সোহরাব হোসেনের সঙ্গে শত্রুতা এ জীবনে শেষ হবার নয়। প্রথমে মনোমালিন্য, ক্রমান্বয়ে বাগবিতণ্ডা এবং তারপর থেকে শত্রুতা- এভাবে চলছে তো চলছেই। কী পরিমাণ শত্রুতা যে করছে, তার সঙ্গে সেটার কোনো ইয়ত্তাই নেই! তার সম্বন্ধে কুৎসা রটনা করাকে সেই তুলনায় মামুলি বিষয় হিসেবেই গণ্য করা যায়, এত্ত শত্রুতার ভেতর। সর্বশেষ শত্রুতা করেছে তার মেয়ের বিয়ে ভেঙে দিয়ে। পরে অবশ্য মেয়ের বিয়ে হয়েছে অন্যত্র। এই বিয়েটিও ভাঙার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিল সে।

খবরটা শোনার পর থেকেই মনে এক ধরনের ফুর্তিভাব বিরাজ করছে সোহরাব হোসেনের। কখনও কখনও মনের এই ফুর্তিভাবটাকে বিদায় করার চেষ্টা সে যে করছে না, তা নয়। কিন্তু এ ভাবটা মন থেকে যেতে চাচ্ছেই না। সে প্রাণপণে চেষ্টা করছে তার মনের এ ভাব যেন কোনোভাবেই পরিবারের ও কাছের লোকজন আঁচ করতে না পারে। বলা যায়, এ ব্যাপারে সে এখন পর্যন্ত শতভাগ সাফল্য ধরে রেখেছে। শেষ কয়েকটি কথা সমবেতদের উদ্দেশ্যে বলার জন্য সে মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছে। শুরুটা সে এভাবে করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে-
আজ হতে আমি অসহায় হয়ে পড়লাম। আমার মন স্থবির হয়ে গেল, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেল, বাহুশক্তি-চলৎশক্তি অসাড় হয়ে গেল ...

এভাবে শুরু করে তাদের দু'জনের মধ্যে কতটা গাঢ় বন্ধুত্ব ছিল তা কথার চাতুর্যে প্রমাণ করে ছাড়বে সোহবার হোসেন। এজন্য মিথ্যার আশ্রয় তাকে নিতে হবে প্রচুর পরিমাণে।
নিতে হলে নেবে, তাতে কী! ঠোঁটের কোনায় ঈষৎ হাসির ঝিলিক ফুটে উঠল তার! মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সোহরাব হোসেন, যেতে যেতে পুরো স্ট্ক্রিপ্টটি সাজিয়ে ফেলবে সে।
এখন সোহরাব হোসেনের ওপর তার রাগ হচ্ছে না, বরং করুণা হচ্ছে। লোকটা সারাজীবন বলতে গেলে কূটবুদ্ধি আর অভিনয় দিয়েই ভরে রেখেছে। কী অভিনয়টাই-না করার চেষ্টা করছে! দেখে মজা পাচ্ছে সে।

এই যে মজাটি দিচ্ছে সোহরাব হোসেন তাকে, এটিইবা কম কোথা দিয়ে। সে সোহরাব হোসেনের অভিনয় দেখতে লাগল।

তার নজর গেল আমজাদ আলীর দিকে। পরপর দু'বার নির্বাচনে হেরে বেশ বেসামাল হয়ে গিয়েছিল সে। নিজেকে অনেকটা গুছিয়ে এনেছে সে কিছুদিন ধরে।
আমজাদ আলীর থেমে থেমে নিজের ওপর রাগ লাগছে। প্রতিটি জায়গায় সে পবিত্র কোরআনের যে আয়াতটি পড়ে, অথচ এখন সেই আয়াতটি তার মনে পড়ছে না। আশ্চর্য!
আমজাদ আলীকে কানে কানে তার বলতে ইচ্ছে করছে-

তুমি যে আয়াতটি হাতড়ে বেড়াচ্ছ, সেটির মর্মার্থ দূরে থাক, সোজা অর্থটিও কি তুমি কখনও অনুধাবন করেছ? করোনি, যদি সামান্য অনুধাবনও করতে, তাহলে আগের সব বাদ দিয়েই বললাম, সর্বশেষ মসজিদ ও ঈদগাহর আয়-ব্যয়ের হিসাব নিয়ে এমন ধূম্রজাল তৈরি করতে না!

