যায় করেছ, লোভ করেছ, তোমার দেহটা পাখির হলেও ভেতরটা এখনও মানুষ নামের মানুষের। তুমি সর্বদা নিজের জন্য ভাবো। তাই তোমার ক্ষুধা-তৃষ্ণা আছে, প্রাকৃতিক কর্মও করবে তুমি। কিন্তু এখানে কোনো পানি নেই, খাবার নেই, প্রাকৃতিক কর্ম করারও নিয়ম নেই। তুমি না খেয়ে মরে যাবে এখানে, আর কখনও সত্যিকারের পাখি হতে পারবে না; জাদুকর তোমার দেহটাকে পাখির রূপ দিয়েছেন, কিন্তু ভিতরে ভিতরে তুমি এখনও মানুষ নামের মানুষ, তোমার স্বাদ, গন্ধ, স্পর্শ খাবারদাবার ক্ষুধা-তৃষ্ণা, লোভ-লালসা সব মানুষ নামের মানুষের মতোই আছে; তুমি এখনই ফিরে যাও সেই জাদুকরের কাছে, গিয়ে মানুষ হও, দেখবে তুমি সত্যি সত্যি একদিন পাখি হয়ে ফিরে আসবে আমাদের কাছে।'
আমি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে থাকি, আমার ক্ষুুধা-তৃষ্ণা বাড়তে থাকে; তখন জাদুকরের কথা মনে পড়ে। আমি বুঝতে পারি জাদুকর কেন বলেছিলেন আমাদের ফিরে যেতে হবে।
আমি আর দেরি করি না, ক্লান্ত শরীর ও বিধ্বস্ত মন নিয়ে ডানা ঝাপটাতে থাকি, ক্ষুধা-তৃষ্ণায় আমার শরীর অবশ হতে থাকে।
আমি উড়তে উড়তে কখন যে জাদুকরের প্রাসাদের কাছে পৌঁছে গেছি টেরই পাইনি। আমি জাদুকরের প্রাসাদের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করি, কিন্তু ভেতরে ঢোকার রাস্তাই খুঁজে পাই না; তবে আমি হাল ছেড়ে দেই না, ক্রমাগত চেষ্টা করতে করতে হঠাৎ জানালার ফাঁক দিয়ে ফুড়ূত করে ঢুকে পড়ি, আমি দেখি জাদুকর বিশাল এক ক্যানভাস সাজিয়ে ছবি আঁকছেন, আর তার আশেপাশে চার-পাঁচজন লোক দাঁড়িয়ে আছে, আমি জাদুকরের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই।
তখন আমার মনে পড়ে স্বপ্টম্নজালে ফেঁসে যাওয়ার সময়ে ফসলের মাঠে কোদাল হাতে কৃষকের ছবি আঁকার দৃশ্য, সেখানে কৃষকের পাশেও চার-পাঁচজন লোক ছিল।
আমি কয়েকদিন চেষ্টা করেও জাদুকরের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারি না, জাদুকর ছবি আঁকায় ব্যস্ত, আর ওনার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে চার-পাঁচজন লোক।
তখন আমার মনে পড়ে আমার সঙ্গীর কথা, আমি একা এসেছি বলে হয়তো জাদুকরের কাছে আমার ডাক পৌঁছায় না, আমি যদি আমার সঙ্গীকে নিয়ে আসি তাহলে হয়তো আমাদের যৌথ ডাক জাদুকরের কানে পৌঁছাবে, আর তিনি আমাদের চিনতে পারবেন।
আমি পাগলের মতো খুঁজে ফিরি আমার সঙ্গীকে, হঠাৎ দেখি আমার সঙ্গী জাদুকরের বাগানে ডালিম গাছের ডালে বসে আছে।
আমরা দু'জন দু'জনকে দেখে প্রাণ ফিরে পাই, আমি ওর কাছে জানতে পারি, সে তার দাদার কাছ থেকে বৃত্তান্ত শুনে মানুষ হওয়ার জন্য ফিরে এসেছে, সেও অনেক চেষ্টা করে জাদুকরের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি।
আমি বলি-
'চলো, আমরা দুইজন একসাথে যাই, আমাদের দুইজনকে একসাথে দেখলে উনি চিনতে পারবেন।'
আমরা ক্ষুুধা-তৃষ্ণায় ঠোঁটে ঠোঁট লাগাই, চোখে চোখ বুলাই, পাখনায় পাখনা রাখি, শঙ্কার মধ্যেও আশা রাখি, পরস্পর মিলিত হয়ে দারুণ তৃপ্তি অনুভব করি।
