আজকের বিশ্ব সবার নাগালের মধ্যে স্থিত হয়েছে। দীর্ঘ সময়ের ক্লান্তিবিহীন চলা আর পরিস্থিতির প্রয়োজনে উদ্ভাবনের প্রতি বিশ্বাস রেখে মানুষ স্বপ্ন দেখেছে নতুন দিনের। সৃষ্টি হয়েছে সম্পর্ক, দেশে দেশে আর মানুষের সঙ্গে মানুষের। নতুন উদ্ভাবন, জ্ঞান, কৌশল কিংবা দক্ষতা মানুষকে ভাবিয়েছে বন্ধনের গভীরতা নিয়ে। আরও এগিয়ে যাওয়ার সংকল্প বাস্তবায়নের রূপরেখা সহজতর করে বুনন করা এক সতেজ সমাজ, যা বৃহৎ তান্ত্রিকতায় মানব সমাজ নামে পরিচিতি পেয়েছে। মানব সমাজ এক দিনে তৈরি হয়নি, এক দিনে সর্বোচ্চ সাফল্যের পতাকা উড়িয়ে স্থান করে নিতে পারেনি। প্রয়োজন হয়েছে অপেক্ষার, ত্যাগের আর নিরলসভাবে লেগে থাকার ইচ্ছান্তর। মানুষ ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র, বন্ধুত্ব হয়েছে প্রকৃতির সঙ্গে। আবার বিরোধিতার সংলাপও কম হয়নি। সংগ্রামের উপজীব্যে মূল ভূমিকায় অভিনয় করছে মানুষ এবং সৃষ্ট সম্প্রীতির গাঢ় পরিচয়। এসব পরিচয় সময়ের ধাক্কায় ঠিকানা বদল করেছে, বদল করেছে অভিনয়ের সংলাপ আর চরিত্রের সহজাত রূপায়ণ। তবে এতে কেউ থেমে যায়নি।

মানুষ থেমে যাওয়ার জন্য বিশ্ব মণ্ডলে আবির্ভূত হয়নি। এগিয়ে যাওয়াই মানুষের জন্মগত মনীষা। এগিয়ে যেতে হবে। তবে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সমাজের তল্লাটে সৃষ্ট সম্পর্ককেন্দ্রিক গোষ্ঠীগুলো পরস্পর ঐক্যবদ্ধ সংগীতে প্রভাব ধরে রেখেছে পরিচিতির অনুশীলিত ব্যাকরণ কিংবা নামকরণে।
মানুষ পরিবারকে আঁকড়ে ধরে সম্পর্কের গাঁথুনি মজবুত করে। পালন করে দায়-দায়িত্ব। বাড়িয়ে দেয় স্নেহাশিস আবেগের পরিধি। অর্থাৎ পরিবারের অভিভাবক কিংবা দায়িত্বশীল ব্যক্তিদ্বয় পরিবারের নবীন সদস্যদের সমাজ ও সম্পর্কোপযোগী ব্যক্তিতে পরিণত করার ক্ষেত্রে এগিয়ে আসে। নব্য উদ্ভাবিত কিংবা অধিকাংশ মানুষ দ্বারা ব্যবহূত প্রযুক্তিগত উপকরণ মানুষের আচরণে পরিবর্তন আনে। মানুষকে অন্বেষণে উদ্বুদ্ধ করে। এ অন্বেষণ হলো মানুষ খোঁজার পদক্ষেপ কিংবা মানুষকে ধরে রাখার সক্রিয় কৌশলের প্রয়োগ। মানুষ যত বেশি মনুষ্য বৈশিষ্ট্য দ্বারা প্রভাবিত হবে, তত বেশি টিকে যাবে সম্পর্ক আর দায়িত্বের ঐতিহ্য; যা দায়ের পরিধি দ্বারা নির্ধারিত ও অগ্রগতির শিরোনামে উপস্থাপিত।

চলতি সময়ে দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহূত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ইন্টারনেট, বিনোদন অ্যাপস, টিকটক, লাইকিসহ অন্যান্য উপকরণে তরুণ সমাজ বেশি আগ্রহান্বিত ও ব্যবহারকারী। কিন্তু বিষয় হলো, এসব প্রযুক্তি ও মাধ্যমের ব্যবহার দেশীয় ইতিহাস, সম্পর্কের দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক শিষ্টাচার ও সমষ্টিভিত্তিক আদবনামা অনুসারে পালন করা অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু এভাবে ব্যবহার হচ্ছে না। হচ্ছে নিজের খুশি মাফিক। এখান থেকেই উৎপত্তি হয় সমাজে ও আচরণের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সূচনাপর্ব ও প্রয়োজনীয় কারণের জোগানদাতা।

সামাজিক মাধ্যমসহ অন্যান্য উপকরণ ব্যবহারে পরিবারের অভিভাবক মহলকে বন্ধুত্বের পরিবেশে শিক্ষার ও আলোচনার আয়োজন করতে হবে এবং এটি অপরিহার্য। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সাইবার অপরাধ, ইনার কিলিং, মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করাসহ হেনস্থা করার নানা কূটকৌশল। এসব বিষয়ে পরিবারে খোলামেলা আলোচনা ও সংলাপের ব্যবস্থা না থাকলে তরুণরা দিকনির্দেশনা পাবে না। ফলে বিপদগ্রস্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়ে যায়।

