সমকাল :বাংলাদেশের পুঁজিবাজার এখনও 'ইক্যুয়িটি' নির্ভর। প্রতিবেশী বা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর কী একই অবস্থা?
মো. মনিরুজ্জামান : না, তা নয়। বিশ্বের বহু দেশেই ইক্যুয়িটি, মানে শেয়ারবাজারের থেকেও বন্ড বাজার অনেক বড়। ভারতের কথা বাদই দিলাম, শ্রীলঙ্কার মতো দেশে শক্তিশালী বন্ড বাজার আছে, জিডিপি আকারে যারা বাংলাদেশের তুলনায় ছোট। সেখানে চাহিদাও ব্যাপক। বিনিয়োগ পণ্যেও অনেক বৈচিত্র্য আছে। প্রভিডেন্ড ফান্ড, মিউচুয়াল ফান্ড, ফিক্সড ইনকাম মিউচুয়াল ফান্ড, ব্যালান্স ফান্ডসহ নানা প্রতিষ্ঠান ও বিনিয়োগ তহবিল থেকে ভালো বিনিয়োগের চাহিদা আছে। এ ফান্ডগুলো সম্মিলিতভাবে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করার ক্ষমতা রাখে। বাংলাদেশে মিউচুয়াল ফান্ড খাত আছে বটে, কিন্তু আকার ছোট। অন্য কিছু নাই। এখানে ব্যাংকই সব। এখানে ব্যাংকের বাইরে বিকল্প অর্থায়নের চাহিদাও নেই, জোগানও নেই। অতি সম্প্রতি কিছু কিছু চাহিদা তৈরি হচ্ছে।

সমকাল :আমরা কেন শ্রীলঙ্কার মতো পুঁজিবাজার গড়তে পারলাম না?
মো. মনিরুজ্জামান :এ ক্ষেত্রে শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব বেশি। তা ছাড়া এ ধরনের বিনিয়োগ পণ্য প্রচলনে প্রথমে সরকারের দিক থেকে সহায়তা দরকার পড়ে। আইন-কানুনেরও সমস্যা আছে। যেমন- প্রভিডেন্ড ফান্ড সরকারি বন্ড ছাড়া অন্য কিছুতে বিনিয়োগ করতে পারে না। আবার শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারী যারা আছেন, তারা বছরে ৭-৮ শতাংশ সুদের আশায় বিনিয়োগ করতে চান না। তারা শেয়ার কেনাবেচা থেকে বড় অঙ্কের মুনাফা চান।

সমকাল :পুরো বিশ্ব যখন দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নে পুঁজিবাজারমুখী, সেখানে বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো বিমুখ কেন?
মো. মনিরুজ্জামান :কারণ সহজ। কোম্পানিগুলোও নির্দিষ্ট বছরে এখনও একের বেশি আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করতে পারছে না। কর ফাঁকি দিতে লোকসান দেখায়, ব্যাংক ঋণ নিতে বেশি লাভ দেখায়। এটাই বড় সমস্যা। শেয়ারবাজার থেকে মূলধন বা ঋণ সংগ্রহ যাই হোক না কেন, কিছু তো জবাবদিহিতার মধ্যে আসতে হয়। এত কিছুর মধ্যে তারা আসতে চায় না। যখনই পুঁজিবাজারে আসবে, তখনই সঠিক আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করতে হবে। অর্থাৎ কর ফাঁকি বন্ধ হয়ে যাবে। এ কারণেই তারা পুঁজিবাজার বিমুখ।