কী হবে বলে আমজাদ আলীকে! নিজে থেকে বোঝার ইচ্ছা না হলে, তাকে তো বলে বোঝানো যায় না। আর আমজাদ আলীরা সব বোঝে, আবার মনে হয় কিছুই বোঝে না! নাকি আমজাদ আলীরা সব সময় অচেনাই থেকে যেতে চায়।

মির্জা মাকসুদুর রহমানকে দেখে সে কিছুটা অবাক হলো। মির্জা সাহেবের তো এখানে আসার কথা না। তবুও তিনি আসছেন কেন?

আমজাদ আলীকে পোড়াতে? মির্জার ছায়াও তো আমজাদ আলী কেটে ফেলতে চায়। পরপর দু'বার নির্বাচনে সে হেরেছে এই মির্জার কাছেই।

মির্জার আজ এখান থেকে চলে যাবার কথা ছিল। সে যাবে, এমন সময় খবরটা পেল। তখনই মির্জা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, সে আজ আমজাদ আলীর বাক বাকুম করা কথার জন্য ইঙ্গিতে কথা বলে তাকে শায়েস্তা করবে।

মির্জার মনের কথা জানতে পেরে তার যেমন উদ্বেগ হচ্ছে, তেমনি হাসিও পাচ্ছে। মির্জা একটিবার চিন্তা করছে না, সে যেমন আমজাদ আলীকে শায়েস্তা করার পরিকল্পনা এঁটেছে, তাকেও কি কথার সাহায্যে আমজাদ আলী আলু ভর্তা, বেগুন ভর্তা না করে ছাড়বে?

আয়াতটি মনে করার কত ভাবেই-না চেষ্টা করছে আমজাদ আলী। সে অবশ্য ঠিক করে রেখেছে, আমজাদ আলী আয়াতটি শেষ পর্যন্ত মনে করতে না পারলে, সে তার কানে কানে বলে আয়াতটি মনে করিয়ে দেবে।

যার সবক'টি পদবিই সাবেক, সেই লিয়াকত খন্দকারকে দেখা যাচ্ছে। পদবিতে সাবেক হলেও বর্তমানে ওই পদবিধারীদের চেয়ে আচরণে সে কম যায় না। কথা-কাজে সে কুলিতে উঠতে না পারলে শেষে হট্টগোল শুরু করে দেয়। এ ব্যাপারে সে যথেষ্ট কৃতিত্বের অধিকারী।

লিয়াকত খন্দকার যখন সাবেক পদবিধারী ছিল না, তার হাতে ক্ষমতা ছিল, তখন একবার সে তার কাছে ছেলের চাকরির ব্যাপারে তদবির করাতে গিয়েছিল।

তার ছেলের চাকরিটি হবে- এ বিষয়ে লিয়াকত খন্দকার তাকে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল। এ কারণে সে অন্য একজনের মাধ্যমে কিছু টাকা উৎকোচ হিসেবে লিয়াকত খন্দকারকে দিয়েছিল।

সেই চাকরিটা তার ছেলের হয়নি। তার ব্যাপারে লিয়াকত খন্দকার নিজের স্বভাবের কোনো পরিবর্তন করেনি। তার স্বভাব হচ্ছে, সবার কাছ থেকে টাকা নেবে, যার কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি আদায় করতে পারবে, তার কাজ করে দেবে।

লিয়াকত খন্দকার আজ সবাইকে বলবে, তার সহপাঠী কত মহৎ লোক ছিল। তার হাতে যখন ক্ষমতা ছিল, তখন যেচে উপকার করতে চেয়েছে, কিন্তু সে নেয়নি। এমনই সৎ স্বভাবের মানুষ!

