
বনের পাশে এক একলা পাথুরে পাহাড়। তারই পাশে আমার ক্যাম্প। এটা আইভরি কোস্টের 'দোয়েনজা' নামের এলাকা। আমার কাঠের ঘরটা মাটি থেকে অনেকটাই উঁচুতে। ছোটবেলায় পোস্টারে কোনো বনের ভেতর যেমন কাঠের সুন্দর বাড়ি দেখতাম- ঠিক অথবা কিছুটা সেরকম। পশ্চিম আফ্রিকার আদিগন্ত এই বনভূমিতে দিনের বেলাতেও পোকাদের আর্তস্বর আমাকে কেমন বিষণ্ণ একাকিত্বের অনুভূতিতে ডুবিয়ে দেয়! আমার ঘরটার সামনে শহরে (ইয়ামাসুক্রো অথবা আবিদজান) যাওয়ার মহাসড়ক। মহাসড়কে যানবাহন এতটা কম যে, আফ্রিকার বিশাল সব গাছের প্রলম্বিত ছায়াকে বুকে নিয়ে এই মহাসড়কও নিঃসঙ্গতা শব্দের সাথে লুকোচুরি খেলায় মত্ত।
রাস্তায় জাতিসংঘের কাজের অংশ হিসেবে (যেন দেশটির উত্তরের স্বাধীনতাকামী বিবদমান দলের সাথে দক্ষিণের সরকার সমর্থিত ইয়াং প্যাট্রিয়ট দলের সংঘর্ষ না বাধে তার জন্য) রাস্তায় আমাদের সেনাবাহিনীর তল্লাশি চৌকি। এ ছাড়া মহাসড়কটিতে একটু পরপর রয়েছে ফানসির (দেশটির সেনাবাহিনী ও পুলিশের সম্মিলিত দল) তল্লাশি চৌকি। প্রতিটি তল্লাশি চৌকিতে প্রতিজন মানুষের থলের প্রতিটি দ্রব্য রাস্তায় সাজিয়ে রেখে প্রদর্শন করার পর নিজেদের পরিচয়পত্র দেখিয়ে এ দেশের নাগরিক ছাড়া পায়। পঁচিশ থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার পরপর চলছে এই মহাযজ্ঞ। সাথে চলছে চাঁদাবাজি। এই চাঁদাবাজি সরকারি মদতেই হচ্ছে। সরকার আর্থিক সঙ্কট দেখিয়ে তার পুলিশ, সেনাবাহিনীর বেতন বন্ধ করে দিয়েছে। তাই তারা চাঁদাবাজির নাম দিয়েছে ট্যাক্সিং। এই পন্থায় সরকারি বাহিনীর সদস্যরা দামি গাড়ি (ফ্রান্সের পিজোট থেকে মার্সিডিজ, বিএমডব্লিউ) হাঁকছে। প্রেসিডেন্টকে ফরাসিরা প্যারিসে তিন স্ত্রী (যারা নাকি মডেলকন্যা বিধায় তারাও মিটিয়ে নিচ্ছে তাদের বিকৃত সাধ) আর কয়েকটা বাড়ি উপহার দিয়ে ক্ষমতার ধ্বজাধারীতে বুঁদ করে রেখে কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে সমগ্র জাতির সব স্বপ্ন!
মানুষগুলো তবু নির্বিকার। কারণ এদের নিজস্ব ভাষাটুকু ফরাসিরা কেড়ে নিয়েছে। ফ্রেঞ্চে কথা বলা এ দেশের মানুষের সাথে আমি কথা বলে দেখেছি, কয়েকশ বছর আগে 'পেত্তি' নামের এদের নিজস্ব যে ভাষা ছিল তা সম্পর্কে এরা কিছুই জানে না। যেন ফ্রেঞ্চই তাদের মাতৃভাষা! আফ্রিকান এই জাতিকে কাছ থেকে দেখে আমি শিখেছি, কোনো জাতিকে শোষণ করতে চাইলে, তাদের প্রতিবাদহীন করতে চাইলে তাদের মাতৃভাষাকে কেড়ে নিতে হয়। আরও শিখেছি, মায়ের ভাষার মতো করে আর কোনো ভাষার অনুপ্রাস মানবসন্তানদের সত্তায় মনুষ্য আবেগের যে শ্রেষ্ঠত্ব তার অনুরণনে অনুরিত হয় না বলে, প্রতিবাদের শব্দের ধার কমে যায়। শব্দের ধার তরবারির ধারের চেয়ে কম শক্তিশালী নয়।
পশ্চিম আফ্রিকার এই অঞ্চলের মানুষের এই ভাষা হারানোর ফলে এখানে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের যে বিস্তৃতি তা স্পষ্ট করতেই জীবনে প্রথম কলম ধরেছি। লিখছি এক উপন্যাস। কী এক অদ্ভুত ঘোরের বশে শুধু লিখে যাই। এতগুলো চরিত্র নিয়ে এই সৃষ্টিকাজে মগ্ন হওয়ার বেদনাও এত মধুর আর আনন্দময়- কী করে বোঝাব? পরের পাতায় কী লিখব জানি না। নিজের আত্মার আলো জ্বেলে অপেক্ষা করি শব্দের জন্য। মায়ের ভাষা কী অদ্ভুত মায়ায় আমার হৃদয়কে উদ্ভাসিত করে চলে! নরখাদক এলাকায় একজন কর্নেলকে উদ্ধারে, আফ্রিকান উপজাতীয়দের সংস্কৃতিকে সৃষ্টির মাঝে আমি রেখে যাচ্ছি উপমার ইঙ্গিত। একটা জাতির ভাষা হারানোর বেদনাকে এই *উপন্যাসে আমি ধরতে চাই। জানি না, পারব কিনা।
এদের পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ আছে। কিন্তু সাধারণ জনগণের জন্য বিদ্যুতের মূল্য আকাশচুম্বী বলে এরা তা ব্যবহারের মতো দুঃস্বপ্ন দেখে না। বাংলাদেশের আড়াই গুণ বড় হলেও এইডসের কারণে দেশটির জনসংখ্যা মাত্র চৌদ্দ মিলিয়ন। মফস্বল শহরের কুঁড়েঘরগুলো অপরিচ্ছন্ন, এলোমেলো হলেও ভূমির পর্যাপ্ততার কারণে শহরের কাঠামো অত্যন্ত পরিকল্পিত। পরিকল্পিত অথচ এলোমেলো এই শহরগুলোতে অনন্ত সময় যেন থমকে থাকে বলে তা সৃষ্টিশীল ভাবনাকে উসকেও দেয়। যেমন, আফ্রিকার গ্রাম, আমাদের দেশের কোনো থানা অথবা গঞ্জের চেয়েও কম দোকানপাটের এইসব দৃশ্য আর মানুষের মৃদু কলতান মুখরিত ঝাঁঝালো রোদের শহরে থমকে থাকা 'সময়' আমার 'স্মৃতি'কে আর অনুভবকে একদিন খুব তাড়া করবে। আমি জানি, আফ্রিকা নিয়ে আমি নস্টালজিক হয়ে উঠব!
এইসব জনপদ মানেই নাইট-ক্লাব আর বার। একটু রাত হলেই এরা সৃষ্টিশীলতায় নয় বরং হাই ভলিউমে গান ছেড়ে মেতে ওঠে নৃত্য আর মদে। এ এদের রক্তের নেশা। এদের সত্তাকে পঙ্গু করে রাখার মারণাস্ত্র নামের এই সংস্কৃতিও ফরাসিদের আমদানি করা। সলিব্রা নামের মদ তৈরির বিশাল বিশাল কারখানাগুলো থেকে উৎপাদিত এক বোতল মদ বাংলাদেশি টাকায় বিশ টাকার সমমূল্যের হলেও এখানে এক বোতল মিনারেল ওয়াটার ষাট টাকায় কিনতে হয়। ওষুধ এবং কনডমের দাম সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। মদে প্রচুর ভর্তুকি থাকলেও পৃথিবীর সর্বোচ্চ কাকাও উৎপাদনকারী দেশটি চড়া দামে কেনা ওষুধেও চড়া কর বসায়। আফ্রিকার জনসংখ্যা যেন কোনোদিন না বেড়ে যায়- এটা হয়তো সেই স্ট্র্যাটেজিরই কোনো অংশ।
তবে শ্রেষ্ঠ মানবভ্রূণ ধারণের জন্য এ দেশের নারীদের স্বাধীনভাবে জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়া এবং সন্তান জন্মদানে নারীর একক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সংস্কৃতি অনবদ্য। এখানে নারীরা একসাথে তিনজন পুরুষকে তার স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। যাকে ইচ্ছা পরিত্যাগও করতে পারে এবং মজার ঘটনা হলো, নারীটা গর্ভে কার সন্তান ধারণ করছে তা সে বলতে বাধ্য নয় মোটেও। স্বামীরই সন্তান ধারণ করতে হবে এমন বাধ্যবাধকতাও নেই এখানে। কী অদ্ভুত! নারীকে সন্তান ধারণের ক্ষেত্রে এমন একজন সম্রাজ্ঞী বানানোর সংস্কৃতিকে ধারণ এবং লালনে যেসব পুরুষ তাদের চেতনা ব্যয় করেছেন- তাদেরকে মহান বলতেই হয়। এখানেই দেশটির ভবিষ্যৎ গোপন এক শক্তি নিহিত। কেননা, নারীদের গর্ভ শ্রেষ্ঠ বীজটুকুই ধারণ করতে চায় বলে আমার মনে হয়। নারীদের চোখে এই শ্রেষ্ঠত্ব আর কিছু নয়। তার ধরন হয়তো মানুষ হিসেবে তার টিকে থাকার সম্ভাবনা, তার উদারতা, ভালোবাসার সামর্থ্য এবং অবশ্যই শারীরিক উপযুক্ততা।
আমরা এ দেশের জনগণের ভালোবাসা অর্জনের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা ক্যাম্পেইন পরিচালনা করি। এইডস থেকে নিরাপদ থাকার জন্য কনডম তাদের ব্যবহারের পরামর্শ দিলে এমন উদ্ভ্রান্ত পরামর্শের জন্য তাদের মুখ হাঁ হয়ে যায়। মূল্য দিয়ে যৌনানন্দে বিঘ্ন ঘটানোর মতো নির্বোধ যে তারা নয়, তা যেন তার হাঁ-মুখের ঝুলে থাকা দুই ঠোঁট স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দেয়। কনডম কেনার অর্থ খরচের চেয়ে মদ খেয়ে মরে গিয়ে আবার তারুণ্যময় পুনর্জন্ম তাদের অনেক বেশি কাম্য। উল্লেখ্য, এদেরকে কে বা কারা শিখিয়েছে যে, যে বয়সে তুমি মৃত্যুবরণ করবে ঠিক সেই বয়স নিয়েই তুমি অনন্ত পুনর্জন্ম পাবে! কী অদ্ভুত মনস্তত্ত্ব। সাম্রাজ্যবাদ শুধু সেনাবাহিনী দিয়েই হয় না, সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় একটা জাতির চেতনাকে, তাদের মনস্তত্ত্বকে প্রভাবিত অথবা পঙ্গু করে দিতে হয়!
এ দেশে শিক্ষাসামগ্রীর মূল্যও আকাশচুম্বী। এদের শিশুতোষ বইয়ে যে গল্পগুলো সন্নিবেশ করা হয়েছে সেখানে পিশাচ, কোনো খল চরিত্র অথবা ভৌতিক আত্মার প্রাণীকে দেখানো হয়েছে এ দেশেরই মানুষের মতো কালোদের প্রতিভূ করে। অন্যদিকে ভালো আর স্বর্গীয় সব চরিত্র যারা মানুষের মঙ্গলের জন্য মরিয়া তাদের দেখানো হয়েছে সাদা (ইউরোপীয়) মানুষের প্রতিভূ করে। সাদা দেশ, সাদা মানুষ যদি শৈশবেই কল্পনার স্বপ্ন হয়ে যায় তাহলে বড় হয়ে তাদের চিন্তাটা কেমন হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। এ দেশকে শোষণের সবচেয়ে বড় মূলমন্ত্র নামক বীজটি এখানেই প্রোথিত।
প্রচুর সম্পদ এ দেশে। গত বছর আইভরি কোস্ট তিন বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্যসামগ্রী আমদানি করেছে। রপ্তানি করেছে ৮.৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের খাদ্য ও পণ্য। পাথুরে হলেও সার অথবা রাসায়নিক দ্রব্যের কবল থেকে চিরকাল মুক্ত এ দেশের ভূমি তাই দারুণ খনিজসমৃদ্ধ ফসল ফলায়, যা ধারণ করে মানবশরীরের জন্য প্রয়োজনীয় লবণ। বাংলাদেশের পলিসমৃদ্ধ জমিতে এত সার আর কীটনাশক ব্যবহার হয় যে, আমার ধারণা, আমাদের ভূমি আফ্রিকার ভূমির মতো এত খনিজ লবণসমৃদ্ধ ফল-খাদ্য উৎপাদন করতে আর সক্ষম নয়। হলুদ কলার ভেতর কেমন লাল টুকটুকে রং আর তার কী অপূর্ব স্বাদ। মুখেই যেন গলে যায়। পেঁপেগুলো গাছেই পচে যায়। এত ফল পাখিদের পক্ষেও খাওয়া সম্ভব নয়।
তোমাকে লিখছি আর দেখছি- দশটি বিশালাকৃতির কনটেইনার নিয়ে কার্গো ট্রাকগুলো আমদের ক্যাম্প অতিক্রম করছে। প্রতিটি কনটেইনারের গায়ে ইংরেজিতে লেখা- 'গোল্ড' এবং 'পঁচিশ টন' শব্দ দুটি। ফরাসিদের চিরশত্রু ব্রিটিশরা রাস্তার বামপাশে গাড়ি চালায় বলে তারা একই কাজের জন্য ডানপাশ বেছে নিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শত্রুতার জের ধরে এরা এখনও মননে-চিন্তায় একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে। ব্রিটিশরা পা দিয়ে হাঁটছে। এর বিকল্প হিসেবে হাত দিয়ে হাঁটা সম্ভব হলে ফরাসিরা তাই-ই করত। কিন্তু দেখ, শোষণের বেলায় এদের একে অন্যের সাথে কত সাদৃশ্য! কনটেইনারের গায়ে ব্রিটিশদের ভাষা ইংরেজিতে 'গোল্ড' লিখতে এদের আর জাত যায় না। সাম্রাজ্যবাদ আর শোষণের বিস্তৃতিতে মোক্ষ এই ভাষাটা জায়গামতো তারা ঠিকই ব্যবহার করছে। ফ্রেঞ্চে কথা বলা আইভরিয়ানরা ইংরেজি ভাষাটা পড়তে পারলেও এর অর্থ বোঝে না! নির্জন মহাসড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা যে কোনো আইভরিয়ানের চোখে এই শোষণ তাই আলাদা কোনো দ্যোতনা তৈরি করে না। তার আগুনের মতো লাল চোখ দুটোতে এত স্বপ্নহীনতা (নিজস্ব ভাষাহীনতা স্বপ্নহীনতা তৈরি করে) যে, তাতে প্রতিবাদের ভাষা ধিকিধিকি আগুন হয়ে নয়, বরং অধিকারহীনতার বিস্ময় হয়ে খেলা করে। ফরাসিরা সেজন্যই সবার আগে এই জাতির ভাষা বিলুপ্ত করে দিয়েছে। এখন আমি ভাষার মহান শক্তিটা উপলব্ধি করি। আর শ্রদ্ধাবনত হই সেইসব মহান আত্মার প্রতি যারা বাংলা ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। প্রয়োজন অনুভব করি শক্তিশালী কোনো গল্পের; যা উপন্যাসে বিধৃত হয়ে সৃষ্টি হয় মহান কোনো উপন্যাস। ভাষাকে প্রাণদায়িনী করার জন্য শক্তিশালী উপন্যাসের চেয়ে আর কিছু বড় ভূমিকা রাখতে পারে না। ভাষার জীবনিশক্তি কবিতা হলে তার বহমানতা ধারণ করে উপন্যাস।
