ফাতেমা তুজ জোহরা। পুলিশ এভিয়েশন উইংয়ের প্রথম নারী পাইলট। গত ১৬ মার্চ সম্পন্ন হয়েছে তার একক উড্ডয়ন। ২০২১ সালের জুলাই মাসে আর্মি এভিয়েশন স্কুলে চারজন পুলিশ কর্মকর্তাকে নিয়ে শুরু হয় এভিয়েশন বেসিক ট্রেনিং কোর্স। সেখানে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর ১০ কর্মকর্তার সঙ্গে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ৩৬তম বিসিএসের ফাতেমা তুজ জোহরা। মানসিক, শারীরিক সুস্থতা, দক্ষতা, সক্ষমতা ও তৎপরতার নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং চূড়ান্ত অ্যাপটিটিউড টেস্ট দিয়ে উড়োজাহাজের ককপিটে পাইলটের সিটে বসেছেন পুলিশের প্রথম নারী পাইলট। এভিয়েশন বেসিক কোর্সে বিভিন্ন বাহিনীর ১০ জন প্রশিক্ষণার্থীর মধ্যে তাত্ত্বিক বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে প্রথম স্থান অর্জন করেন ফাতেমা তুজ জোহরা।

পাবনা থেকে ঢাকায়
ফাতেমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা পাবনায়। রাজবাড়ীর পাংশা গার্লস হাইস্কুল থেকে এসএসসি শেষে পাংশা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লায়েড ফিজিকস, ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগ থেকে। ছাত্রাবস্থায় ভেবেছিলেন উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় ক্যারিয়ার গড়বেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি না পেরুতেই বদলাতে থাকে প্রেক্ষাপট। বদলে যায় ভাবনাও। মনোযোগ দেন ক্যারিয়ার গড়ায়। বসেন বিসিএস পরীক্ষায়। প্রিয় শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় পছন্দের তালিকার শুরুতেই রাখেন পুলিশ।

সিআইডি সাইবার ইউনিটে
৩৬তম বিসিএস দিয়ে ২০১৮ সালে যোগ দেন বাংলাদেশ পুলিশে। শুরুতেই প্রশিক্ষণ। এই প্রশিক্ষণ শেষে কাজ শুরু করেন সিআইডি সাইবার পুলিশ ইউনিটে। সেখানে তার কাজ ছিল ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে। কাজ করতে গিয়ে সাইবার প্ল্যাটফর্মে সংঘটিত অপরাধ ও নিতান্ত অসচেতনতার কারণে সাধারণ মানুষের ভিকটিমে পরিণত হওয়ার অসহায় চিত্র মনে দাগ কাটে ফাতেমার। তখন ফাতেমারা একজন অ্যাডিশনাল এসপির নেতৃত্বে আন্তরিকতা ও সংবেদনশীলতা নিয়ে চেষ্টা করতেন মানুষের পাশে দাঁড়াতে। কর্মক্লান্ত প্রতিটি দিনের শেষে টিমের সদস্যদের মুখে তখনই হাসি দেখা যেত, যখন একজন ভিকটিমের মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠত।

ওড়ার স্বপ্ন সত্যি হলো
২০২১ সালের জানুয়ারিতে পুলিশ সদরদপ্তর থেকে একটি চিঠি পান ফাতেমা। তাতে পাইলট হতে আগ্রহীদের কাছ থেকে আবেদনপত্র চাওয়া হয়। চিঠিটা পেয়ে কিছুটা অবাকই হলেন ফাতেমা। ভাবেন, পাইলট; আকাশে ওড়ার সুযোগ! এই সুযোগ তো আর হাতছাড়া করা যায় না। দ্রুত আবেদনপত্র জমা দিয়ে দেন তিনি। একসময় ডাক আসে ফাতেমার। এরপর শুরু হয় পাইলট হওয়ার প্রস্তুতির বিভিন্ন ধাপ। বসতে হয় নানা পরীক্ষায়। মানসিক, শারীরিক সুস্থতা, দক্ষতা, সক্ষমতা, তৎপরতাসহ রাজ্যের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চূড়ান্ত পরীক্ষা অ্যাপটিটিউড টেস্ট দেন আর্মি এভিয়েশন গ্রুপে। তারপর ২০২১ সালে ৪ মার্চ আসে উড়োজাহাজের ককপিটে পাইলটের সিটে বসার প্রাথমিক সুযোগ। তখন থেকেই বাড়তে থাকে টেনশন; একই সঙ্গে উপরে উঠতে থাকে উত্তেজনার পারদও। পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর বাছাই প্রক্রিয়া শেষে গত বছরের ২ জুলাই আর্মি এভিয়েশন স্কুলে চারজন পুলিশ কর্মকর্তা নিয়ে শুরু হয় এভিয়েশন বেসিক ট্রেনিং কোর্স। সেখানে তাদের সঙ্গে ছিলেন সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর কর্মকর্তারাও। গত মাসে সম্পন্ন হয়েছে তাদের একক উড্ডয়ন। ১৬ মার্চ সলো ফ্লাইং বা একক উড্ডয়ন শেষে নিরাপদে ল্যান্ড করেন ফাতেমা। ওড়ার স্বপ্ন তাহলে সত্যিই হলো ফাতেমার।