এতে লিয়াকত খন্দকারও মহৎ হবে। মহতের বন্ধু তো মহৎ-ই হবে, জোচ্চোর তো আর হবে না।

লিয়াকত খন্দকারের এই ভাবনা তাকে দুঃখ দিল। লোকটি যা ভাবছে তা যদি বলে, তাহলে সে ছোট হয়ে যাবে নিজের কাছেই নিজে। সে মোটেই মহৎ লোক নয়। তবে জানা মতে, সে জীবনযাপনে সততা বজায় রাখার চেষ্টা করছে। ভাবনায় ছেদ ঘটল, আমজাদ আলীর কথা শুনে। কথাগুলো যে মির্জা মাকসুদুর রহমানের উদ্দেশ্যে, তা শুধু সাবালকরা নয়, নাবালকরাও বুঝবে এমন।

'পদ্মা সেতু, মেঘনা সেতু করতেও তো আড়াই বছর লাগাবে না! আর দুই হাত দুই হাত চার হাতের একটা ব্রিজ নিয়ে কী তামাশাটা শুরু হয়েছে! আড়াইটা বছর ধরে কেবল দ্যাখছি, কিছু বলছি না! ফাজলামো শুরু করেছে! বাঁশের সাঁকো দিয়ে মানুষকে চলাফেরা করতে হয় !'

এই পর্যন্ত বলে আমজাদ আলীর ক্ষোভের লক্ষ্য মির্জা মাকসুদুর রহমান থেকে সরে সমবেতদের ওপর গিয়ে পড়ল। এরাই তো মির্জাকে ভোট দিয়ে পাস করায়। তার ইচ্ছা করছে ডিনামাইট দিয়ে ব্রিজের যা কাজ হয়েছে তা উড়িয়ে দিতে। কিসের ব্রিজ লাগে? তোরা সাঁতরিয়ে নদী পার হবি!

আমজাদ আলীর রাগ-ক্ষোভ এখন মির্জার ওপর থেকে নেমে সমবেতদের ওপর ভর করেছে। সে বিতৃষ্ণার দৃষ্টিতে সবাইকে দেখছে। আচমকা আমজাদ আলীর রাগ সমবেতদের ওপর থেকে তার ওপর এসে পড়ল।

এর জন্যই তাকে এখানে আসতে হয়েছে। তা না হলে মির্জার চেহারা তাকে দেখতে হতো না!

আমজাদ আলীর এখন মনে হচ্ছে, এ-ও তাকে ভোট দেয়নি! মির্জাকে এ ভোট দিয়েছি, যার জন্য মির্জা এসেছে!

তার ওপর আমজাদ আলীর রাগ দেখে সে যখন দুঃখিত হচ্ছে, ঠিক তখন মির্জার মনের কথা শুনে সে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। মির্জার মন আমজাদ আলীকে বলছে- দাঁড়াও, আজ তোমাকে শায়েস্তা করব। ব্রিজ নিয়ে কথা বলো, ব্রিজ তোমার মাথায় ভাঙব! মাইক্রোফোন দেখলেই কথা উগরাইয়া ওঠে? সেই কথা আজকে তোমাকে আবার গিলাব।
মির্জা মাকসুদুর রহমানের মন এ কথাগুলো বলেই চলচ্চিত্রের ভিলেন মার্কা হাসি হাসছে।

সেই হাসির শব্দে বিচলিত না হয়ে সে পারল না আসন্ন ঝামেলার আশঙ্কা দেখে।

এরই মধ্যে হেলেদুলে এসে হাজির হলো সত্যিকারের মাইক্রোফোনের লোক আইয়ুব বাচ্চু। যার আরেক নাম চেয়ারম্যান বাচ্চু। যেখানেই মাইক্রোফোন সেখানেই চেয়ারম্যান বাচ্চু; এ যেন একে অপরের পরিপূরক।

সদা হাস্যোজ্জ্বল চেয়ারম্যান বাচ্চুকে দেখলে তার প্রায়ই করুণা হয় এই ভেবে যে, এ আরও বড় পদবি জোগাড় করতে পারত, যদি লোভ ও কৃপণতার কারণে পা-চাটার অভ্যাস ত্যাগ করতে পারত! এটা বোধহয় এ জীবনে ত্যাগ করা এর পক্ষে সম্ভব নয়!

শহিদুল আলমকে আসতে দেখে আইয়ুব বাচ্চু কয়েক কদম এগিয়ে গেল। যেন অভ্যর্থনা দিয়ে নিয়ে আসবে তাকে। বাচ্চু পারেও!

যদিও এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আইয়ুব বাচ্চু মনে মনে বলছে-

শালা গোমস্তা, ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পইরা ঘুরস!

সঙ্গে সঙ্গে সে বিরক্ত হয়ে আইয়ুব বাচ্চুকে বলল-

তোমার চাইতে শহিদুল আলম অনেক ভালো। আলম এক দোকানের কর্মচারী ছিল, এটা সত্য। কর্মচারী হওয়া নিশ্চয়ই দোষের কিছু না। তারপর আলম ব্যবসা শুরু করছে। ওর শ্বশুর ওকে আর্থিক সহযোগিতা করেছে। ওর ভাগ্য, পরিশ্রম ও বুদ্ধি ওর সহায় হয়েছে। আর সর্বশেষে রাজনৈতিক মারপ্যাঁচের খেলায় ওকে জেতানো হয়েছে।

কিন্তু তুমি বাচ্চু; পথ তৈরি ছিল, তুমি হাঁটতে পারনি। এই যে তুমি শহিদুল আলমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছ, সে মনে মনে কী বলছে জান?

সে বলছে-

বাচ্চু আয়, তোর জন্য পকেটে আমি খুচরা পয়সা রাইখ্যাই দেই!

মির্জা মাকসুদুর রহমানের চোখে চোখ পড়তেই আইয়ুব বাচ্চু সিদ্ধান্ত পাল্টিয়ে শহিদুল আলমের দিকে না যেয়ে মির্জার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।

তা দেখে শহিদুল আলমের মনের উক্তি-
লাভ নাই রে বাচ্চু, মির্জা তোরে একটা কানা পয়সাও দিব না !
এরপর শহিদুল আলম নিজেই নিজেকে শাসাল-

কী হয়েছে আমার! বাচ্চুরে নিয়ে আমি চিন্তা করছি ক্যান? এখনও তো বক্তব্য কী দেব, সেটাই স্থির করতে পারি নাই। আমি এখনও ভালো বক্তৃতা দিতে পারি না। পারব কেন? আমি কি আগে বক্তৃতা দিছি কখনও। হালে বক্তৃতার মহা ক্যাচালের মধ্যে পড়ে গেছি। মাইকে তো আমাকে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে কিছু বলতে হবে। কী বলব, সেটা আগে ঠিক করি।
তার সঙ্গে আমার খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল-

এই কথা বলে শুরু করবে শহিদুল আলম। কিন্তু মনে করতে পারছে না সে, উনার সঙ্গে তার কখনও কথা হয়েছে কিনা।

কথা তো নিশ্চয়ই হয়েছে, যখন সে দোকানের কর্মচারী ছিল। সে কথা তো আর এখন বলা যাবে না। এখন বলতে হবে মিথ্যা কথা বানিয়ে বানিয়ে।

