
১৯৮৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রখ্যাত কবি বেনজামিন মোলিসকে ফাঁসি দেয় বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ সরকার। সে সময়ে আরও অনেক কবি-লেখক ও শিল্পী জেল-জুলুমের শিকার হন। কবি মাৎসিসি কুনেনের কপাল ভালো, তাকে ফাঁসিতে ঝুলতে বা কারাগারে যেতে হয়নি। লন্ডনে নির্বাসিত জীবন বেছে নিতে হয়েছে তাকে। বিদেশে বসেও তিনি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের হয়ে কাজ করেছেন। নিজ দেশের জনগণের সংগ্রামের পক্ষে জনমত গড়ে তুলেছেন। তার কবিতায় নিজ সম্প্রদায় জুলুদের সংগ্রাম ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশিত হয়েছে। এলিজি শিরোনামে কবিতায় তিনি লিখেছেন :
আমরা ডেকে এনেছি কুদর্শন অষ্ট-নাগ
যেন পাহারা দেয় আমাদের সহস্র বৎসর, সহস্র যুগ
বাসুকীর দৃষ্টি ছিল আকাশের প্রান্ত-ছোঁয়া
কখনো বা মৃত জনের পদঘাতে সন্ত্রস্ত
একদিন উন্মত্ত ঝড়ে
একদিন বৃষ্টি ও তুফানে
একদিন পড়ন্ত বিকেলে
আমরা দেখেছিলাম শূন্য মরুর বিস্তার
শুনেছিলাম দিগন্ত ফাঁপানো মন্ত্র-স্বর
এবং আবারো ভালোবেসেছি আমাদের লোককথা
ভালোবেসেছি আমাদের অজাচারী প্রেম।
(ভাষান্তর :মফিদুল হক)
দীর্ঘদিন দক্ষিণ আফ্রিকা বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের প্রথম দশকে ভারতের মহাত্মা গান্ধীও সেখানে বিবাদীদের হাতে নিগৃহীত হন এবং অহিংস আন্দোলন গড়ে তোলেন। ব্রিটিশদের ভারত দখলের একশ বছর আগে ১৬৫২ সালে হল্যান্ডের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম ঘাঁটি গাড়ে, যা পরবর্তীকালে কেপটাউন নামে পরিচিত। উনিশ দশকের প্রথম দিকে ব্রিটিশরা ডাচসহ অন্য ইউরোপীয়দের বিতাড়িত করে। দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিটিশদের প্রধান আকর্ষণ ছিল সোনা ও হীরক খনি। পৃথিবীর বৃহত্তম হীরক খনি এখানে অবস্থিত। ১৯১২ সালে ন্যাশনাল কংগ্রেস গঠিত হলে শ্বেতাঙ্গবিরোধী আন্দোলন বেগবান হয়। শ্বেতাঙ্গ সরকার দমনপীড়ন চালিয়ে সেই আন্দোলন স্তব্ধ করে দিতে চাইলে কৃষ্ণাঙ্গদের পক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এগিয়ে আসে। আন্দোলন দমন করতে বর্ণবাদী সরকার ন্যাশনাল কংগ্রেসে নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাকে বন্দি করে। ১৯৬৪ সালে একটি হত্যা মামলায় জড়িয়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদ। এরপর বরিন দ্বীপে কাটে তার নিঃসঙ্গ জীবন। ম্যান্ডেলা একনাগাড়ে ২৭ বছর জেলে থাকার পর ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান। সেটা ছিল ইতিহাসের সন্ধিক্ষণ। এই দিনটির জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার লাখ লাখ কৃষ্ণাঙ্গ অপেক্ষা করছিল। এর মধ্য দিয়েই দেশটিতে অবসান ঘটে শত বছরের শ্বেতাঙ্গ শাসনের। ঐতিহাসিক সেই দিনটির কথা স্মরণ করেছেন তারই সহকর্মী ভ্যালি মুসা। তিনি জানান, নেলসন ম্যান্ডেলার মুক্তির ব্যাপারে তাদের কোনো প্রস্তুতি ছিল না। এ জন্য তাদের খুব দ্রুত কিছু পদক্ষেপ নিতে হয়েছিল। কিন্তু সবকিছু যে সেই পরিকল্পনামতোই হয়েছে, তা নয়। ....... মুক্ত হন।
১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম সর্বজনীন নির্বাচনে ম্যান্ডেলা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ক্ষমতায় এসে তিনি জাতীয় পুনরেকত্রীকরণের উদ্যোগ নেন। ধর্মযাজক ডেসমন্ড টুটুকে এর প্রধান করা হয়। শ্বেতাঙ্গ সরকারের প্রেসিডেন্ট ডি ক্লার্ককে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনীত করেন। নেলসন ম্যান্ডেলা পাঁচ বছর সফলতার সঙ্গে দেশ শাসন করেন, বিভক্ত জাতিকে একত্র করেন। কিন্তু তিনি পরের নির্বাচনে আর অংশ নেননি। রাজনীতি থেকে অবসর নেন। বর্তমান বিশ্বে এটি বিরল ঘটনা।
২.
