জন্ম

বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান প্রতিটি সম্প্রদায়েরই পরিবারের নবজাতকের জন্মলাভ আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। কারণ শিশুই আগামী দিনের ভরসা, আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। মণিপুরি সমাজে শিশু জন্মলাভ খুবই কাঙ্ক্ষিত ও আনন্দদায়ক ঘটনা। বিবাহিতা নারীমাত্রই মাতৃস্বাদ লাভে আকুল হয়ে পড়ে। বিবাহিত নারী সন্তানসম্ভবা হলে তাকে নিজে সতর্কতামূলকভাবে চলাফেরা করতে হয় এবং মণিপুরি সন্তানসম্ভবা মাকে অত্যন্ত সেবাযত্ন করা হয়। পরিমাণ মতো বিশ্রাম, ভারী জিনিস উত্তোলন না করা, পরিশ্রমী কাজ না করা, পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ, নিজেকে কথায় ও কাজে সততা ও সতেজ ও প্রাণবন্ত রেখে চলা, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতাভাবে দিনাতিপাত করা, দৈনন্দিন স্নান-আহার রীতিমতো পালন করা, অমঙ্গলসূচক কোনো ঘটনা এড়িয়ে চলা, সৎচিন্তা থেকে দিনাতিপাত করা। কোনো কোনো পরিবারে এ সময়ে ধর্মীয় গ্রন্থপাঠ বা শ্রবণ করার রীতি রয়েছে। বস্তত মণিপুরি প্রতিটি গ্রামে যে মন্দির ও মণ্ডপ রয়েছে, সেসব মণ্ডপে অনুষ্ঠানাদিতে ধর্মীয় গ্রন্থ শ্রবণের ব্যবস্থা হলে সন্তানসম্ভাবা নারী সেখানে শ্রোতা হিসেবে অংশগ্রহণ করে ও উৎসবাদিতে অংশগ্রহণ করে। আত্মীয়স্বজন আট/নয় মাস গর্ভকালীন সময় থেকে পালাক্রমে উত্তম খাবার খাওয়ানোর জন্য দলবেঁধে ভালো দিন দেখে মহিলার বাড়িতে বিভিন্ন উৎকৃষ্ট খাবার নিয়ে আসে। সাধারণত মাছ, ভাত, দুধ, দই যা কিছু সম্ভব উৎকৃষ্ট খাবার নিয়ে মহিলারা সন্তানসম্ভবা মহিলার বাড়িতে হাজির হয়। আগেই এই খবর পাঠানো হয়। এবং সেখানে রান্না করে পরিবারের সবাইকেসহ খাওয়ানো হয়। কোনো কোনো সময় পাড়া-প্রতিবেশীদের নিমন্ত্রণ করা হয়। কোনো কোনো পরিবারে এভাবে ভাত খাওয়ানো আত্মীয়ের দল সংখ্যা ১০/১২টি হয় এবং শুধুমাত্র ভাত খাওয়ানো ছাড়া দই-দুধ-চিড়া-খৈ ইত্যাদি খাওয়ানোর দল ২০/২২টি পর্যন্ত হয়ে থাকে। সে কারণে অনাগত সন্তানের কল্যাণার্থে ও সন্তানসম্ভবা রমণীর সুস্বাস্থ্যের জন্য মণিপুরি সমাজে বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালনের রীতি পালন করা হয়। এসব অনুষ্ঠানের পশ্চাতে দৈহিক ও মানসিক উভয় প্রকার কল্যাণ নিহিত রয়েছে। মণিপুরি বাসগৃহে সন্তান প্রসবের জন্য আলাদা কোনো আঁতুড়ঘর তৈরি করা হয় না। তবে বড় গৃহের এক পাশে, বাড়তি ছোট চালার ঘরে ও সন্তান প্রসবের স্থান নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। স্থানীয় বা গ্রামের মণিপুরি ধাত্রী রয়েছে। তাদেরই তত্ত্বাবধানে সন্তানসম্ভবা নারী নয় মাস গর্ভকালীন অবস্থা থেকে দশ মাস পর্যন্ত সময়ে থাকে। সমাজে দীর্ঘদিন ধরে এই মেইপী বা ধাত্রীরা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও আগেকার দিনে নিরাপদে তারা সন্তান প্রসব করিয়েছে।

১.

