
১৯৭১ সালের এক শান্ত সুন্দর সকালবেলা কফিলের বাড়ির উঠানের দৃশ্য আমরা দেখি, প্রথমে হয়তো আমরা শুনি বালতিতে দুধ দোহানোর চিনচিন শব্দ তারপর ফস্ ফস্ ক্রমে ভস্ ভস্ শব্দ, আমাদের মনোযোগ সেই দিকে আটকায় না বরং আমাদের নজর যায় কফিলের বউয়ের দিকে, যে কিনা রান্নাঘরে একটা হাঁড়িতে গভীর মনোযোগে দুধ জ্বাল দিতে থাকে। ফলে আমাদের মনে হয় যে কফিল হইল এক দুধের কারবারি। কিংবা আমাদের মনে হয় যে শুধু কফিল না এলে সকালে দুধভাত খাওয়া একটা খুব সাধারণ ব্যাপার। তাই আমরা দেখি কফিলের বউটা ভীষণ মনোযোগ দিয়ে দুধ জ্বাল দেয়, কেননা দুধ হইল রূপসীর এমন এক রূপ, যার দিকে নজর না দিলে উতলায়া পড়ে। ফলে চুলায় দুধ জ্বাল হইতে থাকে আর আমরা দেখি কফিল তার গর্ভবতী গাইটার দিকে থির তাকায় থাকে, যেন সে চোখ দিয়ে পেটের মধ্যে বাছুরের মাপ নেয়।
কফিল হলো একজন ভালো আদমি। কফিল হলো একজন অকর্মা। গেরামে এইরকম অকর্মা থাকে। এইটা গ্রামের সৌন্দর্য। কফিল সেই সৌন্দর্যের জিনিস। কফিলের আছে বিরাট পৈতৃক সম্পত্তি। ফলে সে কিছুই করে না। তার বাপ-মা মইরা ভূত, ভাই নাই, বইন আছে তার বিয়ে হইছে দূরদেশে। ফলে বছরে একবার হয়তো সে তার পোলাপান নিয়ে আসে এইখানে। তখন বিরাট হইচই হয় বাড়িতে। পয়সাওয়ালা এমন মানুষের কিছু বদভ্যাস থাকে, কিন্তু কফিলের কোনো বদভ্যাস নাই। সে তাসপাশাও খেলতে পারে না, কিংবা সে খেলে না। মেয়েমানুষেও লোভ নাই। তার বাড়ির পেছনে আছে এক বিরাট জমি, সেই জমির সঙ্গে আছে বিরাট পুকুর। সেই পুকুরের ওপরে একটা মাচাঘর বানানো। সেই ঘরের লম্বা মাচার এক অংশ পুকুরের ওপর ছড়ানো। কফিলের কাজ হচ্ছে মাছ মারা। কিংবা ছিপ ফেলে পা ঝুলায়ে বসে থাকা। কফিলের পরানের বন্ধু নাম শঙ্কর। শঙ্কর হচ্ছে গোয়ালাবাড়ির পোলা, সেও একটা আখাম্বা জিনিস। প্রায় প্রায় দিনদুপুরে দেখা যায় শঙ্কর আর কফিল পুকুরের ওপর মাচায় বসে পা ঝুলায়ে ছিপ ফেলে তাকায় আছে ফাতনার দিকে। তাদেরকে দূর থেকে দেখলে মনে হয় দুইটা জ্যান্ত উজবুক। ফলে কোন কোন দিন শঙ্করের বউ উষা হয়তো আসে লম্বা ঘোমটা দিয়ে। উষা আসে শঙ্কররে ডাকতে কিংবা উষারে হয়তো শঙ্করের বাপ পাঠায় তার ধাঙড় পোলারে ডাকতে। তখনবা প্রতিবার এসেই উষা দেখে মাচার উপ্রে বসে থাকা দুই বন্ধু পা ঝুলায়ে পোলাপাইনের মতো বসে আছে, আর তাদের পাছার এক হাত কিংবা দেড় হাত দূরে দুইটা কাঁসার খালি জামবাটি, এবং বাটি দুইটার গলায় সর জমার দাগ। ফলে বোঝা যায় তারা দুইজনে বসে বসে দুধ খায় আর মাছ মারে। কফিলের জীবনের একটাই শখ বা ভালো লাগা সেইটা হইল দুধ খাওয়া। দুধ খাইতে তার ভালো লাগে। ঘন মোটা সর জমা দুধ তার কাছে অমৃত সমান। ফলে কফিলের বাড়িতে সকাল মানে হাঁড়িতে ভাত ফোটার থেকে দুধ জ্বাল হওয়ার দৃশ্যই সমীচীন।
এইরকম এক সকালে হয়তো উষা আসে কফিলের উঠানে। উঠানে দেখে কফিল গাভিনটার দিকে তাকায় আছে ফলে সে রান্নাঘরের দিকে আগায় যায়। উষা কফিলের স্ত্রীর কাছে যায়। কফিলের স্ত্রী জেবুন্নেসা হয়তো তখন জ্বালানো দুধ জামবাটিতে ঢালতে থাকে। উষা অপেক্ষা করে হাতের কাজ শেষ হবার, দুধ ঢালা শেষ হলে উষা তার আঁচলের তলার থেকে কলাপাতায় মোড়া সন্দেশ জেবুন্নেসার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলে, দাদায় কাইল কইয়া রাখছিল কাঁচাগোল্লা দিয়া যাইতে। জেবুন্নেসা হয়তো তাকে একটা পিঁড়ি এগিয়ে দিতে দিতে বলে-
বসো।
উষা হয়তো বলে-
না গো দিদি এখন বসব না, বিকালে আসবোনে।
ঘরের কাজ বাকি।
জেবুন্নেসা বলে-
শঙ্কর দা কই?
উষা হতাশ মুখে বলে-
সে কই তা কি আর আমি জানি। ভোরবেলা শ্বশুরমশাই ঘোল টানতে দিয়া গেলেন, আর উনি উল্টা আমার হাতে রশি ধরায় দিয়া উধাও। তার নাকি এইসব করবার জন্য জন্ম হয় নাই।
জেবুন্নেসা বলে-
আমার জন্যও তো ঐ একই লাইনের। কামের মধ্যে কাম। সারাদিন দুধ খাওয়া আর ছিপ ফেলায়া বইসা থাকা। কতবার বললাম আমার ভাইগোর সাথে পাটের ব্যবসায় নামবার, বেশি লাভের দরকার নাই একটা কাজের মধ্যি থাকলেন। কিন্তু সে কানে নেয় না। তার দুনিয়া ওই জামবাটির মইধ্যে আটকায় গেছে। তখন হয়তো কফিলের গাইগরু, হুরি বা নুরি এদের কেউ একজন ডেকে ওঠে। আমরা দেখি বা উষা সেইদিকে তাকায় এবং হুরি বা নুরিকে দেখে।
২.