কনটেইনারগুলো আমাদের চেকপোস্ট অতিক্রম করছে। কনটেইনারগুলোর গায়ে বড় করে ইংরেজিতে 'গোল্ড' লেখা থাকলেও তার ভেতর আসলে সোনার খনিজ রূপ যা 'ওড়' নামে পরিচিত। এগুলো ফরাসি সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পোর্ট সান-পেদ্রোতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেখান থেকে আটলান্টিক হয়ে এগুলোর গন্তব্য ফ্রান্সে। নেপোলিয়নের যুদ্ধে এত সমরসজ্জা ছিল না বোধ হয়। কনটেইনার পরিবাহী প্রতিটি ট্রাকের সামনে এবং পেছনে একটি করে ট্যাঙ্ক। ফরাসি পতাকাবাহী দশটা জিপ, দশটা সামরিক রসদ এবং অস্ত্র-গোলাবারুদ বহনকারী ট্রাক। প্রতিটিতে চতুর্মুখী পাহারায় লিকর্ন আর্মি (ফরাসি সেনাবাহিনীর কোড নাম)। তাদের জন্য ফরাসি জাহাজ সাগর-বন্দরে অপেক্ষা করছে। এ দেশের নিরাপত্তা দেওয়ার বিভ্রান্তি ছড়িয়ে লিকর্ন জালের মতো ক্যাম্প তৈরি করে এই শোষণযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। এই আধুনিক বিশ্বে!
মজার ব্যাপার হলো, এ দেশের সরকার ডালোয়া অতিক্রমের পর পোর্ট সান পেদ্রো যাওয়ার রাস্তা নিরাপদ নয় বলে জাতিসংঘ বাহিনীর জন্যও 'নিষিদ্ধ' করে রেখেছে। ঐ রাস্তাটা ইয়াং প্যাট্রিয়ট নামের সশস্ত্র দলটির নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু ফরাসিরা তাদের পণ্যগুলো এই পথেই নিয়ে যাবে। আর তাদের পাহারা আরও নিশ্চিত করবে জাতিসংঘকেও পাত্তা না দেওয়া ইয়াং প্যাট্রিয়ট দলের নেতা মাও ডানিস। এখানে স্বার্থ আর ভাগাভাগি নিয়ে দারুণ তৎপর বিভিন্ন দল-গোত্র ব্যস্ত হলেও সাধারণ মানুষ দেশটির তিলোত্তমা নগরী আবিদজানে বাস তো করতে পারেই না বরং দেশটির অন্যান্য অংশ থেকে থেকে আসা মানুষদের এই শহরে ঢুকতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। শহরের প্রবেশ মুখগুলো সেনাবাহিনী দ্বারা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। বিদেশি সেনারা তাদের শহরে প্রবেশে বাধা দেয় না। কিন্তু রাজধানীর বাইরে থেকে নিজ দেশেরই আসা মানুষগুলো তাদের প্রয়োজন মোতাবেক ভিসা প্রদানের মতো করে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। অনুমোদিত দিনের বাইরে থাকলে শাস্তি এবং জরিমানা দুইয়েরই বিধান আছে। কারণ, তারা শহরে বসবাসরত প্রচুর বিদেশির (আটলান্টিকের লেগুনে গড়ে ওঠা আবিদজান বস্তুত ফরাসি/ইউরোপীয়দের স্বর্গ-শহর) নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়। হায়, স্বাধীনতা!
আর আমরা? জাতিসংঘ বাহিনী? নিরাপত্তার ধুয়া তুলে চেকপোস্টে প্রতিজন নাগরিককে নিরীক্ষা করে তাদের জীবনের জন্য আমরা কত গুরুত্বপূর্ণ সেই ধারণা তৈরি করি। লিকর্ন আর্মির সমর বহর যাওয়ার সময় সব ব্যারিকেড দ্রুত তুলে দিয়ে তাদের সাথে হাত তুলে শুভেচ্ছা বিনিময় করি। এসব তল্লাশি চৌকিতে তাদের বহর আরও গতিসম্পন্ন হয়। ওরা সব ওড় নিয়ে যায়। কোত দি ভোয়ার জনগণের জন্য আমার হৃদয় ভেঙে যায়।
আমি আমার এই কাঠের ঘর থেকে চেয়ে চেয়ে দেখি। এই ঘরটাও লিকর্ন আর্মির তৈরি। এটা তাদেরই ক্যাম্প ছিল কোনো এক কালে। ফরাসি সরকার সম্পদ আহরণের নামে পৃথিবীর মানব সম্পদ অপচয় করছে। জাতিসংঘ বাহিনীর পঁয়তাল্লিশ ভাগ খরচ তারা বহন করছে। আছে তাদের ডেপ্লয়মেন্ট খরচ। এত খরচ করার চেয়ে যুদ্ধটা (যুদ্ধ কোথাও নেই আসলে। শোষণের জন্য আছে যুদ্ধ প্রস্তুতির ডামাডোল আর যান্ত্রিক সমরসজ্জা) থামালেই ঝামেলা মিটে যায়। তবু এই প্রহসন পৃথিবীতে চলবে। এ দেশে যুদ্ধটা কেন, জানো? কারণ দেশের উত্তরের পাহাড়ি অঞ্চলে কোনো উন্নয়ন নেই বলে তারা স্বাধীনতা চায়। ফরাসিরা তাদের নেতাকে যেমন নারী-বাড়ি দিয়ে স্বাধীন হয়ে যাওয়ার মদত দিয়েছে তেমনি নারী-বাড়ি-গাড়ির সাথে অতিরিক্ত উপঢৌকন হিসেবে কয়েক মিলিয়ন ডলার দিয়ে তারাই দেশটির বাগবো নামের প্রেসিডেন্টকে কঠিন হাতে উত্তরের সন্ত্রাসীদের দমন করতে বলেছে। এই ডামাডোলে আহত হয়েছে চল্লিশজন আর অদ্যাবধি নিহত হয়েছে চারজন। খেয়াল করে দেখো, দুই সংখ্যাতেই আছে একটা চার আর বাকি একটা শূন্য। ব্যাপারটা আমার কাছে রহস্যময় আর চার সংখ্যার এক খেলা মনে হয়। আর তথ্যটাকে মনে হয়, ভুয়া। আরও মনে হয়, 'চার' আসলে এক অপারেশনাল কোড-ওয়ার্ড অথবা চারটা দেশ/দল দেশটার সব স্বার্থ ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। কোনো ঘটনায় মাত্র চারজন নিহত হলে তাকে কেন গৃহযুদ্ধের তকমা দিয়ে জাতিসংঘকে লাফিয়ে এখানে আসতে হবে? বাংলাদেশে চার হাজার মানুষ মরলেও কি এই তকমা তার কপালে পরিয়ে জাতিসংঘ তার সামরিক (আসলে অর্থনৈতিক) শক্তি নিয়ে সেখানে যাবে? যাবে না। কারণ নির্জন এই প্রান্তরে আছে দামি কাঠ, সোনা এবং খনিজ সম্পদ। বাংলাদেশের মতো জনবহুল দরিদ্র দেশের গ গোল অথবা গৃহযুদ্ধ, মহামারির মতো মৃত্যু অথবা দারুণ সব সম্পদ আবিস্কারে মহান এই সংস্থাটির কিছুই এসে যায় না। বিশ্বকে মিডিয়ার ননি আর ঘোল খাইয়ে নিরাপদে বড় মামাদের স্বার্থ উদ্ধার করাই যাদের কাজ, তারা তো মৃতের সংখ্যা গোনে না। তারা খনিজ সম্পদে লুকিয়ে থাকা ডলারের ঘ্রাণ শোকে!
