
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি, প্রকাশক-বাংলা গবেষণা সংসদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, প্রচ্ছদ-মাসুদ চৌধুরী, মূল্য-৪০০ টাকা
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক বাস্তবতা এবং রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে তার বিস্তার নিয়ে নানা সময়ে নানাভাবে কথা হয়েছে। তবু দিন দিন নতুন নতুন পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয় বাঙালির এই মহান যুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়। আমাদের জাতীয় জীবনে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের যেমন রয়েছে সুদূরপ্রসারী অভিঘাত, তেমনি আমাদের শিল্প ও সাংস্কৃতিক জগৎকেও তা আলোড়িত করেছে বহুভাবে। এসব আলোড়ন ও তার প্রভাব নিয়ে সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের 'বাংলা গবেষণা কেন্দ্র' প্রকাশ করেছে 'বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ :শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি' শিরোনামে একটি প্রবন্ধ সংকলন।
স্বাধীনতা যুদ্ধের অভিঘাত আমাদের সাংস্কৃতিক চর্চায়, বিশেষ করে শিল্পকলায়, সাহিত্যে কীভাবে তার বিপুল শক্তি নিয়ে সৃজনশীলতার বিবিধ শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছে, হচ্ছে- তার বিবিধ প্রেক্ষাপট উঠে এসেছে সংকলনটির বিভিন্ন প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও গবেষণায়। যেসব রচনার ভেতর দিয়ে বাঙালি ও বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের গৌরবগাথাই উন্মোচিত হয়েছে বারবার। সংকলনটির প্রারম্ভকথায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান খান যেমনটা বলেছেন, 'বাঙালির রাষ্ট্রনির্মাণ পৃথিবীর যে কোনো মহাকাব্যের ঐশ্বর্যের সঙ্গে তুল্য এক ব্যাপার। বহু জাতি-গোষ্ঠীর শাসন-শোষণ-বঞ্চনায় বিপর্যস্ত ও ক্লিষ্ট বাঙালি জাতি বিশ শতকের শেষদিকে এসে তাদের নিজস্ব রাষ্ট্র নির্মাণ করতে পেরেছে। বাঙালির সংগ্রামের রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস।'
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা গবেষণা সংসদ গঠনের পর থেকেই নিয়মিত বাঙালি ও বাংলা ভাষার বিবিধ বিষয়-আশয় নিয়ে কাজ করে আসছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি সামনে রেখে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করেছিল। এই সেমিনারে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন মানুষ স্বতঃস্ম্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন। অনেকে তাৎক্ষণিক বক্তৃতা করেন, কেউ কেউ বিষয়ভিত্তিক বক্তব্য দেন। আবার অনেকে পাঠ করেছেন লিখিত প্রবন্ধ। সেসব প্রবন্ধকে পরবর্তী ধাপে প্রয়োজনীয় সম্পাদনার মাধ্যমে এই প্রকাশনাটিতে স্থান দেওয়া হয়েছে। এ সংকলনটিতে স্থান পাওয়া প্রবন্ধগুলোতে ৫০ বছরে বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব ও প্রকাশের নানাবিধ বাস্তবতা নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। আমাদের চারুশিল্প থেকে শুরু করে ভাস্কর্য, ছোটগল্প থেকে নাটক, কবিতা ও সমাজজীবনে একাত্তরের অভিঘাতকে পর্যবেক্ষণের নানাবিধ মাত্রা উঠে এসেছে এসব রচনায়।