তখন যে বিপদ বা মারাত্মক জটিলতা দেখা দেয়নি তা নয়, তবে সে ক্ষেত্রে আধুনিক ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হয়েছে। বর্তমানে পাস করা ধাত্রী কিংবা ডাক্তারের সহায়তায় প্রসবকার্য সম্পাদিত হয়। সন্তান প্রসব হলে সদ্য জন্মগ্রহণকারী শিশুর খুইতং-এর অংশ বা নাভিস্থ দড়ি কেটে দেয় ধাত্রীরা এবং তা ঘরের বাইরে কোথাও মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়।
শিশুকে ঈষদুষ্ণ পানিতে স্নান করানো হয় এবং শালদুধ খেতে দেওয়া হয়। আগেকার দিনে এই শালদুধ খেতে দেওয়া হতো না। চাকমা সমাজে দেড় বছর পর্যন্ত মাতৃদুগ্ধই প্রধান খাদ্য। কোনো পরিবারে শিশু জন্মগ্রহণ মাত্রই ওই পরিবার ও গোষ্ঠীর সবাইকে 'ঘরমাংপা' বা আশুচির আওতায় ফেলা হয় এবং ওই গোষ্ঠীর কোনো ধরনের অনুষ্ঠান বা শুভকর্ম নিষিদ্ধ হয় যতক্ষণ পর্যন্ত তা 'ঘরসেংপা' বা শুচি করা হয়। তিন দিনের মাথায় গ্রামের তিন থেকে পাঁচজন ছেলেমেয়েকে ডেকে 'চিপারভাত' খাওয়ানো হয়। 'চিপারভাত' হলো বিজোড় সংখ্যায় পাঁচ থেকে ১০ বছরের ছেলেমেয়েদের ডেকে কলাপাতায় ভাত ও তরকারি খাওয়ানো। এবং এই 'চিপারভাত' অনুষ্ঠানের পর ছেলেমেয়েদের সবাইকে পুকুরে বা নদীতে ডুব দিয়ে স্নান করতে হয়। বলা হয়ে থাকে, এতে শুচিতা হয়। ছয় দিনের মাথায় আয়োজন হয় 'ষষ্ঠি' নামক অনুষ্ঠান। সকালে নাপিতকে ডেকে আনা হয়। উল্লেখ্য, প্রতিটি মণিপুরি গ্রামের জন্য নির্দিষ্ট নাপিত রয়েছে। অবশ্যই বাঙালি নাপিত। এবং নাপিতকে প্রতিবাড়ি ধান কাটার সময় প্রতিবছর এক পোড়া ধান দিতে হয়। তাকে 'বন্দান নাপিত' বলা হয়। নাপিত সদ্য প্রসূত সন্তানের মস্তক-মুণ্ডন বা মাথা কামানোর কার্য সমাধা করে। কোনো কোনো সময় ওই বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েদেরও মস্তক-মুণ্ডন করা হয়। সে জন্য নাপিতকে বাড়তি টাকা দিতে হয় না। মণিপুরি সমাজে শিশুর ছয় দিনে মস্তক-মুণ্ডন বা ১২ দিনে একবার মস্তক-মুণ্ডন করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক মাস পরও মুণ্ডন হয়। মণিপুরি সমাজে প্রসূতির গৃহে কেউ প্রবেশ করে না বা তাকে কেউ স্পর্শ করে না। কারণ প্রসূতিকে তখন 'মাং' বা অশুচি বলা হয়। প্রসূতি গৃহের বাইরে আসেন না বা বাড়ির কোনো কাপড়-চোপড় স্পর্শ করেন না। তার প্রয়োজনীয় কাপড়-চোপড় ব্যতীত অন্য কোনো কাপড় স্পর্শ করতে দেওয়া হয় না।