এই গেল যুদ্ধের প্রয়োজনীয় এবং বাহ্যিক কারণ। কিন্তু এর একটা মনস্তাত্ত্বিক কারণ আছে। তা হলো, শক্তিমত্তা দেখানো এই পৃথিবীর এখন এক বড় প্রয়োজন। এখানে উত্তেজনার মজা আছে। আছে উত্তেজিত হওয়ার আনন্দ। যে আনন্দ ক্লান্তিকে ডেকে আনার এক মহড়া মাত্র। ক্লান্তির পর বিশ্রাম এবং প্রশান্তি এবং বিজয়গাথাকে উদযাপনের এই মনস্তত্ত্ব থেকে মানব সভ্যতা কোনোকালেই রেহাই পায়নি। মনে হয়, কোনোদিন মানব প্রজাতি এখান থেকে পরিত্রাণ পাবেও না। শিকার করে খাদ্য সংগ্রহের কারণে গঠিত ডিএনএ কি এত দ্রুত বদলানো যায়? যায় না বলেই ওপরে ওপরে সভ্যতার ভান ধরার এই ভ ামি রপ্ত করায় সাম্রাজ্যবাদী মানুষ এক অনন্য প্রাণী হয়ে উঠছে। সৃষ্টির ক্লান্তি পরিপূর্ণ ক্লান্তি নয়। পুনরায় তা সৃষ্টি করতে বলে। ধ্বংসের ক্লান্তি সত্যিকারের ক্লান্তি। এই ক্লান্তিতে আকণ্ঠ ডুবে বিজয়োল্লাস উদযাপনের জন্য সাম্রাজ্যবাদীরা আজ মরিয়া বলে, মানুষের রক্তের রংকেও তাদের গাত্রবর্ণের মতোই তারা দেখে।
আমার কাঠের ঘরের সাথেই একটা গোলঘর। দুটোই ভূমি থেকে সমান উচ্চতার সমান্তরালে। পশ্চিমে নিবিড় বন। পাঁচশ গজ দূরে একলা একটা পাথুরে পাহাড়। যেন এই বন আর ঐ পাহাড় অনন্তকাল তাকিয়ে আছে- একে অন্যের পানে। ওরা সারাদিন, সারারাত কী সব ফিসফিস কথা বলাবলি করে! গোলঘর থেকে অবাক বিস্ময়ে এই বিমূর্ত প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকি। একটু লিখি, কিছুটা পড়ি। চমকে ওঠে ক্যালেন্ডারের পাতায় চোখ রাখি। ৩৬৫ দিনের আজকে কততম দিন?
পূর্ণিমা শুরুর তিন-চার দিন আগে এখানে এসেছিলাম। মায়াবী জোছনাপল্গাবিত চারদিকের বন আর নিঃসীম নীরবতার মাঝে অসীম কোনো এক আর্তস্বর আমাকে কোন এক অচিন গ্রহবাসী করে তোলে। আফ্রিকার বনের ভয়ংকর গভীর ডাক- একটানা সুরের মূর্ছনাগীত হয়ে যায়। বনের শূন্যগর্ভের অস্তিত্বের ওপরে; তার রেখা যেখানে অস্পষ্ট হয়েও জোছনার আলো গলাধঃকরণ করে অবিচল; আমি যেন আলো আর অন্ধকার এই দুই রেখার মাঝখানে চুপটি করে লুকিয়ে আছি। আলোর আহ্বান এবং বনের রেখা বরাবর অন্ধকারে কতসব পোকামাকড়ের প্রলয়। বিমূর্ত সুরের মূর্ছনার তান। পৃথিবীর সব অন্ধকার এবং সব আলো; প্রকৃতির সব রং, দৃশ্যমান-অদৃশ্য ভূমিসদৃশ অন্তর্লোক দিয়ে দেখার চেষ্টা করি। একশ বছর আগের, একশ বছর পরের মানবপরম্পরা কোথায় যেন অচেনা তানে গান গেয়ে ফিরে। ভাবি, মানুষ ছাড়া এই পৃথিবী কি এমনি এক আদিস্বরে বিভোর ছিল মিলিয়ন মিলিয়ন বছর? কারা যেন কথা বলে। এই বনের আঁধারে। নিঃসীম আকাশের জোছনালোকে। সাসান্দ্রার কালো জলে। কারা? ধ্যানমগ্ন ধ্যানী এই পৃথিবীর ভাষা বোঝার চেষ্টা করি। বিষণ্ণ, ব্যাকুল আমারই ভিতর কি মানবাত্মার প্রজন্মান্তরের ভাষা খুঁজে ফিরছে? তাহলে আমিও কি নিঃসঙ্গতা এড়াতে এই বনের অসংখ্য প্রাণের আর্তস্বরে মিলিয়েছি নিজের প্রাণস্বর? আমিও বনের অসংখ্য সৃষ্টির মতো সামান্য এক প্রাণ মাত্র! পার্থক্য শুধু তারা ডেকেই চলছে আর আমি তাদের আর্তস্বরের ভাষা খুঁজে ফিরছি আমার একান্ত অনুভবে।
চুপচাপ ঐ নীলাকাশ। বনের শেষ রেখা। জোছনার অবারিত বিহার। সবখানে অজানা এক ভাষার ফিসফিস কানাকানি। আমি তার অনুপ্রাস আবিস্কারে নিজের স্নায়ুতন্ত্রকে উন্মুখ রাখি। আমি হয়তো খুঁজে ফিরি আমার ভেতরের একান্ত ভুবনকে, তার অনুভবে ডানা মেলা ভিন্ন এক স্বরকে। এই স্বরটা আমার উপন্যাসের ভাষার জন্যও প্রয়োজন। নির্ভার চাঁদ তার অবস্থান বদলায়। কী জানি, মাঝে মাঝে মনে হয়- এই বন, ঐ আকাশ- সবাই নিঝুম মগ্নতায় খুঁজে ফিরছে, প্রতিধ্বনিত করে চলছে আমারই হৃদয়ের ফিসফিস। এই আধো-আঁধারির নির্জন ধরাতলে যে এত কথা বলে সে আর কেউ নয়- আমারই সত্তা।
আমি কি আসলে একটা উপন্যাস সৃষ্টির মগ্নতাকে ধারণ করতে চাইছি? আমার প্রথম উপন্যাস (এতদিন ধরে লিখেও উপন্যাসের নামটা ঠিক করতে পারিনি)! প্রথম ভালোবাসার মতো। তার জন্য প্রয়োজন মগ্নতা। নিজেকে বোঝাই, একজন ঔপন্যাসিককে একই সাথে যেমন প্রকৃতির অংশ হয়ে যেতে হয় তেমনি সত্যকে, বাস্তবের অন্তরালের পরাবাস্তবতাকে দেখার জন্য তার চরম নিরপেক্ষ এক দৃষ্টিও থাকতে হয়। সেই দৃষ্টি যা খুঁজে ফিরে মানুষের জীবনার্তিকে। প্রকৃতির গোপন ভাষাকে। মানুষের প্রেম-ভালোবাসা আর তাদের স্বপ্নের আখ্যানকে।
আমার ঘুম পায়। দেখি, চাঁদের হাসিতেও ঘুম ঘুম। ঢলে পড়েছে সে পশ্চিমাকাশে!
