সমকাল :দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম থেকে কার্যকর পুঁজিবাজার, বিশেষত ইক্যুয়িটির (মূলধনি) বাজারে বন্ড বাজার প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন। গত দুই বছরে কতটা অর্জন হলো?
শিবলী রুবাইয়াত :প্রথম বছর তো সুশাসন ফেরাতে নানা উদ্যোগ ও আইন-কানুন করতে সময় চলে গেছে। বিশ্বব্যাপী দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় বন্ড। সরকারি-বেসরকারি বড় প্রকল্পের অর্থায়ন হয় বন্ড বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহের মাধ্যমে। এরই মধ্যে কার্যকর বন্ড বাজার গড়ার কাজ প্রায় শেষ করে এনেছি। করপোরেট বন্ড বাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শিগগিরই ট্রেজারি বন্ড বাজার চালু হবে। স্বল্প মূলধনি কোম্পানিগুলোর জন্য আলাদা ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম করা হয়েছে। একেবারে ছোট বা যারা নিজেরা তালিকাভুক্ত না হয়ে শেয়ার কেনাবেচা করতে চায়, তাদের জন্য অলটারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ডও করা হচ্ছে। অর্থাৎ সব ধরনের অর্থায়নের ব্যবস্থা হিসেবে পুঁজিবাজার গড়া হচ্ছে, যার অনেক কিছুই আগে ছিল না। এক বছর পর বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের ভিন্ন মাত্রা দেখা যাবে। আগামীর পুঁজিবাজারে বন্ড বাজারই হবে বড় শক্তি।

সমকাল :বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কি আগ্রহী হচ্ছে?
শিবলী রুবাইয়াত :ভীষণ। আগে তো ব্যবসায়ীদের কাছে কোনো 'অপশন' ছিল না। এখন আছে। ফলে তারা আগ্রহী হচ্ছেন। দেখুন, একটি প্রতিষ্ঠান যখন ফ্যাক্টরি বিল্ডিং স্থাপন করে বা ক্যাপিটাল মেশিনারিজ কিনতে যায়, এগুলো তার দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ। বাংলাদেশে এখন অনেক বড় কোম্পানি হচ্ছে। ৫০-১০০ কোটি টাকার নয়, হাজার কোটি টাকার কোম্পানিও হচ্ছে। অনেক কোম্পানি আছে, যারা নতুন প্রকল্পে ১০০-৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করার সক্ষমতা রাখে। কিন্তু এ টাকা দিয়েও ব্যবসা হচ্ছে না। বাকি টাকা কোথা থেকে আসবে? এখন ব্যাংক থেকে ৫-৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিলে মাসেই ২০-৩০ কোটি টাকা কিস্তি দিতে হবে। এখন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শুরু করার আগে টাকা দিতে হলে সমস্যা হয়। তার ওপর করোনা বা অন্য কোনো কারণে ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হলে আরও সমস্যা। তখনই ওই ব্যবসায়ী খেলাপি হন। আর এক ব্যবসায় খেলাপি হলে অন্য ব্যবসার জন্য ঋণ পাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। এটা এখন ব্যবসায়ীরা বুঝতে পারছেন। তাই তারা পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহে আসছেন। বড় ব্যবসায়িক গ্রুপগুলো বন্ড ইস্যু করে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পরিশোধ করার জন্য মার্চেন্ট ব্যাংকে ভিড় করছে।

সমকাল :ব্যাংক থেকে বড় ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ অর্থায়নের সুযোগ বন্ধ করার কোনো নীতি-ব্যবস্থা কি বাংলাদেশ ব্যাংকের দিক থেকে চান?
শিবলী রুবাইয়াত :না, তার দরকার পড়বে বলে মনে হয় না। কারণ ব্যবসায়ীরা নিজেরাই তো বুঝতে পারছেন কোনটা ভালো, আর কোনটায় সমস্যা। ফলে যাদের অর্থের চাহিদা, তারা যদি পুঁজিবাজারমুখী হন, তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্যাংক থেকে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন বন্ধ হবে। কমিশন থেকে পুঁজিবাজার ও ব্যাংক অর্থায়নের পার্থক্য বুঝিয়ে বলছি। সরকার ও সরকারি সব প্রতিষ্ঠানকেই বোঝাচ্ছি। এরই মধ্যে সরকারের থেকে কয়েকটি প্রকল্পের জন্য অর্থ সংগ্রহে বন্ড ইস্যুর প্রস্তাব পাস হয়েছে। তবে বন্ড বাজার তৈরিতে এখনও বড় প্রতিবন্ধকতা হলো- ব্যাংকগুলোর শেয়ারবাজার এক্সপোজারে বন্ড থাকায় এসব প্রতিষ্ঠান বন্ডে বিনিয়োগ করতে পারছে না। তারাও স্বল্পমেয়াদি আমানতের অর্থ থেকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিতে চায় না। তারাও বন্ডে বিনিয়োগ করতে চায়। এ প্রতিবন্ধকতা দূর করতে আইনি সমস্যা দূর করতে আবেদন করেছি। আশা করছি, এ বছরের দ্বিতীয়ার্ধে সরকারি ও বেসরকারি বন্ডে ব্যাংকের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পৃথক সিদ্ধান্ত পাব।

সমকাল :বন্ড বাজার হলে ব্যাংকের সমস্যা হবে না?
শিবলী রুবাইয়াত :না, কোনো সমস্যাই হবে না। বরং ব্যাংকগুলো বড় বাঁচা বেঁচে যাবে। স্বল্পমেয়াদি আমানতের টাকায় দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিয়ে ব্যবসায়ীরা টাকা ফেরত নিতে পারছেন না। ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এখন ব্যাংকের এমডিরাই বলছেন, তারা এর থেকে বের হতে চান। তারা শুধু স্বল্পমেয়াদি ঋণ দিতে চান। এসব দিয়ে অতিরিক্ত অর্থ থাকলে তারা প্রয়োজনে বন্ডে বিনিয়োগ করতে চান। সেখানে ঋণের টাকা ফেরত পাওয়া যাবে কি যাবে না, তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। তারাও নিরাপদ বিনিয়োগ পণ্যের অপেক্ষায় আছেন। সরকারের নীতিনির্ধারকদের ভাবনায়ও বড় পরিবর্তন এনেছে। এ বছরের শেষের দিকে সবাই বড় পরিবর্তন দেখতে পাবেন। শিগগিরই আড়াই লাখ কোটি টাকার ট্রেজারি বন্ডের সেকেন্ডারি বাজারে লেনদেন শুরু হবে।

সমকাল :কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে বন্ড তো এখনও জনপ্রিয় নয়।
শিবলী রুবাইয়াত :মানুষ যখন দেখবে, ব্যাংকে টাকা রাখলে ৪-৫ শতাংশ সুদ পাওয়া যায় আর বন্ডে বিনিয়োগ করলে ৭-৮ শতাংশ সুদ মেলে, তখন তারাই বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। আমরা 'অ্যাসেট ব্যাকড' অর্থাৎ সম্পদের বিপরীতে বন্ড ইস্যুর অনুমোদন দিচ্ছি। সঙ্গে করপোরেট গ্যারান্টিও নিচ্ছি। কোম্পানির পরিচালকরা যখন গ্যারান্টি দিচ্ছেন, তখন তার ঘরবাড়িও এর সঙ্গে আটকে যাচ্ছে। ফলে বন্ডে বিনিয়োগও নিরাপদ হচ্ছে।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনোয়ার ইব্রাহীম