![আবু হেনা মোস্তফা কামাল [১৩ মার্চ, ১৯৩৬-২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৯]](https://samakal.com/uploads/2022/03/online/photos/Untitled-89-samakal-6233862b13c0c.jpg)
আবু হেনা মোস্তফা কামাল [১৩ মার্চ, ১৯৩৬-২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৯]
আবু হেনা মোস্তফা কামাল এক বিচিত্র প্রতিভার অধিকারী। শুধু কবিত্বের পরিচয়ে পরিচিত হননি; তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন অধ্যাপনায়, প্রশাসক, উপস্থাপক, বাগ্মী, প্রবন্ধকার এবং গীতিকার হিসেবে। বর্ণিল কর্মজীবনের মতো তার ব্যক্তিজীবনও ছিল বর্ণাঢ্য। চার দশকব্যাপী তার সাহিত্যিক জীবনে তিনি নিজেকে প্রতিনিয়ত ভেঙেছেন, গড়েছেন; পরিশীলিত এবং সমৃদ্ধ করেছেন। পঞ্চাশের দশকের কবি হিসেবে পরিচিত আবু হেনা মোস্তফা কামাল কাব্যচর্চা করেছেন আশির দশকের প্রায় শেষ প্রান্ত পর্যন্ত। পঞ্চাশের দশকের প্রবল সমাজমুখী কবিতার মধ্যেও এই কবি ব্যাপৃত ছিলেন নিজস্ব কাব্যিক আদর্শে।
আবু হেনা মোস্তফা কামালের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৩ মার্চ। তার শৈশব কেটেছে পাবনা জেলার উপকণ্ঠে অবস্থিত গোবিন্দা গ্রামে ইছামতী নদীর তীরে। নানা আয়েনুদ্দিন বিশ্বাস ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাবনা জমিদারি এস্টেটের নায়েব। এমন এক প্রাকৃতিক পরিবেশে তিনি বড় হয়েছিলেন, যেখানে পড়াশোনা এবং সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ ছিল অবারিত। তার পারিবারিক অনুষঙ্গ যথেষ্ট সহায়ক ছিল সাহিত্য চর্চার জন্য। পরিবারে ছিল গান শেখার রেওয়াজ। তিনি ছবিও আঁকতেন। তবে শৈশবে তিনি ছিলেন আত্মমুখী, নিঃসঙ্গ এবং ঘরকুনো। কৈশোরে এসে তিনি হয়ে ওঠেন বহির্মুখী। বেড়ে উঠেছিলেন শিক্ষিত মধ্যবিত্তের পরিমার্জিত, পারিবারিক আবহে এবং এক অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক চেতনার পরিবেশে।
আবু হেনা মোস্তফা কামাল একজন সৃষ্টিশীল লেখক। ছেলেবেলা থেকেই লিখতেন। কুশলতা দেখিয়েছেন মূলত কবিতা এবং অন্যান্য রচনাতেও। তিনি আগাগোড়াই ছিলেন মেধাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সাহিত্য সম্পাদক পদে জয়ী হয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই পঞ্চাশ দশকের কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। তিনি হতে চেয়েছিলেন সফল অধ্যাপক এবং লেখক। হয়েছিলেনও। এক সাক্ষাৎকারে তিনি লিখেছেন- ''আমার জীবনে মোটামুটি দুটি লক্ষ্য ছিল- এক, সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করা এবং আরেকটি, অধ্যাপনা করা। এই দু'দিকেই আমি সাফল্যজনকভাবে এগিয়ে যেতে পেরেছি। আমার প্রথম রচনা ছিল একটি কবিতা, যা গোলাম মোস্তফার 'নও বাহার' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আমি ভবিষ্যতে কবিতা রচনাতেই মনোযোগী হবো। তাছাড়া কিছু সিরিয়াস সাহিত্যকর্ম করার পরিকল্পনাও আছে।''
কবির জীবনকালে মাত্র তিনটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিল। 'আপন যৌবন বৈরী' ১৯৭৪ সালে, 'যেহেতু জন্মান্ধ' ১৯৮৪ সালে এবং 'আক্রান্ত গজল' ১৯৮৮ সালে। পঞ্চাশের দশকে 'মাহে নও' পত্রিকায় যেসব লেখকের কবিতা প্রকাশিত হতো তাদের মধ্যে আব্দুস সাত্তার, ফজল শাহাবুদ্দীন, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, ওমর আলী, জিয়া হায়দার, নীলরতন দাশ, শামসুর রাহমান, শামসুল হক কোরায়শী, মো. মনিরুজ্জামান উল্লেখযোগ্য। তাদের সমসাময়িক কবির মতোই আবু হেনা মোস্তফা কামালও কিছু তাৎক্ষণিক কবিতা লিখেছেন। সাধারণভাবে পঞ্চাশের বাঙালি কবিদের চরিত্রানুগ আবু হেনা মোস্তফা কামালের কবিতাও।
প্রেম চেতনা একজন কবির জন্য স্বাভাবিক সত্তা বলে ধরে নেওয়া যায়। কারণ 'প্রেম' শব্দটি বহুমাত্রিক। আদি এবং অকৃত্রিম। পৃথিবীর সব সাহিত্যেই প্রেম এসেছে অবশ্যম্ভাবী হয়ে, আর কবিতার ক্ষেত্রে তো অনিবার্যভাবে। আবু হেনা মোস্তফা কামালের কবিতার প্রধান সুর প্রেম। তিনি রোমান্টিক কবি। প্রেমের কবিতা যখন তিনি রচনা করেন তখন সেখানে ইতিহাস নেই, পুরাণ নেই কিংবা নেই কোনো সমাজ-সংশ্নিষ্টতা। এ রকমই একটি কবিতা-
এই ইভার চোখে (সুন্দরী যুবতী ইভা)
দুটি নীল আকাশ নেমেছে
এই চেনা গলি ছেড়ে সে কোথাও যাবে না যাবে না
সীমিত উঠোনে ঘাসে রোজ ভোরে এই কারুকাজ
এঁকেছেন সুন্দর বিধাতা (প্রেমিক বিধাতা) আর রাতে
নিঃসঙ্গ জলের শব্দে কলতলা যখন মুখর।
('ইভার সুন্দর, যেহেতু জন্মান্ধ)
তিনি লিখেছেন আবেগি এবং সরল কবিতা; যেখানে কবিতার শব্দ চয়ন, প্রকরণ ছিল নিখুঁত আর বোধে ছিল একরৈখিকতা। তার কবিতায় নারী যে রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা অবয়ব সর্বস্ব। এতে নারীর মনন, মেধা, ব্যক্তিত্ব প্রকাশিত হয়নি। কবির কল্পিত নারীরা স্বৈরিণী, বিশ্বাসঘাতিনী, চর্যার হরিণী আখ্যায়িত হয়েছে। আবার কখনও কোমল মেদুর রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
আজন্ম স্বৈরিণী তুই, এ কথা জানতে বাকি নেই,
বন্ধুরা বলেছে ওকে ছেড়ে দিয়ে অন্য কোনো
সুন্দরীকে নাও, তবু তোকে ঘিরে স্বপ্ন দেখি।
('স্বৈরিণী' আপন যৌবন বৈরী)
আবু হেনা মোস্তফা কামালের কবিতায় প্রকৃতি এবং প্রেমের সমন্ব্বয় লক্ষণীয়। তিনি যেমন রোমান্টিক কবি, তেমনি রোমান্টিকতার সহজাত বৈশিষ্ট্যেই প্রকৃতি তার সংলগ্ন হয়েছে। প্রেমের বৈশিষ্ট্যে কখনও কখনও মিলন মুহূর্তের নির্জন প্রতিবেশ তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে প্রকৃতি। নৈসর্গিক ভাবধারায় প্রেমময় এক মুহূর্তের কথা কবি প্রকাশ করেছেন অনবদ্য পঙ্ক্তিতে।
মধ্যরাতে সেইদিন বড় বৃষ্টি নেমেছিল
তখন বর্ষাতিহীন শহরের কোনোখানে মেলেনি আশ্রয়
অসহায় এসেছিলে কবির নিঃসঙ্গ ঘরে তাই
চিত্রিত ডানায়, চোখে থরথর কেঁপেছিল ভয়।
সমর্পিত করতলে ছিল আমন্ত্রণ।
('বিদেশি প্রজাপতি', আক্রান্ত গজল)
মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের কবিতার অন্যতম উপাদান। কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ কবিদের সমাজচেতনা এবং স্বদেশপ্রেমের চেতনার উৎস। আবু হেনা মোস্তফা কামালের চেতনায় এসেছে মুক্তিযুদ্ধ। তিনি লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধের বেশ কিছু কবিতা। 'ছবি' কবিতাটি মুক্তিযুদ্ধের ওপর অনবদ্য একটি পদ্য। মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বদেশ চেতনার অনুভূতিতে গাঢ় এই কবিতাটি তার জনপ্রিয় কিছু কবিতার অন্তর্ভুক্ত।
বাংলা গান বাংলা কবিতারই সহযাত্রী যুগ যুগ ধরে। গানের সাথে কবিতার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। কবিতা যেমন নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে, তেমনি গানও গীতিকবিতার অংশ হয়ে নানা বিবর্তনের ধাপে এগিয়ে চলেছে। রবীন্দ্র-নজরুলের পরবর্তী সময়ে কলকাতাকেন্দ্রিক উল্লেখযোগ্য গীতিকার হিসেবে উল্লেখ করা যায় গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামল গুপ্ত, সলিল চৌধুরী এবং হেমাঙ্গ বিশ্বাসের নাম। দেশ বিভাগের পর পূর্ব বাংলায় বাংলা গানের রচয়িতাদের মধ্যে আমাদের প্রেরণা জোগায় এই পঞ্চকবি এবং দ্বিতীয়ত উল্লিখিত গীতিকাররা। বিশ্বায়নের প্রভাব যখন আমাদের বাংলা সংগীতে পড়ে তখন এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে আধুনিক সংগীতও বাদ যায়নি। বাংলাদেশের কয়েকজন কবি গানের জগতে প্রবেশ করলেও পরবর্তীকালে আর কেউ এ ব্যাপারে মনোযোগী হননি। এ ধারাবাহিকতায় আবু হেনা মোস্তফা কামাল বাংলা গানের জগৎ সমৃদ্ধ করার প্রয়াস পান। তার গীত রচনা পঞ্চাশের দশকেই শুরু হয় এবং তখনই তিনি প্রতিষ্ঠা পান। পরবর্তী দশকগুলোতে তিনি প্রেম, প্রকৃতি, স্বদেশ চেতনার মতো বিভিন্ন পর্যায়ে গীত রচনা করেন। তার বেশির ভাগ গানই গ্রন্থভুক্ত হয় 'আমি সাগরের নীল'-এ। গান রচনায় বরাবরই তিনি ছিলেন রোমান্টিক। তার গানের বাণী নির্ভার, নিটোল এবং গীতল। তার জনপ্রিয় গানের মধ্যে-
ওই যে আকাশ নীল হলো আজ
সে শুধু তোমার প্রেমে
ওই যে বাতাস বাঁশি হলো আজ
সে শুধু তোমার প্রেমে।
(৩৪, আমি সাগরের নীল)
প্রকৃতির গান রচনায় তিনি কখনও রোদ্দুরের সঙ্গে, কখনও ময়ূরের সঙ্গে তুলনা করেছেন প্রকৃতিকে। বৃষ্টির বর্ষণধারা ফুলের মতো মনে হয়েছে কবির কাছে। প্রেয়সীর আগমনে প্রকৃতি যেমন উদ্ভাসিত, তেমনি কবির হৃদয়ও উদ্ভাসিত। কবিমন সাংগীতিক মূর্ছনায় গুঞ্জরিত হয়ে ওঠে, মেঘমল্লার হয়ে ওঠে কবির বীণা। এমনি একটি জনপ্রিয় গান-
অনেক বৃষ্টি ঝরে
তুমি এলে, যেন এক মুঠো রোদ্দুর
আমার দু'চোখ ভরে।
কত বেদনার বিষণ্ণ মেঘে ভেসে ভেসে
এলে তুমি অবশেষে।
( ১৩৭, আমি সাগরের নীল)
এই গান যতটা না নিসর্গের, তার চেয়ে বেশি প্রেমের।
স্বদেশ চেতনার ভাবনায় কবি রচনা করেছেন বেশ কিছু গান। এ গানের মধ্যে তার একুশের চেতনাসমৃদ্ধ কিছু গান রয়েছে। পঞ্চাশের কবিরা মূলত একুশেরই সন্তান। তাই একুশের চেতনা কবিকে নাড়া দিয়েছিল গানে। তেমন একটি গান-