২০০২ সালের ২৬ আগস্ট থেকে ৪ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে বিশ্ব সামাজিক সম্মেলন হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল টেকসই উন্নয়ন। পরিবেশ ও প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে উন্নয়ন। জাতিসংঘ আয়োজিত এ সম্মেলনে বিশ্বের শতাধিক দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান, মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধিরাও অংশ নেন। বাংলাদেশ থেকে তৎকালীন বন ও পরিবেশমন্ত্রী শাজাহান সিরাজের নেতৃত্বে সরকারি প্রতিনিধি দল অংশ নেয়। এর কিছুদিন আগে বিএনপি সরকার পলিথিন নিষিদ্ধ করে একটি আইন পাস করে। শাজাহান সিরাজ তার বক্তৃতায় পলিথিন নিষিদ্ধ করার কৃতিত্ব জাহির করতে গিয়ে একটা বড়সড় রাজনৈতিক বক্তৃতাই দিয়ে ফেললেন। তিনি বললেন, পূর্ববর্তী সরকারগুলো ঢাকা শহরকে জঞ্জালের শহরে পরিণত করেছিল। সেখান থেকে বিএনপি নগরবাসীকে উদ্ধার করেছে। পলিথিন নিষিদ্ধ করা অবশ্যই প্রশংসনীয় আইন ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে সে আইন আর কার্যকর রাখা যায়নি। এখন নিষিদ্ধ পলিথিনে সয়লাব সারাদেশ। বুড়িগঙ্গার তলদেশে পলিথিনের এমন স্তর পড়েছে, যা ড্রেজিং করেও সরানো যাচ্ছে না।
বিশ্ব সামাজিক সম্মেলনে আমরা যে দলে গিয়েছিলাম, সেই দলের নেতৃত্বে ছিলেন অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. কাজী খুলীকুজ্জমান আহমদ (বর্তমানে পিকেএসএফের চেয়ারম্যান)। আমাদের মূল প্রতিপাদ্য ছিল পানিসম্পদ রক্ষা ও এর সদ্ব্যবহার। পরিবেশবিদদের মতে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে পানি নিয়ে। কিন্তু বাংলাদেশে পানির সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আমরা বৃষ্টি থেকে প্রচুর পানি পাই। উজান থেকেও ঠিকমতো পানি আসত, যদি নদীর গতিপথ রুদ্ধ করে দেওয়া না হতো। পানি ভাগাভাগি নিয়ে ভারতের সঙ্গে ৫০ বছর ধরেই ঝগড়া চলছে। দুই দেশের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন নদী। চুক্তি হয়েছে মাত্র একটির- গঙ্গা। এ অবস্থায় যৌথ নদী ব্যবস্থাপনার ওপরই আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। ভারত এত তিন যৌথ নদী ব্যবস্থাপনায় রাজি ছিল না। এখন রাজি হয়েছে। নেপাল ও ভুটানও রাজি। কিন্তু জট খুলবে কি?
ঢাকা থেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় সরাসরি ফ্লাইট নেই। আমরা ঢাকা থেকে ব্যাংকক হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বিমানে জোহানেসবার্গে যাই। ব্যাংকক থেকে একটানা ১২ ঘণ্টার পথ। কয়েক ঘণ্টা পরপর খাবার ও পানীয় পরিবেশনা। গল্প করতে করতে, ছবি দেখতে দেখতে সময় কেটে গেলে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিমানবন্দরে পৌঁছালে অন্য রকম অনুভূতি হয়। নেলসন ম্যান্ডেলার দেশে এসেছি, যে নেতা তার জনগণের মুক্তির জন্য সাতাশ বছর জেল খেটেছেন। আমরা নিজেদের উন্নয়নের মহাসড়কে আছি। অথচ দক্ষিণ আফ্রিকার মতো একটি বিমানবন্দর তৈরি করতে পারিনি। প্রশাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবকিছুই সেখানে এখন কালোদের নিয়ন্ত্রণে। জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ কালো। তবে কালোদের মধ্যেও নানা ভাগ আছে। জুলুরা সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি। এরপর আছে খোসা, আফ্রিকান্স, উত্তরীয় সোথো, কাসোয়ানা তসাঙ্গো, সোয়াজি, ভেন্দা, দক্ষিণীয় সেথো ও এনবেদেবেলে। শ্বেতাঙ্গরা মাত্র ৮ শতাংশ হলেও তারা দেশ শাসন করে আসছিল যুগের পর যুগ।
জোহানেসবার্গ দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে বড় শহর। যদিও রাজধানী নয়। দক্ষিণ আফ্রিকায় তিনটি রাজধানী- প্রিটোরিয়া প্রশাসনিক রাজধানী, ব্লুমফন্টেই বিচার বিভাগীয় রাজধানী এবং কেপটাউন সংসদীয় রাজধানী।