মৃত্যু ও সৎকার পদ্ধতি

মানুষ মরণশীল। সৃষ্টি মাত্রই একদিন মৃত্যুবরণ করতে হয়। পৃথিবীতে মানুষের ইতিহাস প্রাচীন। সভ্যতার গোড়াপত্তনের কাল থেকে মানব সমাজে মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সমাজে নানান আচার, রীতি-নীতি ও ধর্মানুভূতি কাজ করে যাচ্ছে। খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ বছর পূর্বে গ্রিক দার্শনিক হিরাক্লিটাসের বাণী ছিল 'সবকিছুই পরিবর্তমান'।

২.

আদ্যিকালে মানুষ বৃক্ষ, পাথর, সূর্য, অগ্নি, সমুদ্র প্রভৃতির দেবত্ব আরোপ করে পূজা-অর্চনা করেছে। গ্রিক ও হিন্দু পুরাণ 'মিথ' তার ভিত্তিতেই রচিত হয়েছে। পৃথিবীর বুকে বিভিন্ন সমাজের ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের পার্থক্যের কারণে মৃতদেহ সৎকারের নিয়ম জাতিসত্তা বিশেষ ঐতিহ্য ও ধর্মীয় অনুভূতি অনুযায়ী হয়ে থাকে। বাংলাদেশের মণিপুরিদের বেলায় মৃত্যুপথযাত্রীকে মেইপা বা ঠাকুর ডেকে মৃত্যুর সমাসন্ন হওয়ার ইঙ্গিত জানা যায়। এহেন অসুস্থ ব্যক্তির জন্য 'দানধর্ম' নামে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান করা হয়। অসুস্থ ব্যক্তির দীক্ষাগুরু বা ব্রাহ্মণ পুরোহিত কর্তৃক এই 'দানধর্ম' অনুষ্ঠান পরিচালনা করা হয়। এতে কোনো লোকসমাগম থাকবে না। শুধুমাত্র মৃত্যুপথযাত্রী ও পুরোহিত ঠাকুর একটি কুঠুরিতে বা 'মাংকলের' এক কোণে এ অনুষ্ঠান হয়।

এক পোড়া ধান (পরিমাণ বিশেষ) ও এইরা তাংখাসহ (নানান উপাচার) এ অনুষ্ঠান হয়, যাতে মহান স্রষ্টার পথে যাওয়ার মুহূর্তে তার যাত্রাপথ সুগম হয় ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে বাণী পাঠ করে শোনানো হয়। একবার পাঠ করে শ্রবণ করানো শুরু হলে মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত প্রতিদিন তা চলতে থাকে। কেউ মারা গেলে তখন সামাজিক বিধানমতে মৃত ব্যক্তির দেহ বেশিক্ষণ ঘরের মধ্যে না রেখে উঠোনে তুলসী গাছের বেদিতে কলা গাছের বড় বড় পাতা কেটে এনে তার ওপর শোয়ানো হয়। আত্মীয়স্বজনের কান্নার রোল পড়ে, আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। হরিনাম ধ্বনির মাধ্যমে মৃতদেহ ঘর থেকে বের করা হয়ে থাকে। গ্রামবাসীকে জানানোর জন্য 'পৌয়াল্লা' বা বার্তাবাহক পাঠানো হয়। মৃত্যু সংবাদ পরিবেশক একটি দা বা কাঁচি হাতে ধরে সমস্ত গ্রামে মৃত্যু সংবাদ জানিয়ে দেয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে 'সেলপুঙ' বা বড় বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে মৃত্যু সংবাদ জানানো হয়। মৃত ব্যক্তিকে পরিস্কার পানি দিয়ে স্নান করানো হয়। তিলক চন্দন লাগানো হয়। আগর, ধুপরাতি, সুগন্ধী দেওয়া হয়।


ইত্যবসরে শিংলুপের ঈশালপা-ডাকুলা বা গায়ক-বাদক বা কীর্তনিয়া ও মৃদঙ্গবাদক সেখানে এসে নাম সংকীর্তণ পরিবেশন করতে শুরু করে। মৃতের আত্মীয় শোক প্রকাশ করে বিলাপ করতে থাকে। গ্রামবাসী এসে জমায়েত হন। গ্রামের প্রতিটি বাড়ি থেকে একজন প্রাপ্তবয়স্ক কাঁধে এক টুকরা শুকনো কাঠ বা বাঁশ বহন করে, যা পরবর্তী সময়ে মৃত ব্যক্তির দাহকার্যে ব্যবহার করা হয়। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মানুসারী মণিপুরিদের মৃতদেহ শ্মশান ঘাটে দাহ করা হয়। বাংলাদেশের অন্যান্য ক্ষুদ্র জনজাতি যেমন মারমা সম্প্রদায়ে মৃতদেহ দাহ ও কবর উভয় ব্যবস্থা প্রচলিত। বাঙালি হিন্দুদের মতো রাখাইন সমাজে কোনো লোক মারা গেলে তাকে চিতায় পোড়ানো হয়।

৩.

আবার বৌদ্ধ ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মমির মতো অস্থায়ী বৌদ্ধবিহার তৈরি করে বহন করার রীতি বিদ্যমান। মণিপুরিদের মাঝে মৃতদেহ বহন করার জন্য শাকেই বা মাচাঙ তৈরি করা হয় (চতুস্কোণাকার শাকেই)। হরিনাম ধ্বনি দিয়ে মাচাঙে তুলে নেওয়া হয়। জ্যেষ্ঠ পুত্রসহ গোষ্ঠীর চারজন পুরুষ চারকোণে কাঁধে বহন করে মাচাঙটি। এরপর যথারীতি বাদক-গায়ক সহযোগে নাম সংকীর্তন গাইতে গাইতে শ্মশান ঘাটের দিকে শবযাত্রা রওয়ানা দেয়। শবাধারের পিছু পিছু শোকার্ত আত্মীয়স্বজন বিলাপ করতে করতে শ্মশান ঘাটে যায়। মহিলারা শ্মশানঘাটে সাধারণত যায় না। তারা মাঝপথ পর্যন্ত যায় অথবা বাড়িতে বসে উচ্চ স্বরে মৃতের সদ্গতির জন্য বিলাপ করতে থাকে। করতাল ও মৃদঙ্গের তালে সংকীর্তনের সুরে করুণ রাগিণী তোলে শবযাত্রা এক সময় শ্মশান ঘাটে পৌঁছে। মণিপুরিদের বিশ্বাস, মৃদঙ্গ করতালের ধ্বনি ও সংকীর্তনের সুরে গীত মৃত ব্যক্তির স্বর্গারোহণে সহায়তা করে।
মৃত ব্যক্তির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পরবর্তী কয়েকটি ধাপে বিভক্ত।

প্রতিদিনকার পিণ্ডদান, অস্থি সঞ্চার, ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ, শ্রবণ ও নামকীর্তন, ঘরসেংপা, শল্পা, শ্রাদ্ধ

মণিপুরি বিবাহ ব্যবস্থা

মানুষের সমাজ দীর্ঘ ইতিহাস পেরিয়ে ঐক্যবিবাহে পৌঁছেছে এবং এ ব্যাপারটি যখন বহু সহস্রাব্দ ধরে সুচিরস্থায়ী হয়েছে, তখন এটিই নর-নারী সম্পর্কে বিবর্তনের চূড়ান্ত ও অক্ষয় পর্র্যায়। অধিকাংশ প্রগতিশীল সমাজ ধর্মই বিবাহকে নর-নারী জীবনের কল্যাণকর কর্ম হিসেবেই স্বীকৃতি দিয়েছে। হিন্দু ধর্ম, ইসলাম ধর্ম, খ্রিষ্ট ও বৌদ্ধ ধর্মের ক্ষেত্রেও এই বিশ্বাসের ব্যত্যয় ঘটেনি। প্রাচীনকালে মণিপুরি সমাজে বর-কনেকে বিয়ে করতে হতো নানা উপঢৌকন দিয়ে, একথা বর্ষীয়ান ব্যক্তিমাত্রই ব্যক্ত করে থাকেন। ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে ক্রমোন্নতির পথে সেই প্রথার পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।

৪.

মণিপুরি সমাজে বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপনের রীতি শুধুমাত্র নিজস্ব সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ, অন্য সমাজের সঙ্গে বিবাহ সম্বন্ধ স্বীকৃত নয়, যিনি অন্য সমাজের কনে বা বরকে বিবাহ করেছেন, তিনি সমাজ থেকে বহিস্কৃত হন বা ত্যাজ্য বলে বিবেচিত হন। নৃবিজ্ঞানের দর্পণে বিবাহ মানুষের নিজ গোষ্ঠী সংহতির স্বার্থে, সাংস্কৃতিক ও বংশধারা প্রবাহের একটি কার্যকরী ও গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। বাংলাদেশে বসবাসকারী সব আদিবাসী বা নৃগোষ্ঠী থেকে মণিপুরি বিবাহ সম্পর্ক পৃথক ও আকর্ষণীয় এ জন্য যে, মণিপুরি সমাজ প্রাচীন আর্য রীতিনীতি মেনে চলে। অর্জুন চিত্রাঙ্গদার বিবাহ ছিল গান্ধর্ব বিবাহ। গান্ধর্ব বিবাহে গুরুজনের অনুমতি বা সমর্থনের অপেক্ষা না রেখেই পরস্পরের প্রতি প্রেমে উদ্ধুদ্ধ হয়ে একজন অপরজনকে জীবনের সঙ্গী হিসেবে বেছে নেয় এবং এ বিয়ে শাস্ত্রসম্মত বৈধ ও সমাজে স্বীকৃত। পরবর্তী সময়ে অতি অবশ্যই কনের অভিভাবক বিয়েতে সম্মতি দিয়ে দেন এবং অর্জুন চিত্রাঙ্গদার বিয়েতে চিত্রাঙ্গদার পিতা শর্তও জুড়ে দিয়েছিলেন। স্ত্রী ছাড়া পুরুষের জীবন অপূর্ণ, সংসার অচল, ঘর অন্ধকার, বিবাহ ছাড়া এ জীবন যেন তাদের কাছে অকল্পনীয়।

বর্তমান মণিপুরি সমাজ বিবাহ ব্যবস্থায় সবচেয়ে গ্রহণীয় পদ্ধতি হল 'প্রজাপত্য বিবাহ' ও 'ব্রাহ্ম বিবাহ'। এ ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম বিচার্য হলো স্বগোত্র বা স্বগোষ্ঠী বহির্ভূত পাত্র-পাত্রী নির্বাচন। মণিপুরি সমাজে বিভিন্ন গোত্র ও গোষ্ঠী বিদ্যমান। নিজ 'শাকেই' বা গোষ্ঠীর কোনো বর-কনে বিবাহ নিষিদ্ধ। তেমনি স্বগোত্রতেও বিবাহ নিষিদ্ধ। বর বা কনের অভিভাবক নিশ্চিত হতে হয়, যে পাত্র-পাত্রীকে বিবাহ সম্বন্ধের জন্য আলাপ-আলোচনা করতে হবে, সে কোনোক্রমেই নিজস্ব গোষ্ঠী বা গোত্র সম্বন্ধীয় নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, মণিপুরিদের খুমল (khulmal) গোত্রের কোনো পাত্র একই (khulmal) গোত্রের পাত্রীকে বিবাহ করতে পারবে না। অনুরূপভাবে মৈরাং (Moirang), আঙম (Angom) গোত্রেও একই ব্যবস্থা বিদ্যমান। বাংলাদেশে এরূপ কমপক্ষে পাঁচটি মণিপুরি গোত্রের লোক বসবাস করেন বিধায় বিবাহকার্যে অসুবিধা হয় না। আবার যে এরূপ প্রথার ব্যত্যয় ঘটে না, তাও নয়। সে ক্ষেত্রে বরকে সামাজিক নানাবিধ অনুশাসনের শিকার হতে হয়। তাকে গোষ্ঠী থেকে বাদ দেওয়া হয়, ক্ষেত্র বিশেষে সমাজের নানান ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানাদি থেকে বঞ্চিত করা হয় এবং বংশপরম্পরায় এই কালিমা বহন করে বেড়াতে হয়। কোনো রক্ত সম্পর্কের কাউকেই বর-কনে হিসেবে সমাজ বরণ করে নেয় না, এমনকি তিন পুরুষ পূর্ব থেকেও তা কার্যকরী ধরা হয়ে থাকে।

