২২ এপ্রিল ছিল বিশ্ব ধরিত্রী দিবস। পৃথিবীকে নিরাপদ এবং বাসযোগ্য রাখতে জলবায়ু সংকট রোধে বিশ্বের পরিবেশ সচেতন মানুষ দিবসটি গুরুত্ব সহকারে পালন করে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর ভাগ্যে কী ঘটতে পারে এবং তা থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে কে কী ভাবছেন, তা নিয়ে লিখছেন গোলাম কিবরিয়া

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আক্ষেপের সুরে তার কবিতায় বলেছিলেন, 'যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,/ তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো।' রবিঠাকুরের এ পরিবেশ ভাবনা তার সময়কার। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে সে ভাবনায় প্রভাবিত।

জাতিসংঘের জলবায়ু বিজ্ঞান প্যানেলের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কার্বন নির্গমন এখনও বেড়ে চলেছে। দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এক টুইট বার্তায় লিখেছেন, তিনি জলবায়ু-সংক্রান্ত অনেক রিপোর্ট দেখেছেন। আইপিসির সাম্প্রতিকতম রিপোর্ট যেভাবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার ক্ষেত্রে নেতৃত্বের ব্যর্থতা তুলে ধরেছে, এমন ভয়াবহ চিত্র এর আগে কখনও তিনি দেখেননি।

আইপিসিসির যুগ্ম প্রধান হান্স-অটো পোর্টনার বলেন, পৃথিবীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ এক দশক শুরু হচ্ছে। তবে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য হাতে সময় খুব কম। তার মতে, গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের মাত্রা আরও অনেক কমানো সবচেয়ে জরুরি। সেই সঙ্গে পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে হতাহতের সংখ্যা কমাতেও উদ্যোগ নিতে হবে বলে পোর্টনার মনে করেন।

কার্বন নিঃসরণ বাড়ছে
ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তন হিসেবে ধরলে ২০১৯ সালে ৫৯ গিগাটন কার্বন নিঃসরণ হয়েছে। ২০১০ সালের ৫২ দশমিক পাঁচ গিগাটনের তুলনায় এ পরিমাণ বেড়েছে ১২ শতাংশ, অর্থাৎ গত এক দশকে কার্বন নিঃসরণ প্রতি বছর ১ দশমিক ৩ শতাংশ হারে বেড়েছে।

তাপমাত্রা বৃদ্ধি কমাতে হবে
তাপমাত্রা বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম রাখতে পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে জাতিসংঘের জলবায়ু প্যানেল। বর্তমান নির্গমনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া হলে তাপমাত্রা তিন দশমিক দুই ডিগ্রি বাড়বে বলে ধারণা করা আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সীমিতকরণ
উষ্ণতা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে আটকে রাখতে বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সীমিত করতে হবে। ২০৫০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৩ থেকে ২ দশমিক ৭ শতাংশ পর্যন্ত নেমে আসবে।

পরিবেশবান্ধব উপকরণে গুরুত্ব
তাপমাত্রা বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে সব গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন অর্ধেক এবং ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। এর মানে, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বে ৯৫ শতাংশ কয়লা, ৬০ শতাংশ তেল এবং ৪৫ শতাংশ গ্যাস কম ব্যবহার করতে হবে। একই সঙ্গে ভবন নির্মাণে পরিবেশবান্ধব উপকরণের ব্যবহার বাড়াতে হবে।

জীবনযাপনে পরিবর্তন
বিভিন্ন দেশের সরকারকে ভ্রমণ কমাতে বাড়ি থেকে কাজকে উৎসাহিত করা, সাইকেল চালানো এবং গাড়ির ব্যবহার কমিয়ে হাঁটতে উৎসাহ দেওয়া বা মাংস খাওয়ার চেয়ে উদ্ভিদভিত্তিক খাবারের প্রচার করার মতো ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে প্যানেলের প্রতিবেদনে।
জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট এখন দৃশ্যমান। গত বছরের শেষদিকে কানাডায় ঘটে গেছে ইতিহাসের সর্বোচ্চ তাপদাহ। প্রচণ্ড তাপদাহে সেদেশে প্রায় ১০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। জার্মানির পশ্চিমাঞ্চলে রেকর্ড পরিমাণ অতি বৃষ্টি হয়েছে, সৃষ্টি হয়েছে বন্যার। সেই বন্যার প্রকোপে প্রাণ হারিয়েছেন শতাধিক মানুষ। বন্যায় প্লাবিত হয়েছে নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড ও বেলজিয়াম। ক্যালিফোর্নিয়া, উত্তর আমেরিকার কিছু অঞ্চল, সাইবেরিয়া, ইউরোপের দক্ষিণাঞ্চল দাবানলে পুড়েছে। পশ্চিম ইউরোপে হয়েছে নজিরবিহীন বন্যা। গ্রিস ও আলজেরিয়ায় দাবানলে পুড়েছে শত শত মানুষ। আলজেরিয়ার ১৮টি প্রদেশের ৭০টিরও বেশি জায়গায় দাবানল ছড়িয়ে পড়ে। ১৩৪টি দেশ এখন দাবানলের হুমকির মুখে, যা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। ২০২০ সালে পৃথিবীর প্রায় ২০ শতাংশ এলাকা খরার সম্মুখীন হয়েছে। এর সবই হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে।