সে মিথ্যা কথা বানিয়ে বানিয়ে বলতে পারদর্শী হতে পারছে না। এ জন্য তার রাগও লাগে। অন্যেরা কী সুন্দর করে গুছিয়ে মিথ্যা কথা বলে। আজও এখানে মিথ্যা গল্প আউড়াবে প্রায় সবাই, দুয়েককজন ছাড়া। সমবেত সবাই এসব বুঝবে, কিন্তু কেউ কিছু বলবে না।

শহিদুল আলমও গিয়ে দাঁড়াল মির্জা মাকসুদুর রহমানের পাশে। সে সব সময় ক্ষমতার সঙ্গে থাকে। যার কারণে তার হাতেও ক্ষমতা এসেছে। সে বলেও-
আমি সব সময় সরকারি দল করি!

শহিদুল আলমের এক সময়ের রাজনৈতিক গুরু ছিল আমজাদ আলী। তার হাত-পায়ের সাহচর্যে সে বেশ কয়েকটি সিঁড়ি ওপরে উঠেছে। এখন সে মির্জা মাকসুদুর রহমানের পেছনে পেছনে থাকে। আবার কায়দামতো গোপনে গোপনে আমজাদ আলীর হাত-পাও টিপে দিয়ে আসে।

এজন্য একদিন আমজাদ আলী তাকে ভর্ৎসনা করে বলেছিল-

আলম, দুই নৌকায় পাও দিয়ে থাইক না, নদীর মধ্যে পইড়া ডুইবা যাবা!

তখন শহিদুল আলম বলেছিল-

লিডার, আমি আপনের নৌকায় থাকি। ওই নৌকায় যাইতে হয় ব্যবসা করার কারণে। বোঝেনই তো, ব্যবসা কইরা খাই!

আমজাদ আলী তখন খুব নোংরাভাবে তাকে বলেছিল-

তুমি ব্যবসা কইরা খাও না, তুমি বেশ্যাগিরি কইরা খাও!

শহিদুল আলম রাগ করেনি এ কথায়। হাসিমুখে মাথা নিচু করে রেখেছিল। আর মনে মনে বলেছিল-

কথা সত্য বলছেন, কারও গলায় ছুরি চালাতে আমার হাত কাঁপবে না!

অধ্যাপক বেলাল উদ্দিনকে দেখে তার মনটা আনন্দে ভরে গেল। সে যেন জঞ্জালদের হাত থেকে মুক্তি পেল!

অধ্যাপক সাহেব অশ্রুসজল হয়ে এসে দাঁড়ালেন, চিরন্তন সত্য ভাবনা নিয়ে তাকিয়ে আছেন তার দিকে।

অধ্যাপক সাহেবের সঙ্গে কত মায়াময় স্মৃতি রয়েছে তার! এখন মনে পড়েছে সে যখন বাস দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিল, সে সময়টার কথা। কাকতালীয়ভাবে অধ্যাপক সাহেব সেখানে ছিলেন। কী ছোটাছুটিটাই সে করেছিল তাকে নিয়ে! প্রথমে স্থানীয় হাসপাতাল, পরে জেলা শহরের হাসপাতাল থেকে বিভাগীয় শহরের হাসপাতালে চিকিৎসা করে তাকে সুস্থ করে নিয়ে এসেছিল।

স্থানীয় হাসপাতাল থেকে শুরু করে জেলা শহরের হাসপাতালে চিকিৎসার শেষ পর্যন্ত কত টাকা খরচ হয়েছে তা অধ্যাপক সাহেবের মুখ থেকে বের করতে পারেনি সে।
বরং খরচের কথা তোলাতে অধ্যাপক সাহেব রাগ করেছেন। বলেছেন-

আমি আমার বন্ধুর জন্য করেছি। আমার এ অবস্থা হলে আপনি করতেন না? বন্ধুত্ব ফেরত দিতে চান?