কফিল বারান্দায় পাটি পেতে তার ওপরে বসে নাশতা করে। মুড়ি আর এক জামবাটি দুধ। আমরা দেখি সে কিছুটা বালকদের মতো ফস করে খোঁচা মারে জমে থাকা সরের আস্তরণের ওপর, তারপর সেইদিকে তাকিয়ে থাকে নিরিখ করে, সামান্য লোভীর হাসি ফুটে ওঠে তার ঠোঁটের কিনারায়, তারপর সে দুই আঙুল ডুবায় দুধের বাটির ভেতর এবং তুলে আনে এক টুকরো কাফনের মতো ঢ্যালঢেলে সাদা সর। কালো মুখের লালচে হায়ের মধ্যে সেই সরের টুকরো সে আস্তে করে ছেড়ে দিয়ে পিষতে থাকে জিভ দিয়ে তালুর সঙ্গে। যেন নির্বাণের সুখ। দূর থেকে হয়তো জেবুন্নেসা এই দৃশ্য দেখে, তার হাসি পায়। তারপর কফিল একগাল মুড়ি নেয় আর দুই হাতে জামবাটি তুলে এক চুমুক দুধ খায়। তার মুখে বিজয়ের হাসি কিসিমের আনন্দ লেগে থাকে। তার গোঁফের জায়গা সাদা হয়ে ওঠে। সে জিভ দিয়ে চাটে। এই দৃশ্য দেখে জেবুন্নেসার গা শিরশির করে। তারপর সে আবার চুমুক দেয় এইবার চুমুকে হয়তো একটুকরো সর ঠোঁটে ঝুলে পড়ে সেটাকে সে ভীষণ নরমভাবে সামলায়। এইসব ঘটনা যখন ঘটতে থাকে, তখন কাওসার আসে। সে এসে বারান্দায় কফিলের মাদুরের বাইরে বসে তাকিয়ে তাকিয়ে কফিলের দুধ খাওয়া দেখে। কফিল তারে পাত্তা দেয় না। তার দিকে তাকায়ও না। কফিল সুরুৎ সুরুৎ শব্দ করে বাটির দুধ শেষ করে। তারপর সে বাটির কান্দায় জমে থাকা সর আঙুল দিয়ে চেঁছে আঙুল গালের মধ্যে দিয়ে চুষতে থাকে। ফলে কাওসার সেই দৃশ্য দেখে আর তার চোখেমুখে তাচ্ছিল্যের রেখা ফোটে। এই দৃশ্য দূর থেকে জেবুন্নেসা দেখে এবং তার চোখেমুখে বিরক্তি ফোটে।
কাওসার বলে-
তুমি আছো ভালোই দোস্ত। তিন বেলা দুধ খাও, মাশাল্লাহ!
কফিল তাকায় কাওসারের দিকে, কিন্তু কোনো উত্তর দেয় না।
কাওসার বলে-
ছোটকালের থিকা তুমি দুধ খাইতে পছন্দ করো, বিয়ার পরেও দুধ খায়া যাইতেছ সমানে।
কফিল এইবার ভ্রু কুঁচকে হয়তো বলে-
কী বলতে আসছ সেইটা কও। ফাউ কথা ফেলায়ো না।
কাওসার বলে-
তোমার খোঁজ নিতে আসলাম। অনেকদিন আসি না এই দিকে, যাইতেছিলাম রাস্তা দিয়া ...।
কফিল বলে-
বললাম না ফাউ কথা বাদ দিয়া আসল কথা বলতে, কী বলতে আসছ সেইটা বল? তুমি তো নিয়ম কইরা জুয়ার আসরে যাইতেছ তাই না?
কাওসার জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলে-
তওবা তওবা! এইসব কী কও? কে কইছে তোমারে? ওই মালাউনের বাচ্চা শঙ্কর?
কফিল আরও ভ্রু কুঁচকে বলে-
শঙ্কর কইতে যাব কোন দুঃখে। সেই কি তোমার ফেউ লাগে?
কাওসার বলে-
শঙ্কর ছাড়া তোমারে দিনদুনিয়ার খবর কেডা দিবো? তোমার জানের ইয়ার লাগে সে। তুমি তো তিন বেলা দুধ খাও আর ছিপ ফেইলা বইসা থাকো। লোকে অবশ্য অন্য কথা কয়! কফিল বলে-
কী কয়?
কাওসার বলে-
লোকে কয় তুমি হইলা ভাউরা, বউ পাহারা দেও সারাদিন। কফিল শান্ত স্বরে বলে-
তুমি বিদায় হও। তুমি একটা জ্যান্ত বজ্জাত।
কাওসার বলে-
রাগ নিও না দোস্ত। মজা করলাম। তুমি যে একটা ভালো মানুষ এইটা সবাই জানে। তুমি ওই গরুর দুধ ছাড়া আর কিছু খাও না এইটাও সবাই জানে। এখন আসল কথা কই, আমারে কিছু টাকা ধার দেও দোকানে মাল তুলব।
কফিল বলে-
তুমি বিদায় হও।
কাওসার বলে-
কসম এইবার এই টাকায় মাল তুলব দোকানে। আল্লার কিরা। তুমি তো আবার সুদ খাও না। সুদ নিলে তোমার বাড়ির দুধ কাইটা যায়। নাইলে সুদ দিতে রাজি হইতাম।
কফিল বলে-
তুমি যে একটা জ্যান্ত শয়তান। এইটা তুমিও জানো। তোমারে বিদায় হইতে বলছি, এখনই তুমি বিদায় হও।
কাওসার উঠতে উঠতে বলে-
বাপে রাইখা গেছে দুনিয়ার সম্পদ। তাই বাইচা গেলা, বুঝতে পারলা না দুনিয়াদারির মজা। খালি দুধেই চুমুক দিলা।
৩.
সেদিন দুপুরবেলা জোহরের ওয়াক্তে হয়তো কফিল আর শঙ্কর পুকুরপাড়ের ছিপ ঘরের মাচার ওপর পা ঝুলায়ে ছিপ ফেলে বসে থাকে। তখন বা তার একটু পরে হয়তো জেবুন্নেসা দুই বাটি দুধ রেখে যায় তাদের পেছনে।
শঙ্করকে হয়তো জেবুন্নেসা বলে-
সকালে কই উধাও হইছিলেন বউদি কইল?
শঙ্কর হাসে। তার দিকে তাকায়ে কফিলও হাসে। সেই হাসির মানে কেউ বোঝে না, কিংবা বোঝে। জেবুন্নেসা চলে যেতে যেতে বলে-
আপ্টম্নাগোর দুই বন্ধুর সংসার না করাই উচিত আছিল। ঘুরতেন, ফিরতেন, দুধ খাইতেন আর মাছ মারতেন।
শঙ্কর হাসে মিটিমিটি। তার হাসি দেখে কফিলও হাসে মিটিমিটি। জেবুন্নেসা চলে যাওয়ার পর তারা দুইজন দুধ খায় আর গল্প করে।
শঙ্কর বলে-
ভাল্লাগে না বাড়া! সকালবেলা ঘুমেরতে উঠোয়ে যদি ঘোল টানতি কয় তালি কিরাম লাগে ক তো? দিছি বউর হাতে ধরায়ে তারপর বাজারের দিক হাঁটা।
কফিল বলে-
সকালে কাওসার আসছিল টাকা ধার চাবার।
শঙ্কর বলে-
উঁহু দিস না। দোকান বেইচে দিছে। কিচ্ছু নাই। সব জুয়ার কোর্টে আর পাড়ার ঘরে শ্যাস।
কফিল বলে-
হু। ফাউল কিসিমের হয়ে গেছে, উল্টাপাল্টা কয়।
শঙ্কর বলে-
বাজারে শুনলাম ঢাকার অবস্থা নাকি বেগতিক।
কফিল বলে-
ক্যান?
শঙ্কর বলে-
মিলিটারি নামিছে নাকি।
কফিল বলে-
অ। নামলে নামুক বাড়া। আমাগো কী? আমরা থাহি ঝিম মারা গেরামে, আমাগের কিসের পাকিস্তান কিসের জয় বাংলা।
শঙ্কর চিন্তিত মুখে বলে-
তা ঠিক, তয় শুনলাম বড় যুদ্ধ লাগার পাঁয়তারা চলতিছে। বাবা কতিছিল যুদ্ধ লাগলি ...!
ঠিক এই সময় শোনা যায় কফিলের গাই নুরি বা হুরি কেউ একজন ডেকে ওঠে। ফলে তাদের দুইজনের নজর ওইদিকে যায়।
শঙ্কর বলে-
গাই বিয়েনোর দিন হয়ে আসতেছে। কফিলের চোখেমুখে এইবার চিন্তা দেখা যায়।
সে বলে-
হ।
৪.
রাতেও কফিল দুধ দিয়ে ভাত খায়। জামবাটি থেকে দুধ ঢেলে নেয় পাতে। রাত্রে যখন চারদিকে ঝিঁঝি ডাকে, যখন তারে ভাত দেয় জেবুন্নেসা তখন। নীরবতা ভেঙে জেবুন্নেসা বলে-
ঢাকায় নাকি গ গোল লাগছে?