ফাতেমার জন্য অপেক্ষা
এয়ার উইংয়ের অংশ হওয়াকে একটি বড় সুযোগ হিসেবেই দেখেন ৩৬তম ব্যাচের সহকারী পুলিশ সুপার ফাতেমা তুজ জোহরা। কারণ এটা সম্পূর্ণ আলাদা একটা জগৎ। ফাতেমাদের ট্রেনিং এয়ারক্রাফট দিয়ে সার্কিটে ঘোরা শেখানো হয়। ইনস্ট্রাক্টর যখন প্রশিক্ষণার্থীর বিষয়ে পুরোপুরি আস্থা পান, তখনই তাকে সলো করতে দেন। ওড়ার প্রশিক্ষণ শুরুর পর থেকেই সাধারণত সবার মাথায় ঘুরে কখন সলো ফ্লাই করব। ফাতেমারও ছিল। ফাতেমাকে ইনস্ট্রাক্টর যখন বলেন, 'ইউ আর ক্লিয়ার ফর সলো', তখন থেকেই দারুণ একটা উত্তেজনা কাজ করতে থাকে তার মধ্যে। সলোতে যখন কাউকে পাঠানো হয়, তখন তা প্রশিক্ষক, প্রশিক্ষণার্থী সবার জন্যই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। সবাই উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করে। ফাতেমার জন্যও সেদিন সবাই অপেক্ষা করে। এমন একটি মুহূর্তে একা একা টেকঅফ করে, সেফলি ল্যান্ড করে নেমে আসার পরও যেন উড়ছিল ফাতেমা তুজ জোহরা।

একক উড্ডয়ন
প্রশিক্ষণে সলো ফ্লাইট হচ্ছে ১৫ মিনিটের একটা সার্কিট কমপ্লিট করা। রানওয়ে থেকে উড্ডয়ন করে ১ হাজার ফুট ওপরে রানওয়ে চক্কর দিয়ে ল্যান্ড করা। একটি সলো ফ্লাইট সম্পন্ন করতে সাধারণত ১৫ মিনিট লাগে। উড্ডয়নের পর ল্যান্ডিং সবচেয়ে কঠিন বলে ধরা হয়। রানওয়ে থেকে উড্ডয়ন করার পর কোনো কারণে ল্যান্ড করতে সমস্যা হলে আবারও সার্কিটটি পূর্ণ করে নেমে আসতে হয়।

পুলিশ এয়ার উইং এবং আগামীর প্রত্যাশা
পুলিশ এয়ার উইংয়ের জন্য রাশিয়া থেকে দুটি হেলিকপ্টার আনা হচ্ছে। এয়ার উইং চালুর ফলে বাংলাদেশ পুলিশ ত্রিমাত্রিক ক্ষেত্রে সক্ষমতা অর্জন করবে। এটি দুর্গম অঞ্চলে দ্রুত যোগাযোগ, গুরুত্বপূর্ণ অভিযান পরিচালনা, তল্লাশি অভিযান এবং উদ্ধার কার্যক্রমে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। বর্তমান পুলিশ এয়ার উইংয়ের পূর্ণাঙ্গ এয়ার উইং হতে সময় প্রয়োজন। মাত্র তো শুরু। ১৬৮ জন লোকবলের একটি চাহিদা তৈরি করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদনের পর তাদের প্রশিক্ষণেরও প্রয়োজন পড়বে। তবে র‌্যাব প্রথম পাঁচ বছর এয়ার উইং মেইনটেন্যান্স সাপোর্ট দিতে পারে। ফাতেমার ভাষায়, 'আমরা মাত্র চারজন। পূর্ণাঙ্গ এয়ার উইংয়ের জন্য আমাদের আরও অনেক পথ হাঁটতে হবে। নতুন নতুন ছেলেমেয়েরা এই উইংয়ে যুক্ত হবে। তারুণ্য ও দক্ষতা দিয়ে দেশের মানুষকে পুলিশ আরও ভালো সেবা দিতে পারবে।' পুলিশ এয়ার উইংয়ের কাছে এমন প্রত্যাশা আমারও!