প্রতিনিয়ত মানুষ আতঙ্কে থাকে নিজের সম্মান ও অবস্থান নিয়ে। কারণ মানুষ অন্যকে অপদস্থ করার একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পুঁজি করে নিজের বীরত্ব প্রমাণের চেষ্টা করছে। এটি স্পষ্টত অপকৌশল, যা অনভিপ্রেত ও সমর্থন অযোগ্য। ভালো-মন্দের মিশেলে তৈরি এসব মাধ্যম মানুষকে যেমন সতেজ ও সজীব করে যোগাযোগ ও সম্পর্কের বেষ্টনীতে, তেমনি মানুষকে হীন করে, অসম্মান করে উপস্থাপন করার উদাহরণগুলো সংখ্যায় বেশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

তরুণরা কীভাবে শিখে- এ বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা ও তর্কাতর্কির অবকাশ রয়েছে। তবে তরুণরা পরিবার ও অভিভাবকের মাধ্যমে সমাজের প্রচলিত রীতি ও সম্পর্কের পরিচর্চা বিষয়ে অবগত হয়। সমাজের পরম্পরা এভাবে টিকে থাকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম, যুগের পর যুগ। সমাজকে টিকিয়ে রাখতে হলে অতীত অনুসরণ অপরিহার্য। নতুনকে গ্রহণ করা ক্ষেত্র বা পরিবেশ সম্পর্কে যথেষ্ট আলোচনা পরিবারে থাকা চাই। পরিবারই উপযোগী করে গড়ে তোলে তরুণ সদস্যদের। তরুণরা ধরে রাখে সম্পর্কের পরম্পরা, পরিচিতির সামাজিক রীতি ও বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা।

সমাজের গতি সামনের দিকে অগ্রসরের ক্ষেত্রে এর বিকল্প নেই। আর আমাদের মতো রীতিনিষ্ঠ সমাজ কাঠামোতে সম্পর্ক ও পরিচিতি একটি অপরিহার্য মানদণ্ড, যা মানুষকে এক করে রাখে। সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, যা কিছু নোংরা, অগ্রহণযোগ্য কিংবা উন্নয়ন পরিপন্থি তার বিরুদ্ধে। ঐক্যবদ্ধের নীতিমালা এভাবে সমাজকে অন্ধকার থেকে আলোতে আনে, সংযোজন ঘটায় শুভবোধের চর্চায়, যা প্রতিনিয়ত হওয়া জরুরি।

সমাজের প্রচলিত রীতি অনুসারে তরুণ প্রজন্মকে গড়তে পরিবার বা সমাজের অভিভাবকদের মনে রাখা প্রয়োজন যে, যোগ্য না হলে ধ্বংস করবে, বিপদ এসে জায়গা করে নেবে, সারাক্ষণ অস্থিরতা হবে আচরণে, শুভবোধকে বিদায় করবে বিশৃঙ্খল ও উন্মাদ আকাঙ্ক্ষা দিয়ে। এসবের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। রাষ্ট্রিক পদক্ষেপ সীমিতই থাকে এসব ক্ষেত্রে।

সামাজিক বিষয় সমাজলব্ধ উপকরণ বা আধেয় দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে। আইনি কাঠামো কিংবা সরকারি কর্মসূচি খুব কম ভূমিকা রাখতে পারে। সামাজিক পরিপকস্ফতা অভ্যাসের বিষয়। অভ্যাসে পরিণত করতে না পারলে সমাজ কুক্ষিগত হয়ে পড়ে। যাদের হাতে সমাজ বন্দি হয়ে পড়ে তারা স্বার্থান্বেষী ও চরিতার্থ গোষ্ঠী। এর বিরুদ্ধে সমবেত সংগ্রাম ও সোচ্চার ভূমিকা প্রয়োজন। খুব স্পষ্টত দৃশ্যমান যে, সমাজ কিংবা পরিবার কাঠামোতে ব্যক্তিকেন্দ্রিক বা নিজ পরিবার-সংশ্নিষ্ট ভাবনা মানুষকে তৈরি করে মানুষের জন্য, দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য এবং এগিয়ে যাওয়ার বাসনা পূরণে। এ যুদ্ধ বা সংগ্রামে শিখন অপরিহার্য। পরিবার মূল কেন্দ্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ থেকে তরুণ সমাজকে এগিয়ে রাখার তাড়না তৈরিতে কাজ করবে। সংলাপ হবে পরিবারে, সমাজে, প্রতিষ্ঠানে ও রাষ্ট্রে। মনে রাখা প্রয়োজন, যা কিছু দেখতে পাওয়া যায় ঘরের বাইরে, সবকিছু তার সৃষ্টি হয় ঘরের ভেতর মহলে। যোজন থেকে যোজন, দূরত্ব থেকে দূরত্ব- মানুষ ভেঙে দিতে পারে ইচ্ছার মনোবলে।

ইচ্ছার মনোবল শক্তিশালী না হলে অথবা ভঙ্গুর হলে মানুষ দাম্ভিক হয়ে ওঠে। ব্যক্তিস্বার্থ দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়। এ জন্য প্রয়োজন প্রস্তুতির, প্রয়োজন নিজ সমাজ-সংস্কৃতির প্রতি সদ্ভাব বজায় রাখা। আস্থাশীল থেকে এগিয়ে যাওয়ার মনস্কাম রেখা তৈরি এবং সবাইকে সম্পৃক্ত করার মানসিকতা ধারণ। মানুষ ভাবে যুক্ত হওয়ার আগে, মানুষ উপলব্ধি করে সম্পৃক্ত হওয়ার প্রেক্ষাপট কীরূপে ফিরে আসতে পারে জীবনে। মানুষ ভয় পায় যদি হারিয়ে যায়। তবে হারাবে না নিজেদের কোনো কিছু যদি তা নিয়ম-নীতির আদলে অনুশীলনের কৌশল ও প্রচলিত ধারা ধরে রাখার ঐক্যবদ্ধ নীতি মানুষকে প্রভাবিত করে।
লেখক :কবি ও শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়