কফিল শব্দ করে লম্বা চুমুক দেয় থালার দুধে। কফিল বলে-
গুড় নাই? জেবুন্নেসা কুচি করা গুড় এগিয়ে দিতে দিতে আবার বলে-
ঢাকায় নাকি গোলাগুলি হইছে?
কফিল বলে-
হইলে হইসে আমাগোর কী?
জেবুন্নেসার মুখ বেজার হয়। কফিল গুড় পিষে শব্দ করে চুমুক দেয় গুড় পেষা দুধে।
৫.
পরদিন সকালে কফিলকে ভয়াবহ পেরেশান লাগে। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ায়ে থাকে। তার সামনে তার প্রিয় গরু নুরি বা হুরি। একজন লোক দাঁড়ানো।
সে বলে-
তটস্থ হইয়ো না। আরেকটু দেখি। বাচ্চা ঠিকঠাক হবে।
কফিল বলে-
বেচারি কষ্ট পাচ্ছে।
লোকটা বলে-
আল্লা আল্লা করো। তুমি ভিতরে যাও, আমি দেখতেছি। কফিল দাঁড়ায় থাকে।
লোকটা বলে-
শুনলাম শেখ সাব রে নিকি হাওয়া কইরে দিছে মিলিটারি!
কফিল বলে-
আমি কিছু জানি না।
লোকটা বলে-
আমাগে কী হবে তাইলে?
কফিল বলে-
দেহেন তো গাভিনটা কাঁপতেছে মনে হয়।
লোকটা বলে-
ও কিছু না। আল্লা আল্লা করো। ... তয় আমার মনে হয় মাওলানা সাব এইবার খেইল দেহাবে!
কফিল বলে-
কোন মাওলানা? লোকটা বিস্ময়ে তাকায় তার দিকে।
এইসময়ে একটা পরিবার আসে। কফিলের বোন বাচ্চা আর তার স্বামী। তাদের চোখেমুখে ভয়াবহতা থেকে পালিয়ে বাঁচার স্বস্তি। কফিল এগিয়ে যেতেই তার বোন তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হুহু করে কানতে লাগে। পুরা ব্যাপারটা আমরা বুঝতে পারি যখন জেবুন্নেসা বেরিয়ে আসে। উঠোনে যেন এক ভয়াবহতার বয়ান চলে। কফিলের বোনজামাই গুছিয়ে বলে আর কফিলের বোন একটু পরপর হুহু করে কান্দে। কফিলের বোনজামাই যার নাম হয়তো কামাল।
সেই কামাল বলে-
কিছু নাই ভাইজান। মিলিটারিরা মানুষ মারতেছে পিঁপড়ার মতোন!
কফিল ফস করে বলে-
সত্যই?
কফিলের বোন হুহু করে কান্দে। কফিলের বোন আরও বলে-
তারা কোনোরকম জানে বেঁচে এসেছে এবং তারা এইখানেও থাকবে না কারণ এইখানেও মিলিটারি আসবে।
৬.
পরদিন বা তার পরদিন সকালে শঙ্কর আসে। তার মুখ বিমর্ষ লাগে। কফিল দুধের বাটিতে চুমুক দিচ্ছিল, সেই সময় শঙ্কর এসে ঢোকে। তার পাশে বসে। কফিল বাটির ওপর মুখ ঝুঁকিয়ে বলে-
কী হইছে দোস্ত?
শঙ্কর বলে-
পেরেশান লাগে।
কফিল বলে-
কিসের পেরেশান?
শঙ্কর বলে-
মিলিটারির ক্যাম্প বসিছে ওপার!
কফিলের মুখ হয়তো এই কথা শুনে হাঁ হয়ে যায় কিংবা তার হাত থেকে কাঁসার জামবাটিভর্তি দুধ ঝুম্মম্ম করে মেঝেতে পড়ে যায় কিংবা তার চোখ বড় বড় রসগোল্লার মতোন হয়ে ওঠে। কেননা এই কথা তার বিশ্বাস হতে চায় না। কিন্তু তাকে বিশ্বাস করতে হয়। ফলে সেইদিন দুপুরবেলা কফিলের বোনের পরিবারের সঙ্গে কফিলের স্ত্রী জেবুন্নেসাকে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। কফিলের বোনের স্বামীর সব ব্যবস্থা করা ছিল। শুধু অতিরিক্ত হিসেবে কফিলের স্ত্রী যোগ হয় তাদের সঙ্গে। জেবুন্নেসা গোঁয়ারের মতো গেড়ে বসে। সে যেতে চায় না। কফিল তারে বোঝায়। তারা সবাই কফিলরে বোঝায়। কিন্তু কেউ বোঝে না। ব্যাপারটা এ রকম দাঁড়ায় যে, কফিল বলে-
জেবুন্নেসা ঘাউরামি কইরা লাভ নাই। তুমি ওগোর সাথে যাও, আমি কয়দিন পর আসব।
জেবুন্নেসা বলে-
আমিও দুইদিন পর আপনার সাথে যাব।
কফিল বলে-
দেখি এদিকের কী হয়, হইতেও পারে কিছুই হইল না!
কফিলের বোনের স্বামী বলে-
ভাইজান। যা হবে তা হজম করতে পারবেন না। তার চেয়ে চলেন একসাথে রওনা হই।
কফিল বলে-
উঁহু। তোমরা যাও। আমি দিনদুই পর শঙ্কর গো সাথে আসব নে।
জেবুন্নেসা বলে-
আমিও। আমি আপনারে একলা ফেইলা যাব না।
কফিল বলে-
বেবোধ মেয়েমানুষের মতোন কথা কবা না। তুমি অগের সাথে যাবা।
জেবুন্নেসা কেঁদে ফেলে বলে-
আমি গেলে আপনেরে দেখবে কে? দুধ জ্বালায় দেবে কে? না খায়া মরবেন আপনে।
কফিল ভিজে যায়। হয়তো সে জেবুন্নেসার মাথায় হাত রেখে বলে-
তুমি যাও। আমি এই বাড়ি, নুরি-হুরি এগোরে ফেইলা যাই কেল্ফেম্ন। পরিস্থিতি দেইখা আসব আমি।
এইরকম ঘোলাটে পরিস্থিতির পর সেইদিন সন্ধ্যায় দেখা যায়, যখন আলো মরে পাতলা আন্ধার নেমে আসে তখন কফিলের বোনের পরিবারের সঙ্গে জেবুন্নেসাও রওনা হয়। কফিল ঘরের উঠানে দাঁড়ায় থাকে আবছায়ার ভেতর তার মনটা হুহু করে। যেন এক পুরোনা শোক বাড়িটারে ঘিরে রাখে। ফলে তার মায়া মায়া লাগে। ঘরে গিয়ে সে দেখে টেবিলের ওপর কাঁসার জামবাটিভর্তি জ্বালানো সর জমা দুধ রেখে গেছে জেবুন্নেসা। দুধের বাটির ঢাকনা তুলে তাকাতেই তার চোখে জল আসে। বহুদিন পর তার মনে হয় জেবুন্নেছা ছাড়া বাড়ি খালি খালি লাগে।
৭.
পরদিন সকালে শঙ্কর আসে। তারা দুইজন পুকুরের ওপর মাচায় পা ঝুলায়ে বসে থাকে।
শঙ্কর বলে-
গেরাম তো শীঘ্র ছাড়া লাগবেনে মনে হচ্ছে। কফিল বলে-
পলায়া যাব। যেইখানে-সেইখানে কি এই জীবন পাব?