অপমানে তুমি জ্বলে উঠেছিলে
সেদিন বর্ণমালা
সেদিন থেকে শুরু দিন বদলের পালা।
নতুন মন্ত্রে ভরেছিলে অঞ্জলি
আর নয় ভীরু ফাল্কগ্দুনী পদাবলি।
(১৭১, আমি সাগরের নীল)
মুক্তিযোদ্ধাদের দেশে ফেরার ঘটনা বিধৃত হয়েছে এ গানে। একটি অতৃপ্তির সুরও ধ্বনিত হয়েছে এখানে। কবি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি, তবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তার রচিত গান মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ত সাহস জুগিয়েছিল।
যায় যদি যাক প্রাণ
তবু দেবো না দেবো না দেবো না গোলার ধান।
তার 'জাগো প্রদীপ নিভিয়ে দাও, ওঠো তরবারি হাতে নাও' গানটি কলকাতা, বহরমপুর, দুর্গাপুর প্রভৃতি জায়গায় বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পের অনুষ্ঠানে অনেক গানের সাথে গীত হতো মুক্তিযোদ্ধা এবং শরণার্থীদের প্রেরণা দেওয়ার জন্য। যদিও এ গানটি তখন অন্য রচয়িতার নামে প্রচারিত হতো। আবু হেনা মোস্তফা কামাল তখন দেশের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবরুদ্ধ দিনযাপন করছিলেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে :
বর্গিরা এলো রাতের আঁধারে
দুঃস্বপ্নের মতো
উন্মাদ উদ্ধত।
এলো তার সাথে মৃত্যু ও মহামারি
ভয়ে থরথর মানুষের ঘরবাড়ি
জ্বলে দাউ দাউ অগ্নিশিখার ক্ষত।
(১৭০, আমি সাগরের নীল)
আবু হেনা মোস্তফা কামাল ছিলেন অসাধারণ বাগ্মী। টিভিতে তাকে দেখা যেত উপস্থাপক হিসেবে। বস্তুত জনসাধারণ্যে তার পরিচিতি ছড়িয়েছে যতখানি তার পাণ্ডিত্য ও কবিত্বের জন্য, তার চেয়ে অনেক বেশি তার সহজ সাবলীল কৃত্রিমতাবর্জিত, মনোমুগ্ধকর রেডিও-টিভি অনুষ্ঠান উপস্থাপনার জন্য। লোকগবেষক প্রয়াত শামসুজ্জামান খান বলেছেন- 'কথা বলার নিপুণ একটি ভঙ্গি তিনি আয়ত্ত করেছিলেন। তার কথকতা তাই হয়ে উঠত শিল্প। অনেক কথা বলতেন, কিন্তু বাজে বকতেন না। কথাশিল্পীর পরিমিতি বোধ ও অনন্য কৌশল তিনি তার বাচনভঙ্গি ও আলাপচারিতায় আনতে পারতেন।'
তিনি চলচ্চিত্রের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন। যেসব চলচ্চিত্রের জন্য গান লিখেছেন তা হলো- দর্পচূর্ণ, যোগবিয়োগ, অনির্বাণ, অসাধারণ, কলমীলতা, সমর্পণ ইত্যাদি। মুস্তফা আনোয়ার পরিচালিত 'অসাধারণ' ছবির চিত্রনাট্য তার লেখা।
তার শিক্ষকতা জীবনের প্রায় দু'দশকই কেটেছে মফস্বলে। সেখানে বসে বলতে গেলে তেমন কোনো সাহিত্যচর্চা তিনি করেননি। রাজশাহীতে থাকাকালে লেখার অনুকূল পরিবেশ তিনি পাননি। ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে যোগদান করার পর থেকে তার সাহিত্যচর্চায় গতি ফিরে আসে। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রামে ছিলেন। শিক্ষক হিসেবে তিনি আগাগোড়াই অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন, তবে চট্টগ্রামে তিনি ছাত্রদের নিয়ে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা করেছেন। এ প্রসঙ্গে তার মন্তব্য স্মরণীয়- 'চাটগাঁয় আমি ক্রমশ লুপ্ত আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছি। আবার লিখতে শুরু করেছি ক্রমশ, রাজশাহীতে যদি আমার মৃত্যু হয়ে থাকে তবে চাটগাঁয় ঘটেছে পুনরুত্থান, পুনরুজ্জীবন।' এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাকালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'আপন যৌবন বৈরী' প্রকাশিত হয়।
আবু হেনা মোস্তফা কামালের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৩ মার্চ। তার শৈশব কেটেছে পাবনা জেলার উপকণ্ঠে অবস্থিত গোবিন্দা গ্রামে ইছামতী নদীর তীরে। নানা আয়েনুদ্দিন বিশ্বাস ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাবনা জমিদারি এস্টেটের নায়েব। এমন এক প্রাকৃতিক পরিবেশে তিনি বড় হয়েছিলেন, যেখানে পড়াশোনা এবং সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ ছিল অবারিত। তার পারিবারিক অনুষঙ্গ যথেষ্ট সহায়ক ছিল সাহিত্য চর্চার জন্য। পরিবারে ছিল গান শেখার রেওয়াজ। তিনি ছবিও আঁকতেন। তবে শৈশবে তিনি ছিলেন আত্মমুখী, নিঃসঙ্গ এবং ঘরকুনো। কৈশোরে এসে তিনি হয়ে ওঠেন বহির্মুখী। বেড়ে উঠেছিলেন শিক্ষিত মধ্যবিত্তের পরিমার্জিত, পারিবারিক আবহে এবং এক অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক চেতনার পরিবেশে।
আবু হেনা মোস্তফা কামাল একজন সৃষ্টিশীল লেখক। ছেলেবেলা থেকেই লিখতেন। কুশলতা দেখিয়েছেন মূলত কবিতা এবং অন্যান্য রচনাতেও। তিনি আগাগোড়াই ছিলেন মেধাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সাহিত্য সম্পাদক পদে জয়ী হয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই পঞ্চাশ দশকের কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। তিনি হতে চেয়েছিলেন সফল অধ্যাপক এবং লেখক। হয়েছিলেনও। এক সাক্ষাৎকারে তিনি লিখেছেন- ''আমার জীবনে মোটামুটি দুটি লক্ষ্য ছিল- এক, সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করা এবং আরেকটি, অধ্যাপনা করা। এই দু'দিকেই আমি সাফল্যজনকভাবে এগিয়ে যেতে পেরেছি। আমার প্রথম রচনা ছিল একটি কবিতা, যা গোলাম মোস্তফার 'নও বাহার' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আমি ভবিষ্যতে কবিতা রচনাতেই মনোযোগী হবো। তাছাড়া কিছু সিরিয়াস সাহিত্যকর্ম করার পরিকল্পনাও আছে।''
কবির জীবনকালে মাত্র তিনটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিল। 'আপন যৌবন বৈরী' ১৯৭৪ সালে, 'যেহেতু জন্মান্ধ' ১৯৮৪ সালে এবং 'আক্রান্ত গজল' ১৯৮৮ সালে। পঞ্চাশের দশকে 'মাহে নও' পত্রিকায় যেসব লেখকের কবিতা প্রকাশিত হতো তাদের মধ্যে আব্দুস সাত্তার, ফজল শাহাবুদ্দীন, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, ওমর আলী, জিয়া হায়দার, নীলরতন দাশ, শামসুর রাহমান, শামসুল হক কোরায়শী, মো. মনিরুজ্জামান উল্লেখযোগ্য। তাদের সমসাময়িক কবির মতোই আবু হেনা মোস্তফা কামালও কিছু তাৎক্ষণিক কবিতা লিখেছেন। সাধারণভাবে পঞ্চাশের বাঙালি কবিদের চরিত্রানুগ আবু হেনা মোস্তফা কামালের কবিতাও।