সমকাল :বন্ডেও বেসরকারি খাতের অনাগ্রহ কেন?
মো. মনিরুজ্জামান :একই কারণ। তবে বেসরকারি ব্যাংকগুলো মূলধন পর্যাপ্ততা নিশ্চিতে বন্ড ইস্যু করতে এগিয়ে আসছে। যদিও এখনও এক ব্যাংক, অন্য ব্যাংকের বন্ড কিনছে। তবে সেকেন্ডারি বাজার তৈরি হচ্ছে। হয়তো সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এসব বন্ডে আগ্রহী হবেন। বেসরকারি খাতের কয়েকটি এনজিও বন্ড ইস্যু করে অর্থ সংগ্রহ শুরু করেছে। এরই ব্র্যাক হাজার কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করেছে। এর বাইরে টিএমএসএস, সাজিদা ফাউন্ডেশন টাকা তুলেছে।

অর্থায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলো- কত সময়ে টাকা মিলবে, কত কম খরচে মিলবে। এখন বন্ড ইস্যুর করতে আবেদন করলে কখন কবে তা অনুমোদন হবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। এ কারণে খরচের তুলনায় সময় বড় ইস্যু হয়ে দেখা যায়। আগে আইপিও অনুমোদনে ২-৩ বছরও লাগত। বন্ডেও একই কম। ফলে ব্যবসায়ীর পরিকল্পনা ঠিক রাখতে ব্যাংকের কাছে যায়। ব্যাংকও তাকে হয়তো সহজে অর্থায়ন করছে। তবে অবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। ২-৩ মাসেই অনুমোদন হচ্ছে। কিন্তু এ অভিজ্ঞতা খুবই অল্প সময়ের। এখনও সব ব্যবসায়ী এটা জানেন না। জানলে হয়তো এ ক্ষেত্রে আগ্রহ বাড়বে।

সমকাল :মূল শেয়ারবাজারে বন্ড বাজার আছে। এখানে আটটি বন্ড তালিকাভুক্ত। কিন্তু এগুলো তেমন কেনাবেচাই হয় না। কেন?
মো. মনিরুজ্জামান :কারণ আমাদের এ বাজারটি এখনও শেয়ারবাজার হয়ে আছে। এখানে বিনিয়োগকারী সবাই বড় 'ক্যাপিটাল গেইন' চান। বার্ষিক ফিক্সড ইনকাম, বিশেষ করে ৭-৮ শতাংশ সুদ তার কাছে কম মুনাফা বলে মনে হয়। এ কারণে চাহিদা কম। এ জন্য পৃথক একটা লেনদেন ব্যবস্থা গড়া হলে এবং সেখানে ভিন্ন ধাঁচের বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা গেলে, বিশেষত যারা সঞ্চয়পত্র বিনিয়োগে অভ্যস্ত, তাদের জানানো গেলে এ বাজারটি বড় হবে। বাজার হতে হলে এখানে যথেষ্ট কেনাবেচা হতে হবে। কোনো বিনিয়োগকারী তখনই এ ধরনের বন্ড কিনবে, যখন সে এমনটি দেখবে যে তার প্রয়োজনের সময় চাইলেই বিক্রি করে টাকা তুলে নিতে পারবে। অর্থাৎ এ বাজারে যথেষ্ট ক্রেতা ও বিক্রেতা থাকতে হবে। এ জন্য সময় লাগবে।

সমকাল :কার্যকর বন্ড বাজারের জন্য কোন বিষয়টি সবচেয়ে জরুরি?
মো. মনিরুজ্জামান :প্রথমত বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এ বিশ্বাস তৈরি করতে হবে যে, তারা মেয়াদ শেষে টাকা ফেরত পাবেন। যেমন- সুদ যা-ই হোক, মানুষ ব্যাংকে টাকা রেখে নিরাপদ বোধ করেন। এমন নিরাপদ বোধ তৈরি করতে হবে। তার ওপর সরকারি ও খুব ভালো কোম্পানির বন্ড এনে এ বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। আইনকানুন আরও সহজ করতে হবে। প্রয়োজনে কর ছাড় দিয়ে মানুষকে আগ্রহী করে তুলতে হবে। ব্যবসায়ীদেরও প্রয়োজনে কিছু ছাড় দিতে হবে।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনোয়ার ইব্রাহীম