শঙ্কর বলে-
জানডা আগে বাঁচাও দোস্ত। পাগলামি কইরো না। তুমি আয়েশি মানুষ, তোমার কষ্ট হবে। তবু পালানো লাগবেই।
কফিল বলে-
হুম।
শঙ্কর তারপর বলে-
আমি উঠি। বাবা আবার বাজারে গেছে এর মধ্যি।
শঙ্কর উঠতে উঠতে বলে-
আবার কী যেন পিচ কমিটি না কী যেন হচ্ছে, এলাকার লোকগের নিয়ে যারা পাকিস্তান চায়।
কিন্তু সেইদিন বিকেলেই চারদিক লন্ডভন্ড হয়ে যায়। বাজারে মিলিটারি আসে। তারা বাজার পোড়ায় দেয়। হিন্দুপাড়ায় দেয় আগুন। গুলি চলে। সারা গ্রাম তছনছ হয়। শঙ্কর তার মাচায় বসে থাকে। তার চেহারার ভোদাইভাবে পরিবর্তন দেখা যায়। সে বিহ্বল হয়ে দেখে চারদিকে ধোঁয়ার কু লী। যেন সে অবধারিত মৃত্যুর মুখোমুখি।
রাত্রে যখন সে চুপিচুপি ঘরে ফেরে খুব সন্তর্পণে, ঘরে ঢুকে চারদিকের সুনসানের মধ্যে যখন সে বসে, তখন সে টের পায় কারোর ফোঁপানি। যেন কোনো নারী। অন্ধকার ঘরের মধ্যে কফিল ফিসফিস স্বরে জিজ্ঞেস করে-
কে?
কোনো উত্তর পাওয়া যায় না। সে আবার বলে-
কান্দে কে? জেবুন্নেসা? জেবুন্নেসা?
নারীকণ্ঠ কান্নাজড়িত স্বরে বলে-
দাদা, আমি উষা।
কফিল আলো জ্বালায়। সে জিজ্ঞেস করে-
কাকাবাবু, শঙ্কর কই?
উষা চাপা স্বরে কেঁদে লুটিয়ে পড়ে আর মেঝেতে হাত আছড়ে আছড়ে শাঁখা ভাঙে।
৮.
কিন্তু ১৯৭১ সালে কফিলের জীবনে সবচেয়ে তাজ্জব ঘটনাটা ঘটে তার পরের দিন। সেদিন তার উঠানে একদল লোক আসে। তারা কফিলকে উচ্চ স্বরে ডাকে। কফিল বের হয়। তাকিয়ে দেখে তার উঠানে দাঁড়ানো একদল লোক। লোকজন সবাই তার চেনা এবং এদের প্রধানের ভূমিকায় আছে কাওসার। তার মাথায় জিন্নাহ টুপি। তার চেহারায় চকচকে ভাব। কাওসার হাসি হাসি মুখে বলে-
কেমন আছো দোস্ত?
কফিল তাকায় থাকে।
কাওসার বলে-
টাকা ধার চাইতে আসি নাই আইজ। কিসের জন্য টাকা ধার করব বল? বাজারই তো পুইড়া ছাই! তাই ভাবলাম সব যখন গেছে, এইবার বাকি জিন্দেগিটা পাকিস্তানের খিদমতে লুটায়ে দি।
অন্যরা হাসে। কফিল তাকায়ে থাকে।
কাওসার বলে-
তুমি ভয় নিও না। তয় তোমারে বলি, মেহমানদের সেবায় লাইগা যাও, কাজে দিব। খালি দুধ খাইলে কাজ হবে না এখন। সবাই হাসে। কাওসার অন্যদের বলে-
ওই গরু দুইটা নে। বাছুরটাও। কচি বাছুরের কাবাব নাকি মেহমানদের বিশেষ পছন্দ।
কফিল বলে-
কী করো তোমরা এইসব? ঐ ...!
কাওসার ঠোঁটে আঙুল এনে বলে-
হিসস। পাকিস্তানের খিদমত। অনেক তো দুধ খাইছ, এইবার আমরা একটু খাই। কফিল চুপ করে থাকে।
কাওসার দল নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করে-
ঘরে কে?
কফিল বলে-
তোমার ভাবি!
কাওসার মুচকি হেসে বলে-
আবার বিয়া করছ?
সবাই হাসে।
কাওসার বের হয়ে যেতে যেত বলে-
ব্যাটা মানুষ খাতারনাক চিজ, বউ ছাড়া এক রাইতের বেশি ঘুমাইতে পারে না। সবাই হো হো শব্দে হাসে।
এই ঘটনার পর কফিলের জিন্দেগি আন্ধার হয়ে আসে। অপমানে হয়তো তার চারপাশ ঘোলা ঘোলা লাগে। তার দৃশ্যপট কাঁপে। সে দেখে তার নিয়মে বান্ধা ভালো লাগার এই জীবন পুরো ধসে গেছে। সে তাকায়ে দেখে চুলায় দুধ জ্বাল দেওয়া জেবুন্নেসা নাই, আঙিনায় জেবুন্নেসা নাই, গোয়ালে গরু নাই, পাটির ওপর দুধের বাটি নাই, মাচায় বসে পা ঝুলিয়ে সে আর শঙ্কর নাই। কফিল দেখে, শঙ্করের বিধবা বউয়ের বিমর্ষ মুখ, শূন্য গোয়াল, ফাঁকা উঠান, চারদিকে কয়লা হয়ে যাওয়া ঘরবাড়ি। পিছন থেকে শান্ত স্বরে উষা ডাক দেয় কফিলকে। কফিলে চেতনা ফেরে।
উষা বলে-
দাদা; চলেন বাড়ির মায়া কইরা লাভ নাই। জানটা বাঁচান।
কফিল চুপ করে থাকে।
উষা বলে-
এরা আইজ না হইলে কাইল আপনারে মাইরা ফেলবে। তার আগে আপনারে রোজ বেইজ্জত করবে। আমারেও ধইরা নিয়া যাবে। আমার দিব্যি দাদা চলেন পালাই।
কফিল বাচ্চা ছেলের মতো অসহায় তাকায় থাকে।
৯.
মাস দুই পর এক রাতে নদীর শান্ত বুকে নৌকার বৈঠার নরম শব্দ শোনা যায়। জল কেটে ধীরে আগায় একটা নৌকা। কয়েকটা মাথা বসে আছে। পাথরের মতো স্থির। আকাশ থেকে ভরা পুন্নিমার চান্দের আলোয় চারদিক থৈ থৈ। চরাচর যেন তলিয়ে গেছে পুন্নিমার জোয়ারে। তার মধ্যে মায়াময় গ্রামের কোলঘেঁষে বয়ে যাওয়া নদীর বুকে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা ছোট দল যাচ্ছে। কেউ একজন জোরে ঝাঁকা দিয়ে ডাকতে থাকে-
কফিল ভাই। কফিল ভাই। উঠেন। কফিল ভাই।
কফিলের ঘোর ভাঙে। সে চোখ মেলে দেখে চারদিক তলিয়ে গেছে ফিনকি দিয়ে ঝরে পড়া চান্দের আলোয়। দলের কমান্ডার বলে-
কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা নামব। তারপর ঘণ্টা দেড়েকের হাঁটা। তারপর আমরা মূল দলটার সঙ্গে মিলব। সেখানে আমরা অ্যাটাকের ডিটেইল পরিকল্পনা জানব।
একজন কফিলের পিঠে হাত রেখে বলে-
দাদার কি শইল খারাপ করছে?