প্রেম চেতনা একজন কবির জন্য স্বাভাবিক সত্তা বলে ধরে নেওয়া যায়। কারণ 'প্রেম' শব্দটি বহুমাত্রিক। আদি এবং অকৃত্রিম। পৃথিবীর সব সাহিত্যেই প্রেম এসেছে অবশ্যম্ভাবী হয়ে, আর কবিতার ক্ষেত্রে তো অনিবার্যভাবে। আবু হেনা মোস্তফা কামালের কবিতার প্রধান সুর প্রেম। তিনি রোমান্টিক কবি। প্রেমের কবিতা যখন তিনি রচনা করেন তখন সেখানে ইতিহাস নেই, পুরাণ নেই কিংবা নেই কোনো সমাজ-সংশ্নিষ্টতা। এ রকমই একটি কবিতা-
এই ইভার চোখে (সুন্দরী যুবতী ইভা)
দুটি নীল আকাশ নেমেছে
এই চেনা গলি ছেড়ে সে কোথাও যাবে না যাবে না
সীমিত উঠোনে ঘাসে রোজ ভোরে এই কারুকাজ
এঁকেছেন সুন্দর বিধাতা (প্রেমিক বিধাতা) আর রাতে
নিঃসঙ্গ জলের শব্দে কলতলা যখন মুখর।
('ইভার সুন্দর, যেহেতু জন্মান্ধ)
তিনি লিখেছেন আবেগি এবং সরল কবিতা; যেখানে কবিতার শব্দ চয়ন, প্রকরণ ছিল নিখুঁত আর বোধে ছিল একরৈখিকতা। তার কবিতায় নারী যে রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা অবয়ব সর্বস্ব। এতে নারীর মনন, মেধা, ব্যক্তিত্ব প্রকাশিত হয়নি। কবির কল্পিত নারীরা স্বৈরিণী, বিশ্বাসঘাতিনী, চর্যার হরিণী আখ্যায়িত হয়েছে। আবার কখনও কোমল মেদুর রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
আজন্ম স্বৈরিণী তুই, এ কথা জানতে বাকি নেই,
বন্ধুরা বলেছে ওকে ছেড়ে দিয়ে অন্য কোনো
সুন্দরীকে নাও, তবু তোকে ঘিরে স্বপ্ন দেখি।
('স্বৈরিণী' আপন যৌবন বৈরী)
আবু হেনা মোস্তফা কামালের কবিতায় প্রকৃতি এবং প্রেমের সমন্ব্বয় লক্ষণীয়। তিনি যেমন রোমান্টিক কবি, তেমনি রোমান্টিকতার সহজাত বৈশিষ্ট্যেই প্রকৃতি তার সংলগ্ন হয়েছে। প্রেমের বৈশিষ্ট্যে কখনও কখনও মিলন মুহূর্তের নির্জন প্রতিবেশ তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে প্রকৃতি। নৈসর্গিক ভাবধারায় প্রেমময় এক মুহূর্তের কথা কবি প্রকাশ করেছেন অনবদ্য পঙ্ক্তিতে।
মধ্যরাতে সেইদিন বড় বৃষ্টি নেমেছিল
তখন বর্ষাতিহীন শহরের কোনোখানে মেলেনি আশ্রয়
অসহায় এসেছিলে কবির নিঃসঙ্গ ঘরে তাই
চিত্রিত ডানায়, চোখে থরথর কেঁপেছিল ভয়।
সমর্পিত করতলে ছিল আমন্ত্রণ।
('বিদেশি প্রজাপতি', আক্রান্ত গজল)
মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের কবিতার অন্যতম উপাদান। কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ কবিদের সমাজচেতনা এবং স্বদেশপ্রেমের চেতনার উৎস। আবু হেনা মোস্তফা কামালের চেতনায় এসেছে মুক্তিযুদ্ধ। তিনি লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধের বেশ কিছু কবিতা। 'ছবি' কবিতাটি মুক্তিযুদ্ধের ওপর অনবদ্য একটি পদ্য। মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বদেশ চেতনার অনুভূতিতে গাঢ় এই কবিতাটি তার জনপ্রিয় কিছু কবিতার অন্তর্ভুক্ত।