আমরা যে সময় দক্ষিণ আফ্রিকায় যাই, তখন ছিল ক্রান্তিকাল। শ্বেতাঙ্গ শাসন থেকে কৃষ্ণাঙ্গ শাসনে উত্তরণ প্রক্রিয়া চলছিল। আমরা যে বাংলোতে ছিলাম, তার মালিক ছিলেন একজন ডাচ বংশোদ্ভূত সাদা আফ্রিকান। নাম পিটার্স। বাড়ি ভাড়াই প্রধান আয়ের উৎস। তার সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বললাম। তিনি হতাশ। বললেন, কালোরা ক্ষমতায় আসার পর অনেক ইউরোপীয় ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে দেশে চলে গেছেন। অনেকে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বুঝলাম, এর একটি মনস্তাত্ত্বিক কারণ আছে। সাদারা জনসংখ্যার ৮ শতাংশ হলেও এত দিন প্রশাসন ও ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল। কালোরা ছিল কেবল হুকুম বরদার। সেই হুকুম বরদারদের এই অবস্থান সাদারা তা সহজভাবে নিতে পারেননি; আমাদের দেশের জমিদারদের মতো।
পিটার্স বললেন, তার আত্মীয়স্বজনেরও কেউ কেউ চলে গেছেন। তিনি এখনও মনস্থির করতে পারছেন না। ভয়ের আরেকটি কারণ, দীর্ঘদিন তারা যে কালোদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছেন, ভবিষ্যতে কখনও প্রতিশোধ নিতে পারেন কালোরা। ম্যান্ডেলার শান্তি ও পুনরেকত্রীকরণের নীতিকে সমর্থন করেন। তার দাবি, আফ্রিকার শিল্পকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্যও তো সাদারাই তৈরি করেছে। আফ্রিকার উন্নয়নে তাদের ভূমিকাই প্রধান। অথচ এখন কালোরা তাদের অবদান স্বীকারই করতে চান না।
বাসা থেকে সম্মেলনস্থলে আমাদের নিয়ে যেতেন যে গাইড ও গাড়িচালক, তাদের সঙ্গে বেশ সখ্য হয়। ইংরেজি তাদের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা। ফলে আলাপ জমাতে অসুবিধা হয়নি। তাদের পরিবার সম্পর্কে জানতে চাই। একটা বিষয় লক্ষ্য করি, আফ্রিকান কালোরাও লেখাপড়ায় বেশ এগিয়ে।
তারা জানালেন, এমন কোনো পরিবার পাওয়া যাবে না, যারা শ্বেতাঙ্গ সরকারের আমলে নিগৃহীত হননি। জেলে যেতে হয়নি। এটাই তারা স্বাভাবিক মনে করেছেন। আবার আন্দোলনও করেছেন। আমাদের গাড়িতে আসতে-যেতে একটি ক্যাসেটই বারবার বাজছিল। কৌতূহল হলো। জিজ্ঞেস করলাম, তারা সব সময় এই গান বাজাচ্ছেন কেন। চালক মৃদু হেসে বললেন, এটি তারই গান। তিনি একটি ক্যাসেট উপহার দিয়েছিলেন। এটাই হয়তো বাংলাদেশের বন্ধুর প্রতি তাদের শুভেচ্ছার নিদর্শন। এই শিল্পী গাড়ি চালনার ফাঁকে অনুষ্ঠানাদি করে থাকেন। বুঝলাম, দক্ষিণ আফ্রিকার সব নারী-পুরুষই গান ও নাচ জানেন। আত্মজীবনীর এক জায়গায় নেলসন ম্যান্ডেলা লিখেছেন :কারাগারে গান ও কবিতা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে তিনি গান গাইছেন, কবিতা আবৃত্তি করেছেন।
একদিন গাইডকে বললাম, আমরা দক্ষিণ আফ্রিকার গ্রাম দেখতে চাই। তারা সম্মেলনের ফাঁকে একটি গ্রামে নিয়ে গেলেন। সেখানে দেখলাম, একটি মসজিদ থেকে কয়েকজন মুসল্লি বের হয়েছেন। আমাদের দেখে কুশল বিনিময় করলেন। জানতে চাইলাম, তারা কোথা থেকে এসেছেন। বললেন, তিউনিসিয়া। তারা তবলিগ জামাতে শরিক হতে এসেছেন। জিজ্ঞাসা করলাম, এখানে ধর্ম প্রচারে কোনো বিধিনিষেধ আছে কিনা। জানালেন- না, কোনো বিধিনিষেধ নেই। সৌদি অর্থে অনেক ইসলামী এনজিও এখানে কাজ করে। আবার খ্রিষ্টীয় ধর্মযাজকরাও বেশ তৎপর। আফ্রিকার বেশির ভাগ মানুষ প্রকৃতি-পূজারি। ফলে তাদের যে কোনো ধর্মে সহজে প্রলুব্ধ করা যায়। গরিবদের প্রতিই তাদের দৃষ্টি।
সপ্তাহব্যাপী সম্মেলন বেশ শান্তিপূর্ণই ছিল। একটি অধিবেশনে গোলযোগের খবর পেয়ে গেলাম। দেখলাম, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল বক্তৃতা দেওয়ার সময় পেছন থেকে বেশ কয়েক দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করলেন। পকেট থেকে ব্যানার বের করে সামনে টানিয়ে বললেন, নো নো। অর্থাৎ তোমার বক্তৃতা আমরা শুনতে চাই না। তোমরা দেশে দেশে অভিযান চালিয়ে মানুষ মারছ। রাষ্ট্রীয় পুলিশ প্রস্তুতই ছিল। বিশালদেহী এসব পুলিশ প্রতিবাদকারীদের আক্ষরিক অর্থেই বগল দাবা করে বাইরে নিয়ে গেল। তখনও কলিন পাওয়ালের বক্তৃতা চলছিল।
৩.
দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বাংলাদেশে এসেছিলেন ১৯৯৭ সালে, স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শিখা চিরন্তনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাকেও দেখি। সেই অনুষ্ঠানে আরও এসেছিলেন ফিলিস্তিন মুক্তি আন্দোলনের নেতা ইয়াসির আরাফাত ও তুরস্কের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সুলেমান ডেমিরেল। তারা রাষ্ট্রপতির ভোজসভাসহ আরও বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। নেলসন ম্যান্ডেলা সেদিন বাংলাদেশের অনেক সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, কিছু আন্তরিক উদ্যোগ নিলেই দেশটি পাল্টে যেতে পারে। এ জন্য দরকার স্বচ্ছতার ভিত্তিতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। স্বচ্ছতা না থাকলে দায়বদ্ধতা থাকে না। তিনি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার কথাও বলেছিলেন।
নেলসন ম্যান্ডেলা মারা যান ২০১৩ সালে। ২০১৮ সালে তার জন্মশতবর্ষ অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও উদযাপিত হয়। ম্যান্ডেলা তার আত্মজীবনী 'লং ওয়াক টু ফ্রিডম' বইয়ে জীবনসংগ্রামের কথা বলেছেন। তার এই সংগ্রামী চেতনার পেছনে যে কবির ভূমিকা আছে, তার নাম এমখাওয়াই, তিনি ছিলেন খোস ভাষার কবি। তার হাতে ছিল একটি বল্লম। বল্লমটি তারের সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার কথা উল্লেখ করে কবি বললেন, তারের সঙ্গে আমার বল্লম বাড়ি খেয়ে যে ঝনঝন আওয়াজ হচ্ছে, সেটি ইউরোপীয় সংস্কৃতির সঙ্গে আফ্রিকান সংস্কৃতির সংঘর্ষের প্রতীক। এই যে তামার তার দেখছ, এটি পশ্চিমা শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের একটা আলামত। এই পশ্চিমা তার খুব চিকন, কিন্তু খুব শক্ত। প্রাণহীন, কিন্তু কুটিল চতুর। তিনি আরও বলেছিলেন, যারা আমাদের কৃষ্টি ও সভ্যতাকে বিনষ্ট করে তাদের সভ্যতা চাপিয়ে দিতে চায়, সেই বিদেশিদের আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। আফ্রিকানরা মেনেও নেননি।
আফ্রিকা একদিন জাগবেই। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসীদের বিরুদ্ধে আফ্রিকা ঘুরে দাঁড়াবে। হ্যাঁ, সেদিনের কলেজের ছাত্র ম্যান্ডেলার হাত ধরেই আফ্রিকা ঘুরে দাঁড়িয়েছিল।
নেলসন ম্যান্ডেলা নিজেও কবি ছিলে। তিনি গান গাইতেন। তার একটি কবিতার ভাষান্তর এখানে তুলে ধরছি।
আদতেই আমি একজন আশাবাদী মানুষ।
কীভাবে এটা ঘটে আমি জানি না, প্রকৃতি থেকে নাকি
পরিচর্যায় পাওয়া, আমি বলতে পারব না।
আশাবাদের কিছু ছেঁড়াখোঁড়া টুকরো অংশ,
সূর্যের দিকে মাথা উঁচু করে তুলে রাখতে সাহায্য করে,
একটু একটু করে পা সামনের দিকে এগোয়।
প্রায়ান্ধকার অনেক মুহূর্ত আসে, যখন
মানবতার প্রতি আমার প্রত্যয় আর প্রত্যাশা শুধু টোল খায়,
কিন্তু আমি কখনোই নিজেকে নিরাশ্বাস হতাশার কাছে সমর্পণ করি না।
কেননা আমি জানি, ওখানেই তো আছে পরাজয়, আছে মৃত্যু।
স্বাধীনতা মানে শুধু শৃঙ্খলমুক্তি নয়,
স্বাধীনতা হলো মাথা উঁচু করে বাঁচা আর নিজেকে দীপিত রাখা
স্বাধীনতা মানে অন্যের স্বাধীনতা।
কখনও পতন ঘটেনি, এটাই বেঁচে থাকার বড় গৌরব নয়
বেঁচে থাকার গৌরব হচ্ছে পতনের মুখে বারবার উঠে দাঁড়ানো।
আত্মতৃপ্তি হচ্ছে বিষপানের মতো আর বিষপানের পরেই
মনে হতে পারে শত্রুর বুঝি বিনাশ ঘটেছে।
আমি হেঁটে দরজা ঠেলে যখন বাইরে যাই,