এ কথার পর আর কি কোনো কথা বলা যায়? সত্যি অধ্যাপক বেলাল উদ্দিনের মতো বন্ধু এ জীবনে সে পাবে না। বন্ধুর পরিচয় পাওয়া যায় বিপদের সময়। শুধু এই দুর্ঘটনার সময়ই নয়, তার জীবনের আরও অনেক দুর্যোগের সময় অধ্যাপক সাহেব বন্ধুত্বের পরিচয় রেখেছেন।

সোহরাব হোসেনের কারণে যখন তার মেয়ের বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল, তখন এই অধ্যাপক বেলাল উদ্দিন পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। সে খোঁজাখুঁজি করে অবশেষে ভালো পাত্র জোগাড় করে এনেছেন। পাত্র তার সম্বন্ধীর ভাইয়ের ছেলে। তার সেই মেয়ে ভালো আছে, সুখে আছে!

এই জীবনে অধ্যাপকের কাছে ঋণ শোধ করা যাবে না। এ কথা একদিন বলতে অধ্যাপক শুনে বলেছিলেন-

ঋণ যদি থাকে, তাহলে শোধ করে দেন! ঋণী থাকবেন কেন?

এ কথা বলেই সে তাকে আলিঙ্গন করে বলেছিলেন-

ঋণের কথা আর বলবেন না, এতে বন্ধুত্বের অমর্যাদা হয়, মাফ করবেন!

অধ্যাপকের সেই কথাগুলি এখনও তার কানে ধ্বনিত হলো। সে কৃতজ্ঞদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

আর তখনই উপস্থিত হয়ে অবশ্যম্ভাবী বক্তাদের উপস্থিতি দেখে উদ্বিগ্ন হলেন মুফতি গোলাম মাওলা। আজও কয়েকদিন আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। শুধু কয়েকদিন আগের অবস্থার পুনরাবৃত্তি নয়, এ যেন চলমান একটি অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বক্তাদের সত্য-মিথ্যা বক্তৃতার চাপে সমবেতরা অতিষ্ঠ হয়ে যায়। কেউ এদেরকে থামাচ্ছে না, আর নিজে থেকে থামার লোকও এরা নয়। কথা বলতে পেরে এরা যেমন ধন্য হচ্ছে, এদেরকে দিয়ে কথা বলাতে পেরেও কেউ কেউ ধন্য বনে যাচ্ছে।

এমন সময় হাঁকডাক দিতে দিতে এসে হাজির হলো আবদুস সালাম। তাকে দেখলে সেই প্রবাদটির কথা মনে পড়ে- গাঁয়ে মানে না আপনা মোড়ল।

আবদুস সালাম দাঁড়িয়েই মুফতি গোলাম মাওলাকে দেখে বলল-

মুফতি আসছ?

মুফতি গোলাম মাওলা বিনীত ভঙ্গিতে তাকে সালাম জানালেন। আর মনে মনে মুফতি ভাবলেন, আজ এ অবস্থার প্রতিবাদ সে করবে কৌশলে। এভাবে চলতে দেওয়া উচিত না। সবাই বিরক্ত হয়, কেউ শব্দ করে কিছু বলে না। গুনগুন করে বিরক্তি প্রকাশ করে কোনো ফল হবে না। এভাবে চলতে থাকলে লোকজনের উপস্থিতি ধীরে ধীরে কমতে থাকবে।
মুফতি গোলাম মাওলার এই ভাবনাকে সে সমর্থন করল। তাইতো, পরেও তো বলা যায়। গুরুত্বপূর্ণ মানুষকে নিয়ে কী যেন সভা করে। সেটা করেও তো ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলা যায়। আর সে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ না তার চোখে, সমাজের কাছে। তাই তাকে নিয়ে এখন কিংবা পরে কোনো কথাই তো হবার নয়। অথচ কত পরিকল্পনা একেকজন করছে কী বলবে তা নিয়ে। মুফতি, আপনি এসবের বিরুদ্ধে কিছু বলুন। কাউকে না কাউকে এসব অন্যায্য কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তো প্রতিবাদ করতে হবে। এরই মধ্যে লোকমান ও শওকতের দিকে নজর গেল তার। তারা ফিসফিস করে কথা বলছে একে অপরের সঙ্গে।

: আগেই বলছি পরে আসি! না, এখনই যাই, এখন এক ঘণ্টা বকবকানি শুনতে হবে!