রাস্তায় জাতিসংঘের কাজের অংশ হিসেবে (যেন দেশটির উত্তরের স্বাধীনতাকামী বিবদমান দলের সাথে দক্ষিণের সরকার সমর্থিত ইয়াং প্যাট্রিয়ট দলের সংঘর্ষ না বাধে তার জন্য) রাস্তায় আমাদের সেনাবাহিনীর তল্লাশি চৌকি। এ ছাড়া মহাসড়কটিতে একটু পরপর রয়েছে ফানসির (দেশটির সেনাবাহিনী ও পুলিশের সম্মিলিত দল) তল্লাশি চৌকি। প্রতিটি তল্লাশি চৌকিতে প্রতিজন মানুষের থলের প্রতিটি দ্রব্য রাস্তায় সাজিয়ে রেখে প্রদর্শন করার পর নিজেদের পরিচয়পত্র দেখিয়ে এ দেশের নাগরিক ছাড়া পায়। পঁচিশ থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার পরপর চলছে এই মহাযজ্ঞ। সাথে চলছে চাঁদাবাজি। এই চাঁদাবাজি সরকারি মদতেই হচ্ছে। সরকার আর্থিক সঙ্কট দেখিয়ে তার পুলিশ, সেনাবাহিনীর বেতন বন্ধ করে দিয়েছে। তাই তারা চাঁদাবাজির নাম দিয়েছে ট্যাক্সিং। এই পন্থায় সরকারি বাহিনীর সদস্যরা দামি গাড়ি (ফ্রান্সের পিজোট থেকে মার্সিডিজ, বিএমডব্লিউ) হাঁকছে। প্রেসিডেন্টকে ফরাসিরা প্যারিসে তিন স্ত্রী (যারা নাকি মডেলকন্যা বিধায় তারাও মিটিয়ে নিচ্ছে তাদের বিকৃত সাধ) আর কয়েকটা বাড়ি উপহার দিয়ে ক্ষমতার ধ্বজাধারীতে বুঁদ করে রেখে কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে সমগ্র জাতির সব স্বপ্ন!
মানুষগুলো তবু নির্বিকার। কারণ এদের নিজস্ব ভাষাটুকু ফরাসিরা কেড়ে নিয়েছে। ফ্রেঞ্চে কথা বলা এ দেশের মানুষের সাথে আমি কথা বলে দেখেছি, কয়েকশ বছর আগে 'পেত্তি' নামের এদের নিজস্ব যে ভাষা ছিল তা সম্পর্কে এরা কিছুই জানে না। যেন ফ্রেঞ্চই তাদের মাতৃভাষা! আফ্রিকান এই জাতিকে কাছ থেকে দেখে আমি শিখেছি, কোনো জাতিকে শোষণ করতে চাইলে, তাদের প্রতিবাদহীন করতে চাইলে তাদের মাতৃভাষাকে কেড়ে নিতে হয়। আরও শিখেছি, মায়ের ভাষার মতো করে আর কোনো ভাষার অনুপ্রাস মানবসন্তানদের সত্তায় মনুষ্য আবেগের যে শ্রেষ্ঠত্ব তার অনুরণনে অনুরিত হয় না বলে, প্রতিবাদের শব্দের ধার কমে যায়। শব্দের ধার তরবারির ধারের চেয়ে কম শক্তিশালী নয়।
পশ্চিম আফ্রিকার এই অঞ্চলের মানুষের এই ভাষা হারানোর ফলে এখানে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের যে বিস্তৃতি তা স্পষ্ট করতেই জীবনে প্রথম কলম ধরেছি। লিখছি এক উপন্যাস। কী এক অদ্ভুত ঘোরের বশে শুধু লিখে যাই। এতগুলো চরিত্র নিয়ে এই সৃষ্টিকাজে মগ্ন হওয়ার বেদনাও এত মধুর আর আনন্দময়- কী করে বোঝাব? পরের পাতায় কী লিখব জানি না। নিজের আত্মার আলো জ্বেলে অপেক্ষা করি শব্দের জন্য। মায়ের ভাষা কী অদ্ভুত মায়ায় আমার হৃদয়কে উদ্ভাসিত করে চলে! নরখাদক এলাকায় একজন কর্নেলকে উদ্ধারে, আফ্রিকান উপজাতীয়দের সংস্কৃতিকে সৃষ্টির মাঝে আমি রেখে যাচ্ছি উপমার ইঙ্গিত। একটা জাতির ভাষা হারানোর বেদনাকে এই *উপন্যাসে আমি ধরতে চাই। জানি না, পারব কিনা।
এদের পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ আছে। কিন্তু সাধারণ জনগণের জন্য বিদ্যুতের মূল্য আকাশচুম্বী বলে এরা তা ব্যবহারের মতো দুঃস্বপ্ন দেখে না। বাংলাদেশের আড়াই গুণ বড় হলেও এইডসের কারণে দেশটির জনসংখ্যা মাত্র চৌদ্দ মিলিয়ন। মফস্বল শহরের কুঁড়েঘরগুলো অপরিচ্ছন্ন, এলোমেলো হলেও ভূমির পর্যাপ্ততার কারণে শহরের কাঠামো অত্যন্ত পরিকল্পিত। পরিকল্পিত অথচ এলোমেলো এই শহরগুলোতে অনন্ত সময় যেন থমকে থাকে বলে তা সৃষ্টিশীল ভাবনাকে উসকেও দেয়। যেমন, আফ্রিকার গ্রাম, আমাদের দেশের কোনো থানা অথবা গঞ্জের চেয়েও কম দোকানপাটের এইসব দৃশ্য আর মানুষের মৃদু কলতান মুখরিত ঝাঁঝালো রোদের শহরে থমকে থাকা 'সময়' আমার 'স্মৃতি'কে আর অনুভবকে একদিন খুব তাড়া করবে। আমি জানি, আফ্রিকা নিয়ে আমি নস্টালজিক হয়ে উঠব!