তখনই মনে হয়, আমি বুঝি স্বাধীনতার কাছে পৌঁছে যাব,
আমি জানি, তিক্ততা আর ঘৃণাকে পেছনে ফেলে আসতে না পারলে
আমাকে তখনও কারাগারে বন্দি থাকতে হবে।
খণ্ডিত স্বাধীনতা বলে কিছু নেই।
মানুষটি যে ভাষা বোঝে, তুমি যদি সেই ভাষায় কথা বলো,
তাহলে তোমার কথাগুলো তার মাথায় ঢুকে যাবে।
কিন্তু তুমি যদি ঠিক ঠিক তার নিজের ভাষায় কথা বলো,
তাহলে তা ঠাঁই পাবে তার হৃদয়ে।
আমরা ডেকে এনেছি কুদর্শন অষ্ট-নাগ
যেন পাহারা দেয় আমাদের সহস্র বৎসর, সহস্র যুগ
বাসুকীর দৃষ্টি ছিল আকাশের প্রান্ত-ছোঁয়া
কখনো বা মৃত জনের পদঘাতে সন্ত্রস্ত
একদিন উন্মত্ত ঝড়ে
একদিন বৃষ্টি ও তুফানে
একদিন পড়ন্ত বিকেলে
আমরা দেখেছিলাম শূন্য মরুর বিস্তার
শুনেছিলাম দিগন্ত ফাঁপানো মন্ত্র-স্বর
এবং আবারো ভালোবেসেছি আমাদের লোককথা
ভালোবেসেছি আমাদের অজাচারী প্রেম।
(ভাষান্তর :মফিদুল হক)
দীর্ঘদিন দক্ষিণ আফ্রিকা বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের প্রথম দশকে ভারতের মহাত্মা গান্ধীও সেখানে বিবাদীদের হাতে নিগৃহীত হন এবং অহিংস আন্দোলন গড়ে তোলেন। ব্রিটিশদের ভারত দখলের একশ বছর আগে ১৬৫২ সালে হল্যান্ডের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম ঘাঁটি গাড়ে, যা পরবর্তীকালে কেপটাউন নামে পরিচিত। উনিশ দশকের প্রথম দিকে ব্রিটিশরা ডাচসহ অন্য ইউরোপীয়দের বিতাড়িত করে। দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিটিশদের প্রধান আকর্ষণ ছিল সোনা ও হীরক খনি। পৃথিবীর বৃহত্তম হীরক খনি এখানে অবস্থিত। ১৯১২ সালে ন্যাশনাল কংগ্রেস গঠিত হলে শ্বেতাঙ্গবিরোধী আন্দোলন বেগবান হয়। শ্বেতাঙ্গ সরকার দমনপীড়ন চালিয়ে সেই আন্দোলন স্তব্ধ করে দিতে চাইলে কৃষ্ণাঙ্গদের পক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এগিয়ে আসে। আন্দোলন দমন করতে বর্ণবাদী সরকার ন্যাশনাল কংগ্রেসে নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাকে বন্দি করে। ১৯৬৪ সালে একটি হত্যা মামলায় জড়িয়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদ। এরপর বরিন দ্বীপে কাটে তার নিঃসঙ্গ জীবন। ম্যান্ডেলা একনাগাড়ে ২৭ বছর জেলে থাকার পর ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান। সেটা ছিল ইতিহাসের সন্ধিক্ষণ। এই দিনটির জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার লাখ লাখ কৃষ্ণাঙ্গ অপেক্ষা করছিল। এর মধ্য দিয়েই দেশটিতে অবসান ঘটে শত বছরের শ্বেতাঙ্গ শাসনের। ঐতিহাসিক সেই দিনটির কথা স্মরণ করেছেন তারই সহকর্মী ভ্যালি মুসা। তিনি জানান, নেলসন ম্যান্ডেলার মুক্তির ব্যাপারে তাদের কোনো প্রস্তুতি ছিল না। এ জন্য তাদের খুব দ্রুত কিছু পদক্ষেপ নিতে হয়েছিল। কিন্তু সবকিছু যে সেই পরিকল্পনামতোই হয়েছে, তা নয়। ....... মুক্ত হন।
১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম সর্বজনীন নির্বাচনে ম্যান্ডেলা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ক্ষমতায় এসে তিনি জাতীয় পুনরেকত্রীকরণের উদ্যোগ নেন। ধর্মযাজক ডেসমন্ড টুটুকে এর প্রধান করা হয়। শ্বেতাঙ্গ সরকারের প্রেসিডেন্ট ডি ক্লার্ককে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনীত করেন। নেলসন ম্যান্ডেলা পাঁচ বছর সফলতার সঙ্গে দেশ শাসন করেন, বিভক্ত জাতিকে একত্র করেন। কিন্তু তিনি পরের নির্বাচনে আর অংশ নেননি। রাজনীতি থেকে অবসর নেন। বর্তমান বিশ্বে এটি বিরল ঘটনা।
২.