৫.

তাহলে অবস্থাটা এমন যে, মণিপুরি সমাজে নিজ গোষ্ঠী, গোত্র, রক্ত সম্পর্ক কিংবা মাতুল সম্বন্ধীয় কোনো পাত্র-পাত্রীর মধ্যে বিবাহ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ রয়েছে।
মণিপুরি বিবাহ সাধারণত আটটি পর্বে বিভক্ত। পর্বগুলো হলো-
ক. ওয়ারৌপদ পর্ব
খ. হেইজাপদ পর্ব
গ. নিকন খেলানি পর্ব
ঘ. বরবার্তন
ঙ. প্রজাপত্য বিবাহ বা মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান (কুঞ্জ সাজন)
চ. তিনদিনকার চানা
ছ. পাচোভাত খানা
জ. ঠিল্পা

প্রজাপত্য বিবাহ বা মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান (কুঞ্জ সাজন)

মণিপুরি বিবাহে লগ্ন একটি অতি আবশ্যকীয় বিষয়। যে কোনো পঞ্জিকা দ্বারা ব্রাহ্মণ পুরোহিত লগ্ন জেনে নেওয়া হয়। এবং এই বিবাহলগ্নে অবশ্যই বিবাহকার্য সম্পন্ন হতে হবে। প্রাচীনকাল অবধি এই বিবাহলগ্ন অনুসারে প্রজাপত্য বিবাহ প্রচলিত। বরযাত্রার সময় বিকেলে বর স্নান সমাপন করে নতুন ধুতি ও সাদা পাঞ্জাবি পরিধান করবেন। গলে মালা ও দেহে ক্ষত্রিয়োচিত পৈতা ধারণ করবেন, কপোলে চন্দন রেখা টানবেন। সঙ্গী তিনজন ও অনুরূপ সাজে সজ্জিত হবেন। এই তিনজন সঙ্গী সার্বক্ষণিক বরের সঙ্গ দেবেন। কনের বাড়িতে যাত্রার প্রাক্কালে বাড়ির মাংকলে ঘটপূজা হবে, সামনে বর উপবেশন করবেন ফিদায়, শান্তসৌম্য মুখাবয়নে ব্রাহ্মণ পুরোহিত যথামন্ত্র পাঠকরতঃ শুদ্ধমনে বরকে রওনা দেওয়ার উপযুক্ত করে যাত্রার ব্যবস্থা করবেন। বাজনার দল বাদ্য বাজাবে, গ্রামোফোন রেকর্ডে কলের গান বাজবে, পটকা ফাটানো হবে, বর ধীর শান্ত মনে পালকিতে উঠে বসবে। অন্য পালকিতে বরের মা উঠে বসবেন। এভাবে পালকি বেয়ে চলবে, সঙ্গে বাজনার দল, মাইক বাজবে, বাজি পোড়ানো হবে, পটকা ফাটবে আর বরযাত্রীরা বরের পিছু পিছু হেঁটে চলবেন কনে বাড়ির উদ্দেশ্যে।

বিষয় : মণিপুরি সমাজ ড. রণজিত সিংহ

মন্তব্য করুন