বাংলা গান বাংলা কবিতারই সহযাত্রী যুগ যুগ ধরে। গানের সাথে কবিতার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। কবিতা যেমন নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে, তেমনি গানও গীতিকবিতার অংশ হয়ে নানা বিবর্তনের ধাপে এগিয়ে চলেছে। রবীন্দ্র-নজরুলের পরবর্তী সময়ে কলকাতাকেন্দ্রিক উল্লেখযোগ্য গীতিকার হিসেবে উল্লেখ করা যায় গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামল গুপ্ত, সলিল চৌধুরী এবং হেমাঙ্গ বিশ্বাসের নাম। দেশ বিভাগের পর পূর্ব বাংলায় বাংলা গানের রচয়িতাদের মধ্যে আমাদের প্রেরণা জোগায় এই পঞ্চকবি এবং দ্বিতীয়ত উল্লিখিত গীতিকাররা। বিশ্বায়নের প্রভাব যখন আমাদের বাংলা সংগীতে পড়ে তখন এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে আধুনিক সংগীতও বাদ যায়নি। বাংলাদেশের কয়েকজন কবি গানের জগতে প্রবেশ করলেও পরবর্তীকালে আর কেউ এ ব্যাপারে মনোযোগী হননি। এ ধারাবাহিকতায় আবু হেনা মোস্তফা কামাল বাংলা গানের জগৎ সমৃদ্ধ করার প্রয়াস পান। তার গীত রচনা পঞ্চাশের দশকেই শুরু হয় এবং তখনই তিনি প্রতিষ্ঠা পান। পরবর্তী দশকগুলোতে তিনি প্রেম, প্রকৃতি, স্বদেশ চেতনার মতো বিভিন্ন পর্যায়ে গীত রচনা করেন। তার বেশির ভাগ গানই গ্রন্থভুক্ত হয় 'আমি সাগরের নীল'-এ। গান রচনায় বরাবরই তিনি ছিলেন রোমান্টিক। তার গানের বাণী নির্ভার, নিটোল এবং গীতল। তার জনপ্রিয় গানের মধ্যে-
ওই যে আকাশ নীল হলো আজ
সে শুধু তোমার প্রেমে
ওই যে বাতাস বাঁশি হলো আজ
সে শুধু তোমার প্রেমে।
(৩৪, আমি সাগরের নীল)
প্রকৃতির গান রচনায় তিনি কখনও রোদ্দুরের সঙ্গে, কখনও ময়ূরের সঙ্গে তুলনা করেছেন প্রকৃতিকে। বৃষ্টির বর্ষণধারা ফুলের মতো মনে হয়েছে কবির কাছে। প্রেয়সীর আগমনে প্রকৃতি যেমন উদ্ভাসিত, তেমনি কবির হৃদয়ও উদ্ভাসিত। কবিমন সাংগীতিক মূর্ছনায় গুঞ্জরিত হয়ে ওঠে, মেঘমল্লার হয়ে ওঠে কবির বীণা। এমনি একটি জনপ্রিয় গান-
অনেক বৃষ্টি ঝরে
তুমি এলে, যেন এক মুঠো রোদ্দুর
আমার দু'চোখ ভরে।
কত বেদনার বিষণ্ণ মেঘে ভেসে ভেসে
এলে তুমি অবশেষে।
( ১৩৭, আমি সাগরের নীল)
এই গান যতটা না নিসর্গের, তার চেয়ে বেশি প্রেমের।
স্বদেশ চেতনার ভাবনায় কবি রচনা করেছেন বেশ কিছু গান। এ গানের মধ্যে তার একুশের চেতনাসমৃদ্ধ কিছু গান রয়েছে। পঞ্চাশের কবিরা মূলত একুশেরই সন্তান। তাই একুশের চেতনা কবিকে নাড়া দিয়েছিল গানে। তেমন একটি গান-
অপমানে তুমি জ্বলে উঠেছিলে
সেদিন বর্ণমালা
সেদিন থেকে শুরু দিন বদলের পালা।
নতুন মন্ত্রে ভরেছিলে অঞ্জলি
আর নয় ভীরু ফাল্কগ্দুনী পদাবলি।
(১৭১, আমি সাগরের নীল)
মুক্তিযোদ্ধাদের দেশে ফেরার ঘটনা বিধৃত হয়েছে এ গানে। একটি অতৃপ্তির সুরও ধ্বনিত হয়েছে এখানে। কবি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি, তবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তার রচিত গান মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ত সাহস জুগিয়েছিল।