২০০২ সালের ২৬ আগস্ট থেকে ৪ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে বিশ্ব সামাজিক সম্মেলন হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল টেকসই উন্নয়ন। পরিবেশ ও প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে উন্নয়ন। জাতিসংঘ আয়োজিত এ সম্মেলনে বিশ্বের শতাধিক দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান, মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধিরাও অংশ নেন। বাংলাদেশ থেকে তৎকালীন বন ও পরিবেশমন্ত্রী শাজাহান সিরাজের নেতৃত্বে সরকারি প্রতিনিধি দল অংশ নেয়। এর কিছুদিন আগে বিএনপি সরকার পলিথিন নিষিদ্ধ করে একটি আইন পাস করে। শাজাহান সিরাজ তার বক্তৃতায় পলিথিন নিষিদ্ধ করার কৃতিত্ব জাহির করতে গিয়ে একটা বড়সড় রাজনৈতিক বক্তৃতাই দিয়ে ফেললেন। তিনি বললেন, পূর্ববর্তী সরকারগুলো ঢাকা শহরকে জঞ্জালের শহরে পরিণত করেছিল। সেখান থেকে বিএনপি নগরবাসীকে উদ্ধার করেছে। পলিথিন নিষিদ্ধ করা অবশ্যই প্রশংসনীয় আইন ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে সে আইন আর কার্যকর রাখা যায়নি। এখন নিষিদ্ধ পলিথিনে সয়লাব সারাদেশ। বুড়িগঙ্গার তলদেশে পলিথিনের এমন স্তর পড়েছে, যা ড্রেজিং করেও সরানো যাচ্ছে না।
বিশ্ব সামাজিক সম্মেলনে আমরা যে দলে গিয়েছিলাম, সেই দলের নেতৃত্বে ছিলেন অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. কাজী খুলীকুজ্জমান আহমদ (বর্তমানে পিকেএসএফের চেয়ারম্যান)। আমাদের মূল প্রতিপাদ্য ছিল পানিসম্পদ রক্ষা ও এর সদ্ব্যবহার। পরিবেশবিদদের মতে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে পানি নিয়ে। কিন্তু বাংলাদেশে পানির সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আমরা বৃষ্টি থেকে প্রচুর পানি পাই। উজান থেকেও ঠিকমতো পানি আসত, যদি নদীর গতিপথ রুদ্ধ করে দেওয়া না হতো। পানি ভাগাভাগি নিয়ে ভারতের সঙ্গে ৫০ বছর ধরেই ঝগড়া চলছে। দুই দেশের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন নদী। চুক্তি হয়েছে মাত্র একটির- গঙ্গা। এ অবস্থায় যৌথ নদী ব্যবস্থাপনার ওপরই আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। ভারত এত তিন যৌথ নদী ব্যবস্থাপনায় রাজি ছিল না। এখন রাজি হয়েছে। নেপাল ও ভুটানও রাজি। কিন্তু জট খুলবে কি?
ঢাকা থেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় সরাসরি ফ্লাইট নেই। আমরা ঢাকা থেকে ব্যাংকক হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বিমানে জোহানেসবার্গে যাই। ব্যাংকক থেকে একটানা ১২ ঘণ্টার পথ। কয়েক ঘণ্টা পরপর খাবার ও পানীয় পরিবেশনা। গল্প করতে করতে, ছবি দেখতে দেখতে সময় কেটে গেলে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিমানবন্দরে পৌঁছালে অন্য রকম অনুভূতি হয়। নেলসন ম্যান্ডেলার দেশে এসেছি, যে নেতা তার জনগণের মুক্তির জন্য সাতাশ বছর জেল খেটেছেন। আমরা নিজেদের উন্নয়নের মহাসড়কে আছি। অথচ দক্ষিণ আফ্রিকার মতো একটি বিমানবন্দর তৈরি করতে পারিনি। প্রশাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবকিছুই সেখানে এখন কালোদের নিয়ন্ত্রণে। জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ কালো। তবে কালোদের মধ্যেও নানা ভাগ আছে। জুলুরা সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি। এরপর আছে খোসা, আফ্রিকান্স, উত্তরীয় সোথো, কাসোয়ানা তসাঙ্গো, সোয়াজি, ভেন্দা, দক্ষিণীয় সেথো ও এনবেদেবেলে। শ্বেতাঙ্গরা মাত্র ৮ শতাংশ হলেও তারা দেশ শাসন করে আসছিল যুগের পর যুগ।
জোহানেসবার্গ দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে বড় শহর। যদিও রাজধানী নয়। দক্ষিণ আফ্রিকায় তিনটি রাজধানী- প্রিটোরিয়া প্রশাসনিক রাজধানী, ব্লুমফন্টেই বিচার বিভাগীয় রাজধানী এবং কেপটাউন সংসদীয় রাজধানী।