কফিল উত্তর দেয়-
না।
সে বিস্ময় নিয়ে চান্দের দিকে তাকায় থাকে। কমান্ডার বলে-
কফিল ভাই, দেশ স্বাধীন হলে অনেক পূর্ণিমা দেখতে পারবেন। এখন অপারেশনের ব্যাপারে মনোযোগী হন।
কফিল ঘোর লাগা স্বরে চান্দের দিকে তাকায়ে আঁজলা ভরে চান্দের দুধ পান করতে করতে বলে-
আহা রে স্বাধীনতা! তুই আসলে আবার আমি নিশ্চিন্তে চান্দের বাটিতে চুমুক দিবো। তুই আসলে আবার আমি দুপুরে ঝিম মাইরা ছিপ ফেইলা বইসা থাকব। তুই আসলে জেবুন্নেসা ফিরবে। হাঁড়িতে দুধ জ্বাল হবে। আমি মাদুর পাইতা বারান্দায় বইসা থাকব। তুই আসলে আমার দুধের পিপাসা মিটব।
কফিল হুহু করে কাঁদতে থাকে আর আঁজলায় পূর্ণিমার চান্দের আলো পান করতে থাকে। নৌকার সবাই বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকে। কারও কারও চোখে জল। কেউ কেউ শান্ত। চারদিক ক্রমশ যেন চান্দের আলোয় ক্রমশ জ্বালানো দুধের মতো ঘন হয়ে আসতে থাকে। যোদ্ধারা যেন ডুবে যেতে থাকে। পুরো দেশটা যেন ফিনকি দেওয়া দুধে মাখামাখি হয়ে যেতে থাকে। আর চান্দ যেন তিরতির করে কাঁপতে কাঁপতে একবাটি দুধের মতো উল্টে পড়তে থাকে।
কফিল হলো একজন ভালো আদমি। কফিল হলো একজন অকর্মা। গেরামে এইরকম অকর্মা থাকে। এইটা গ্রামের সৌন্দর্য। কফিল সেই সৌন্দর্যের জিনিস। কফিলের আছে বিরাট পৈতৃক সম্পত্তি। ফলে সে কিছুই করে না। তার বাপ-মা মইরা ভূত, ভাই নাই, বইন আছে তার বিয়ে হইছে দূরদেশে। ফলে বছরে একবার হয়তো সে তার পোলাপান নিয়ে আসে এইখানে। তখন বিরাট হইচই হয় বাড়িতে। পয়সাওয়ালা এমন মানুষের কিছু বদভ্যাস থাকে, কিন্তু কফিলের কোনো বদভ্যাস নাই। সে তাসপাশাও খেলতে পারে না, কিংবা সে খেলে না। মেয়েমানুষেও লোভ নাই। তার বাড়ির পেছনে আছে এক বিরাট জমি, সেই জমির সঙ্গে আছে বিরাট পুকুর। সেই পুকুরের ওপরে একটা মাচাঘর বানানো। সেই ঘরের লম্বা মাচার এক অংশ পুকুরের ওপর ছড়ানো। কফিলের কাজ হচ্ছে মাছ মারা। কিংবা ছিপ ফেলে পা ঝুলায়ে বসে থাকা। কফিলের পরানের বন্ধু নাম শঙ্কর। শঙ্কর হচ্ছে গোয়ালাবাড়ির পোলা, সেও একটা আখাম্বা জিনিস। প্রায় প্রায় দিনদুপুরে দেখা যায় শঙ্কর আর কফিল পুকুরের ওপর মাচায় বসে পা ঝুলায়ে ছিপ ফেলে তাকায় আছে ফাতনার দিকে। তাদেরকে দূর থেকে দেখলে মনে হয় দুইটা জ্যান্ত উজবুক। ফলে কোন কোন দিন শঙ্করের বউ উষা হয়তো আসে লম্বা ঘোমটা দিয়ে। উষা আসে শঙ্কররে ডাকতে কিংবা উষারে হয়তো শঙ্করের বাপ পাঠায় তার ধাঙড় পোলারে ডাকতে। তখনবা প্রতিবার এসেই উষা দেখে মাচার উপ্রে বসে থাকা দুই বন্ধু পা ঝুলায়ে পোলাপাইনের মতো বসে আছে, আর তাদের পাছার এক হাত কিংবা দেড় হাত দূরে দুইটা কাঁসার খালি জামবাটি, এবং বাটি দুইটার গলায় সর জমার দাগ। ফলে বোঝা যায় তারা দুইজনে বসে বসে দুধ খায় আর মাছ মারে। কফিলের জীবনের একটাই শখ বা ভালো লাগা সেইটা হইল দুধ খাওয়া। দুধ খাইতে তার ভালো লাগে। ঘন মোটা সর জমা দুধ তার কাছে অমৃত সমান। ফলে কফিলের বাড়িতে সকাল মানে হাঁড়িতে ভাত ফোটার থেকে দুধ জ্বাল হওয়ার দৃশ্যই সমীচীন।
এইরকম এক সকালে হয়তো উষা আসে কফিলের উঠানে। উঠানে দেখে কফিল গাভিনটার দিকে তাকায় আছে ফলে সে রান্নাঘরের দিকে আগায় যায়। উষা কফিলের স্ত্রীর কাছে যায়। কফিলের স্ত্রী জেবুন্নেসা হয়তো তখন জ্বালানো দুধ জামবাটিতে ঢালতে থাকে। উষা অপেক্ষা করে হাতের কাজ শেষ হবার, দুধ ঢালা শেষ হলে উষা তার আঁচলের তলার থেকে কলাপাতায় মোড়া সন্দেশ জেবুন্নেসার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলে, দাদায় কাইল কইয়া রাখছিল কাঁচাগোল্লা দিয়া যাইতে। জেবুন্নেসা হয়তো তাকে একটা পিঁড়ি এগিয়ে দিতে দিতে বলে-
বসো।
উষা হয়তো বলে-
না গো দিদি এখন বসব না, বিকালে আসবোনে।
ঘরের কাজ বাকি।
জেবুন্নেসা বলে-
শঙ্কর দা কই?
উষা হতাশ মুখে বলে-
সে কই তা কি আর আমি জানি। ভোরবেলা শ্বশুরমশাই ঘোল টানতে দিয়া গেলেন, আর উনি উল্টা আমার হাতে রশি ধরায় দিয়া উধাও। তার নাকি এইসব করবার জন্য জন্ম হয় নাই।
জেবুন্নেসা বলে-
আমার জন্যও তো ঐ একই লাইনের। কামের মধ্যে কাম। সারাদিন দুধ খাওয়া আর ছিপ ফেলায়া বইসা থাকা। কতবার বললাম আমার ভাইগোর সাথে পাটের ব্যবসায় নামবার, বেশি লাভের দরকার নাই একটা কাজের মধ্যি থাকলেন। কিন্তু সে কানে নেয় না। তার দুনিয়া ওই জামবাটির মইধ্যে আটকায় গেছে। তখন হয়তো কফিলের গাইগরু, হুরি বা নুরি এদের কেউ একজন ডেকে ওঠে। আমরা দেখি বা উষা সেইদিকে তাকায় এবং হুরি বা নুরিকে দেখে।
২.
কফিল বারান্দায় পাটি পেতে তার ওপরে বসে নাশতা করে। মুড়ি আর এক জামবাটি দুধ। আমরা দেখি সে কিছুটা বালকদের মতো ফস করে খোঁচা মারে জমে থাকা সরের আস্তরণের ওপর, তারপর সেইদিকে তাকিয়ে থাকে নিরিখ করে, সামান্য লোভীর হাসি ফুটে ওঠে তার ঠোঁটের কিনারায়, তারপর সে দুই আঙুল ডুবায় দুধের বাটির ভেতর এবং তুলে আনে এক টুকরো কাফনের মতো ঢ্যালঢেলে সাদা সর। কালো মুখের লালচে হায়ের মধ্যে সেই সরের টুকরো সে আস্তে করে ছেড়ে দিয়ে পিষতে থাকে জিভ দিয়ে তালুর সঙ্গে। যেন নির্বাণের সুখ। দূর থেকে হয়তো জেবুন্নেসা এই দৃশ্য দেখে, তার হাসি পায়। তারপর কফিল একগাল মুড়ি নেয় আর দুই হাতে জামবাটি তুলে এক চুমুক দুধ খায়। তার মুখে বিজয়ের হাসি কিসিমের আনন্দ লেগে থাকে। তার গোঁফের জায়গা সাদা হয়ে ওঠে। সে জিভ দিয়ে চাটে। এই দৃশ্য দেখে জেবুন্নেসার গা শিরশির করে। তারপর সে আবার চুমুক দেয় এইবার চুমুকে হয়তো একটুকরো সর ঠোঁটে ঝুলে পড়ে সেটাকে সে ভীষণ নরমভাবে সামলায়। এইসব ঘটনা যখন ঘটতে থাকে, তখন কাওসার আসে। সে এসে বারান্দায় কফিলের মাদুরের বাইরে বসে তাকিয়ে তাকিয়ে কফিলের দুধ খাওয়া দেখে। কফিল তারে পাত্তা দেয় না। তার দিকে তাকায়ও না। কফিল সুরুৎ সুরুৎ শব্দ করে বাটির দুধ শেষ করে। তারপর সে বাটির কান্দায় জমে থাকা সর আঙুল দিয়ে চেঁছে আঙুল গালের মধ্যে দিয়ে চুষতে থাকে। ফলে কাওসার সেই দৃশ্য দেখে আর তার চোখেমুখে তাচ্ছিল্যের রেখা ফোটে। এই দৃশ্য দূর থেকে জেবুন্নেসা দেখে এবং তার চোখেমুখে বিরক্তি ফোটে।
কাওসার বলে-
তুমি আছো ভালোই দোস্ত। তিন বেলা দুধ খাও, মাশাল্লাহ!
কফিল তাকায় কাওসারের দিকে, কিন্তু কোনো উত্তর দেয় না।
কাওসার বলে-
ছোটকালের থিকা তুমি দুধ খাইতে পছন্দ করো, বিয়ার পরেও দুধ খায়া যাইতেছ সমানে।
কফিল এইবার ভ্রু কুঁচকে হয়তো বলে-
কী বলতে আসছ সেইটা কও। ফাউ কথা ফেলায়ো না।
কাওসার বলে-
তোমার খোঁজ নিতে আসলাম। অনেকদিন আসি না এই দিকে, যাইতেছিলাম রাস্তা দিয়া ...।
কফিল বলে-
বললাম না ফাউ কথা বাদ দিয়া আসল কথা বলতে, কী বলতে আসছ সেইটা বল? তুমি তো নিয়ম কইরা জুয়ার আসরে যাইতেছ তাই না?
কাওসার জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলে-
তওবা তওবা! এইসব কী কও? কে কইছে তোমারে? ওই মালাউনের বাচ্চা শঙ্কর?
কফিল আরও ভ্রু কুঁচকে বলে-
শঙ্কর কইতে যাব কোন দুঃখে। সেই কি তোমার ফেউ লাগে?
কাওসার বলে-
শঙ্কর ছাড়া তোমারে দিনদুনিয়ার খবর কেডা দিবো? তোমার জানের ইয়ার লাগে সে। তুমি তো তিন বেলা দুধ খাও আর ছিপ ফেইলা বইসা থাকো। লোকে অবশ্য অন্য কথা কয়! কফিল বলে-
কী কয়?
কাওসার বলে-
লোকে কয় তুমি হইলা ভাউরা, বউ পাহারা দেও সারাদিন। কফিল শান্ত স্বরে বলে-
তুমি বিদায় হও। তুমি একটা জ্যান্ত বজ্জাত।
কাওসার বলে-
রাগ নিও না দোস্ত। মজা করলাম। তুমি যে একটা ভালো মানুষ এইটা সবাই জানে। তুমি ওই গরুর দুধ ছাড়া আর কিছু খাও না এইটাও সবাই জানে। এখন আসল কথা কই, আমারে কিছু টাকা ধার দেও দোকানে মাল তুলব।
কফিল বলে-
তুমি বিদায় হও।
কাওসার বলে-
কসম এইবার এই টাকায় মাল তুলব দোকানে। আল্লার কিরা। তুমি তো আবার সুদ খাও না। সুদ নিলে তোমার বাড়ির দুধ কাইটা যায়। নাইলে সুদ দিতে রাজি হইতাম।
কফিল বলে-
তুমি যে একটা জ্যান্ত শয়তান। এইটা তুমিও জানো। তোমারে বিদায় হইতে বলছি, এখনই তুমি বিদায় হও।
কাওসার উঠতে উঠতে বলে-
বাপে রাইখা গেছে দুনিয়ার সম্পদ। তাই বাইচা গেলা, বুঝতে পারলা না দুনিয়াদারির মজা। খালি দুধেই চুমুক দিলা।
৩.
সেদিন দুপুরবেলা জোহরের ওয়াক্তে হয়তো কফিল আর শঙ্কর পুকুরপাড়ের ছিপ ঘরের মাচার ওপর পা ঝুলায়ে ছিপ ফেলে বসে থাকে। তখন বা তার একটু পরে হয়তো জেবুন্নেসা দুই বাটি দুধ রেখে যায় তাদের পেছনে।
শঙ্করকে হয়তো জেবুন্নেসা বলে-
সকালে কই উধাও হইছিলেন বউদি কইল?
শঙ্কর হাসে। তার দিকে তাকায়ে কফিলও হাসে। সেই হাসির মানে কেউ বোঝে না, কিংবা বোঝে। জেবুন্নেসা চলে যেতে যেতে বলে-
আপ্টম্নাগোর দুই বন্ধুর সংসার না করাই উচিত আছিল। ঘুরতেন, ফিরতেন, দুধ খাইতেন আর মাছ মারতেন।
শঙ্কর হাসে মিটিমিটি। তার হাসি দেখে কফিলও হাসে মিটিমিটি। জেবুন্নেসা চলে যাওয়ার পর তারা দুইজন দুধ খায় আর গল্প করে।
শঙ্কর বলে-
ভাল্লাগে না বাড়া! সকালবেলা ঘুমেরতে উঠোয়ে যদি ঘোল টানতি কয় তালি কিরাম লাগে ক তো? দিছি বউর হাতে ধরায়ে তারপর বাজারের দিক হাঁটা।
কফিল বলে-
সকালে কাওসার আসছিল টাকা ধার চাবার।
শঙ্কর বলে-
উঁহু দিস না। দোকান বেইচে দিছে। কিচ্ছু নাই। সব জুয়ার কোর্টে আর পাড়ার ঘরে শ্যাস।
কফিল বলে-
হু। ফাউল কিসিমের হয়ে গেছে, উল্টাপাল্টা কয়।
শঙ্কর বলে-
বাজারে শুনলাম ঢাকার অবস্থা নাকি বেগতিক।
কফিল বলে-
ক্যান?
শঙ্কর বলে-
মিলিটারি নামিছে নাকি।
কফিল বলে-
অ। নামলে নামুক বাড়া। আমাগো কী? আমরা থাহি ঝিম মারা গেরামে, আমাগের কিসের পাকিস্তান কিসের জয় বাংলা।
শঙ্কর চিন্তিত মুখে বলে-
তা ঠিক, তয় শুনলাম বড় যুদ্ধ লাগার পাঁয়তারা চলতিছে। বাবা কতিছিল যুদ্ধ লাগলি ...!
ঠিক এই সময় শোনা যায় কফিলের গাই নুরি বা হুরি কেউ একজন ডেকে ওঠে। ফলে তাদের দুইজনের নজর ওইদিকে যায়।
শঙ্কর বলে-
গাই বিয়েনোর দিন হয়ে আসতেছে। কফিলের চোখেমুখে এইবার চিন্তা দেখা যায়।
সে বলে-
হ।
৪.
রাতেও কফিল দুধ দিয়ে ভাত খায়। জামবাটি থেকে দুধ ঢেলে নেয় পাতে। রাত্রে যখন চারদিকে ঝিঁঝি ডাকে, যখন তারে ভাত দেয় জেবুন্নেসা তখন। নীরবতা ভেঙে জেবুন্নেসা বলে-
ঢাকায় নাকি গ গোল লাগছে?
কফিল শব্দ করে লম্বা চুমুক দেয় থালার দুধে। কফিল বলে-
গুড় নাই? জেবুন্নেসা কুচি করা গুড় এগিয়ে দিতে দিতে আবার বলে-
ঢাকায় নাকি গোলাগুলি হইছে?
কফিল বলে-
হইলে হইসে আমাগোর কী?
জেবুন্নেসার মুখ বেজার হয়। কফিল গুড় পিষে শব্দ করে চুমুক দেয় গুড় পেষা দুধে।
৫.
পরদিন সকালে কফিলকে ভয়াবহ পেরেশান লাগে। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ায়ে থাকে। তার সামনে তার প্রিয় গরু নুরি বা হুরি। একজন লোক দাঁড়ানো।
সে বলে-
তটস্থ হইয়ো না। আরেকটু দেখি। বাচ্চা ঠিকঠাক হবে।
কফিল বলে-
বেচারি কষ্ট পাচ্ছে।
লোকটা বলে-
আল্লা আল্লা করো। তুমি ভিতরে যাও, আমি দেখতেছি। কফিল দাঁড়ায় থাকে।
লোকটা বলে-
শুনলাম শেখ সাব রে নিকি হাওয়া কইরে দিছে মিলিটারি!
কফিল বলে-
আমি কিছু জানি না।
লোকটা বলে-
আমাগে কী হবে তাইলে?
কফিল বলে-
দেহেন তো গাভিনটা কাঁপতেছে মনে হয়।
লোকটা বলে-
ও কিছু না। আল্লা আল্লা করো। ... তয় আমার মনে হয় মাওলানা সাব এইবার খেইল দেহাবে!
কফিল বলে-
কোন মাওলানা? লোকটা বিস্ময়ে তাকায় তার দিকে।
এইসময়ে একটা পরিবার আসে। কফিলের বোন বাচ্চা আর তার স্বামী। তাদের চোখেমুখে ভয়াবহতা থেকে পালিয়ে বাঁচার স্বস্তি। কফিল এগিয়ে যেতেই তার বোন তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হুহু করে কানতে লাগে। পুরা ব্যাপারটা আমরা বুঝতে পারি যখন জেবুন্নেসা বেরিয়ে আসে। উঠোনে যেন এক ভয়াবহতার বয়ান চলে। কফিলের বোনজামাই গুছিয়ে বলে আর কফিলের বোন একটু পরপর হুহু করে কান্দে। কফিলের বোনজামাই যার নাম হয়তো কামাল।
সেই কামাল বলে-
কিছু নাই ভাইজান। মিলিটারিরা মানুষ মারতেছে পিঁপড়ার মতোন!
কফিল ফস করে বলে-
সত্যই?
কফিলের বোন হুহু করে কান্দে। কফিলের বোন আরও বলে-
তারা কোনোরকম জানে বেঁচে এসেছে এবং তারা এইখানেও থাকবে না কারণ এইখানেও মিলিটারি আসবে।
৬.
পরদিন বা তার পরদিন সকালে শঙ্কর আসে। তার মুখ বিমর্ষ লাগে। কফিল দুধের বাটিতে চুমুক দিচ্ছিল, সেই সময় শঙ্কর এসে ঢোকে। তার পাশে বসে। কফিল বাটির ওপর মুখ ঝুঁকিয়ে বলে-
কী হইছে দোস্ত?
শঙ্কর বলে-
পেরেশান লাগে।
কফিল বলে-
কিসের পেরেশান?
শঙ্কর বলে-
মিলিটারির ক্যাম্প বসিছে ওপার!
কফিলের মুখ হয়তো এই কথা শুনে হাঁ হয়ে যায় কিংবা তার হাত থেকে কাঁসার জামবাটিভর্তি দুধ ঝুম্মম্ম করে মেঝেতে পড়ে যায় কিংবা তার চোখ বড় বড় রসগোল্লার মতোন হয়ে ওঠে। কেননা এই কথা তার বিশ্বাস হতে চায় না। কিন্তু তাকে বিশ্বাস করতে হয়। ফলে সেইদিন দুপুরবেলা কফিলের বোনের পরিবারের সঙ্গে কফিলের স্ত্রী জেবুন্নেসাকে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। কফিলের বোনের স্বামীর সব ব্যবস্থা করা ছিল। শুধু অতিরিক্ত হিসেবে কফিলের স্ত্রী যোগ হয় তাদের সঙ্গে। জেবুন্নেসা গোঁয়ারের মতো গেড়ে বসে। সে যেতে চায় না। কফিল তারে বোঝায়। তারা সবাই কফিলরে বোঝায়। কিন্তু কেউ বোঝে না। ব্যাপারটা এ রকম দাঁড়ায় যে, কফিল বলে-
জেবুন্নেসা ঘাউরামি কইরা লাভ নাই। তুমি ওগোর সাথে যাও, আমি কয়দিন পর আসব।
জেবুন্নেসা বলে-
আমিও দুইদিন পর আপনার সাথে যাব।
কফিল বলে-
দেখি এদিকের কী হয়, হইতেও পারে কিছুই হইল না!
কফিলের বোনের স্বামী বলে-
ভাইজান। যা হবে তা হজম করতে পারবেন না। তার চেয়ে চলেন একসাথে রওনা হই।
কফিল বলে-
উঁহু। তোমরা যাও। আমি দিনদুই পর শঙ্কর গো সাথে আসব নে।
জেবুন্নেসা বলে-
আমিও। আমি আপনারে একলা ফেইলা যাব না।
কফিল বলে-
বেবোধ মেয়েমানুষের মতোন কথা কবা না। তুমি অগের সাথে যাবা।
জেবুন্নেসা কেঁদে ফেলে বলে-
আমি গেলে আপনেরে দেখবে কে? দুধ জ্বালায় দেবে কে? না খায়া মরবেন আপনে।
কফিল ভিজে যায়। হয়তো সে জেবুন্নেসার মাথায় হাত রেখে বলে-
তুমি যাও। আমি এই বাড়ি, নুরি-হুরি এগোরে ফেইলা যাই কেল্ফেম্ন। পরিস্থিতি দেইখা আসব আমি।
এইরকম ঘোলাটে পরিস্থিতির পর সেইদিন সন্ধ্যায় দেখা যায়, যখন আলো মরে পাতলা আন্ধার নেমে আসে তখন কফিলের বোনের পরিবারের সঙ্গে জেবুন্নেসাও রওনা হয়। কফিল ঘরের উঠানে দাঁড়ায় থাকে আবছায়ার ভেতর তার মনটা হুহু করে। যেন এক পুরোনা শোক বাড়িটারে ঘিরে রাখে। ফলে তার মায়া মায়া লাগে। ঘরে গিয়ে সে দেখে টেবিলের ওপর কাঁসার জামবাটিভর্তি জ্বালানো সর জমা দুধ রেখে গেছে জেবুন্নেসা। দুধের বাটির ঢাকনা তুলে তাকাতেই তার চোখে জল আসে। বহুদিন পর তার মনে হয় জেবুন্নেছা ছাড়া বাড়ি খালি খালি লাগে।
৭.
পরদিন সকালে শঙ্কর আসে। তারা দুইজন পুকুরের ওপর মাচায় পা ঝুলায়ে বসে থাকে।
শঙ্কর বলে-
গেরাম তো শীঘ্র ছাড়া লাগবেনে মনে হচ্ছে। কফিল বলে-
পলায়া যাব। যেইখানে-সেইখানে কি এই জীবন পাব?
শঙ্কর বলে-
জানডা আগে বাঁচাও দোস্ত। পাগলামি কইরো না। তুমি আয়েশি মানুষ, তোমার কষ্ট হবে। তবু পালানো লাগবেই।
কফিল বলে-
হুম।
শঙ্কর তারপর বলে-
আমি উঠি। বাবা আবার বাজারে গেছে এর মধ্যি।
শঙ্কর উঠতে উঠতে বলে-
আবার কী যেন পিচ কমিটি না কী যেন হচ্ছে, এলাকার লোকগের নিয়ে যারা পাকিস্তান চায়।
কিন্তু সেইদিন বিকেলেই চারদিক লন্ডভন্ড হয়ে যায়। বাজারে মিলিটারি আসে। তারা বাজার পোড়ায় দেয়। হিন্দুপাড়ায় দেয় আগুন। গুলি চলে। সারা গ্রাম তছনছ হয়। শঙ্কর তার মাচায় বসে থাকে। তার চেহারার ভোদাইভাবে পরিবর্তন দেখা যায়। সে বিহ্বল হয়ে দেখে চারদিকে ধোঁয়ার কু লী। যেন সে অবধারিত মৃত্যুর মুখোমুখি।
রাত্রে যখন সে চুপিচুপি ঘরে ফেরে খুব সন্তর্পণে, ঘরে ঢুকে চারদিকের সুনসানের মধ্যে যখন সে বসে, তখন সে টের পায় কারোর ফোঁপানি। যেন কোনো নারী। অন্ধকার ঘরের মধ্যে কফিল ফিসফিস স্বরে জিজ্ঞেস করে-
কে?