ক্লাইমেট রিজিলিয়েন্ট শহর মোংলা
একসময় বন্যা ও নদীভাঙনে জর্জরিত শহর ছিল মোংলা। বর্তমানে ইপিজেডসহ বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে সেখানে। শহর রক্ষা বাঁধসহ প্রভৃতি উন্নয়নের ফলে আশপাশের জেলার জলবায়ু শরণার্থীরা বড় শহরে না গিয়ে সেখানে নতুন জীবন শুরু করতে পারছেন। মোংলাকে ক্লাইমেট রিজিলিয়েন্ট শহরে পরিণত করা হয়েছে। এ রকম আরও ২০টি শহর নির্বাচিত করা হয়েছে ক্লাইমেট রিজিলিয়েন্ট শহর হিসেবে গড়ে তোলার জন্য।

আশার কথা
জাতিসংঘের ২৬তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনটি করোনা মহামারিকালে ছিল রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সবচেয়ে বড় সম্মেলন। স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোয় গত ১২ নভেম্বর সম্মেলনটি শেষ হয়। বাংলাদেশ এবারের জলবায়ু সম্মেলনে মূলত ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম (সিভিএফ) ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) জোটের মাধ্যমে কথা বলেছে। এ দুই জোটের অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রগুলো একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিপন্ন ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে। ফলে তাদের ক্ষয়ক্ষতিও বেশি হচ্ছে।

বাংলাদেশ এ দুই জোটের দেশগুলোর পক্ষে কার্বন নিঃসরণ কমানো এবং জলবায়ু তহবিলের পরিমাণ বাড়ানো ও তা পাওয়ার শর্ত শিথিলের পক্ষে অবস্থান নেয়। এই শতাব্দীর মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা যাতে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি না বাড়ে, সে জন্য বাংলাদেশ শুরু থেকে শক্ত অবস্থান নিয়েছিল। সম্মেলনে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশ পরিকল্পনায় থাকা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ থেকে সরে আসার ঘোষণা দেয়।

বাংলাদেশে পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সাসটেইনেবল ইনিশিয়েটিভ ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাকশনের (সিডরা বাংলাদেশ) প্রতিষ্ঠাতা শেখ শাহরিয়ার পান্না বলেন, আমাদের পরিবেশ সংরক্ষণে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ ছিল 'গ্লোবাল অক্সিজেন আওয়ার'। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা এবং পরিবেশ ঝুঁকিতে পুরো পৃথিবী। যেখানে বিশুদ্ধ অক্সিজেন অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং পর্যাপ্ত অক্সিজেনের প্রাপ্যতা উল্লেখযোগ্য। গ্লোবাল অক্সিজেন আওয়ারের মাধ্যমে ২০২১ সালের জুলাই মাসজুড়ে আমরা বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, সিয়েরা লিওন, নাইজেরিয়া থেকে একসঙ্গে আমাদের গ্লোবাল অ্যাম্বাসাডরদের মাধ্যমে একটি বার্তা উল্লেখযোগ্যভাবে সবার কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছি। আপনি আপনার নিজের অক্সিজেন নিশ্চিত করতে অন্তত একটি করে গাছ লাগান। পাশাপাশি আমরা একটি ফটোগ্রাফি এক্সিবিশন করেছি 'ওয়েলনেস অব বাংলাদেশ'। যেখানে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় ছিল কভিডকালীন সময়ে পরিবেশের পরিবর্তন এবং স্বাস্থ্যের ওপর পরিবেশের প্রভাব।

ধরণিকে আবাসযোগ্য করে রাখতে সবার চেষ্টার যেন কমতি নেই। তবে দেরিতে হলেও পরিবেশের প্রতি সবার সুবিবেচক হয়ে ওঠার বিষয়টি মনের মাঝে আশার সঞ্চার করবে নিঃসন্দেহে। অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে, ধরিত্রীকে সবুজ ও সতেজ রাখার আহ্বান পৌঁছে দিতে হবে সবার কাছে।
কবি রবিঠাকুর বলেছেন, 'দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর, লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী, দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি'