যে কোনো বড় শিল্প বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়তে শত শত কোটি টাকার প্রয়োজন হয়। কখনও দরকার পড়ে হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ। শুধু বাংলাদেশ নয়, উন্নত দেশসহ বিশ্বের কোনো দেশেই এমন কোনো বৃহৎ শিল্প বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পাওয়া যাবে না, যার পুরো বিনিয়োগ হয়েছে উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ীর নিজের অর্থে।

ব্যবসার শুরুতে তো বটেই, পরবর্তী সময়ে ব্যবসা আরও বড় করতে সব উদ্যোক্তারই বাড়তি অর্থের প্রয়োজন পড়ে। নিজের সামর্থ্যের পর ব্যবসা শুরুর জন্য প্রয়োজনীয় বাড়তি অর্থায়ন বা বিনিয়োগ চাহিদা মেটাতে তারা ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হন।

আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পৃথিবীর অনেক দেশেই দীর্ঘমেয়াদি এ অর্থায়নের জন্য ব্যাংক নির্ভরতা কম। পুঁজিবাজার প্রধান উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিশ্বের সব উন্নত দেশে। উন্নত বিশ্বের মতো অনেক আগে থেকেই অনেক উন্নয়নশীল দেশও ব্যবসায় সহজ ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন চাহিদা মেটাতে সে পথে হাঁটছে। এ ক্ষেত্রে এখনও ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। তবে যাত্রা হয়েছে।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশে পুঁজিবাজার বলতে এখনও উদ্যোক্তা মনে করেন, এখানে বুঝি শুধু শেয়ার বিক্রি করে মূলধন সংগ্রহ করা যায়। কিন্তু এখনও উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা পরিবারের বাইরে কাউকে অংশীদার করতে চান না। ফলে শেয়ারবাজারমুখী হতে চান না।
ব্যবসায় কী ধরনের অর্থায়ন প্রয়োজন :যে কোনো বড় শিল্প বা কারখানা প্রতিষ্ঠার জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি দুই ধরনের অর্থায়ন দরকার। ব্যবসার শুরুতে মূলধনি বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজন বড় অঙ্কের অর্থায়ন। কারখানার অবকাঠামো স্থাপন বা মূলধনি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে এ অর্থায়ন দীর্ঘমেয়াদি বা স্থায়ী অর্থায়ন হওয়াও দরকার। ব্যবসার কাঁচামাল বা পণ্য ক্রয় এবং প্রশাসনিক ব্যয় মেটাতেও অর্থের দরকার। তবে এ অর্থের পরিমাণ টাকার অঙ্কে সাধারণত মূলধনি বিনিয়োগের তুলনায় কম হয়, আবার স্বল্পমেয়াদি হলেও চলে।

পুঁজিবাজারের বিকল্প নেই :ব্যাংক ঋণের বড় সমস্যা হলো- ঋণ গ্রহণের পরই তার সুদ সমেত ফেরত দেওয়া শুরু করতে হয়। অবশ্য মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে কিছু ক্ষেত্রে ছয় মাস বা বছর গ্রেস পিরিয়ড মেলে। এনার্জি প্যাক পাওয়ার জেনারেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন রশিদ বলেন, বাস্তবতা হলো ওই সময়ের মধ্যে কোম্পানি বা কারখানা ব্যবসায় আসতে পারে না। ফলে সুদসহ ঋণ পরিশোধে সমস্যা তৈরি হয়। অর্থাৎ আয় না থাকলেও সুদ দিতে গিয়ে মূলধন ভাঙাতে হয়, না হয় অন্য ব্যবসার টাকা এনে দিতে হয়। আবার ঋণ অর্থাৎ মূল বিনিয়োগের অর্থ ফেরত দিতে গিয়ে নতুন করে অর্থ সংকটে পড়েন। এভাবে ব্যবসায়ী ঋণ জালে বাধা পড়েন। আবার কোম্পানি বা কারখানা প্রতিষ্ঠার সময় যে পরিমাণ মূলধনি বিনিয়োগ হয়, তা ওই কোম্পানির মুনাফা থেকে ১০-১৫ বছরেও পরিশোধ করা সম্ভব হয় না। আবার ব্যাংক এত দীর্ঘ সময়ের জন্য ঋণও দিতে পারে না।

মার্চেন্ট ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান এএএ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওবায়দুর রহমান বলেন, এ ক্ষেত্রে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহই সবচেয়ে ভালো মাধ্যম। যেহেতু অর্থায়নকারীরাও কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার হন, ফলে এ অর্থ কখনোই ফেরত দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তাই ব্যবসার মূলধন কমে যাওয়ারও সম্ভাবনা থাকে না। এ নিয়ে উদ্যোক্তার ওপর বাড়তি চাপও তৈরি হয় না। অংশীদার না করেও বন্ড বা ডিবেঞ্চার (ঋণপত্র) ইস্যু করে পুঁজিবাজার থেকে ১০ থেকে ২০ বছর মেয়াদে অর্থ সংগ্রহ করা যায়। এ ক্ষেত্রে উদ্যোক্তা চাইলে মেয়াদ শেষে বা প্রতি পাঁচ বা যে কোনো মেয়াদ শেষে কিছুটা অর্থ পরিশোধ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে শুধু বছরান্তে সুদ প্রদান করলেই চলে। আবার ডিসকাউন্টেও বন্ড ইস্যু করে অর্থ সংগ্রহ করে ৫ থেকে ১৫ বছর মেয়াদ শেষেও অর্থ পরিশোধের সুযোগ আছে। এ ধরনের বন্ড 'জিরো কুপন' বন্ড হিসেবে সমধিক পরিচিত।

বন্ড বাজারের যাত্রা :১৯৫৬ সালে ঢাকার শেয়ারবাজার যাত্রা করলেও দীর্ঘ সাড়ে ছয় দশকেও এ বাজারে কার্যকর বন্ড বাজার তৈরি হয়নি। এ বাজার কেবল 'ইক্যুয়িটি' বা মূলধনি বাজারই রয়ে গেছে। অর্থাৎ শেয়ার বিক্রি করে কোম্পানি কিছু মূলধন সংগ্রহ করে। তার ওপর দেশের নিবন্ধিত হাজার হাজার কোম্পানির মধ্যে গুটিকয় এভাবে মূলধন সংগ্রহ করলেও বড় পুঁজির জন্য তারা ব্যাংকের কাছেই যান। ঋণের বাজার গড়ার কোনো ব্যবস্থাই পুঁজিবাজার থেকেও ছিল না।

বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম বলেন, বর্তমান কমিশন শুধু আইপিও নয়, বন্ড বাজারের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করতে বিভিন্ন কোম্পানিকে উদ্বুদ্ধ করছে। এখন বন্ডের আবেদন নিয়ে এলে দ্রুত সময়ে অনুমোদন হচ্ছে। কমিশন ও স্টক এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ীদের বোঝাচ্ছে যে, ব্যাংকের তুলনায় পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ সবচেয়ে লাভজনক। এ জন্য সচেতনতা তৈরিতেও সভা-সেমিনার হচ্ছে।

পরিবর্তন শুরু হয়েছে :এটাও ঠিক, আগে দুই থেকে তিন বছরে অনুমোদন মিলবে না জেনেও কিছু কোম্পানি আইপিও প্রক্রিয়ায় মূলধন সংগ্রহ করতে আবেদন করত। এভাবে আবেদন করার কারণ ছিল, কোম্পানিগুলো আগেই প্রাইভেট প্লেসমেন্ট প্রক্রিয়ায় শেয়ার বিক্রি করে বড় মূলধন সংগ্রহ করেছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রিমিয়ামও নিয়েছে। তবে বর্তমান কমিশন এক থেকে তিন মাসের মধ্যে আইপিও অনুমোদন দিচ্ছে। কোনো কোম্পানির নথিপত্রে ঝামেলা বা ঘাটতি থাকলে তা দ্রুতই বাতিল করে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে এ ক্ষেত্রে অপেক্ষা থাকার প্রয়োজন পড়ছে না। বন্ড অনুমোদনের ক্ষেত্রে আরও কম সময় নিচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। এক মাসের মধ্যেই সব যাচাই-বাছাই সম্পন্ন করে বন্ডের অনুমোদন দিচ্ছে।

সব অর্থায়নই হচ্ছে ব্যাংক থেকে :বাংলাদেশ এখনও ব্যবসা বা শিল্প প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই বড় ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের জন্য ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল। মূলধন সংগ্রহ বা ঋণ অর্থায়নের জন্য পুঁজিবাজারমুখী হন না উদ্যোক্তারা। বর্তমানে বাংলাদেশে নিবন্ধিত কোম্পানির সংখ্যা দুই লাখের বেশি। হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান অর্থায়নের প্রয়োজনে ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। কিন্তু পুঁজিবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহে এখন পর্যন্ত চারশ কোম্পানিও আসেনি। বন্ড ইস্যু করে ঋণ নিতে আসা কোম্পানি এখনও দুই অঙ্কের ঘর পার হয়নি। বর্তমানে ব্যাংক খাতের ঋণ স্থিতি ১২ লাখ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে শিল্পে ও বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া ৫০ কোটি টাকার বেশি মেয়াদি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ৭২ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৭ শতাংশের বেশি। বড় কোম্পানিকে ঋণ নিতে ব্যাংকগুলোই উদ্যোগী হয়ে বসে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে বাজার সুদহারের তুলনায় কম সুদেও চাহিদা অনুযায়ী বড় অঙ্কের ঋণ দিচ্ছে। এ কারণেও উদ্যোক্তারা পুঁজিবাজারমুখী হন না।

বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি আজম জে চৌধুরী বলেন, অন্য দেশে এ ক্ষেত্রে পুঁজিবাজার বড় সহায়তা করলেও বাংলাদেশ এখনও তেমন প্রস্তুত নয়। ব্যাংকগুলো বড় ব্যবসায়ীদের ঋণ দিতে নিজেরাই ছোটে। ফলে যখনই টাকার প্রয়োজন হয়, তখনই টাকা মেলে বলে। অনেকে সে কারণে পুঁজিবাজারমুখী হন না।

কর ফাঁকি পুঁজিবাজার বিমুখতার বড় কারণ :অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে থাকা দেশগুলোর তুলনায় তো বটেই, সমপর্যায়ের দেশগুলোর তুলনায়ও বাংলাদেশের কর আদায়ের হার জিপিডির তুলনায় সবচেয়ে কম। এর কারণ, ব্যবসায়ীদের বড় একটা অংশ কর ফাঁকি দেয়। মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর সংগঠন বিএমবিএর সভাপতি ছায়েদুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে কর ফাঁকি দিতে ভুয়া বা জাল আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করা সহজ। কিন্তু এ ধরনের আর্থিক প্রতিবেদন দিয়ে পুঁজিবাজার থেকে সহজে অর্থ সংগ্রহ করা যায় না। তার ওপর নানা পর্যায় থেকে জবাবদিহিতার প্রশ্ন আসে। ফলে শেয়ার বিক্রি করে মূলধন কিংবা বন্ড বা ডিবেঞ্চার ইস্যু করে ঋণ সংগ্রহ ব্যাংক অর্থায়নের থেকে লাভজনক ও সুবিধাজনক হওয়া সত্ত্বেও উদ্যোক্তারা সে পথে হাঁটেন না। আজম জে চৌধুরী বলেন, সব ব্যবসায়ী কর ফাঁকি দিতে চান- এমনটা ঠিক নয়। দীর্ঘমেয়াদি ও বৃহৎ অর্থায়নে ব্যাংক ঋণের ভালো বিকল্প যে পুঁজিবাজার হতে পারে, এ বিষয়ে অনেকের ভালো ধারণা নেই।

নতুন কোম্পানির অর্থায়ন সুবিধা সীমিত :শেয়ারবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের ক্ষেত্রে সংশ্নিষ্ট কোম্পানির দীর্ঘ ব্যবসার অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। অন্তত তিন বছরের পুরোনো না হলে আইপিও প্রক্রিয়ায় মূলধন সংগ্রহ করা যায় না। বন্ডের ক্ষেত্রেও তাই। একমাত্র লাফার্জ সিমেন্ট ছাড়া গ্রিনফিল্ড বা নতুন কোম্পানি হিসেবে মূলধন সংগ্রহের নজির নেই। এ ক্ষেত্রে বৃহৎ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের নতুন কোনো কোম্পানি গঠন বা প্রকল্পের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে আইপিও বা বন্ডের মাধ্যমে অর্থায়ন করা যেতে পারে।

বিশ্বাস অর্জনও জরুরি :পুঁজি সংগ্রহের জন্য শুধু উদ্যোক্তাদের পুঁজিবাজারমুখী হলেই চলবে না, পর্যাপ্ত পুঁজি সরবরাহের জন্য বিনিয়োগকারীদেরও উদ্বুদ্ধ করতে হবে। ২০২০ সালে সরকারের আশুগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ড ছেড়ে ১০০ কোটি টাকার অর্থ সংগ্রহ করতে এসে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের থেকে পুরো অর্থ সংগ্রহ করতে পারেনি। এর কারণ, সাধারণ মানুষের কাছে করপোরেট বন্ড এখনও জনপ্রিয় নয়। বন্ডে বিনিয়োগে ব্যাংকের থেকে বেশি সুদ মিললেও মানুষ জানেন না বলে বন্ডে বিনিয়োগ করতে চান না। তা ছাড়া ব্যাংকে টাকা রেখে মানুষ নিরাপদ বোধ করেন। সুদ বা রিটার্ন কম হলেও টাকা মার যাবে না- এমন বিশ্বাস সাধারণ মানুষের মধ্যে আছে। করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কাছে টাকা দিলে শেষ পর্যন্ত আসল মিলবে কিনা, তা নিয়ে মানুষের এখনও অভিজ্ঞতা নেই। এ অভিজ্ঞতা হলে পরিস্থিতি বদলে যাবে। তার জন্য আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। ভালো, বড় এবং স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানকে পুঁজিবাজারমুখী করতে হবে। তাদের শেয়ার ও বন্ড এলে এ বাজার জনপ্রিয় হবে।