কোনো উত্তর পাওয়া যায় না। সে আবার বলে-
কান্দে কে? জেবুন্নেসা? জেবুন্নেসা?
নারীকণ্ঠ কান্নাজড়িত স্বরে বলে-
দাদা, আমি উষা।
কফিল আলো জ্বালায়। সে জিজ্ঞেস করে-
কাকাবাবু, শঙ্কর কই?
উষা চাপা স্বরে কেঁদে লুটিয়ে পড়ে আর মেঝেতে হাত আছড়ে আছড়ে শাঁখা ভাঙে।
৮.
কিন্তু ১৯৭১ সালে কফিলের জীবনে সবচেয়ে তাজ্জব ঘটনাটা ঘটে তার পরের দিন। সেদিন তার উঠানে একদল লোক আসে। তারা কফিলকে উচ্চ স্বরে ডাকে। কফিল বের হয়। তাকিয়ে দেখে তার উঠানে দাঁড়ানো একদল লোক। লোকজন সবাই তার চেনা এবং এদের প্রধানের ভূমিকায় আছে কাওসার। তার মাথায় জিন্নাহ টুপি। তার চেহারায় চকচকে ভাব। কাওসার হাসি হাসি মুখে বলে-
কেমন আছো দোস্ত?
কফিল তাকায় থাকে।
কাওসার বলে-
টাকা ধার চাইতে আসি নাই আইজ। কিসের জন্য টাকা ধার করব বল? বাজারই তো পুইড়া ছাই! তাই ভাবলাম সব যখন গেছে, এইবার বাকি জিন্দেগিটা পাকিস্তানের খিদমতে লুটায়ে দি।
অন্যরা হাসে। কফিল তাকায়ে থাকে।
কাওসার বলে-
তুমি ভয় নিও না। তয় তোমারে বলি, মেহমানদের সেবায় লাইগা যাও, কাজে দিব। খালি দুধ খাইলে কাজ হবে না এখন। সবাই হাসে। কাওসার অন্যদের বলে-
ওই গরু দুইটা নে। বাছুরটাও। কচি বাছুরের কাবাব নাকি মেহমানদের বিশেষ পছন্দ।
কফিল বলে-
কী করো তোমরা এইসব? ঐ ...!
কাওসার ঠোঁটে আঙুল এনে বলে-
হিসস। পাকিস্তানের খিদমত। অনেক তো দুধ খাইছ, এইবার আমরা একটু খাই। কফিল চুপ করে থাকে।
কাওসার দল নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করে-
ঘরে কে?
কফিল বলে-
তোমার ভাবি!
কাওসার মুচকি হেসে বলে-
আবার বিয়া করছ?
সবাই হাসে।
কাওসার বের হয়ে যেতে যেত বলে-
ব্যাটা মানুষ খাতারনাক চিজ, বউ ছাড়া এক রাইতের বেশি ঘুমাইতে পারে না। সবাই হো হো শব্দে হাসে।
এই ঘটনার পর কফিলের জিন্দেগি আন্ধার হয়ে আসে। অপমানে হয়তো তার চারপাশ ঘোলা ঘোলা লাগে। তার দৃশ্যপট কাঁপে। সে দেখে তার নিয়মে বান্ধা ভালো লাগার এই জীবন পুরো ধসে গেছে। সে তাকায়ে দেখে চুলায় দুধ জ্বাল দেওয়া জেবুন্নেসা নাই, আঙিনায় জেবুন্নেসা নাই, গোয়ালে গরু নাই, পাটির ওপর দুধের বাটি নাই, মাচায় বসে পা ঝুলিয়ে সে আর শঙ্কর নাই। কফিল দেখে, শঙ্করের বিধবা বউয়ের বিমর্ষ মুখ, শূন্য গোয়াল, ফাঁকা উঠান, চারদিকে কয়লা হয়ে যাওয়া ঘরবাড়ি। পিছন থেকে শান্ত স্বরে উষা ডাক দেয় কফিলকে। কফিলে চেতনা ফেরে।
উষা বলে-
দাদা; চলেন বাড়ির মায়া কইরা লাভ নাই। জানটা বাঁচান।
কফিল চুপ করে থাকে।
উষা বলে-
এরা আইজ না হইলে কাইল আপনারে মাইরা ফেলবে। তার আগে আপনারে রোজ বেইজ্জত করবে। আমারেও ধইরা নিয়া যাবে। আমার দিব্যি দাদা চলেন পালাই।
কফিল বাচ্চা ছেলের মতো অসহায় তাকায় থাকে।
৯.
মাস দুই পর এক রাতে নদীর শান্ত বুকে নৌকার বৈঠার নরম শব্দ শোনা যায়। জল কেটে ধীরে আগায় একটা নৌকা। কয়েকটা মাথা বসে আছে। পাথরের মতো স্থির। আকাশ থেকে ভরা পুন্নিমার চান্দের আলোয় চারদিক থৈ থৈ। চরাচর যেন তলিয়ে গেছে পুন্নিমার জোয়ারে। তার মধ্যে মায়াময় গ্রামের কোলঘেঁষে বয়ে যাওয়া নদীর বুকে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা ছোট দল যাচ্ছে। কেউ একজন জোরে ঝাঁকা দিয়ে ডাকতে থাকে-
কফিল ভাই। কফিল ভাই। উঠেন। কফিল ভাই।
কফিলের ঘোর ভাঙে। সে চোখ মেলে দেখে চারদিক তলিয়ে গেছে ফিনকি দিয়ে ঝরে পড়া চান্দের আলোয়। দলের কমান্ডার বলে-
কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা নামব। তারপর ঘণ্টা দেড়েকের হাঁটা। তারপর আমরা মূল দলটার সঙ্গে মিলব। সেখানে আমরা অ্যাটাকের ডিটেইল পরিকল্পনা জানব।
একজন কফিলের পিঠে হাত রেখে বলে-
দাদার কি শইল খারাপ করছে?
কফিল উত্তর দেয়-
না।
সে বিস্ময় নিয়ে চান্দের দিকে তাকায় থাকে। কমান্ডার বলে-
কফিল ভাই, দেশ স্বাধীন হলে অনেক পূর্ণিমা দেখতে পারবেন। এখন অপারেশনের ব্যাপারে মনোযোগী হন।
কফিল ঘোর লাগা স্বরে চান্দের দিকে তাকায়ে আঁজলা ভরে চান্দের দুধ পান করতে করতে বলে-
আহা রে স্বাধীনতা! তুই আসলে আবার আমি নিশ্চিন্তে চান্দের বাটিতে চুমুক দিবো। তুই আসলে আবার আমি দুপুরে ঝিম মাইরা ছিপ ফেইলা বইসা থাকব। তুই আসলে জেবুন্নেসা ফিরবে। হাঁড়িতে দুধ জ্বাল হবে। আমি মাদুর পাইতা বারান্দায় বইসা থাকব। তুই আসলে আমার দুধের পিপাসা মিটব।
কফিল হুহু করে কাঁদতে থাকে আর আঁজলায় পূর্ণিমার চান্দের আলো পান করতে থাকে। নৌকার সবাই বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকে। কারও কারও চোখে জল। কেউ কেউ শান্ত। চারদিক ক্রমশ যেন চান্দের আলোয় ক্রমশ জ্বালানো দুধের মতো ঘন হয়ে আসতে থাকে। যোদ্ধারা যেন ডুবে যেতে থাকে। পুরো দেশটা যেন ফিনকি দেওয়া দুধে মাখামাখি হয়ে যেতে থাকে। আর চান্দ যেন তিরতির করে কাঁপতে কাঁপতে একবাটি দুধের মতো উল্টে পড়তে থাকে।
বিষয় : গল্প রোমেল রহমান
মন্তব্য করুন