বাংলা গবেষণা সংসদের সভাপতি প্রফেসর খন্দকার ফরহাদ হোসেন [অনীব মাহমুদ]-এর স্বাগত বক্তব্যের পর মোট ১৫টি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে সংকলনটিতে। প্রথমেই স্থান পেয়েছে অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হকের 'বাংলাদেশের চারুশিল্পে মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব' শীর্ষক প্রবন্ধ। এ প্রবন্ধটিতে বাংলাদেশের চারুশিল্প আন্দোলনের উন্মেষ ও এর সঙ্গে আমাদের স্বাধীনতা-সংগ্রামের হাত ধরাধরি করে পথচলার ঐতিহাসিক বাস্তবতার অনুপুঙ্খ বিশ্নেষণ উঠে এসেছে। সৈয়দ আজিজুল হক বলেন, 'জন্মলগ্ন থেকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বাঙালিবিরোধী মানসিকতার কারণে বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে যে দেশাত্মবোধক জাগরণ সৃষ্টি হয়, চারুশিল্পীরা ছিলেন তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ।' বাংলাদেশের চিত্রকলা চর্চায় মুক্তিযুদ্ধের প্রভাবকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, 'একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বিমূর্ততার প্রসারকে বাধাগ্রস্ত করে চিত্রের জমিনে নতুন অবয়বের উজ্জীবন ঘটিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ জাতীয় জীবনে যে স্বপ্নপূরণের নতুন আনন্দঘন পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছিল, তা বাংলাদেশের চারুশিল্পের ক্ষেত্রকেও করেছিল উর্বর ও আশাবাদী চেতনায় ভাস্বর।' 'বাংলাদেশের নারীর কলমে মুক্তিযুদ্ধের গল্প :হৃদয়ক্ষরিত তপ্ত রক্তধার' শিরোনামে প্রবন্ধে মৃণালকান্তি মণ্ডল বিশ্নেষণ করেছেন বাংলাদেশের নারী কথাসাহিত্যিকদের গল্পে মুক্তিযুদ্ধের রূপান্তর ও তার পথরেখা নিয়ে। সুজিত সরকারের 'একাত্তরের রণাঙ্গনের পত্র-পত্রিকা :সাধারণ সমীক্ষা' শীর্ষক রচনাটি মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকার তথ্য-প্রমাণ সংবলিত একটি তাৎপর্যপূর্ণ গবেষণা প্রবন্ধ। এরপর আছে 'মুক্তিযুদ্ধের নাটক :মমতাজউদদীনের নাট্যশিল্প'। এ রচনায় লেখক সুরঞ্জন মিদ্দে নাট্যকার মমতাজউদদীন আহমদের নাটকের শিল্পকে কেন্দ্র করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটকের পূর্বাপর বিশ্নেষণ করেছেন। তারপর একে একে যেসব প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে 'মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য ও সমর-সাহিত্য :তুলনামূলক পাঠ'- বরেন্দু মণ্ডল, 'বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য :আমাদের অর্জন'- মোস্তফা শরীফ আনোয়ার, 'মুক্তিযুদ্ধ ও শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির অর্জন :প্রসঙ্গ আদিবাসী'- রণজিত সিংহ, 'বাংলাদেশের ছোটগল্পে মুক্তিযুদ্ধ'- চঞ্চল কুমার বোস, 'একাত্তরের দিনগুলি :পর্যবেক্ষণের অন্তরালে'- শহীদ ইকবাল, 'শামসুর রাহমানের মুক্তিযুদ্ধের কবিতা :মুক্তিপ্রত্যয় ও প্রতিবাদের ভাষা'- সৈয়দ তৌফিক জুহরী, 'মুক্তিযুদ্ধের ছোটগল্প :সময়ের সাক্ষী'- এস এম সাইদুল আম্বিয়া, 'মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দুটি উপন্যাস :জীবনধর্ম ও জঙ্গমতা'- তানিয়া তহমিনা সরকার, 'মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসের তিন নারী'- মনোরমা ইসলাম, 'মুক্তিযুদ্ধের আলেখ্য :পরিপ্রেক্ষিত দুই বাংলার কবিতা'- গৌতম গোস্বামী, 'মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা :প্রত্যয় ও প্রবণতা'- অনীক মাহমুদ।
মন্তব্য করুন