: এক ঘণ্টা বকবক করলে সবাইকে গোসল করে ফেলতে হবে! আকাশের অবস্থা ভালো না!

তাদের কথা শুনে সে আকাশের দিকে তাকাল। সত্যিই তো, মেঘ আকাশ ঢেকে ফেলেছে।

: আরে, এদের কোনো কাণ্ডজ্ঞান আছে! বৃষ্টির মধ্যেই এরা কথা বলবে! একজন কথা বলে ফেললে, প্রত্যেকেই তখন কথা বলবে! তা না হলে ইজ্জত থাকবে তাদের! তখন কিসের বৃষ্টি, কিসের ঝড়!

: আচ্ছা, এরা একটা কাজ করতে পারে না, নিজেদের বাড়িতে মাইক নিয়ে সারা দিনরাত বক্তৃতা দিবে! কেউ বাধা দেবার থাকবে না!

তাদের কথা শুনে তার প্রচণ্ড হাসি পাচ্ছে। কতটা বিরক্তি থেকে তারা এসব বলছে। এরা যদি এসব সাধারণ মানুষের কথা একটু বুঝত!

: বাড়িতে মাইক নিয়া বক্তৃতা দিলে চলব? মানুষরে চেহারা দেখাতে হবে না!

: এক চেহারা মানুষ আর কত দেখব! বছরের পর বছর ধরে নির্দিষ্ট কয়েকটি চেহারা দেখে যেতে হচ্ছে! চেহারা তো বদলিয়েও আসে না!

বক্তারা আটঘাট বেঁধে কথা বলার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। কথা বলার সময় হয়তো কিছু পরিবর্তন করে বলতে হতে পারে, অন্যের কথার পরিপ্রেক্ষিতে।

সমবেত সবাই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। বক্তারাও সমবেতদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

আমজাদ আলী ভীষণ খুশি, পবিত্র কোরআনের সেই আয়াতটি অবশেষে মনে পড়াতে, যার বাংলা অর্থ- প্রতিটি প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করিতে হবে।

শুধু আমজাদ আলী নয়, প্রত্যেক বক্তাই খুশি। কেননা, প্রত্যেকেই তাদের বক্তব্য কী হবে, তা গুছিয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তারা কেউই আকাশের দিকে খেয়াল করছে না। শুধু সে আর সমবেতরাই তা খেয়াল করছে।

সঞ্চালক মাইক্রোফোন হাতে নেবার সঙ্গে সঙ্গে সমবেতরা সমস্বরে চিৎকার করে বলতে লাগল-

জানাজা শুরু করেন, বৃষ্টি শুরু হয়ে যাচ্ছে!

বক্তারা উদ্বিগ্ন চোখে সমবেতদের দিকে তাকাতে লাগল।

সমস্বরে নির্দেশমূলক কথা বলা চলছে। এটাই স্বাভাবিক। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো জোরালোভাবে বৃষ্টি পড়া শুরু হবে।

বক্তারা দ্রুতপায়ে যেয়ে প্রথম সারিতে জোরপূর্বক স্থান করে নিয়ে শুরু করল।

বৃষ্টির আগমন বার্তা তাদের প্রত্যেকের পরিকল্পনাকে ভেস্তে দিল। তাদের মনের সাজানো কথাগুলো বলা হলো না!

তারা প্রত্যেকেই বিরক্ত চোখে আকাশের দিকে তাকাতে লাগল।