আমরা যে সময় দক্ষিণ আফ্রিকায় যাই, তখন ছিল ক্রান্তিকাল। শ্বেতাঙ্গ শাসন থেকে কৃষ্ণাঙ্গ শাসনে উত্তরণ প্রক্রিয়া চলছিল। আমরা যে বাংলোতে ছিলাম, তার মালিক ছিলেন একজন ডাচ বংশোদ্ভূত সাদা আফ্রিকান। নাম পিটার্স। বাড়ি ভাড়াই প্রধান আয়ের উৎস। তার সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বললাম। তিনি হতাশ। বললেন, কালোরা ক্ষমতায় আসার পর অনেক ইউরোপীয় ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে দেশে চলে গেছেন। অনেকে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বুঝলাম, এর একটি মনস্তাত্ত্বিক কারণ আছে। সাদারা জনসংখ্যার ৮ শতাংশ হলেও এত দিন প্রশাসন ও ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল। কালোরা ছিল কেবল হুকুম বরদার। সেই হুকুম বরদারদের এই অবস্থান সাদারা তা সহজভাবে নিতে পারেননি; আমাদের দেশের জমিদারদের মতো।
পিটার্স বললেন, তার আত্মীয়স্বজনেরও কেউ কেউ চলে গেছেন। তিনি এখনও মনস্থির করতে পারছেন না। ভয়ের আরেকটি কারণ, দীর্ঘদিন তারা যে কালোদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছেন, ভবিষ্যতে কখনও প্রতিশোধ নিতে পারেন কালোরা। ম্যান্ডেলার শান্তি ও পুনরেকত্রীকরণের নীতিকে সমর্থন করেন। তার দাবি, আফ্রিকার শিল্পকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্যও তো সাদারাই তৈরি করেছে। আফ্রিকার উন্নয়নে তাদের ভূমিকাই প্রধান। অথচ এখন কালোরা তাদের অবদান স্বীকারই করতে চান না।
বাসা থেকে সম্মেলনস্থলে আমাদের নিয়ে যেতেন যে গাইড ও গাড়িচালক, তাদের সঙ্গে বেশ সখ্য হয়। ইংরেজি তাদের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা। ফলে আলাপ জমাতে অসুবিধা হয়নি। তাদের পরিবার সম্পর্কে জানতে চাই। একটা বিষয় লক্ষ্য করি, আফ্রিকান কালোরাও লেখাপড়ায় বেশ এগিয়ে।
তারা জানালেন, এমন কোনো পরিবার পাওয়া যাবে না, যারা শ্বেতাঙ্গ সরকারের আমলে নিগৃহীত হননি। জেলে যেতে হয়নি। এটাই তারা স্বাভাবিক মনে করেছেন। আবার আন্দোলনও করেছেন। আমাদের গাড়িতে আসতে-যেতে একটি ক্যাসেটই বারবার বাজছিল। কৌতূহল হলো। জিজ্ঞেস করলাম, তারা সব সময় এই গান বাজাচ্ছেন কেন। চালক মৃদু হেসে বললেন, এটি তারই গান। তিনি একটি ক্যাসেট উপহার দিয়েছিলেন। এটাই হয়তো বাংলাদেশের বন্ধুর প্রতি তাদের শুভেচ্ছার নিদর্শন। এই শিল্পী গাড়ি চালনার ফাঁকে অনুষ্ঠানাদি করে থাকেন। বুঝলাম, দক্ষিণ আফ্রিকার সব নারী-পুরুষই গান ও নাচ জানেন। আত্মজীবনীর এক জায়গায় নেলসন ম্যান্ডেলা লিখেছেন :কারাগারে গান ও কবিতা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে তিনি গান গাইছেন, কবিতা আবৃত্তি করেছেন।
একদিন গাইডকে বললাম, আমরা দক্ষিণ আফ্রিকার গ্রাম দেখতে চাই। তারা সম্মেলনের ফাঁকে একটি গ্রামে নিয়ে গেলেন। সেখানে দেখলাম, একটি মসজিদ থেকে কয়েকজন মুসল্লি বের হয়েছেন। আমাদের দেখে কুশল বিনিময় করলেন। জানতে চাইলাম, তারা কোথা থেকে এসেছেন। বললেন, তিউনিসিয়া। তারা তবলিগ জামাতে শরিক হতে এসেছেন। জিজ্ঞাসা করলাম, এখানে ধর্ম প্রচারে কোনো বিধিনিষেধ আছে কিনা। জানালেন- না, কোনো বিধিনিষেধ নেই। সৌদি অর্থে অনেক ইসলামী এনজিও এখানে কাজ করে। আবার খ্রিষ্টীয় ধর্মযাজকরাও বেশ তৎপর। আফ্রিকার বেশির ভাগ মানুষ প্রকৃতি-পূজারি। ফলে তাদের যে কোনো ধর্মে সহজে প্রলুব্ধ করা যায়। গরিবদের প্রতিই তাদের দৃষ্টি।
সপ্তাহব্যাপী সম্মেলন বেশ শান্তিপূর্ণই ছিল। একটি অধিবেশনে গোলযোগের খবর পেয়ে গেলাম। দেখলাম, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল বক্তৃতা দেওয়ার সময় পেছন থেকে বেশ কয়েক দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করলেন। পকেট থেকে ব্যানার বের করে সামনে টানিয়ে বললেন, নো নো। অর্থাৎ তোমার বক্তৃতা আমরা শুনতে চাই না। তোমরা দেশে দেশে অভিযান চালিয়ে মানুষ মারছ। রাষ্ট্রীয় পুলিশ প্রস্তুতই ছিল। বিশালদেহী এসব পুলিশ প্রতিবাদকারীদের আক্ষরিক অর্থেই বগল দাবা করে বাইরে নিয়ে গেল। তখনও কলিন পাওয়ালের বক্তৃতা চলছিল।
৩.
দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বাংলাদেশে এসেছিলেন ১৯৯৭ সালে, স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শিখা চিরন্তনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাকেও দেখি। সেই অনুষ্ঠানে আরও এসেছিলেন ফিলিস্তিন মুক্তি আন্দোলনের নেতা ইয়াসির আরাফাত ও তুরস্কের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সুলেমান ডেমিরেল। তারা রাষ্ট্রপতির ভোজসভাসহ আরও বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। নেলসন ম্যান্ডেলা সেদিন বাংলাদেশের অনেক সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, কিছু আন্তরিক উদ্যোগ নিলেই দেশটি পাল্টে যেতে পারে। এ জন্য দরকার স্বচ্ছতার ভিত্তিতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। স্বচ্ছতা না থাকলে দায়বদ্ধতা থাকে না। তিনি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার কথাও বলেছিলেন।
নেলসন ম্যান্ডেলা মারা যান ২০১৩ সালে। ২০১৮ সালে তার জন্মশতবর্ষ অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও উদযাপিত হয়। ম্যান্ডেলা তার আত্মজীবনী 'লং ওয়াক টু ফ্রিডম' বইয়ে জীবনসংগ্রামের কথা বলেছেন। তার এই সংগ্রামী চেতনার পেছনে যে কবির ভূমিকা আছে, তার নাম এমখাওয়াই, তিনি ছিলেন খোস ভাষার কবি। তার হাতে ছিল একটি বল্লম। বল্লমটি তারের সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার কথা উল্লেখ করে কবি বললেন, তারের সঙ্গে আমার বল্লম বাড়ি খেয়ে যে ঝনঝন আওয়াজ হচ্ছে, সেটি ইউরোপীয় সংস্কৃতির সঙ্গে আফ্রিকান সংস্কৃতির সংঘর্ষের প্রতীক। এই যে তামার তার দেখছ, এটি পশ্চিমা শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের একটা আলামত। এই পশ্চিমা তার খুব চিকন, কিন্তু খুব শক্ত। প্রাণহীন, কিন্তু কুটিল চতুর। তিনি আরও বলেছিলেন, যারা আমাদের কৃষ্টি ও সভ্যতাকে বিনষ্ট করে তাদের সভ্যতা চাপিয়ে দিতে চায়, সেই বিদেশিদের আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। আফ্রিকানরা মেনেও নেননি।
আফ্রিকা একদিন জাগবেই। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসীদের বিরুদ্ধে আফ্রিকা ঘুরে দাঁড়াবে। হ্যাঁ, সেদিনের কলেজের ছাত্র ম্যান্ডেলার হাত ধরেই আফ্রিকা ঘুরে দাঁড়িয়েছিল।
নেলসন ম্যান্ডেলা নিজেও কবি ছিলে। তিনি গান গাইতেন। তার একটি কবিতার ভাষান্তর এখানে তুলে ধরছি।
আদতেই আমি একজন আশাবাদী মানুষ।
কীভাবে এটা ঘটে আমি জানি না, প্রকৃতি থেকে নাকি
পরিচর্যায় পাওয়া, আমি বলতে পারব না।
আশাবাদের কিছু ছেঁড়াখোঁড়া টুকরো অংশ,
সূর্যের দিকে মাথা উঁচু করে তুলে রাখতে সাহায্য করে,
একটু একটু করে পা সামনের দিকে এগোয়।
প্রায়ান্ধকার অনেক মুহূর্ত আসে, যখন
মানবতার প্রতি আমার প্রত্যয় আর প্রত্যাশা শুধু টোল খায়,
কিন্তু আমি কখনোই নিজেকে নিরাশ্বাস হতাশার কাছে সমর্পণ করি না।
কেননা আমি জানি, ওখানেই তো আছে পরাজয়, আছে মৃত্যু।
স্বাধীনতা মানে শুধু শৃঙ্খলমুক্তি নয়,
স্বাধীনতা হলো মাথা উঁচু করে বাঁচা আর নিজেকে দীপিত রাখা
স্বাধীনতা মানে অন্যের স্বাধীনতা।
কখনও পতন ঘটেনি, এটাই বেঁচে থাকার বড় গৌরব নয়
বেঁচে থাকার গৌরব হচ্ছে পতনের মুখে বারবার উঠে দাঁড়ানো।
আত্মতৃপ্তি হচ্ছে বিষপানের মতো আর বিষপানের পরেই
মনে হতে পারে শত্রুর বুঝি বিনাশ ঘটেছে।
আমি হেঁটে দরজা ঠেলে যখন বাইরে যাই,
তখনই মনে হয়, আমি বুঝি স্বাধীনতার কাছে পৌঁছে যাব,
আমি জানি, তিক্ততা আর ঘৃণাকে পেছনে ফেলে আসতে না পারলে
আমাকে তখনও কারাগারে বন্দি থাকতে হবে।
খণ্ডিত স্বাধীনতা বলে কিছু নেই।
মানুষটি যে ভাষা বোঝে, তুমি যদি সেই ভাষায় কথা বলো,
তাহলে তোমার কথাগুলো তার মাথায় ঢুকে যাবে।
কিন্তু তুমি যদি ঠিক ঠিক তার নিজের ভাষায় কথা বলো,
তাহলে তা ঠাঁই পাবে তার হৃদয়ে।
মন্তব্য করুন