এইসব জনপদ মানেই নাইট-ক্লাব আর বার। একটু রাত হলেই এরা সৃষ্টিশীলতায় নয় বরং হাই ভলিউমে গান ছেড়ে মেতে ওঠে নৃত্য আর মদে। এ এদের রক্তের নেশা। এদের সত্তাকে পঙ্গু করে রাখার মারণাস্ত্র নামের এই সংস্কৃতিও ফরাসিদের আমদানি করা। সলিব্রা নামের মদ তৈরির বিশাল বিশাল কারখানাগুলো থেকে উৎপাদিত এক বোতল মদ বাংলাদেশি টাকায় বিশ টাকার সমমূল্যের হলেও এখানে এক বোতল মিনারেল ওয়াটার ষাট টাকায় কিনতে হয়। ওষুধ এবং কনডমের দাম সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। মদে প্রচুর ভর্তুকি থাকলেও পৃথিবীর সর্বোচ্চ কাকাও উৎপাদনকারী দেশটি চড়া দামে কেনা ওষুধেও চড়া কর বসায়। আফ্রিকার জনসংখ্যা যেন কোনোদিন না বেড়ে যায়- এটা হয়তো সেই স্ট্র্যাটেজিরই কোনো অংশ।
তবে শ্রেষ্ঠ মানবভ্রূণ ধারণের জন্য এ দেশের নারীদের স্বাধীনভাবে জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়া এবং সন্তান জন্মদানে নারীর একক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সংস্কৃতি অনবদ্য। এখানে নারীরা একসাথে তিনজন পুরুষকে তার স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। যাকে ইচ্ছা পরিত্যাগও করতে পারে এবং মজার ঘটনা হলো, নারীটা গর্ভে কার সন্তান ধারণ করছে তা সে বলতে বাধ্য নয় মোটেও। স্বামীরই সন্তান ধারণ করতে হবে এমন বাধ্যবাধকতাও নেই এখানে। কী অদ্ভুত! নারীকে সন্তান ধারণের ক্ষেত্রে এমন একজন সম্রাজ্ঞী বানানোর সংস্কৃতিকে ধারণ এবং লালনে যেসব পুরুষ তাদের চেতনা ব্যয় করেছেন- তাদেরকে মহান বলতেই হয়। এখানেই দেশটির ভবিষ্যৎ গোপন এক শক্তি নিহিত। কেননা, নারীদের গর্ভ শ্রেষ্ঠ বীজটুকুই ধারণ করতে চায় বলে আমার মনে হয়। নারীদের চোখে এই শ্রেষ্ঠত্ব আর কিছু নয়। তার ধরন হয়তো মানুষ হিসেবে তার টিকে থাকার সম্ভাবনা, তার উদারতা, ভালোবাসার সামর্থ্য এবং অবশ্যই শারীরিক উপযুক্ততা।
আমরা এ দেশের জনগণের ভালোবাসা অর্জনের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা ক্যাম্পেইন পরিচালনা করি। এইডস থেকে নিরাপদ থাকার জন্য কনডম তাদের ব্যবহারের পরামর্শ দিলে এমন উদ্ভ্রান্ত পরামর্শের জন্য তাদের মুখ হাঁ হয়ে যায়। মূল্য দিয়ে যৌনানন্দে বিঘ্ন ঘটানোর মতো নির্বোধ যে তারা নয়, তা যেন তার হাঁ-মুখের ঝুলে থাকা দুই ঠোঁট স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দেয়। কনডম কেনার অর্থ খরচের চেয়ে মদ খেয়ে মরে গিয়ে আবার তারুণ্যময় পুনর্জন্ম তাদের অনেক বেশি কাম্য। উল্লেখ্য, এদেরকে কে বা কারা শিখিয়েছে যে, যে বয়সে তুমি মৃত্যুবরণ করবে ঠিক সেই বয়স নিয়েই তুমি অনন্ত পুনর্জন্ম পাবে! কী অদ্ভুত মনস্তত্ত্ব। সাম্রাজ্যবাদ শুধু সেনাবাহিনী দিয়েই হয় না, সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় একটা জাতির চেতনাকে, তাদের মনস্তত্ত্বকে প্রভাবিত অথবা পঙ্গু করে দিতে হয়!
এ দেশে শিক্ষাসামগ্রীর মূল্যও আকাশচুম্বী। এদের শিশুতোষ বইয়ে যে গল্পগুলো সন্নিবেশ করা হয়েছে সেখানে পিশাচ, কোনো খল চরিত্র অথবা ভৌতিক আত্মার প্রাণীকে দেখানো হয়েছে এ দেশেরই মানুষের মতো কালোদের প্রতিভূ করে। অন্যদিকে ভালো আর স্বর্গীয় সব চরিত্র যারা মানুষের মঙ্গলের জন্য মরিয়া তাদের দেখানো হয়েছে সাদা (ইউরোপীয়) মানুষের প্রতিভূ করে। সাদা দেশ, সাদা মানুষ যদি শৈশবেই কল্পনার স্বপ্ন হয়ে যায় তাহলে বড় হয়ে তাদের চিন্তাটা কেমন হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। এ দেশকে শোষণের সবচেয়ে বড় মূলমন্ত্র নামক বীজটি এখানেই প্রোথিত।
প্রচুর সম্পদ এ দেশে। গত বছর আইভরি কোস্ট তিন বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্যসামগ্রী আমদানি করেছে। রপ্তানি করেছে ৮.৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের খাদ্য ও পণ্য। পাথুরে হলেও সার অথবা রাসায়নিক দ্রব্যের কবল থেকে চিরকাল মুক্ত এ দেশের ভূমি তাই দারুণ খনিজসমৃদ্ধ ফসল ফলায়, যা ধারণ করে মানবশরীরের জন্য প্রয়োজনীয় লবণ। বাংলাদেশের পলিসমৃদ্ধ জমিতে এত সার আর কীটনাশক ব্যবহার হয় যে, আমার ধারণা, আমাদের ভূমি আফ্রিকার ভূমির মতো এত খনিজ লবণসমৃদ্ধ ফল-খাদ্য উৎপাদন করতে আর সক্ষম নয়। হলুদ কলার ভেতর কেমন লাল টুকটুকে রং আর তার কী অপূর্ব স্বাদ। মুখেই যেন গলে যায়। পেঁপেগুলো গাছেই পচে যায়। এত ফল পাখিদের পক্ষেও খাওয়া সম্ভব নয়।
তোমাকে লিখছি আর দেখছি- দশটি বিশালাকৃতির কনটেইনার নিয়ে কার্গো ট্রাকগুলো আমদের ক্যাম্প অতিক্রম করছে। প্রতিটি কনটেইনারের গায়ে ইংরেজিতে লেখা- 'গোল্ড' এবং 'পঁচিশ টন' শব্দ দুটি। ফরাসিদের চিরশত্রু ব্রিটিশরা রাস্তার বামপাশে গাড়ি চালায় বলে তারা একই কাজের জন্য ডানপাশ বেছে নিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শত্রুতার জের ধরে এরা এখনও মননে-চিন্তায় একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে। ব্রিটিশরা পা দিয়ে হাঁটছে। এর বিকল্প হিসেবে হাত দিয়ে হাঁটা সম্ভব হলে ফরাসিরা তাই-ই করত। কিন্তু দেখ, শোষণের বেলায় এদের একে অন্যের সাথে কত সাদৃশ্য! কনটেইনারের গায়ে ব্রিটিশদের ভাষা ইংরেজিতে 'গোল্ড' লিখতে এদের আর জাত যায় না। সাম্রাজ্যবাদ আর শোষণের বিস্তৃতিতে মোক্ষ এই ভাষাটা জায়গামতো তারা ঠিকই ব্যবহার করছে। ফ্রেঞ্চে কথা বলা আইভরিয়ানরা ইংরেজি ভাষাটা পড়তে পারলেও এর অর্থ বোঝে না! নির্জন মহাসড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা যে কোনো আইভরিয়ানের চোখে এই শোষণ তাই আলাদা কোনো দ্যোতনা তৈরি করে না। তার আগুনের মতো লাল চোখ দুটোতে এত স্বপ্নহীনতা (নিজস্ব ভাষাহীনতা স্বপ্নহীনতা তৈরি করে) যে, তাতে প্রতিবাদের ভাষা ধিকিধিকি আগুন হয়ে নয়, বরং অধিকারহীনতার বিস্ময় হয়ে খেলা করে। ফরাসিরা সেজন্যই সবার আগে এই জাতির ভাষা বিলুপ্ত করে দিয়েছে। এখন আমি ভাষার মহান শক্তিটা উপলব্ধি করি। আর শ্রদ্ধাবনত হই সেইসব মহান আত্মার প্রতি যারা বাংলা ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। প্রয়োজন অনুভব করি শক্তিশালী কোনো গল্পের; যা উপন্যাসে বিধৃত হয়ে সৃষ্টি হয় মহান কোনো উপন্যাস। ভাষাকে প্রাণদায়িনী করার জন্য শক্তিশালী উপন্যাসের চেয়ে আর কিছু বড় ভূমিকা রাখতে পারে না। ভাষার জীবনিশক্তি কবিতা হলে তার বহমানতা ধারণ করে উপন্যাস।
কনটেইনারগুলো আমাদের চেকপোস্ট অতিক্রম করছে। কনটেইনারগুলোর গায়ে বড় করে ইংরেজিতে 'গোল্ড' লেখা থাকলেও তার ভেতর আসলে সোনার খনিজ রূপ যা 'ওড়' নামে পরিচিত। এগুলো ফরাসি সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পোর্ট সান-পেদ্রোতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেখান থেকে আটলান্টিক হয়ে এগুলোর গন্তব্য ফ্রান্সে। নেপোলিয়নের যুদ্ধে এত সমরসজ্জা ছিল না বোধ হয়। কনটেইনার পরিবাহী প্রতিটি ট্রাকের সামনে এবং পেছনে একটি করে ট্যাঙ্ক। ফরাসি পতাকাবাহী দশটা জিপ, দশটা সামরিক রসদ এবং অস্ত্র-গোলাবারুদ বহনকারী ট্রাক। প্রতিটিতে চতুর্মুখী পাহারায় লিকর্ন আর্মি (ফরাসি সেনাবাহিনীর কোড নাম)। তাদের জন্য ফরাসি জাহাজ সাগর-বন্দরে অপেক্ষা করছে। এ দেশের নিরাপত্তা দেওয়ার বিভ্রান্তি ছড়িয়ে লিকর্ন জালের মতো ক্যাম্প তৈরি করে এই শোষণযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। এই আধুনিক বিশ্বে!
মজার ব্যাপার হলো, এ দেশের সরকার ডালোয়া অতিক্রমের পর পোর্ট সান পেদ্রো যাওয়ার রাস্তা নিরাপদ নয় বলে জাতিসংঘ বাহিনীর জন্যও 'নিষিদ্ধ' করে রেখেছে। ঐ রাস্তাটা ইয়াং প্যাট্রিয়ট নামের সশস্ত্র দলটির নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু ফরাসিরা তাদের পণ্যগুলো এই পথেই নিয়ে যাবে। আর তাদের পাহারা আরও নিশ্চিত করবে জাতিসংঘকেও পাত্তা না দেওয়া ইয়াং প্যাট্রিয়ট দলের নেতা মাও ডানিস। এখানে স্বার্থ আর ভাগাভাগি নিয়ে দারুণ তৎপর বিভিন্ন দল-গোত্র ব্যস্ত হলেও সাধারণ মানুষ দেশটির তিলোত্তমা নগরী আবিদজানে বাস তো করতে পারেই না বরং দেশটির অন্যান্য অংশ থেকে থেকে আসা মানুষদের এই শহরে ঢুকতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। শহরের প্রবেশ মুখগুলো সেনাবাহিনী দ্বারা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। বিদেশি সেনারা তাদের শহরে প্রবেশে বাধা দেয় না। কিন্তু রাজধানীর বাইরে থেকে নিজ দেশেরই আসা মানুষগুলো তাদের প্রয়োজন মোতাবেক ভিসা প্রদানের মতো করে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। অনুমোদিত দিনের বাইরে থাকলে শাস্তি এবং জরিমানা দুইয়েরই বিধান আছে। কারণ, তারা শহরে বসবাসরত প্রচুর বিদেশির (আটলান্টিকের লেগুনে গড়ে ওঠা আবিদজান বস্তুত ফরাসি/ইউরোপীয়দের স্বর্গ-শহর) নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়। হায়, স্বাধীনতা!
আর আমরা? জাতিসংঘ বাহিনী? নিরাপত্তার ধুয়া তুলে চেকপোস্টে প্রতিজন নাগরিককে নিরীক্ষা করে তাদের জীবনের জন্য আমরা কত গুরুত্বপূর্ণ সেই ধারণা তৈরি করি। লিকর্ন আর্মির সমর বহর যাওয়ার সময় সব ব্যারিকেড দ্রুত তুলে দিয়ে তাদের সাথে হাত তুলে শুভেচ্ছা বিনিময় করি। এসব তল্লাশি চৌকিতে তাদের বহর আরও গতিসম্পন্ন হয়। ওরা সব ওড় নিয়ে যায়। কোত দি ভোয়ার জনগণের জন্য আমার হৃদয় ভেঙে যায়।
আমি আমার এই কাঠের ঘর থেকে চেয়ে চেয়ে দেখি। এই ঘরটাও লিকর্ন আর্মির তৈরি। এটা তাদেরই ক্যাম্প ছিল কোনো এক কালে। ফরাসি সরকার সম্পদ আহরণের নামে পৃথিবীর মানব সম্পদ অপচয় করছে। জাতিসংঘ বাহিনীর পঁয়তাল্লিশ ভাগ খরচ তারা বহন করছে। আছে তাদের ডেপ্লয়মেন্ট খরচ। এত খরচ করার চেয়ে যুদ্ধটা (যুদ্ধ কোথাও নেই আসলে। শোষণের জন্য আছে যুদ্ধ প্রস্তুতির ডামাডোল আর যান্ত্রিক সমরসজ্জা) থামালেই ঝামেলা মিটে যায়। তবু এই প্রহসন পৃথিবীতে চলবে। এ দেশে যুদ্ধটা কেন, জানো? কারণ দেশের উত্তরের পাহাড়ি অঞ্চলে কোনো উন্নয়ন নেই বলে তারা স্বাধীনতা চায়। ফরাসিরা তাদের নেতাকে যেমন নারী-বাড়ি দিয়ে স্বাধীন হয়ে যাওয়ার মদত দিয়েছে তেমনি নারী-বাড়ি-গাড়ির সাথে অতিরিক্ত উপঢৌকন হিসেবে কয়েক মিলিয়ন ডলার দিয়ে তারাই দেশটির বাগবো নামের প্রেসিডেন্টকে কঠিন হাতে উত্তরের সন্ত্রাসীদের দমন করতে বলেছে। এই ডামাডোলে আহত হয়েছে চল্লিশজন আর অদ্যাবধি নিহত হয়েছে চারজন। খেয়াল করে দেখো, দুই সংখ্যাতেই আছে একটা চার আর বাকি একটা শূন্য। ব্যাপারটা আমার কাছে রহস্যময় আর চার সংখ্যার এক খেলা মনে হয়। আর তথ্যটাকে মনে হয়, ভুয়া। আরও মনে হয়, 'চার' আসলে এক অপারেশনাল কোড-ওয়ার্ড অথবা চারটা দেশ/দল দেশটার সব স্বার্থ ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। কোনো ঘটনায় মাত্র চারজন নিহত হলে তাকে কেন গৃহযুদ্ধের তকমা দিয়ে জাতিসংঘকে লাফিয়ে এখানে আসতে হবে? বাংলাদেশে চার হাজার মানুষ মরলেও কি এই তকমা তার কপালে পরিয়ে জাতিসংঘ তার সামরিক (আসলে অর্থনৈতিক) শক্তি নিয়ে সেখানে যাবে? যাবে না। কারণ নির্জন এই প্রান্তরে আছে দামি কাঠ, সোনা এবং খনিজ সম্পদ। বাংলাদেশের মতো জনবহুল দরিদ্র দেশের গ গোল অথবা গৃহযুদ্ধ, মহামারির মতো মৃত্যু অথবা দারুণ সব সম্পদ আবিস্কারে মহান এই সংস্থাটির কিছুই এসে যায় না। বিশ্বকে মিডিয়ার ননি আর ঘোল খাইয়ে নিরাপদে বড় মামাদের স্বার্থ উদ্ধার করাই যাদের কাজ, তারা তো মৃতের সংখ্যা গোনে না। তারা খনিজ সম্পদে লুকিয়ে থাকা ডলারের ঘ্রাণ শোকে!