যায় যদি যাক প্রাণ
তবু দেবো না দেবো না দেবো না গোলার ধান।
তার 'জাগো প্রদীপ নিভিয়ে দাও, ওঠো তরবারি হাতে নাও' গানটি কলকাতা, বহরমপুর, দুর্গাপুর প্রভৃতি জায়গায় বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পের অনুষ্ঠানে অনেক গানের সাথে গীত হতো মুক্তিযোদ্ধা এবং শরণার্থীদের প্রেরণা দেওয়ার জন্য। যদিও এ গানটি তখন অন্য রচয়িতার নামে প্রচারিত হতো। আবু হেনা মোস্তফা কামাল তখন দেশের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবরুদ্ধ দিনযাপন করছিলেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে :
বর্গিরা এলো রাতের আঁধারে
দুঃস্বপ্নের মতো
উন্মাদ উদ্ধত।
এলো তার সাথে মৃত্যু ও মহামারি
ভয়ে থরথর মানুষের ঘরবাড়ি
জ্বলে দাউ দাউ অগ্নিশিখার ক্ষত।
(১৭০, আমি সাগরের নীল)
আবু হেনা মোস্তফা কামাল ছিলেন অসাধারণ বাগ্মী। টিভিতে তাকে দেখা যেত উপস্থাপক হিসেবে। বস্তুত জনসাধারণ্যে তার পরিচিতি ছড়িয়েছে যতখানি তার পাণ্ডিত্য ও কবিত্বের জন্য, তার চেয়ে অনেক বেশি তার সহজ সাবলীল কৃত্রিমতাবর্জিত, মনোমুগ্ধকর রেডিও-টিভি অনুষ্ঠান উপস্থাপনার জন্য। লোকগবেষক প্রয়াত শামসুজ্জামান খান বলেছেন- 'কথা বলার নিপুণ একটি ভঙ্গি তিনি আয়ত্ত করেছিলেন। তার কথকতা তাই হয়ে উঠত শিল্প। অনেক কথা বলতেন, কিন্তু বাজে বকতেন না। কথাশিল্পীর পরিমিতি বোধ ও অনন্য কৌশল তিনি তার বাচনভঙ্গি ও আলাপচারিতায় আনতে পারতেন।'
তিনি চলচ্চিত্রের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন। যেসব চলচ্চিত্রের জন্য গান লিখেছেন তা হলো- দর্পচূর্ণ, যোগবিয়োগ, অনির্বাণ, অসাধারণ, কলমীলতা, সমর্পণ ইত্যাদি। মুস্তফা আনোয়ার পরিচালিত 'অসাধারণ' ছবির চিত্রনাট্য তার লেখা।
তার শিক্ষকতা জীবনের প্রায় দু'দশকই কেটেছে মফস্বলে। সেখানে বসে বলতে গেলে তেমন কোনো সাহিত্যচর্চা তিনি করেননি। রাজশাহীতে থাকাকালে লেখার অনুকূল পরিবেশ তিনি পাননি। ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে যোগদান করার পর থেকে তার সাহিত্যচর্চায় গতি ফিরে আসে। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রামে ছিলেন। শিক্ষক হিসেবে তিনি আগাগোড়াই অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন, তবে চট্টগ্রামে তিনি ছাত্রদের নিয়ে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা করেছেন। এ প্রসঙ্গে তার মন্তব্য স্মরণীয়- 'চাটগাঁয় আমি ক্রমশ লুপ্ত আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছি। আবার লিখতে শুরু করেছি ক্রমশ, রাজশাহীতে যদি আমার মৃত্যু হয়ে থাকে তবে চাটগাঁয় ঘটেছে পুনরুত্থান, পুনরুজ্জীবন।' এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাকালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'আপন যৌবন বৈরী' প্রকাশিত হয়।
মন্তব্য করুন