বৈশাখ মানে রঙে রঙে রঙিন হওয়ার দিন। আকাশজুড়ে রঙিন বেলুন, বাতাসে ভেসে আসে মুড়ি-মুড়কির ঘ্রাণ। মেলা বসবে, সে অপেক্ষায় প্রহর গুনি। বহুদিন ধরে জমিয়ে রাখা টাকা নিয়ে মেলায় যাওয়ার দিন। আহা, শৈশব! কালিবাড়ী মেলা, আঙ্গারু মেলাসহ প্রতিটি গ্রামে সেদিন মেলা বসতো। কোনো কোনো গ্রামে পাড়ায় পাড়ায় মেলা। চারদিক লোকে লোকারণ্য। গ্রামের সব মলিনতা দূর করে, আমরা সবাই মাতোয়ারা আনন্দ যাপনে। নেই ধর্মের ভেদাভেদ, রয়েছে পারস্পরিক সম্প্রীতি। হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সবাই মেতে উঠতাম বৈশাখী আনন্দে। হৈ-হুল্লোড়ে পুরো মাঠ কাঁপিয়ে তোলা, বাঁশি আর টমটম গাড়ির শব্দে সঙ্গে চারপাশ মেতে উঠত আমাদের মতো শিশুর কলতানে।

এক অজানা ভালো লাগার নাম বৈশাখী মেলা। ছোট বোনের বায়নায় লাজুকতা মাখানো মুখ, ছোট ভাইয়ের জেদের শখ পূরণের রাগী মুখ। চুড়ির দোকানে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট বোনের লাল ফিতে, একটা আলতা, হরেক রকমের চুড়ির গুচ্ছ আরও কত কী! আমাকে এসে দেখাবে, দাদা কেমন হয়েছে? সব মিলে এত টাকা হয়েছে? একটু বেশি হলো, কিছু মনে করো না। ওই রঙের চুড়ি বাদ দিই?

আমি প্রতি উত্তরে বলতাম, 'তোর আরও কিছু লাগলে নে। আমি বাবার পকেট থেকে টাকা মেরেছি। নিজের জমানো তো ছিলই।
মাও কিছু দিয়েছে।'

বোনের মুখে ঝলমলে রোদ্দুর মাখানো। সব মলিনতা আর লাজুকতা নিমেষে বিলীন। এই আনন্দ, এই হাসিমুখ দেখতেও অন্যরকম সুখ।
আমাদের গ্রামের কালীবাড়িতে মেলা বসত। চৈত্রসংক্রান্তির দিন থেকে ছুটে আসত মানুষ। বটগাছের নিচে হরেক রকমের দোকানপাট। অনেকেই আসতো বহু পথ পেরিয়ে, দলে দলে। কত রকমের জিনিস, কত রঙের মানুষ!

নাগরদোলায় বাচ্চাদের রকস্টারের মতো চিৎকার আর সবচেয়ে মজা লাগত রাধা কাকার জাদুর খেলা দেখতে। কাগজ দিয়ে টাকা বানাত। মানুষ থমকে যেত নদীর স্রোত থমকে যাওয়ার মতো। চোখের পাতা পেরেক দিয়ে আটকে রাখার মতো, যখন বড়শি পিঠে গেঁথে দিয়ে চড়ক ঘোরাত। ভয় আর শিহরণ এক করে আমরা দাঁড়িয়ে যেতাম। চড়ক থেকে নামিয়ে দোকানে দোকানে চাঁদা তুলত।

দিন গড়িয়ে রাতের আগমনে মেলার সৌন্দর্য বেড়ে যেত। রাত মানে খেলার পরিধি বাড়ানো। পরিবার নিয়ে সবাই একসঙ্গে দেখতাম। লাঠি খেলা, সং। কবর খুঁড়ে মানুষ রেখে দিত। তাকে আবার জীবিত করত। কত ধরনের গ্রামীণ ছোট নাটিকা। মানুষজন হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ত। গ্রামের মানুষের সারা দিনের সব ক্লান্তি দূর হয়ে যেত। সারা বছরের বেদনা ভুলে আনন্দে মেতে উঠত। ভুলে যেত নিজেদের অভাব-অনটনের কথা। মনে পড়ে, বাদুল্লা কাকার নাচ। বয়স সত্তরোর্ধ্ব হলেও, মেতে উঠত তারুণ্যে। মঞ্চে উঠে শুধু নিজে মেতে উঠত না, সবাইকে মাতিয়ে রাখত। রাতে চলত পালা গান, জারি গান; চলত বৈশাখীর মজার মজার কথামালা। পুরুষ মানুষকে নারী সাজিয়ে চলত আরও হরেক রকমের আয়োজন। আমার বাড়িতে ডা. দিলীপ দাদা ঝুড়ি কিনে দিয়ে যেত, তিনি বড় বৈশাখী মেলা থেকে ঘুরে আসতেন। আমরা অপেক্ষায় থাকতাম দাদার ঝুড়ি খাবারের। কখন আসবে।

কত বছর হলো গ্রামে মেলায় যাই না। শুনেছি বাদুল্লা কাকা মারা গেছেন, রাধা কাকাও নেই। আগের আয়োজকরা বয়সের ভাড়ে নুয়ে পড়েছেন। দিলীপ দাদা কোথায় আছেন জানি না। শুনেছি তিনি নাকি গ্রাম ছেড়েছেন। মলিন হয়ে গেছে সব আয়োজন। পরবর্তী প্রজন্ম পারেনি ধরে রাখতে এই মেলার ঐতিহ্য। আমার মনে আছে প্রায় ১০ কিলোমিটার হেঁটে হেঁটে আঙ্গারু মেলায় যেতাম। রাস্তায় মানুষ আর মানুষ। চারদিক থেকে কেউ মেলায় ছুটছে, আবার কেউ ফিরছে। সবার হাতে হাতে থাকত নানান রকম জিনিসপত্র। এখন কী মেলা আছে, আছে সেই মহামিলন।

এবার খুব ইচ্ছে করছে গ্রামের সেই বৈশাখী মেলায় যেতে। মেলা থেকে শখের হাঁড়িতে খাগড়াই, বাতাসা আর চিনির ছাঁচ কিনতে। এখন কি সেই মেলা আছে, আছে কি মজার আয়োজনগুলো, জানা নেই...।
দপ্তর সম্পাদক, ঢাকা কেন্দ্রীয় কমিটি