এই গেল যুদ্ধের প্রয়োজনীয় এবং বাহ্যিক কারণ। কিন্তু এর একটা মনস্তাত্ত্বিক কারণ আছে। তা হলো, শক্তিমত্তা দেখানো এই পৃথিবীর এখন এক বড় প্রয়োজন। এখানে উত্তেজনার মজা আছে। আছে উত্তেজিত হওয়ার আনন্দ। যে আনন্দ ক্লান্তিকে ডেকে আনার এক মহড়া মাত্র। ক্লান্তির পর বিশ্রাম এবং প্রশান্তি এবং বিজয়গাথাকে উদযাপনের এই মনস্তত্ত্ব থেকে মানব সভ্যতা কোনোকালেই রেহাই পায়নি। মনে হয়, কোনোদিন মানব প্রজাতি এখান থেকে পরিত্রাণ পাবেও না। শিকার করে খাদ্য সংগ্রহের কারণে গঠিত ডিএনএ কি এত দ্রুত বদলানো যায়? যায় না বলেই ওপরে ওপরে সভ্যতার ভান ধরার এই ভ ামি রপ্ত করায় সাম্রাজ্যবাদী মানুষ এক অনন্য প্রাণী হয়ে উঠছে। সৃষ্টির ক্লান্তি পরিপূর্ণ ক্লান্তি নয়। পুনরায় তা সৃষ্টি করতে বলে। ধ্বংসের ক্লান্তি সত্যিকারের ক্লান্তি। এই ক্লান্তিতে আকণ্ঠ ডুবে বিজয়োল্লাস উদযাপনের জন্য সাম্রাজ্যবাদীরা আজ মরিয়া বলে, মানুষের রক্তের রংকেও তাদের গাত্রবর্ণের মতোই তারা দেখে।
আমার কাঠের ঘরের সাথেই একটা গোলঘর। দুটোই ভূমি থেকে সমান উচ্চতার সমান্তরালে। পশ্চিমে নিবিড় বন। পাঁচশ গজ দূরে একলা একটা পাথুরে পাহাড়। যেন এই বন আর ঐ পাহাড় অনন্তকাল তাকিয়ে আছে- একে অন্যের পানে। ওরা সারাদিন, সারারাত কী সব ফিসফিস কথা বলাবলি করে! গোলঘর থেকে অবাক বিস্ময়ে এই বিমূর্ত প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকি। একটু লিখি, কিছুটা পড়ি। চমকে ওঠে ক্যালেন্ডারের পাতায় চোখ রাখি। ৩৬৫ দিনের আজকে কততম দিন?
পূর্ণিমা শুরুর তিন-চার দিন আগে এখানে এসেছিলাম। মায়াবী জোছনাপল্গাবিত চারদিকের বন আর নিঃসীম নীরবতার মাঝে অসীম কোনো এক আর্তস্বর আমাকে কোন এক অচিন গ্রহবাসী করে তোলে। আফ্রিকার বনের ভয়ংকর গভীর ডাক- একটানা সুরের মূর্ছনাগীত হয়ে যায়। বনের শূন্যগর্ভের অস্তিত্বের ওপরে; তার রেখা যেখানে অস্পষ্ট হয়েও জোছনার আলো গলাধঃকরণ করে অবিচল; আমি যেন আলো আর অন্ধকার এই দুই রেখার মাঝখানে চুপটি করে লুকিয়ে আছি। আলোর আহ্বান এবং বনের রেখা বরাবর অন্ধকারে কতসব পোকামাকড়ের প্রলয়। বিমূর্ত সুরের মূর্ছনার তান। পৃথিবীর সব অন্ধকার এবং সব আলো; প্রকৃতির সব রং, দৃশ্যমান-অদৃশ্য ভূমিসদৃশ অন্তর্লোক দিয়ে দেখার চেষ্টা করি। একশ বছর আগের, একশ বছর পরের মানবপরম্পরা কোথায় যেন অচেনা তানে গান গেয়ে ফিরে। ভাবি, মানুষ ছাড়া এই পৃথিবী কি এমনি এক আদিস্বরে বিভোর ছিল মিলিয়ন মিলিয়ন বছর? কারা যেন কথা বলে। এই বনের আঁধারে। নিঃসীম আকাশের জোছনালোকে। সাসান্দ্রার কালো জলে। কারা? ধ্যানমগ্ন ধ্যানী এই পৃথিবীর ভাষা বোঝার চেষ্টা করি। বিষণ্ণ, ব্যাকুল আমারই ভিতর কি মানবাত্মার প্রজন্মান্তরের ভাষা খুঁজে ফিরছে? তাহলে আমিও কি নিঃসঙ্গতা এড়াতে এই বনের অসংখ্য প্রাণের আর্তস্বরে মিলিয়েছি নিজের প্রাণস্বর? আমিও বনের অসংখ্য সৃষ্টির মতো সামান্য এক প্রাণ মাত্র! পার্থক্য শুধু তারা ডেকেই চলছে আর আমি তাদের আর্তস্বরের ভাষা খুঁজে ফিরছি আমার একান্ত অনুভবে।
চুপচাপ ঐ নীলাকাশ। বনের শেষ রেখা। জোছনার অবারিত বিহার। সবখানে অজানা এক ভাষার ফিসফিস কানাকানি। আমি তার অনুপ্রাস আবিস্কারে নিজের স্নায়ুতন্ত্রকে উন্মুখ রাখি। আমি হয়তো খুঁজে ফিরি আমার ভেতরের একান্ত ভুবনকে, তার অনুভবে ডানা মেলা ভিন্ন এক স্বরকে। এই স্বরটা আমার উপন্যাসের ভাষার জন্যও প্রয়োজন। নির্ভার চাঁদ তার অবস্থান বদলায়। কী জানি, মাঝে মাঝে মনে হয়- এই বন, ঐ আকাশ- সবাই নিঝুম মগ্নতায় খুঁজে ফিরছে, প্রতিধ্বনিত করে চলছে আমারই হৃদয়ের ফিসফিস। এই আধো-আঁধারির নির্জন ধরাতলে যে এত কথা বলে সে আর কেউ নয়- আমারই সত্তা।
আমি কি আসলে একটা উপন্যাস সৃষ্টির মগ্নতাকে ধারণ করতে চাইছি? আমার প্রথম উপন্যাস (এতদিন ধরে লিখেও উপন্যাসের নামটা ঠিক করতে পারিনি)! প্রথম ভালোবাসার মতো। তার জন্য প্রয়োজন মগ্নতা। নিজেকে বোঝাই, একজন ঔপন্যাসিককে একই সাথে যেমন প্রকৃতির অংশ হয়ে যেতে হয় তেমনি সত্যকে, বাস্তবের অন্তরালের পরাবাস্তবতাকে দেখার জন্য তার চরম নিরপেক্ষ এক দৃষ্টিও থাকতে হয়। সেই দৃষ্টি যা খুঁজে ফিরে মানুষের জীবনার্তিকে। প্রকৃতির গোপন ভাষাকে। মানুষের প্রেম-ভালোবাসা আর তাদের স্বপ্নের আখ্যানকে।
আমার ঘুম পায়। দেখি, চাঁদের হাসিতেও ঘুম ঘুম। ঢলে পড়েছে সে পশ্চিমাকাশে!
মন্তব্য করুন