আমরা ভাবি, এখন রাত হয়ে গেছে, জাদুকর নিশ্চয় ছবি আঁকছেন, এই সময়েও ওনার সামনে যাওয়া যাবে না। তাই আমরা পরিকল্পনা করি আজকের রাতটা ডামিল গাছে বসে গল্প করে কাটিয়ে দেব; ভোরে যদি জাদুকর বাগানে হাঁটতে আসেন তাহলে সামনে যাব, তখন অনুরোধ করে বলব আমাদের যাতে আবার মানুষ করে দেন, আমরা মানুষের শরীর ফিরে পেয়ে মানুষ হওয়ার পথ খুঁজে বের করব আর একদিন সত্যি সত্যি পাখি হয়ে ফিরে যাব।
আমরা ডালিম গাছের আলো-ছায়ায় বসে আলাপ করি, শাওন মাসের রাত বাড়তে থাকে, হঠাৎ দমকা হাওয়া বয়ে যায়, আমরা দাঁত কামড়ে পড়ে থাকি। তারপর হিমহিম ঝিরঝিরে হাওয়া বয়ে যায়, আমাদের ডাল মৃদু কেঁপে ওঠে, তখন কয়েকটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ওঠে।
আমরা বুঝতে পারি জাদুকরের প্রাসাদের সামনে শব্দ হচ্ছে, খেয়াল করে দেখি সেখানে মানুষের আনাগোনা বাড়ছে, আমরা আগ্রহ নিয়ে বসে থাকি। নিশ্চয় জাদুকর নতুন কোনো খেলা দেখাবেন। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয় শেষ রাতের দিকে জাদুকর খেলা দেখাবেন কেন। ফলে আমরা উৎকণ্ঠিত হয়ে ঘটনা বোঝার চেষ্টা করি। আমার সঙ্গী বলে-
'এই, আমি গিয়ে আসি একটু।'
আমি বলি-
'তুমি যেয়ো না, এই অন্ধকারে যাইতে পারবে না।'
আমার সঙ্গী তবু যেতে চায়, তখন বিকট শব্দ আর আর্তচিৎকারে কেঁপে ওঠে সব। আমরা কিছুই বুঝতে পারি না। আমরা পালাতে থাকি, কে কোনদিকে ছুটি তা বলতে পারি না।
আমি গিয়ে বসি নাম না জানা একটা গাছের মগডালে। তখন খেয়াল করি জাদুকরের প্রাসাদ থেকে গুলির আওয়াজ আসছে, হুড়োহুড়ির আওয়াজ আছে, হিম হিম হাওয়ার সঙ্গে ভেসে আসে গন্ধ, আমি বুঝতে পারি এটা বারুদের গন্ধ।
আমি অত্যন্ত উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করি আলো ফোটার জন্য এবং দেখতে দেখতে ফর্সা হতে থাকে সব। ততক্ষণে গুলির আওয়াজ থেমে গেছে; তখন আমি জাদুকরের প্রাসাদের দিকে ছুটি; প্রাসাদের আনাচে-কানাচে উৎকট ও ঝাঁঝালো গন্ধ পাই।
আমি আমার সঙ্গীকে খুঁজে পেয়ে স্বস্তি অনুভব করি। আমরা একসাথে অনুসন্ধান করে আবছা অন্ধকারে জাদুকরকে খুঁজে পাই। আমরা দেখি জাদুকর সিঁড়ির শেষ সীমানায় পড়ে আছেন, তার সারা শরীরে বুলেটের দাগ, হাঁ করা মুখে মাছি ঢুকে যাচ্ছে, বুকের রক্ত চেটে খাচ্ছে কালো ইঁদুর, লাল পিঁপড়ারা কপালে পিল পিল করছে, একটা কালো কুকুর প্রাসাদের গেট থেকে পালিয়ে যাচ্ছে, আর কয়েকটা বাদুড় ওড়াউড়ি করছে মাথার ওপর।
আমরা সব বুঝতে পেরে স্তব্ধ হয়ে যাই, ক্ষুুধা-তৃষ্ণা ও আতঙ্কে আমাদের শরীর অবশ হয়ে আসে, দম বন্ধ হয়ে আসে, চোখ নিঃসাড় হয়ে আসে; আমরা বুঝতে পারি আমরা আর মানুষ হতে পারব না, আর মুক্ত হতে পারব না, আমরা খেয়ে না খেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ব।
জীবনের শেষ সীমানায় এসে আমাদের শুধু মনে হয়, আমরা আর কখনও পাখি হতে পারব না, আর কখনও স্বাধীন ও মুক্ত জীবন পাব না।
আমরা শেষবারের মতো পরস্পরের দিকে তাকাই, শেষবারের মতো জাদুকরের দিকে তাকাই, চোখে নীল জোছনা নিয়ে দেখতে পাই জাদুকরের দেহ থেকে একটা সাদা সত্যিকারের পাখি সাত আসমানের দিকে উড়ে যাচ্ছে।

বিষয় : গল্প মেহেদী ধ্রুব

মন্তব্য করুন